বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা অপরিহার্য-ধারাবাহিক বাজেটে সীমিত প্রয়াস
অনেক কিছু প্রত্যাশা ও অনুমান করা হয়েছিল। যৌক্তিক কারণেই সবকিছুর দেখা মিলল না মহাজোট সরকারের দ্বিতীয় বাজেটে। বরং অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০০৯-১০ অর্থবছরের যে বাজেট দিয়েছিলেন, বলা যেতে পারে সেটাকেই বিভিন্ন মাত্রায় সম্প্রসারণ করে ২০১০-১১ অর্থবছরের জন্য বাজেট দিলেন।
ফলে চলতি বাজেট তাঁর জন্য প্রস্তুতিমূলক থাকলেও সেই প্রস্তুতিকে জোরেশোরে কাজে রূপান্তরের প্রয়াস নতুন বাজেটে উঠে এল না। বরং নির্বাচনী ইশতেহারে যেসব উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল, কঠিন বাস্তবতার আলোকে সেগুলো থেকে একটু একটু করে সরে আসার ইঙ্গিত মিলল। যেমন, অর্থমন্ত্রী নিজেই স্বীকার করে নিলেন যে ২০১০ সালের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে শতভাগ ভর্তি নিশ্চিতকরণ ‘হয়তো বেশ উচ্চাভিলাষী’ ছিল।
আর্থসামাজিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে গতিময়তা আনতে বড় ধরনের বিনিয়োগের প্রয়োজন। সেই বিনিয়োগ বাড়ানোর সুসমন্বিত কোনো নির্দেশনা মিলল না বাজেটে। মোট দেশজ উত্পাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জন করার জন্য জিডিপিতে বিনিয়োগের অংশ যেখানে ২৪ শতাংশে আটকে আছে, সেখানে কীভাবে আগামী বছর ৬ দশমিক ৭০ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হবে, তা বোঝা মুশকিল। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ-সংকটে যেখানে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে শ্লথতা চলছে, সেখানে এই সংকট নিরসনে বাজেটে সাড়ে ৬১ শতাংশ বেশি বরাদ্দ দেওয়াটা সঠিক পদক্ষেপ হলেও ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ উত্পাদনে অধিক গুরুত্ব ও এই খাতে উচ্চ ভর্তুকি শেষ পর্যন্ত কতটা সুফল বয়ে আনবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকছে। ভর্তুকির সদ্ব্যবহারে সুশাসনের বিষয়টি নিশ্চিত করা দরকার। জ্বালানি-সংকট মোকাবিলার ওপরই শিল্প খাতের বিকাশ নির্ভর করছে। আর শিল্প খাতই কর্মসংস্থান তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখে। বাজেটে অবশ্য ভারী শিল্পকে উত্সাহিত করতে মূসক ছাড় দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কৃষিতে ভর্তুকি কেন কমে গেল, তাও বোঝা গেল না। তবে কৃষিবিমার বিষয়টি ইতিবাচক।
বাজেটে আয়বৈষম্য হ্রাসের বিষয়টিও কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় গুরুত্ব পায়নি বলে প্রতীয়মান হয়। কর ও মূসকের আওতা ও হার বাড়ার চূড়ান্ত ভার ভোক্তাদের ওপরই পড়বে, যার বেশির ভাগই মধ্যবিত্ত। গাড়ির আমদানি শুল্ক পুনর্বিন্যাস যেভাবে করা হলো, তা যানজট নিরসনে যতটা না সহায়ক হবে, তার চেয়ে বেশি সহায়ক হবে উচ্চবিত্তের গাড়ি ক্রয়ে। ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ গ্রহণ করে ঘাটতি অর্থায়নের পরিকল্পনা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেবে। আর মূল্যস্ফীতির চাপে সীমিত ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নিম্ন-আয়ের মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীতে যেটুকু বরাদ্দ বেড়েছে, তা মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করলে কার্যত অপরিবর্তিত থাকে। বিশেষত আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত দক্ষিণাঞ্চলের জনজীবনের চরম দুর্ভোগ এবং হাওর ও চরাঞ্চলের মানুষের অসুবিধা বিবেচনা করে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীতে এদের জন্য বড় ধরনের সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ প্রয়োজন ছিল।
যেহেতু জাতীয় সংসদে প্রস্তাব আকারে বাজেট তোলা হয়েছে, সেহেতু আলোচনা-বিতর্কের মাধ্যমে চূড়ান্ত করার আগে কিছু সংযোজন-বিয়োজনের অবকাশ রয়েছে। এ জন্য একদিকে বিরোধী দলের সংসদে যোগদান করে কথা বলা, অন্যদিকে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা—দুটোই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থমন্ত্রী এবারের বাজেটে যেভাবে আগের বিভিন্ন কাজ করতে না পারার বিষয় ব্যাখ্যা করার ও আত্মসমালোচনার চেষ্টা করেছেন, তা অবশ্যই একটি শুভ দিক। তবে অর্থমন্ত্রীকে সফল হতে হলে তাঁর সহকর্মীদের এগিয়ে আসতে হবে
No comments