মত দ্বিমত-উন্মুক্ত পদ্ধতি ছাড়া লাভজনক হবে না by ইউনুস আকন

কয়লা উত্তোলনের পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক চলছে। এক পক্ষ বলছেন, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে উত্তোলন করলে এই জাতীয় সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার সম্ভব। অন্য পক্ষ বলছেন, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে জাতীয় স্বার্থের চেয়ে বিদেশিদের স্বার্থই বেশি রক্ষিত হবে। তবে উভয় পক্ষ সময়ক্ষেপণ না করে এ ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন।


কয়লা উত্তোলনের পদ্ধতি নিয়ে এখানে একজন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও একজন অর্থনীতিবিদের লেখা প্রকাশ করা হলো।

কয়লা কোন পদ্ধতিতে উত্তোলন করা হবে, তা নির্ভর করে কয়লাখনির অবস্থান, এর গভীরতা, কয়লা স্তরের পুরুত্ব, ভূতাত্ত্বিক ও হাইড্রোলজিক্যাল পরিবেশের ওপর। যেখানে খনির গভীরতা কম এবং অন্যান্য পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুকূলে, সেখানে উন্মুক্ত পদ্ধতিতেই কয়লা তোলা সব দিক থেকে যৌক্তিক। এ বিবেচনায় বাংলাদেশের অন্তত তিনটি ক্ষেত্রের (বড়পুকুরিয়া, ফুলবাড়ি ও খালাশপীর) কয়লা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে তোলা উচিত বলেই আমরা মনে করি।
উল্লেখ্য, দেশে মোট পাঁচটি কয়লাখনি আবিষ্কৃত হয়েছে, যার মোট মজুদের পরিমাণ প্রায় দুই হাজার ৭০০ মিলিয়ন টন। এর মধ্যে জামালগঞ্জ খনিটি অনেক গভীর (এক হাজার মিটারেরও বেশি) হওয়ায় এই মুহূর্তে সেখান থেকে কোনো পদ্ধতিতেই কয়লা উত্তোলন লাভজনক নয়।
ওপরে যে তিনটি কয়লাখনির কথা বলা হলো, সেখানে গভীরতাসহ আনুষঙ্গিক সব বিষয়ই উন্মুক্ত পদ্ধতির অনুকূলে। সেখানে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে মজুদ কয়লার ৯০ শতাংশ পর্যন্ত বা তারও বেশি উত্তোলন করা যাবে। অন্যদিকে ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে মাত্র ১০ থেকে ২০ শতাংশ উত্তোলন করা সম্ভব, যা কোনোভাবেই লাভজনক হবে না। প্রসঙ্গত, বড়পুকুরিয়ায় এখন পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে মাত্র ৫০০ কোটি টাকার কয়লা পাওয়া গেছে। এ ধরনের লোকসানি প্রকল্প বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যাবে না। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে না গিয়ে বড়পুকুরিয়ায় কয়লা তোলার পদক্ষেপই নেওয়া অনুচিত হয়েছে। সেখানে ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করে অনেক বড় জাতীয় ক্ষতি করা হয়েছে।
হিসাব করে দেখা গেছে, শুধু বড়পুকুরিয়া ও ফুলবাড়ি খনির কয়লা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে তোলা হলে যে পরিমাণ কয়লা পাওয়া যাবে, তা দিয়ে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ অন্তত ১০০ বছর ধরে উৎপাদন করা যাবে।
দ্বিতীয়ত, ওই তিনটি ক্ষেত্রে উন্মুক্ত পদ্ধতি প্রয়োগ করলে কয়লার পাশাপাশি আমরা আরও কিছু খনিজদ্রব্য যেমন, কাঁচ বালু, চিনামাটি ইত্যাদি পাব। ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে তা পাওয়া যাবে না।
আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তুললে যে গর্ত হবে, তা পুনর্ভরণ করে ৩০ বছরের মধ্যে খনি করার আগের অবস্থায় নিয়ে ব্যবহার করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে জমির উর্বরাশক্তিও অক্ষুণ্ন রাখার জন্য এখন ভূমির উপরিভাগের মাটি (টপ সয়েল) আলাদা করে রাখা হয় এবং কয়লা তোলার পর তা আবার মাটির ওপর স্থাপন করে দেওয়া হয়।
অপর দিকে, ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করলে যে গর্ত হয়, তা আর ভরাট করা যায় না। খনি এলাকায় ভূমিধস হয়ে স্থায়ীভাবে বড় বড় জলাশয় সৃষ্টি হয়। ওই জমিতে মানুষের বসবাস তো দূরের কথা, ফসলের আবাদও অসম্ভব হয়। করা যায় মাছের চাষ।
উন্মুক্ত পদ্ধতির খনি করার জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষের পুনর্বাসন দরকার হয়। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ জায়গায় স্বাভাবিকভাবেই বেশি মানুষকে পুনর্বাসনের আওতায় নিতে হবে। কিন্তু তা কারও জন্যই কোনো দিক থেকে ক্ষতিকর হবে না। কারণ, খনি এলাকার মানুষ বর্তমানে যে আর্থসামাজিক পরিস্থিতির মধ্যে বসবাস করছে, জীবিকার জন্য যে পেশা তাদের অবলম্বন করতে হচ্ছে, তার চেয়ে অনেক ভালো ব্যবস্থা তাদের জন্য করা সম্ভব পুনর্বাসনের মাধ্যমে।
তাদের জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন উপশহর গড়ে তোলা যায়। তাদের জন্য উন্নত জীবিকার ব্যবস্থা করা যায়। এ জন্য যে অর্থ ব্যয় হবে, তার সংস্থান কয়লা থেকে উপার্জিত অর্থের সামান্য অংশ দিয়েই হয়ে যাবে। এগুলো করতে হবেও।
কারণ, মনে রাখতে হবে, তারা জাতীয় স্বার্থে একটি দীর্ঘ সময়ের জন্য তাদের ভিটেমাটি ছেড়ে দিচ্ছে। অবশ্য ৩০ বছর পর যার জমি তাকে ফেরত দেওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করলে স্থানীয় মানুষ চিরকালের জন্য তাদের জমি হারাবে। ফসল হারাবে। হারাবে জীবিকাও। সে ক্ষেত্রে সরকারকে যদি তাদের জন্য এসবের ব্যবস্থা করতে হয়, তাহলে তার অর্থ আনতে হবে অন্য কোনো খাত থেকে; উত্তোলিত কয়লা থেকে হবে না। বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক গঠনের কারণেই কোথাও ভূগর্ভস্থ কয়লাখনি কোনো দিন লাভজনক হবে না। এ ধরনের খনি দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন তো দূরের কথা, অর্থনীতিকে ধ্বংসই করবে।
এ ছাড়া ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনে ঝুঁকির বিষয়টিও উপেক্ষনীয় নয়। প্রায়ই খনিতে দুর্ঘটনায় শ্রমিকেরা মারা যান। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে দুর্ঘটনা ঘটে না বললেই চলে। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, এসিড মাইন ড্রেনেজ ইত্যাদি পরিবেশগত যে সমস্যার কথা বলা হয়, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে তা অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব। কয়লা উত্তোলনে সবচেয়ে ক্ষতিকর এসিড মাইন ড্রেনেজ ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতেও হয়ে থাকে। এ ছাড়া খনি এলাকা শুষ্ক রাখার স্বার্থে প্রচুর পানি পাম্প করে বের করে দিতে হয় এবং আশপাশের এলাকায় পানি সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ সমস্যা ভূগর্ভস্থ ও উন্মুক্ত উভয় ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
এ কথা সত্য যে, আমাদের দেশের কয়লাখনিগুলো উর্বর এলাকায়। ওই সব এলাকায় প্রচুর খাদ্যশস্য হয়। তাই সেখানে ভূগর্ভস্থ খনি করে ওই জমি চিরকালের জন্য নষ্ট করা হবে এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। তার চেয়ে কয়লা উত্তোলন না করাই লাভ। বরং উন্মুক্ত কয়লা তুললে নির্দিষ্ট সময়ের পর উর্বরতাসহ জমি ফেরত পাওয়া যাবে। আর উন্মুক্ত পদ্ধতিতে প্রচুর কয়লা তুলে দেশের জ্বালানি চাহিদা পূরণ করতে পারলে যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে, তা দিয়ে জনগণের খাদ্যের সংস্থান করা তো বটেই, উন্নত জীবন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
তা ছাড়া বর্তমান সরকার কৃষিব্যবস্থায় যে পরিবর্তন আনার পদক্ষেপ নিয়েছে, তা-ও খাদ্য ঘাটতি পূরণে বিশেষ সহায়ক হবে। একসময় বরিশালকে বলা হতো দেশের শস্যভান্ডার। কিন্তু এখন বরিশালে ধান হয় তুলনামূলক কম। ওই অঞ্চল এখন খাদ্য ঘাটতি এলাকা। এটা হয়েছে তখনই, যখন কৃষিব্যবস্থায় পরিবর্তন এসেছে, আমনের পরিবর্তে বোরো হয়েছে প্রধান ফসল। এখন আবার সরকার আমনকে বোরোর সমান গুরুত্ব দিয়ে আবাদের পদক্ষেপ নিয়েছে। ফলে দেশের কয়লা অঞ্চলের বোরো আবাদের ওপর নির্ভরতা কমবে। তা ছাড়া এখন যুগ এসেছে হাইব্রিড ধানের। সুতরাং কয়লা উত্তোলন করার কারণে কিছু জমি চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ও, তাতেও দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে সমস্যা হবে না। বরং তখন খাদ্যের পাশাপাশি জ্বালানির নিশ্চয়তা হওয়ায় শিল্প, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জাতীয় প্রবৃদ্ধি অনেক বেশি হবে।
একটি কথা বলা দরকার, বাংলাদেশের কয়লার মান অত্যন্ত ভালো। জার্মানি বা ভারতের কয়লার দাম যেখানে প্রতি টন ৫০ ডলার, সেখানে বাংলাদেশের কয়লার দাম ১০০ ডলার। তাই এ রকম উন্নতমানের কয়লার যথাযথ অর্থনৈতিক ব্যবহার সম্পর্কেও আমাদের অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। অনেকে দেশীয় কয়লা উত্তোলন না করে আমদানির কথা বলছেন। দেশে উন্নতমানের কয়লা থাকতে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে বিদেশ থেকে নিম্নমানের কয়লা আমদানি ঠিক হবে না।
কয়লা আমাদের জাতীয় সম্পদ। এর ওপর ১৬ কোটি মানুষেরই অধিকার আছে। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে উত্তোলন করলেই কেবল এ সম্পদের সর্বোচ্চ উত্তোলন ও ব্যবহার সম্ভব, যার সুফল দেশের সব মানুষই পাবে।
বর্তমানে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে আমরা প্রতিবছর প্রচুর কয়লা আমদানি করে থাকি। এই কয়লা অত্যন্ত নিম্নমানের, যা পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এসব নিয়ে দেশে প্রতিবাদ হওয়া উচিত।
অতএব সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে এ ব্যাপারে সরকারকে সাহসের সঙ্গে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কয়লা উত্তোলনের বিষয়টি উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত। একটি বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি বিষয় নিয়ে অযথা রাজনৈতিক বিতর্ক কাম্য নয়। যাঁরা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের বিরোধিতা করছেন, তাঁরা কেউ কয়লা বিশেষজ্ঞ বা খনি প্রকৌশলী নন। ভূতাত্ত্বিক পরিবেশ-পরিস্থিতি ও খনির অবস্থান বিশ্লেষণ করেই কয়লা উত্তোলনের পদ্ধতি ঠিক করতে হবে। অন্য কোনো বিবেচনায় নয়।
ড. ইউনুস আকন: সাবেক প্রধান ভূতাত্ত্বিক ও পরিচালক, খনিজ ইউনিট, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন।

No comments

Powered by Blogger.