বিশ্বকাপ ফুটবল-উত্তেজনা ও উন্মাদনা by মোহাম্মদ কায়কোবাদ
বিশ্বকাপ নিয়ে আমাদের দেশে যে উত্তেজনা, প্রতিটি খেলা দেখার জন্য যে মহা-আয়োজন, এমনটি আর মনে হয় না অন্য কোনো দেশে হয়। ইংলিশ লিগ নিয়ে সমর্থকদের মধ্যে লাঠালাঠি, মারামারি, গোলাগুলির ভূরি ভূরি উদাহরণ রয়েছে। এমনকি এই কর্মকাণ্ডগুলো বিদেশের মাটিতেও তারা করে থাকে।
তবে বাংলাদেশের আকাশে বিশ্বের ফুটবল-দেশগুলোর যত পতাকা ওড়ানো হয়, তা শুধু ইংল্যান্ড কেন, বিশ্বের অন্য কোনো দেশেও ওড়ানো হয় কি না সন্দেহ। অস্ট্রেলিয়া অত্যন্ত নামকরা একটি খেলুড়ে দেশ। পৃথিবীর প্রতি ২০০ জনের মাত্র একজনের বাস এই দেশে, কিন্তু অলিম্পিক খেলায় এদের পদক প্রাপ্তির হার অনেক বেশি। অন্যান্য খেলায়ও দোর্দণ্ড প্রতাপ তাদের। কিন্তু তার পরও সেখানে ভিনদেশি কোনো পতাকা দেখি না। কয়েক দিন আগে দিনাজপুরের হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি মেলায় গিয়েছিলাম। শুধু দিনের আলোয় নয়, রাতের অন্ধকারেও নানা দেশের পতাকা দেখতে পেলাম; নানা আকারের ক্ষুদ্র দেশীয় থেকে বৃহৎ মহাদেশীয় পর্যন্ত। সহজেই অনুমেয়, এটা শুধু ঢাকা-দিনাজপুরের বাস ও রেলপথের চারপাশেই ওড়ানো হয়নি, দেশজুড়েই এই পতাকা ওড়ানোর যজ্ঞ শুরু হয়েছে। যত দূর জানি, আমাদের দেশীয় পতাকা যখন-তখন যত্রতত্র যে কেউ ওড়াতে পারে না। একটি বিধিবিধান মেনে চলতে হয়। গাড়িতে যে কেউ ওড়াতে পারে না। অবশ্য বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসে সাধারণ জনগণকে এই অধিকার দেওয়া হয়েছে। বিদেশি পতাকা ওড়ানোর কি কোনো বিধিনিষেধ নেই?
ঢাকা শহরসহ শহরতলির আকাশ ধীরে ধীরে পতাকায় পতাকায় ছেয়ে যায়। এখানে একটি প্রতিযোগিতাও লক্ষ করা যাচ্ছে, কে কত বড় পতাকা ওড়াতে পারে। ফলে অধিকতর বড় পতাকায় বাংলাদেশের আকাশ ছেয়ে যাচ্ছে—দুর্ভাগ্যজনকভাবে পতাকাটি বাংলাদেশের নয়। আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, জার্মানির পতাকাই বেশি লক্ষণীয়। সবচেয়ে বেশি আর্জেন্টিনা। আমাদের ছেলেবেলায় ব্রাজিলের সমর্থকই বেশি ছিল। এখন পাল্লা অনেক ভারী আর্জেন্টিনার দিকে। এর নাকি মূল কারণ ম্যারাডোনা। খেলার মাঠে প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়ের বুকে লাথি মেরেছেন, মাদক সেবন করেছেন, ঈশ্বরের হাত দিয়ে গোল করেছেন। তাহলে কী হবে, খেলোয়াড় তো ভালো ছিলেন। তাই মানুষ হিসেবে ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলেও খেলোয়াড় হিসেবে সমর্থক বেশি। তাই আর্জেন্টিনার জনপ্রিয়তা বেশি। এর সঙ্গে অবশ্য ফকল্যান্ড পুনরুদ্ধারের সহমর্মিতাও কাজ করতে পারে। তার পরও ফুটবলামোদী মানুষের অনুভূতি বিচার-বিবেচনা-যুক্তি দ্বারা প্রভাবিত হয় না। ভারতে যেমন টেন্ডুলকারকে ঈশ্বরসম ভাবে ক্রিকেটামোদীরা; সারা বিশ্বে তেমনি রয়েছে ম্যারাডোনা-বন্দনার জন্য কোটি কোটি ফুটবল-উন্মত্ত মানুষ।
আমার এক সহকর্মী বললেন, শুধু পতাকার পেছনে বাংলাদেশে ব্যয় হবে কমপক্ষে অর্ধশত কোটি টাকা। যে দেশের রাজধানীতে যখন-তখন দালান ধসে পড়ে আর আগুন লেগে শত শত মানুষের মৃত্যু হয়, সে দেশে এই অর্থের অধিকতর যৌক্তিক ও মানবিক ব্যবহার হতে পারত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেশপ্রেমের বীজ কখনো আমাদের মধ্যে রোপিত হয়নি। বিভিন্ন দেশে দেশসেবায় সুস্পষ্ট বিধিনিষেধ রয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রত্যেক নাগরিককেই সেনাবাহিনী-সংশ্লিষ্ট সেবাদান করতে হয়। এ রকম বিধান অন্যান্য দেশেও রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে নেই। হতে পারত এসএসসি কিংবা এইচএসসি পরীক্ষার পর বয়স্ক শিক্ষার কর্মসূচি, এমনকি রাস্তাঘাট, পার্ক পরিষ্কারের কিংবা অন্যান্য স্থানীয় উন্নয়নমূলক কর্মসূচিতে ছাত্রদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাদের মধ্যে দেশপ্রেমের প্রাতিষ্ঠানিক বীজ বপন। তাই দেশের প্রতি মায়ামমতা আমাদের নেই বললেই চলে। ভারতীয়রা বিদেশি পণ্য কিনতে লজ্জাবোধ করে আর আমরা লজ্জাবোধ করি দেশীয় পণ্য কিনতে। অবশ্য বিশ্বকাপ উপলক্ষে আরও বড় বড় অসংখ্য বিদেশি টিভি কিনে ফেলব। আমাদের খেটে খাওয়া বঞ্চিত মানুষের চিত্তবিনোদনের সুযোগ কম। তাও যদি আবার বাংলাদেশের টিভিতে হিন্দি ছবি আর গান করে চিত্তবিনোদন করতে হয়, তাহলে স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা আমাদের ভাষা, কৃষ্টি, ঐতিহ্য—সর্বোপরি আমাদের দেশের সমৃদ্ধি কী করে ঘটাব? ফুটবল খেলা আজ থেকে ৪০-৫০ বছর আগে আমাদের দেশে খুবই জনপ্রিয় ছিল। আমরা কখনোই আন্তর্জাতিক মানের হতে পারিনি। সম্ভবত তাই অন্তত বিদেশি কোনো দলকে সমর্থন জানিয়ে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো।
ফিফার মে মাসের র্যাংকিং অনুযায়ী প্রথম ১০টি দেশ হলো ব্রাজিল, স্পেন, পর্তুগাল, নেদারল্যান্ড, ইতালি, জার্মানি, আর্জেন্টিনা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও ক্রোয়েশিয়া। ২০৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫৭, শ্রীলঙ্কার ১৫৯, নেপালের ১৬১, পাকিস্তানের ১৬৫, ভারতের ১৩৩, মালদ্বীপের ১৪২ ও মিয়ানমারের ১৪৭। আমাদের মতো বড় জনসংখ্যা নিয়ে এমন নিচু র্যাংকিং রয়েছে কেবল পাকিস্তানের। বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ মানুষ আমাদের উপমহাদেশে বাস করলেও কোনো দেশেরই র্যাংক সম্মানজনক নয়। এই গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যানকে অবহেলা করার সুযোগ নেই। এই খেলায় দর্শক হিসেবেই আমাদের আনন্দ পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে এই আনন্দ যাতে কোনোক্রমেই আমাদের জাতিসত্তা, আমাদের দেশকে ক্ষুদ্র করে না হয়, সেদিকেও যত্নবান হতে হবে। এই আনন্দ যাতে দেশের উত্পাদনকে ব্যাহত না করে, অন্যান্য কর্মকাণ্ডকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে। বিগত বিশ্বকাপগুলোতে আমরা দেখেছি, আমাদের অফিস-আদালতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাত্রাতিরিক্ত অনুপস্থিতি, কর্মে অনাগ্রহ। অধিক রাত জেগে খেলা দেখার ফলে শিল্প-কলকারখানার উত্পাদন ব্যাহত, অফিস-আদালতের কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কর্মসূচি ব্যাহত। এই বিশ্বসভায় আমরা কোনকালে প্রতিনিধিত্ব করতে পারব, তা খুবই আশাবাদী ফুটবলামোদীও বলতে পারবে না, কবে ‘আমার সোনার বাংলা’ সংগীতটি সেখানে বেজে উঠবে। সেই বিশ্বকাপ নিয়ে উন্মাদনা, উত্তেজনা, উত্পাদন ক্ষতিগ্রস্ত করা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
শুনেছি, মহাসম্পদশালী জাপানে বিশ্বকাপ দেখানো হয়, তবে যে খেলাগুলোতে জাপান থাকে। সে ধরনের নিয়ম পালন করলে অবশ্য আমরা কোনো দিনই হয়তো বিশ্বকাপের খেলা দেখতে পারব না। তবে এ ক্ষেত্রে একটি যৌক্তিক সমাধানে আসা উচিত। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটা শুধু দর্শকদের উন্মাদনা নয়, আমাদের সব গণমাধ্যমই বিশ্বকাপ নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। টেলিভিশনের নানা চ্যানেল দেশীয় ফুটবল বিশেষজ্ঞদের নিয়ে টক শো করবে, পুরস্কার পাওয়ার জন্য এসএমএস করার নানা সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি হবে। কোন খেলার দ্বিতীয়ার্ধে কোন খেলোয়াড়টি বেশি দৌড়াবে, গোলের ব্যবধান কত হবে, কতজন বদলি খেলোয়াড় খেলবে, কত দূর থেকে নেওয়া শটে গোল হবে ইত্যাকার মহাগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে এসএমএস এবং যোগ্য ব্যক্তিকে যোগ্য পুরস্কার। তাতে এসএমএস করে হাজার হাজার টাকা খরচ হবে। পত্রিকার পাতায় আসবে ফুটবল নিয়ে পরিসংখ্যানসমৃদ্ধ নানা লেখা। তা ছাড়া খেলোয়াড় ও তাদের বান্ধবীদের নিয়ে বাড়তি আনন্দের নানা ঘটনা, যার বাহুল্যে নিসন্দেহে চাপা পড়ে যাবে আমাদের নানা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু।
কয়েক দিনের মধ্যেই বাংলাদেশের আকাশ দেখে আমাদের পতাকা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে না, বিশেষ করে বিদেশিরা নিশ্চয়ই খুবই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাবে। আকাশে ওড়া পতাকা দেখে কোনোমতেই বলার সুযোগ নেই, আমরা আমাদের দেশ নিয়ে গর্বিত। এর মধ্যেও কিন্তু গর্বের একটি বিষয় রয়েছে, দরিদ্র খেটে খাওয়া ফেরিওয়ালার যে লাঠিতে বিক্রির জন্য নানা দেশের পতাকা ওড়ানো থাকবে, এর সর্বোচ্চ স্থানে থাকবে বাংলাদেশের পতাকা; যদিও সে জানে, ওই পতাকাটি কারও কেনার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এই ভাগ্যবিড়ম্বিত খেটে খাওয়া মানুুষটাকে অভিবাদন জানাই। বিশ্বকাপের আসরে এর থেকে বড় কোনো বাংলাদেশি নেই।
উন্নয়ন-প্রতিকূল সংস্কৃতিতে দেশটি সয়লাব। দূরপাল্লার বাসে হিন্দি গান, বিয়ের আসরে হিন্দি গান, প্রতি রাতে ও দিনে বাসায় বাসায় হিন্দি ছবির অত্যাচার। কবে আমাদের দেশে উন্নয়ন-অনুকূল সংস্কৃতি জেগে উঠবে? তবে বিশ্বকাপের এই ঋতুতে প্রার্থনা একটিই, বিশ্বকাপকে উপলক্ষ করে দেশের ক্ষতি যাতে সর্বনিম্ন হয়, টেলিভিশন চালানোর বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে যাতে উত্পাদন ব্যাহত না হয়, খেলা দেখতে গিয়ে যাতে আমাদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস, পরীক্ষা ও অন্যান্য শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট কর্মসূচি ব্যাহত না হয়, বিশ্বকাপের বিজয়ে প্রতিটি দেশের দর্শকদের উচ্ছ্বসিত হওয়া দেখে যাতে আমাদের মনে দেশপ্রেম জেগে ওঠে।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।
No comments