ফুটবল সংহতি-আমরা ফুটবল by এদুয়ার্দো গালিয়ানো
৬০ বছরেরও বেশি হয়ে গেছে ব্রাজিলের সুবিশাল মারাকানা স্টেডিয়ামে উরুগুয়ে বিশ্বকাপ জিতেছিল। তার পর থেকে বাস্তবতা শুধু ছলনা করে যাচ্ছে, আর আমরা সান্ত্বনা খুঁজছি স্মৃতিতে। আর তাতেও যদি আমাদের শিক্ষা হতো, তাহলে সব ল্যাঠা চুকেই যেত।
কিন্তু ঘটনা তা নয়; আশা যখন আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করে, আমরা তখন আশ্রয় খুঁজি স্মৃতিচারণায়, কারণ আশা পূরণে প্রয়োজন হয় অসম সাহসের, কিন্তু স্মৃতিচারণায় এসব কোনো কিছুই লাগে না। বেবে কপোলা পেশায় একজন হেয়ার ড্রেসার; একই সঙ্গে নিকো পেরেজ নামের এক ছোট শহরের ফুটবল দলের প্রধান কোচও। তাঁর দলের জন্য শেখানো মূলমন্ত্র ছিল একটাই: বল মাঠে, স্ট্রাইকাররাও তৈরি, এখন ভাগ্য তোমাদের সহায় হোক, খেলে যাও।
বেবে কপোলার সঙ্গে মারাকানার কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু তারা যেন সেদিন তাঁর ওই মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়েই খেলেছিল; ১৯৫০ সালের ফাইনালে উরুগুয়ানদের সেই সহজ-স্বচ্ছন্দ খেলা, কী যে চমত্কাল ছিল—আজ অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় পার করে এসে বলতে হচ্ছে, সব উল্টে গেছে, কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। এখন আমরা যখন ফুটবল খেলি, (ঈশ্বর ক্ষমা করুন) আমাদের স্ট্রাইকাররা, আমাদের দুই পাশের উইংরা এখন আর ওড়ার ক্ষমতা রাখে না; বস্তুত এখন তাদের খেলা দেখলে মনে হয়, তারা একেকজন যেন মাঝমাঠে ঘুমের মধ্যে হাঁটছে। আমরা এখন ঘেঁষাঘেঁষি করে, কঞ্জুসের মতো এক দুরূহ, দুর্বোধ্য ফুটবল খেলি, আর মন্দ কপাল আমাদের, ভাগ্যও এখন আর সহায় হয় না আমাদের। সত্যি কথা বলতে কি, আমরা কারও জন্য এখন আর কিছু করি না, অথচ আমাদের একেকটা বিপর্যয় ও ভ্রান্তির পর তার চুলচেরা নানা বুদ্ধিদীপ্ত বিচার-বিশ্লেষণের জন্য আমাদের পণ্ডিতের অভাব নেই, বরং এসব প্রখ্যাত, বরেণ্য বিশেষজ্ঞ-পণ্ডিত প্রয়োজনের চেয়ে আমাদের বেশিই। কিন্তু তাতে উরুগুয়ের ফুটবলের কোনো সাহায্য হয় না।
মারাকানার সেই ফাইনালে উরুগুয়ের খেলোয়াড়দের ফাউল হয়েছিল ব্রাজিলের তুলনায় প্রায় অর্ধেক। আর এখন মাঠের ভেতরে কি মাঠের বাইরে উরুগুয়ানদের অনেকেই মনে করে ফাউল করাটা বীরত্বের, অসীম সাহসের। আন্তর্জাতিক খেলার পরিমণ্ডলে অগ্রিবর্ষি ক্রীড়া ভাষ্যকার কিংবা গলা ফাটিয়ে চিত্কার করা সমর্থকদের কোনোকালেই আকাল ছিল না, কোনো কোনো সময় তাদের সমস্বর চিত্কার ছিল: শুট, শুট (বলে লাথি দেওয়ার কথাই তারা বলত)! আর এখন তারা চিত্কার করে গলা ফাটায়: মার, মার (বল নয়, এরা মারতে বলে বিপক্ষের খেলোয়াড়কে)! এখন এমন অনেক ক্রীড়া ভাষ্যকারও হয়েছে, যারা মুখিয়ে থাকে কায়দা করে বিশেষ করে ফাউলের বর্ণনা দেওয়ার জন্য, যেমন: ‘প্রশংসনীয় ফাউল’—রেফারির দৃষ্টি এড়িয়ে সংঘটিত হওয়া এই ফাউল আর ‘গুঁড়িয়ে দেওয়া ফাউল’ খেলার শুরুতেই রেফারি যখন কঠোর হতে দ্বিধান্বিত থাকেন, সেই সুযোগে তেড়েফুঁড়ে বিপক্ষের ওপর হামলে পড়া, যখন মারাত্মক ফাউল করেও লঘুদণ্ডে নিস্তার পাওয়া যায়।
আমরা এখন এমন এক জায়গায় পৌঁছেছি, যেখানে কোনো কিছুই আর উরুগুয়ান নেই, আমরা এখন খেলি লাল কার্ডের একেবারে কিনারায় গিয়ে, কাজেই রেফারি কার্ড বের করল তো আমরা হয়ে গেলাম দশজনের দল; অবশ্য এতে আরেকটি জিনিসও প্রমাণিত হয়, আমাদের প্রতিপক্ষ খেলছে ১২ জন নিয়ে। আরও একটা ব্যাখ্যা আছে, ষড়যন্ত্র; ষড়যন্ত্র করে রেফারি আমাদের বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছে। আর তাই আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ হচ্ছে আমাদের মন্দভাগ্যের জন্য দুঃখিত হওয়া, হায়! অভাগা দেশ আমাদের, দিনে দিনে শুধু ব্যর্থতার অতলে তলিয়েই যাচ্ছে।
বাস্তবতা হলো, মারকানার পর থেকে আমাদের শুধু অবনমনই হয়েছে, খারাপ থেকে আরও খারাপ। হয়তো ফুটবলের এই শক্তি হারানোর সঙ্গে আমাদের গণশিক্ষা সমস্যার কোনো যোগসূত্র আছে। আমাদের সোনালি দিন। এখন পেছনে অপস্রিয়মাণ প্রায়, দিনকে দিন কেবলই দূরে সরে যাচ্ছে। ১৯২০ সালে আমরা দুবার অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন; ১৯৩০ সালে আমাদের প্রথম বিশ্বকাপ জয়; ১৯৫০ সাল স্বর্ণময়, রাজসিক এক জয়ের বছর। আমাদের প্রতিবেশী মেক্সিকো সিটি, বুয়েনস এইরেস, সাও পাওলোর চেয়েও ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর এই দেশের জন্য এসবই ব্যাখ্যাতীত বিষয়। অথচ শতাব্দীর শুরুতে আমাদের মুক্ত, ধর্মীয় প্রভাবহীন গণমুখী শিক্ষা পদ্ধতি দেশজুড়ে ক্রীড়াঙ্গনে সোনা ফলিয়েছে, তখনো এই শিক্ষাব্যবস্থায় ধড় থেকে মুণ্ড কেটে ফেলা হয়নি, তৈরি হয়নি ধনী-গরিব বৈষম্য।
এটা একটা গভীর পরিচয়সংকট। এরা এখন নিজের ছায়াকেই শনাক্ত করতে পারে না, দারুণ পরিতাপের ব্যাপার। আমাদের ফুটবলের এই মুমূর্ষু অবস্থার জন্য দায়ী অনেক সমস্যার একটি, একই সঙ্গে এটা বিরাট জাতীয় সমস্যাও, তা হলো: আমরা আমাদের নাগরিকদের বিক্রি করে দিচ্ছি। আমরা একই সঙ্গে জনশক্তি রপ্তানি করছি, রপ্তানি করছি পদশক্তিও। উরুগুয়ানরা এখন পরদেশে পরবাসী, বিশ্বময় তারা ছড়িয়ে আছে। আমাদের ফুটবলাররাও। আমাদের ২৪৮ জন পেশাদার ফুটবলার প্রবাসী ৩৯টি দেশে।
ফুটবল এক ধরনের সামাজিক ক্রীড়া, এক ধরনের যৌথ প্রয়াসের সৃষ্টিকর্ম, আর তাই বিমানে সাক্ষাৎ ঘটা একেকজন খেলোয়াড় দিয়ে জাতীয় দল গঠন করে আমাদের কিছু হয় না। আমরা ফুটবল। ফুটবলে আমাদের বসবাস, আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাপনে মিশে আছে ফুটবল, যদি বলি:
মনোযোগ দাও তো: বলে (ফুটবলে)
দায়িত্ব থেকে মুক্ত হতে চাও: বল ফেলে দাও
দারুণ হয়েছে: দারুণ শট (ফুটবলে)
কাজ শুরু করতে চাও: বল তুলে নাও
কোনো সুযোগ নিতে চাও: বলের সঙ্গে দৌড়াও
প্রতারক স্বামীকে গলাধাক্কা দিতে চাও: সোজা লাল কার্ড দেখাও
কোনো মেয়েকে পটাতে চাও: গোলের চিন্তা মাথায় আনো (কোন কায়দায় গোল দেওয়া যায়)
ক্ষীণ সম্ভাবনা: লং শট
অন্যায় ফাঁস করতে চাও: বাঁশি বাজিয়ে দাও।
আমরা উরুগুয়ানরা, যাদের রক্তে-মাংসে ফুটবল, ভাবি আমরা মারাকানারও ওপরে। আমার সন্দেহ, আমরা একেবারে তলায়, সমস্যা হলো ধ্রুব সত্যের মতো আমাদের ওপর একটা মিথ্যে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
যে কেবল টিকে থাকার জন্য আমরা লড়াই করি, টিকে থাকার জন্য শুধু আমাদের জয়ের দরকার হয়। অথচ ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপে মারাকানাতেই এসেছিল আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজয়। আমাদের সেই বিজয় এসেছিল এক অসাধারণ, প্রেরণাদায়ী বীর অধিনায়কের হাত ধরেই, বিজয়ের পরেও যে বিজয়োল্লাসে ভেসে যায়নি। খেলা শেষে হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়েছে সে, যোগ দিয়েছে উত্সবে, হেঁটে বেরিয়েছে রাতের রিওতে, নীরবে, এক বার থেকে আরেক বারে, জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে কার্পণ্য করেনি পরাজিতকেও।
অনুবাদ: আলীম আজিজ
এদুয়ার্দো গালিয়ানো: উরুগুয়ের কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক। ফুটবল ইন সান অ্যান্ড শ্যাডো ও মেমরিস অব ফায়ার গ্রন্থের লেখক।
No comments