কালের পুরাণ-বর্জনে কী অর্জন হয় by সোহরাব হাসান

পৃথিবীতে গণতন্ত্রের এমন দ্বিতীয় নজির পাওয়া যাবে না। দেশে সংসদ আছে, নির্বাচিত সাংসদ আছেন, প্রথা অনুযায়ী সংসদে অর্থমন্ত্রী বাজেট প্রস্তাব পেশ করবেন। কিন্তু বিরোধী দল সেখানে যথারীতি গরহাজির থাকবে। বর্জন করবে। বাংলাদেশে এই অদ্ভুত ও অস্বাভাবিক কাণ্ডই চলে আসছে বহু বছর ধরে।


যখন বিএনপি ক্ষমতায় থাকবে, তখন যেকোনো অজুহাতে আওয়ামী লীগের সাংসদেরা সংসদে অনুপস্থিত থাকবেন। আর যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকবে, তখন বিএনপির সাংসদেরা সংসদ বর্জন করে চলবেন। অথচ সাংসদ হিসেবে তাঁরা বেতন-ভাতা, গাড়ি-বাড়ি-অফিস-সুবিধা—সবই আদায় করে নেবেন জনগণের কাছ থেকে।
গত বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সংসদে ২০১০-১১ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব পেশ করেন। সে সময় মহাজোটের সাংসদেরা ছাড়াও অতিথি হিসেবে বিদেশি কূটনীতিক, অর্থনীতিবিদ, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। ছিলেন পেশাগত দায়িত্ব পালনকারী সাংবাদিকেরাও। কিন্তু বিরোধী দল বিএনপি ও তাদের সহযোগী জামায়াতের সাংসদেরা ছিলেন না।
কেন ছিলেন না? তার জুতসই কোনো জবাব নেই। বিএনপির মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন খোঁড়া যুক্তি দেখাতে চেয়েছেন, ‘ওখানে কথা বলা যায় না। ওখানে শুধু গালাগাল হয়। অশ্রাব্য ভাষা ব্যবহার করা হয়।’ বিএনপির আমলে আওয়ামী লীগও একই অভিযোগ করত। আসল কথা হলো, আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কেউই নিজেকে বিরোধী দলের আসনে দেখতে রাজি নয়। এ কারণেই লাগাতার সংসদ বর্জন, গরহাজিরা। এর মাধ্যমে তাঁরা সংসদীয় ব্যবস্থাকেই দুর্বল করছেন না, তাদের যাঁরা ভোট দিয়ে সংসদে পাঠিয়েছেন, সেই নির্বাচকমণ্ডলীকেও অসম্মান করছেন।
বিএনপির মহাসচিব প্রস্তাবিত বাজেটকে ‘স্বপ্নের সোনার হরিণ’ আখ্যায়িত করে বলেছেন, যতক্ষণ স্বপ্নে থাকা যায়, ভালো লাগে। স্বপ্ন ভেঙে গেলেই সমস্যা। খোন্দকার সাহেবদের স্বপ্ন তো অন্য কেউ ভাঙেনি। তাঁরাই স্বপ্নের পায়ে কুড়াল মারলেন ২০০৬ সালে ক্ষমতা ত্যাগের আগে ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বানিয়ে। এখন আক্ষেপ করে লাভ কী?
আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটের বাজেট স্বপ্নের সোনার হরিণ হোক আর ডিজিটাল লুটপাটই হোক, সে কথাটি সংসদে গিয়ে বলুন। সংসদে গিয়ে জনগণের পক্ষে কথা বলার জন্যই তো তাঁরা নির্বাচিত হয়েছেন। অবশ্য খোন্দকার সাহেবের কপাল খারাপ। গুণধর দুই পুত্র ও সংসদ-ক্যানটিনের মালামাল-কেলেংকারি সংসদে গিয়ে তাঁর কথা বলার সুযোগ কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু বিএনপিতে তো বেশ কয়েকজন অভিজ্ঞ সাংসদ আছেন। সংসদের বাইরে তাঁরা যে বুলন্দ আওয়াজ তুলছেন, সেটি সংসদের ভেতরে গিয়ে বলাই কি বুদ্ধিমানের কাজ নয়?
সব দেশেই সংসদের বাজেট অধিবেশনকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়। এতে আয়-ব্যয়ের হিসাবই শুধু করা হয় না, আগামী এক বছরে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কী কী করা হবে, তারও খাতওয়ারি পরিকল্পনা থাকে। এসব বিষয়ে বিরোধী দলের সক্রিয় ভূমিকা থাকা আবশ্যক। একই সঙ্গে বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে সরকারি ও বিরোধী উভয় পক্ষের সাংসদেরা নিজ নিজ এলাকার জনগণের সমস্যা, তথা দাবি-দাওয়ার কথা বলতে পারেন। বাজেট অধিবেশনেই সর্বোচ্চসংখ্যক সাংসদ বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পান।
বিএনপির নেতারা আজ সংসদ বর্জনের পক্ষে নানা যুক্তি দেখাচ্ছেন, সংসদে না যাওয়ার ‘উপকারিতা’ দেশবাসীকে বোঝাচ্ছেন। দেশ ও মানুষ বাঁচাতে হরতালের ‘প্রয়োজনীয়তা’ ব্যাখ্যা করছেন। কিন্তু ক্ষমতায় থাকতে তাঁরাই ঠিক এর বিপরীত কথাই বলতেন। এক দিনের হরতালে কত কোটি টাকার ক্ষতি, তাও হিসাব করে দেখিয়ে দিতেন। মনে আছে, ২০০৬ সালের ৫ আগস্ট সাবেক আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ বলেছিলেন, গণতন্ত্রের স্বার্থে সংসদ বর্জনের সংস্কৃতির অবসান ঘটাতে হবে।
এমনকি ২০০৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর বিবিসি সংলাপে অংশ নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনও স্বীকার করেছিলেন, সংসদ বর্জন গণতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ। গণতন্ত্রের স্বার্থে এ সংস্কৃতির অবসান হওয়া প্রয়োজন। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে তাঁরা অবস্থান পরিবর্তন করলেন কেন?
বিএনপির অভিযোগ, সরকারি দল গায়ের জোরে সবকিছু করে। বিরোধী দলকে কথা বলতে দেয় না। এ অভিযোগ কি সর্বাংশে সত্য? তাহলে গত অধিবেশনে বিরোধীদলীয় নেত্রী একনাগাড়ে দেড় ঘণ্টা বক্তৃতা দিলেন কীভাবে? বিরোধী দলের প্রথম দায়িত্ব সংসদে যাওয়া। সরকারি দল তাদের কথা বলতে না দিলে সে কথাও দেশবাসীকে জানাবে। কতবার সরকারি দল মাইক বন্ধ করবে? কতবার বাধা দেবে? প্রয়োজনে বিরোধী দল সংসদ লবিতেও অবস্থান নিতে পারে। কিন্তু সংসদে তাদের যে অধিকার, তা ছাড়বে কেন?
গত দুই দশকেও দেশে সংসদীয় ব্যবস্থা টেকসই হয়নি। হবে কীভাবে? নব্বইয়ে স্বৈরাচারের পতনের পর ১৯৯১ সালে সব দল মিলে সংসদীয় ব্যবস্থা কায়েম করলেও নেতাদের চলন-বলন, আচার-আচরণে স্বৈরাচারী মানসিকতাই রয়ে গেছে। এর থেকে কেউ বেরিয়ে আসতে পারেননি বা আসার চেষ্টাও করেননি। ক্ষমতাসীনেরা যেমন সবকিছু দখল করতে চেয়েছে, তেমনি বিরোধী দল সবকিছু নাকচ করার মহড়া দিয়ে এসেছে। এখনো দিচ্ছে। গণতন্ত্রের প্রথম ও প্রধান শর্ত আলোচনা, প্রতি আলোচনা-সমালোচনা, যুক্তি-তর্ক। আমাদের রাজনীতিতে যুক্তির জায়গা দখল করে নিয়েছে পেশিশক্তি, মাস্তানি, ক্ষমতার দম্ভ।
বৃহস্পতিবারের বাজেট অধিবেশনে বিরোধী দলের অনুপস্থিতি দেশবাসীকে হতাশ করলেও বিএনপির নেতাদের কোনো বোধোদয় ঘটেছে বলে মনে হয় না। সরকারি দলও লোকদেখানো আহ্বান ছাড়া কিছু করেনি। গতবারের বাজেট পেশকালেও বিরোধী দল গরহাজির ছিল। কেন এমনটি হবে? এরই নাম কি গণতন্ত্র? বহু রক্ত ও প্রাণের বিনিময়ে এই গণতন্ত্রই কি আমরা চেয়েছিলাম?
১৯৯১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২০টি বাজেট হয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় সংসদে ১৮টি বাজেট পেশ করেছে নির্বাচিত সরকার (২০০৭ ও ২০০৮ সালের বাজেট দিয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবাদ সম্মেলন করে)। এর মধ্যে দুই মেয়াদে বিএনপি দিয়েছে ১০টি। চলতি বছরসহ আওয়ামী লীগ দিয়েছে সাতটি। খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারের প্রথম বাজেট পেশকালে বিরোধী দল উপস্থিত ছিল, দ্বিতীয়টিতে অর্থাৎ ১৯৯২ সালে ছিল না। ১৯৯৩ সালে উপস্থিত ছিল। পরবর্তী দুটিতে উপস্থিত থাকার প্রশ্নই আসে না। তখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সব বিরোধী দল সংসদ থেকে পদত্যাগ করে রাজপথে আন্দোলন করছিল।
১৯৯৬—২০০১ মেয়াদে আওয়ামী লীগ মোট পাঁচটি বাজেট পেশ করে। এর মধ্যে বিএনপি ১৯৯৮, ২০০০ ও ২০০১ সালে অনুপস্থিত ছিল। উপস্থিত ছিল ১৯৯৭ ও ১৯৯৯ সালে।
২০০২—২০০৬ মেয়াদে বিএনপি পাঁচটি বাজেট পেশ করে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ উপস্থিত ছিল মাত্র একবার, ২০০৬ সালে। বাকি চারটি বাজেটই পেশ হয়েছে তাদের অনুপস্থিতিতে।
২০০৯ সালে বিএনপি বাজেট অধিবেশন পুরোই বর্জন করে। ২০১০ সালে অধিবেশনের প্রথম দিন অল্প সময়ের জন্য গেলেও ওয়াকআউট করে এ পর্যন্ত ফিরে আসেনি।
বাংলাদেশের সংসদীয় ব্যবস্থার এ ভঙ্গুর অবস্থা বিশ্লেষণ করে সাউথ এশিয়ান গ্রুপের বিশেষজ্ঞ জ্যোতি এম পাথানিয়া বলেছেন, আওয়ামী লীগ বা বিএনপি যে-ই হোক, বাংলাদেশে বিরোধী দলের ভূমিকা গঠনমূলক নয়, ধ্বংসাত্মক।
২০০৪ সালে বিএনপি সংসদ বর্জনের মেয়াদ ৯০ দিন থেকে কমিয়ে ৩০ দিন করার উদ্যোগ নিয়েছিল, তখন সহযোগী দৈনিক ডেইলি স্টার সম্পাদকীয় লিখে জানিয়েছিল, ‘এক দিনের জন্যও সংসদ বর্জন করা যাবে না।’ আমরাও মনে করি, সাংসদের পদমর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করলে সংসদে যেতে হবে। এ ব্যাপারে আইনি বাধ্যবাধকতা থাকা প্রয়োজন। সংসদীয় কার্যবিধির যে ধারায় সংসদে অনুপস্থিতির বিধান আছে, তা ইচ্ছাকৃত হতে পারে না। ব্যক্তিগত সমস্যা, অসুস্থতার কারণে হতে পারে। পঞ্চম জাতীয় সংসদ থেকে একযোগে বিরোধী দলের সাংসদদের পদত্যাগ সুপ্রিম কোর্ট অবৈধ ঘোষণা করেছিলেন। আমাদের দাবি, অনিবার্য কারণ ছাড়া সংসদ বর্জনের ক্ষেত্রে অনুরূপ আইন করা হোক। জনপ্রতিনিধিদের কাছে যখন সদিচ্ছা ও শুভবোধ দুর্লভ, তখন আইন করেই তাঁদের সংসদে আটকে রাখতে হবে বৈকি।
আমাদের গণতন্ত্র রক্ষাকর্তারা অল্পেই অধৈর্য হয়ে যান। পাঁচ বছর পরপর ক্ষমতায় আসেন, কিন্তু বিরোধী দলের আসনে বসতে পছন্দ করেন না। পশ্চিমবঙ্গে ৩৩ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে বামফ্রন্ট। বিরোধী কংগ্রেস ও তৃণমূলের আসনসংখ্যা কখনোই এক-তৃতীয়াংশের বেশি ছিল না, এখনো নেই। কিন্তু তাই বলে তারা বছরের পর বছর অধিবেশন বর্জন করে না।
গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে হলে সংসদ বর্জনের এই অপসংস্কৃতি থেকে বিরোধী দলকে বেরিয়ে আসতে হবে। বাজেট পেশের আগে বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলন করে যে ‘ছায়া বাজেট’ পেশ করেছেন, তার আইনগত ভিত্তি নিয়ে সরকারি দল প্রশ্ন তুললেও জনগণ বাঁকা চোখে দেখেনি। দেখেছে সরকারের বাজেট প্রস্তাবের সম্পূরক হিসেবেই। এখন সংসদে বাজেট পেশ হয়েছে। বিরোধী দলের উচিত হবে সংসদে গিয়ে বাজেট প্রস্তাব সম্পর্কে তাদের বক্তব্য তুলে ধরা। যদি সে ক্ষেত্রে তারা ব্যর্থ হয়, তাহলে সেটি শুধু গণতন্ত্রের জন্যই নয়, তাদের নিজেদের জন্যও আত্মঘাতী হবে।
সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.