ঐতিহ্য-বিচার-সালিসে হুলহুলিয়া-কালিগ্রাম মডেল by সাইফুদ্দীন চৌধুরী
নাটোর জেলার হুলহুলিয়া গ্রামের সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়ে জাতীয় দৈনিকে বড়সড় খবর প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪৪ সাল থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে বিলচলনের একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত হুলহুলিয়া গ্রামের ওই পরিষদ গ্রামের ঝগড়া-বিবাদ মীমাংসায়, চুরি-ডাকাতি-রাহাজানি রোধে এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে।
প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত ২৩ সদস্যের দুই বছর মেয়াদি কমিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এ পরিষদে। কমিটি নিজেরাই গ্রামের মামলা-মোকদ্দমা নিষ্পত্তি করে। কদাচিৎ কোনো মামলা বিচারের জন্য আদালতে যায়। হুলহুলিয়ার বিচারের রায় নিয়ে গ্রামবাসীর মধ্যে অদ্যাবধি কোনো দ্বিমত নেই, বিতর্কাবস্থারও সৃষ্টি হয়নি। গ্রামের মানুষের মধ্যে পরমতসহিষ্ণুতা থাকায় গ্রামে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় আছে। এরা পরস্পরের প্রতি উন্নয়নের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে লাভ হয়েছে গ্রামের। অনেক মেধাবী মুখ গ্রাম থেকে বেরিয়েছে এবং বেরোচ্ছে। এই গ্রামের অনেকে শুধু দেশেই নয়, দেশের বাইরে গিয়েও মেধার স্বাক্ষর রেখেছে।
হুলহুলিয়ার মানুষ এমন একটি ঐতিহ্যবাহী সংগঠন গড়ে তুলেছিল কীভাবে? একটি সূত্র থেকে জানা যায়, এ গ্রামের মানুষ নিজেরা মিলেই এর কার্যক্রম শুরু করেছিল। তবে অনেকেই ধারণা করেন, তাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল কালিগ্রাম হিতৈষী সভা। কালিগ্রাম পরগনায় ওই হিতৈষী সভা গড়ে তুলেছিলেন স্বয়ং কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পূর্ববঙ্গে কবির নিজস্ব জমিদারি ছিল এই কালিগ্রাম পরগনা, যার সদর ছিল নাগর নদের তীরের পতিসর। শরিকদের সঙ্গে জমিদারি ভাগবাটোয়ারা হয়ে গেলে নিজ জমিদারিতে উন্নতির কাজে মনোনিবেশ করেন কবি-জমিদার। গরিব চাষিদের সাহায্য করার জন্য কৃষিঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। এ জন্য সমবায় পদ্ধতিভিত্তিক ‘পতিসর কৃষি ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করেন। ছেলের সঙ্গে আলোচনা করে নোবেল পুরস্কারে পাওয়া টাকার বৃহদাংশ রাখেন এ ব্যাংকে। রবীন্দ্রনাথ প্রজার কল্যাণার্থে গঠিত কালিগ্রাম হিতৈষী সভার জন্য কিছু উপযুক্ত লোকও সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন। শৈলেশ মজুমদার, কালীমোহন ঘোষ, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, অতুল সেন, উপেনভদ্র ও বিশ্বেশ্বর বসুদেবকে নিয়ে বিশাল কর্মীবাহিনী গড়ে তোলেন কবি। এই হিতৈষী সভা জমিদারির বিভিন্ন স্থানে স্কুল ও দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করে, সর্বসাধারণের জলকষ্ট নিবারণের জন্য কূপ ও দিঘি খনন করে, চলাচলের জন্য রাস্তাঘাট তৈরি ও সংস্কার করে, ঝোপঝাড় কেটে আবাদি জমিতে রূপান্তর করে। রবীন্দ্রনাথ ‘কালিগ্রাম হিতৈষী সভায়’ সবচেয়ে বড় কাজ করেছিলেন সালিসি প্রথা চালু করে। পরগনার সব কলহ এবং মামলা-মোকদ্দমার নিষ্পত্তি করা হতো এর মাধ্যমে। সালিসির ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম স্বদেশি কর্মী খুলনার সেনহাটির অতুল সেন। রবীন্দ্রনাথের ওই হিতৈষী সভা সম্পর্কে একজন রবীন্দ্রগবেষক লিখেছেন:
‘প্রজাদের মধ্যে যেকোনো কারণে বিরোধ সংঘটিত হলে অতুল সেনের গোচরীভূত করা হতো, তিনি দিন-তারিখ এবং সময় নির্ধারণ করতেন। নির্ধারিত দিনে বিচার করে অতুল সেন রায় প্রদানের ব্যবস্থা নিতেন। তাঁর সালিসিতে প্রজারা ন্যায়বিচার তো পেতেনই, অপর দিকে তারা মামলার অর্থ অপচয় করা থেকেও রেহাই পেতেন।...শান্তিনিকেতনের কাগজপত্র এবং মহাফেজখানায় রক্ষিত তথ্য থেকে জানা যায়, কবির কালিগ্রাম হিতৈষী সভা যত দিন চালু ছিল, তত দিন তো বটেই, তার পরে বেশ কয়েক বছর এই পরগনা থেকে একটি মামলাও সদরে যায়নি বিচারের জন্য।’
হুলহুলিয়ার অবস্থান রবীন্দ্রনাথের জমিদারির একেবারেই সন্নিকটবর্তী। কবি শিলাইদহ কিংবা শাহজাদপুর থেকে বোটে চড়ে যখন বড়াল বেয়ে আত্রাই নদী দিয়ে যেতেন, তখন অদূরেই থাকত হুলহুলিয়া গ্রাম, সিঙ্গরাসহ নানা গ্রাম।
বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অনেক দান পৌঁছালেও আমাদের গ্রামগুলোতে তার প্রভাব খুব একটা পড়েছে বলে মনে হয় না। গ্রামনির্ভর কৃষিসমাজ রয়েছে বলেই পুরোনো ‘ভ্যালুজ’গুলো এখনো বহাল রয়েছে আমাদের গ্রামগুলোতে। এখনো বাংলাদেশের গ্রাম কৃষিজ পণ্যের উৎপাদকই শুধু নয়, সংস্কৃতিরও স্রষ্টা। চলুক না গ্রাম গ্রামের মতোই। যেমন চলছে এখনো হুলহুলিয়ার মানুষেরা। হুলহুলিয়াতেও অনেক ঘটনা ঘটেছে জমি নিয়ে, পারিবারিক কলহ নিয়ে, ব্যক্তিস্বার্থ নিয়ে। সে ঘটনা গ্রামেই তো নিষ্পত্তি হয়েছে, আদালতে যেতে হয়নি। স্থানীয়ভাবে বিবাদ-বিসংবাদ মিটে যাওয়ায় স্বস্তি পায় সবাই বাদী-বিবাদী উভয়ই। হুলহুলিয়ার মানুষ বলে, আদালতে গিয়ে লাভ কি অন্যকে টাকা খাওয়ানোর? বছরের পর বছর ধরে মামলা চালিয়ে নিঃশেষ হওয়ার প্রয়োজন নেই তাদের।
আদতে ঘটনাও তাই। একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, দেশে উচ্চ আদালত থেকে নিম্ন আদালত পর্যন্ত বেশ কয়েক লাখ মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে। আদালতে বিচারাধীন মামলার জট বাঁধে আশির দশকে এরশাদ সরকারের আমলে, যখন উপজেলাতেই আদালত বসানো হয়েছিল। দেশের বর্তমান প্রধান বিচারপতি মহোদয় দায়িত্ব নিয়েই নিষ্পত্তির জন্য অপেক্ষমাণ মামলার বিশাল সংখ্যার কারণে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তিনি যথাসম্ভব দ্রুত সেগুলোর বিচারিক কাজ শেষ করতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তবে সে নির্দেশ খুব একটা পালিত হয়েছে বলে আমাদের মনে হয় না।
অনেকেই পত্রিকার ওই খবর পড়ে মন্তব্য করেছেন, হুলহুলিয়া-কালিগ্রাম মডেলে যদি আমাদের গ্রামগুলো চলে, তাতে লাভ তো অনেক। গ্রামবাসী নিজেদের সমস্যা নিজেরাই নিষ্পত্তি করবে (কোনো কোনো জটিল বিষয় নিষ্পত্তির জন্য অবশ্যই শহরের আদালতে যেতেই পারে), নিজেরা পরস্পরের প্রতি পরমতসহিষ্ণু হয়ে উঠবে—সর্বত কল্যাণ হবে গ্রামের। দেশের প্রতিটি গ্রামই তো এভাবে নিজেদের মতো করে গড়ে উঠতে পারে। আদতেই আমাদের গ্রামগুলোকে স্বাবলম্বী করে তোলা একান্ত অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। গ্রামের মানুষকেই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এগিয়ে আসতে হবে এ জন্য।
সাইফুদ্দীন চৌধুরী: গবেষক অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
pr_saif@yahoo.com
হুলহুলিয়ার মানুষ এমন একটি ঐতিহ্যবাহী সংগঠন গড়ে তুলেছিল কীভাবে? একটি সূত্র থেকে জানা যায়, এ গ্রামের মানুষ নিজেরা মিলেই এর কার্যক্রম শুরু করেছিল। তবে অনেকেই ধারণা করেন, তাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল কালিগ্রাম হিতৈষী সভা। কালিগ্রাম পরগনায় ওই হিতৈষী সভা গড়ে তুলেছিলেন স্বয়ং কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পূর্ববঙ্গে কবির নিজস্ব জমিদারি ছিল এই কালিগ্রাম পরগনা, যার সদর ছিল নাগর নদের তীরের পতিসর। শরিকদের সঙ্গে জমিদারি ভাগবাটোয়ারা হয়ে গেলে নিজ জমিদারিতে উন্নতির কাজে মনোনিবেশ করেন কবি-জমিদার। গরিব চাষিদের সাহায্য করার জন্য কৃষিঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। এ জন্য সমবায় পদ্ধতিভিত্তিক ‘পতিসর কৃষি ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করেন। ছেলের সঙ্গে আলোচনা করে নোবেল পুরস্কারে পাওয়া টাকার বৃহদাংশ রাখেন এ ব্যাংকে। রবীন্দ্রনাথ প্রজার কল্যাণার্থে গঠিত কালিগ্রাম হিতৈষী সভার জন্য কিছু উপযুক্ত লোকও সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন। শৈলেশ মজুমদার, কালীমোহন ঘোষ, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, অতুল সেন, উপেনভদ্র ও বিশ্বেশ্বর বসুদেবকে নিয়ে বিশাল কর্মীবাহিনী গড়ে তোলেন কবি। এই হিতৈষী সভা জমিদারির বিভিন্ন স্থানে স্কুল ও দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করে, সর্বসাধারণের জলকষ্ট নিবারণের জন্য কূপ ও দিঘি খনন করে, চলাচলের জন্য রাস্তাঘাট তৈরি ও সংস্কার করে, ঝোপঝাড় কেটে আবাদি জমিতে রূপান্তর করে। রবীন্দ্রনাথ ‘কালিগ্রাম হিতৈষী সভায়’ সবচেয়ে বড় কাজ করেছিলেন সালিসি প্রথা চালু করে। পরগনার সব কলহ এবং মামলা-মোকদ্দমার নিষ্পত্তি করা হতো এর মাধ্যমে। সালিসির ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম স্বদেশি কর্মী খুলনার সেনহাটির অতুল সেন। রবীন্দ্রনাথের ওই হিতৈষী সভা সম্পর্কে একজন রবীন্দ্রগবেষক লিখেছেন:
‘প্রজাদের মধ্যে যেকোনো কারণে বিরোধ সংঘটিত হলে অতুল সেনের গোচরীভূত করা হতো, তিনি দিন-তারিখ এবং সময় নির্ধারণ করতেন। নির্ধারিত দিনে বিচার করে অতুল সেন রায় প্রদানের ব্যবস্থা নিতেন। তাঁর সালিসিতে প্রজারা ন্যায়বিচার তো পেতেনই, অপর দিকে তারা মামলার অর্থ অপচয় করা থেকেও রেহাই পেতেন।...শান্তিনিকেতনের কাগজপত্র এবং মহাফেজখানায় রক্ষিত তথ্য থেকে জানা যায়, কবির কালিগ্রাম হিতৈষী সভা যত দিন চালু ছিল, তত দিন তো বটেই, তার পরে বেশ কয়েক বছর এই পরগনা থেকে একটি মামলাও সদরে যায়নি বিচারের জন্য।’
হুলহুলিয়ার অবস্থান রবীন্দ্রনাথের জমিদারির একেবারেই সন্নিকটবর্তী। কবি শিলাইদহ কিংবা শাহজাদপুর থেকে বোটে চড়ে যখন বড়াল বেয়ে আত্রাই নদী দিয়ে যেতেন, তখন অদূরেই থাকত হুলহুলিয়া গ্রাম, সিঙ্গরাসহ নানা গ্রাম।
বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অনেক দান পৌঁছালেও আমাদের গ্রামগুলোতে তার প্রভাব খুব একটা পড়েছে বলে মনে হয় না। গ্রামনির্ভর কৃষিসমাজ রয়েছে বলেই পুরোনো ‘ভ্যালুজ’গুলো এখনো বহাল রয়েছে আমাদের গ্রামগুলোতে। এখনো বাংলাদেশের গ্রাম কৃষিজ পণ্যের উৎপাদকই শুধু নয়, সংস্কৃতিরও স্রষ্টা। চলুক না গ্রাম গ্রামের মতোই। যেমন চলছে এখনো হুলহুলিয়ার মানুষেরা। হুলহুলিয়াতেও অনেক ঘটনা ঘটেছে জমি নিয়ে, পারিবারিক কলহ নিয়ে, ব্যক্তিস্বার্থ নিয়ে। সে ঘটনা গ্রামেই তো নিষ্পত্তি হয়েছে, আদালতে যেতে হয়নি। স্থানীয়ভাবে বিবাদ-বিসংবাদ মিটে যাওয়ায় স্বস্তি পায় সবাই বাদী-বিবাদী উভয়ই। হুলহুলিয়ার মানুষ বলে, আদালতে গিয়ে লাভ কি অন্যকে টাকা খাওয়ানোর? বছরের পর বছর ধরে মামলা চালিয়ে নিঃশেষ হওয়ার প্রয়োজন নেই তাদের।
আদতে ঘটনাও তাই। একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, দেশে উচ্চ আদালত থেকে নিম্ন আদালত পর্যন্ত বেশ কয়েক লাখ মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে। আদালতে বিচারাধীন মামলার জট বাঁধে আশির দশকে এরশাদ সরকারের আমলে, যখন উপজেলাতেই আদালত বসানো হয়েছিল। দেশের বর্তমান প্রধান বিচারপতি মহোদয় দায়িত্ব নিয়েই নিষ্পত্তির জন্য অপেক্ষমাণ মামলার বিশাল সংখ্যার কারণে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তিনি যথাসম্ভব দ্রুত সেগুলোর বিচারিক কাজ শেষ করতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তবে সে নির্দেশ খুব একটা পালিত হয়েছে বলে আমাদের মনে হয় না।
অনেকেই পত্রিকার ওই খবর পড়ে মন্তব্য করেছেন, হুলহুলিয়া-কালিগ্রাম মডেলে যদি আমাদের গ্রামগুলো চলে, তাতে লাভ তো অনেক। গ্রামবাসী নিজেদের সমস্যা নিজেরাই নিষ্পত্তি করবে (কোনো কোনো জটিল বিষয় নিষ্পত্তির জন্য অবশ্যই শহরের আদালতে যেতেই পারে), নিজেরা পরস্পরের প্রতি পরমতসহিষ্ণু হয়ে উঠবে—সর্বত কল্যাণ হবে গ্রামের। দেশের প্রতিটি গ্রামই তো এভাবে নিজেদের মতো করে গড়ে উঠতে পারে। আদতেই আমাদের গ্রামগুলোকে স্বাবলম্বী করে তোলা একান্ত অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। গ্রামের মানুষকেই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এগিয়ে আসতে হবে এ জন্য।
সাইফুদ্দীন চৌধুরী: গবেষক অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
pr_saif@yahoo.com
No comments