যুক্তি তর্ক গল্প-জনগণের ঐক্য ও বিএনপির ভবিষ্যৎ by আবুল মোমেন
মার্ক্সবাদী তত্ত্ব বলে, যেকোনো সমাজে পরিবর্তনের প্রক্রিয়া চলতেই থাকে। সাধারণত দীর্ঘদিন ধরে পরিমাণগত পরিবর্তন হয়ে একসময় তা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে সমাজে গুণগত পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে ওঠে। এ গুণগত পরিবর্তনটা স্পষ্টভাবে বোঝা যায়, তাই ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় একে একটা বিপ্লবী ঘটনাই বলা যায়।
অনেক সময় সত্যি সত্যি বিপ্লবও ঘটে যায়। আমাদের দেশে এভাবেই দেশভাগের পরপর আটচল্লিশ সালে সূচিত ভাষার অধিকার আদায়ের আন্দোলন বায়ান্ন, চুয়ান্ন, বাষট্টি, ছেষট্টি, ঊনসত্তরের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাইলফলক ছুঁয়ে একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধে উপনীত হয় এবং শেষ পর্যন্ত আমরা স্বাধীনতা অর্জন করি। এভাবে আটচল্লিশ থেকে রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে সূচিত পরিমাণগত পরিবর্তনই ২৩ বছর পরে গুণগত পরিবর্তনকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে একটি বৈপ্লবিক ঘটনা হিসেবেই মূল্যায়িত করা যায়।
বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, পরিমাণগত পরিবর্তনের সময় মতাদর্শ, স্বার্থ ও চিন্তাগতভাবে বিভক্ত সমাজে ক্রমেই একটি মূলধারা তৈরি হয়ে উঠেছে। সেটিও আবার অনড় রক্ষণশীল ধারা নয়, বিরাজমান বাস্তবতা থেকে গ্রহণযোগ্য ও জনসমর্থিত প্রবণতাগুলো আত্মস্থ করে নিতে থাকে। বাংলাদেশে ওই সময়ে একদিকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের একক প্রতিষ্ঠা, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দল হিসেবে একক অগ্রগামিতা এবং মূল রাজনীতির ন্যূনতম অর্জন-লক্ষ্য হিসেবে পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসনের দাবির অগ্রগণ্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এই নেতৃত্ব ও রাজনীতিই আবার সমকালীন সময়ের রাজনৈতিক চিন্তাধারার মধ্যে জনসমর্থিত বলিষ্ঠ দুটি বিষয় হিসেবে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকেও গ্রহণ করে নিয়েছে। এভাবেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের জন্য যুগপত্ জনমতের ও জনগণের ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।
এই সূত্র ধরেই দুটি বিষয় আজ বোঝা দরকার এবং বলা প্রয়োজন বলে মনে করছি। পঁচাত্তরের পর থেকে প্রথমে খন্দকার মোশতাক আহমদ ও পরে জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পাকিস্তানি ধারার উপাদানগুলো ফিরিয়ে আনা হয়। রাজনীতিতে ধর্মভিত্তিক মুসলিম জাতীয়তাবাদের প্রাধান্য, সমাজতন্ত্রের রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী বলয় থেকে বিযুক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী পাকিস্তান-মার্কিন-সৌদি বলয়ে প্রবেশ এবং রাজনীতি ও শাসনে সেনাপ্রভাব জোরদার করা এর মধ্যে অন্যতম। এরই ধারাবাহিকতায় দেশে সাম্প্রদায়িকতার উত্থান হয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোটের হাত ধরে ধর্মান্ধ জঙ্গিবাদের উত্থান ও পৃষ্ঠপোষকতা পর্যন্ত গড়িয়েছে। এই একই সময়ে সেনাবাহিনী, বিশেষত সেনা গোয়েন্দা দপ্তর বেসামরিক প্রশাসন ও গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে প্রভাব খাটিয়ে গণতন্ত্রের পথকে কঠিন করেছে। আন্তর্জাতিকভাবেও এ সময় বাংলাদেশ বন্ধুর সংকট ও ভাবমূর্তির সংকটে পড়েছে।
এই প্রবণতা চলেছে রাষ্ট্রীয় ও সামরিক সহযোগিতায়, পৃষ্ঠপোষকতায়। ফলে একাত্তরের অর্জনসমূহকে ধারণ ও লালন করার রাজনীতি রাষ্ট্রের শক্তিশালী ও কার্যকর দুই অঙ্গের—বেসামরিক প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীর—বিরোধিতা, এমনকি নিপীড়ন-নির্যাতনের মুখে পড়ে যায়। এর প্রথম বলি হয়েছে এ দেশের সবচেয়ে সফল, গৌরবময়, শক্তিশালী ও কার্যকর ধারা, ছাত্ররাজনীতি। অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্র ও সরকারের হস্তক্ষেপ ও পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে এখানে অস্ত্র ও অর্থের জোগান দিয়ে তার সর্বনাশ করা হয়েছে। একইভাবে টাকা-পয়সা ও ক্ষমতার প্রসাদ বিতরণের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে কলুষিত ও অকার্যকর করার কাজও চলেছে।
এই প্রবল প্রতিকূলতার মধ্যেও কিন্তু প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাজনীতি এবং একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েমের সংগ্রাম থেমে থাকেনি। গণতন্ত্রের এই অভিযাত্রায় শেখ হাসিনার অংশগ্রহণ যেমন একটি ইতিবাচক ঘটনা ছিল, তেমনি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে পরিচালিত ঘাতক-দালালবিরোধী আন্দোলন জাতির জন্য, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের মধ্যে নতুনভাবে জাতীয় চেতনা জাগিয়েছে ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফিরিয়ে এনেছে। তার পরও কাজ সহজ হয়নি। দীর্ঘ দিনে ছাত্ররাজনীতি, শ্রমিক রাজনীতি, মূল গণতান্ত্রিক রাজনীতিসহ সর্বত্র অবক্ষয় ও নানা দূষণ ঢুকে পড়েছিল। ফলে আন্দোলন-সংগ্রামের ফলে পরিবর্তন ও উত্তরণের যে সুযোগগুলো তৈরি হচ্ছিল, তা ঠিকভাবে কাজে লাগানোও যাচ্ছিল না। তা ছাড়া ঊনসত্তরে বঙ্গবন্ধু যেভাবে বাঙালির জাতীয় নেতা ও নায়কে পরিণত হয়েছিলেন, এখানে তারও অভাব ছিল। আওয়ামী লীগেও নানা ক্ষুদ্র স্বার্থের উপদলীয় টানাপোড়েন তৈরি হয়েছিল প্রবল। আবার সহযোগী বাম সংগঠনগুলোর মধ্যেও ছিল নানা সংশয়, বিভ্রান্তি ও স্বার্থের দোলাচল। ফলে দেশজুড়ে একটা ঐক্যের বাতাবরণ কিছুতেই তৈরি হচ্ছিল না।
কিন্তু, কথায় বলে ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিজয়ের পর বিএনপি-জামায়াত জোটের দুঃশাসন কতকগুলো বিষয় পরিষ্কার করে দিয়েছে: বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের লক্ষ্য ও স্বার্থগত কোনো পার্থক্য নেই, ধর্মান্ধ জঙ্গিবাদের উত্থানে ও পৃষ্ঠপোষকতায় ক্ষমতাসীন জোটের হাত রয়েছে, একাত্তর ও পঁচাত্তরের ঘাতক-খুনিদের বিচারের বিষয়ে বিএনপি আন্তরিক নয়, জোট সরকারের মন্ত্রী-আমলা ও দলীয় নেতারা বেপরোয়া দুর্নীতিতে লিপ্ত হয়ে পড়েছেন। এ ছাড়া এটাও পরিষ্কার হলো যে প্রশাসনে ও সরকারি দপ্তরের সর্বত্র দলীয়করণ ও দুর্নীতির ভয়াবহ ব্যাপকতা দেশের ভবিষ্যেক সর্বনাশের পথে নিয়ে যাবে। হয়তো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিএনপির অতিচালাকিপূর্ণ বেপরোয়া আচরণের ফলে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল তা একদিকে নির্বাচন, গণতন্ত্র ও ক্ষমতা নিয়ে তাদের দুরভিসন্ধি পরিষ্কার করে তুলেছিল, আর অন্য দিকে এসব ঘটনা তাদের প্রতি তরুণ প্রজন্মকে বিমুখ করে দিচ্ছিল। এ সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরের শাসনামলে জনমতের এই পরিবর্তনের কাজটি ঘটার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে বলেই আমার বিশ্বাস। যেহেতু এ সময়টি নিয়ে রাজনীতিক ও পেশাজীবী মহলে ব্যাপক বিতর্ক আছে, তাই এ বিষয়ে পরে আলাদাভাবে লেখার ইচ্ছা রইল।
২০০৮-এর নির্বাচনে জনগণ বস্তুত বিএনপিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তাই তাদের ফলাফলে এত বড় বিপর্যয় হয়েছে আর মানুষের সামনে অন্য কোনো বিকল্প ছিল না বলে আওয়ামী লীগকে একটি সুযোগ তাদের দিতেই হয়েছে। কিন্তু তলে তলে জনমানসে আরও কিছু পরিবর্তন ঘটেছিল বলেই মনে হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, তরুণ প্রজন্ম যুদ্ধাপরাধী ও পঁচাত্তরের ঘাতকদের অপকর্মের বা পাপের বোঝা টানতে রাজি নয়। দেখা যাচ্ছে, ঊনসত্তরের পরে আবারও দেশের বাম রাজনৈতিক দলগুলোর বড় অংশ মূলধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, এই প্রথম বাংলাদেশে সেনাবাহিনী গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে তাদের পছন্দের দল হিসেবে একমাত্র বিএনপিকেই বিশেষভাবে গণ্য করা থেকে বিরত থেকেছে। আন্তর্জাতিকভাবেও ইসলামি জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যে শক্তি অর্থাত্ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিমা বিশ্ব ও ভারত বিএনপিকে নির্ভরযোগ্য রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে গণ্য করেনি। এ ছাড়া কিছু চমকপ্রদ উত্তরণ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ঘটে গেছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো একজন দূরদর্শী, পরিণত রাজনীতিক হিসেবে শেখ হাসিনার উত্তরণ। ক্ষমতায় এসে মন্ত্রিসভা গঠনের মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর এই উত্তরণের স্বাক্ষর জোরালোভাবেই রেখেছিলেন। তখন যাঁরা সংশয় প্রকাশ করেছিলেন, তাঁরাও এখন স্বীকার করছেন সে পরিবর্তন দেশের জন্য শুভ হয়েছে। তিনি দলেও একইভাবে পরিবর্তন এনেছেন। এ ছাড়া সরকারের জঙ্গিবিরোধী অবস্থান, পঁচাত্তরের ঘাতকদের বিচার ও শাস্তি সম্পন্ন করা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া চালু রাখা ইত্যাদি তরুণ প্রজন্মের কাছে আশার বার্তাই পৌঁছে দিয়েছে। পাশাপাশি কৃষি, শিক্ষা, আইনশৃঙ্খলা, খাদ্য সরবরাহের ক্ষেত্রেও জনগণকে আশ্বস্ত করা গেছে।
সব দেখে মনে হচ্ছে, পঁচাত্তরের পরে কিছুকাল সম্পূর্ণ স্থগিত ছিল প্রগতি ও গণতন্ত্রের অভিযাত্রা। তারপর ’৮১-৮২ সাল থেকে যে যাত্রা শুরু তা সমাজে পরিমাণগত পরিবর্তন সৃষ্টি করতে করতে বর্তমানে একটি গুণগত পরিবর্তনের দিকে যাচ্ছে। সেটা যেমন যুদ্ধাপরাধ ও ঘাতকের পাপের বোঝা বহনে তরুণ সমাজের অনীহার প্রকাশ ঘটিয়েছে, তেমনি ধর্মান্ধতা ও জঙ্গিবাদের কাছে নতি স্বীকার না করার আত্মপ্রত্যয়ও দেখিয়েছে। এই নতুন চেতনা ও তারুণ্য অযথা ভারতীয় জুজুর ভয়ে কাতর হবে না, আপন কৃষ্টি-গৌরব নিয়ে ধর্মান্ধদের কথায় বিভ্রান্ত হবে না। দুর্নীতি, অস্ত্র ও পেশিশক্তিমুক্ত রাজনীতি ও প্রশাসনই এই ঐক্যের লক্ষ্য। দক্ষতা, আধুনিক শিক্ষা এবং সর্বত্র যুগোপযোগী সংস্কার আজকে জনগণের ঐকান্তিক কামনা।
ফলে দেশে জনমতের নৈকট্য ও জনগণের ঐক্যের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে, যা দেশকে একটি গুণগত পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে নিচ্ছে বলে মনে হয়। এখন বেগম জিয়া, তাঁর দল ও সহযোগীদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাঁরা এই ঐক্যের বাতাবরণ ও প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত থাকবেন নাকি বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা করতে গিয়ে নিজেদের রাজনীতিকে ষড়যন্ত্রের পাকে জড়াবেন ও দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যেক বিপন্ন করবেন। তবে কথা হলো, মানুষ ঐক্যবদ্ধ হলে ষড়যন্ত্রের রাজনীতিকে সমুচিত জবাব দিয়ে থাকে। পাকিস্তানে মুসলিম লীগের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের রাজনীতিকে, পাঞ্জাবি সেনাশাসকদের চক্রান্তকে বাংলাদেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবেই পরাস্ত ও বিলুপ্ত করেছিল।
আজ ইতিহাস এক কঠিন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে বিএনপির সামনে। সেটা উপলব্ধি করা এবং সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ওপর দেশের আগামী দিনের রাজনীতির গতিধারা এবং রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির ভবিষ্যত্ নির্ভর করবে। মানুষ অবশ্যই চায়, অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে বিএনপি এই জায়মান ঐক্য ও গুণগত পরিবর্তনের অভিযাত্রায় শরিক হবে।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments