আমার ভাষা আমার একুশ-কম্পিউটার-ইন্টারনেটে বাংলা ভাষা: এখানো পথ বাকি by সৌরভ সিকদার
বিশ্বে জনসংখ্যার মাপকাঠিতে বাংলা ভাষাভাষীদের অবস্থান সপ্তম। সব মিলিয়ে বর্তমানে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ এই ভাষা ব্যবহার করে। একুশে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষিত হওয়ায় বাংলা ভাষার গৌরব ও ঐতিহ্য এখন বিশ্ববাসী জেনে গেছে।
কিন্তু এই বাংলা ভাষা এখনো তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের যুগেও ইন্টারনেট-কম্পিউটারের সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগ সম্ভব হচ্ছে না। যেমন, খুব সহজেই বলা যায়, ইংরেজি ভাষা কম্পিউটারে নির্দেশ দিলেই সে বর্ণনানুক্রমিক শব্দ বা বাক্য সাজিয়ে নিতে পারে। বাংলা ভাষায় এখনো এ কাজটি সম্পন্ন করা হয়নি। কিন্তু এটি যে করা অসম্ভব, তা নয়। ইউনিকোড নিয়েও আমাদের বাংলা মান ফন্ট নির্ধারণে জাতীয় উদ্যোগের অভাবের কারণে কিছুটা হলেও আমরা পিছিয়ে গেছি। কিন্তু কম্পিউটার কিংবা ইন্টারনেটে বাংলা ভাষার প্রয়োগ ও সম্ভাবনা অনুসন্ধান থেমে নেই। এরই মধ্যে দেশের ৬৪টি জেলার ‘জেলা তথ্যবাতায়ন’ ওয়েব বাংলায় চালু হয়েছে। মন্ত্রণালয়সহ সব প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট আশা করা যাচ্ছে ২০১০ সালের মধ্যে বাংলায় পাওয়া যাবে। ক্রমে ক্রমে নিশ্চয় অন্যরাও বাংলা ওয়েবসাইট চালু করবে। দুই যুগ আগে কম্পিউটারে বাংলা ভাষা প্রচলন করার জন্য যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ব্যক্তি পর্যায়ে, তা আজ সামষ্টিক ও জাতীয় উদ্যোগে পরিণত হয়েছে। তার পরও পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বাংলাকে কম্পিউটারে মেলানো সম্ভব হয়নি। এমনকি ইন্টারনেট জগতে যত তথ্য আছে, ভাষাভিত্তিক অবস্থান বিচারে বাংলা ভাষা প্রথম দশের মধ্যে এখনো আসতে পারেনি।
বাংলায় কম্পিউটার প্রচলনের সূচনালগ্নের অন্যতম উদ্যোক্তা মোস্তাফা জব্বার বর্তমানে কম্পিউটারে বাংলা ভাষার অবস্থা বিষয়ে জানান, ‘প্রথমত, বাংলা ভাষা কম্পিউটার দিয়ে লেখার ক্ষেত্রে এখন কোনো সমস্যা নেই। যেকোনো ডিজিটাল ডিভাইসে বাংলা লেখা সম্ভব। কি-বোর্ড, ফন্ট, অপারেটিং সিস্টেম—সবই রয়েছে। তবে বানান ও ব্যাকরণ শুদ্ধিকরণের সমস্যা এখনো রয়ে গেছে। সল্টিংয়ের সমাধান করা সম্ভব, কিন্তু অভিধান ও পাঠ্যবইয়ে ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনানুক্রমের সমস্যা হচ্ছে। এ ছাড়া বাংলায় অপটিক্যাল ক্যারেক্টর রিডার না থাকায় ইংরেজির মতো টেক্সকে স্ক্যান করে সফ্টওয়ারের মাধ্যমে কম্পোজ আকারে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বাংলা আমাদের ভাষা। তাই আমাদের দায়িত্ব এসব সমস্যার সমাধান করে বাংলা ভাষায় কম্পিউটার প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটানো।’
যেহেতু কম্পিউটার ইংরেজিভাষীরা তৈরি করেছেন, কাজেই তাঁরা কম্পিউটারে কোন অক্ষরকে কোন বিন্যাসে বোঝাবে তার একটি মানচিত্র তৈরি করে নিল, যাকে বলে আসকি (ASCII)। এরপর বিশ্বের অন্য ভাষার মানুষ তাদের অক্ষরকে বিন্যাস করে একটি মান তৈরি করে নিল। বাংলাদেশে তথা বাংলাভাষীদের উচিত ছিল একটামাত্র ‘আসকি’ তৈরি করা—যেটা কম্পিউটার কাউন্সিল করতে পারত। তা হলো না। বরং অনেকেই নিজেদের মতো হায়ার আসকি সংকেতগুলো সাজিয়ে নিলেন। ফলে এক কম্পিউটারের বাংলা অন্য কম্পিউটার পড়তে পারে না। যদিও বাংলা ফন্ট কি-বোর্ডের সমস্যা অনেক আগেই সমাধান হয়েছে। এর পর এল যার যার ভাষার ফন্ট পড়ার জন্য ইউনিকোড। বাংলা ও অসমিয়া ভাষার লিপি এক, কিন্তু আমাদের যেমন ব-য়ে ফোঁটা দিয়ে ‘র’ ওদের তেমন পেটকাটা ‘ব’ কিছু জটিলতা সৃষ্টি করলেও বাংলা অসমিয়া পৃথক ইনিকোড হয়ে গেল। যদিও খণ্ড-ত নিয়ে কিছুদিন বাংলায় বিরোধ চলেছে—এখন সেটারও সমাধান হয়ে গেছে। তার পরও কথা থেকে যায়, বাংলা ভাষায় যে ফন্ট সবচেয়ে বেশি ব্যবহূত হয় সেই সুতন্বী-এমজে ইউনিকোড সমর্থিত নয়। ইউনিকোড আসার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, কম্পিউটারে এখন আমরা বাংলায় চিঠি লিখতে ও পাঠাতে পারি। শুধু ইন্টারনেট থেকে ইউনিকোড সমর্থিত যেকোনো একটি বিনা মূল্যের সফটওয়ার নামিয়ে নিলেই হলো।
কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ মুনির হাসান কম্পিউটার ও বাংলা ভাষা প্রসঙ্গে আমাদের জানান, ‘বাংলা ভাষায় কম্পিউটিংয়ের প্রধান সমস্যাগুলো ইতিমধ্যেই দূর হয়েছে। ইউনিকোডে আমাদের বর্ণমালার জন্য আলাদা কোড হয়েছে শুধু ‘ব’-ফলা ছাড়া। কোডিং ছাড়াও প্রয়োজন ইনপুট সিস্টেম ও ফন্ট। বাজারি ফন্ট ছাড়াও সফটওয়ার আন্দোলনের কর্মীরা বিনা মূল্যের ফন্ট ও সিস্টেম তৈরি করেছেন। নির্বাচন কমিশন তৈরি করেছে নিকস পরিবারের পাঁচটি ফন্ট। ইউনিকোড চালু হওয়ায় বাংলা ওয়েবসাইট ব্লগ এখন আর কল্পনা নয়, দেশের প্রধান দৈনিকগুলো তাদের ওয়েব সংস্করণ প্রকাশ করছে নিয়মিত। তবে ইউনিকোডভিত্তিক বাংলা লিপির প্রচলন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েনি। সরকার গৃহীত আইসিটি নীতিমালা ২০০৯ অনুসারে বাংলা ভাষায় কম্পিউটার উত্সাহিত করা হচ্ছে। এমনকি বাংলা প্রমিতকরণ কমিটিও তৈরি করা হয়েছে।’
আমাদের যে টুকু পথ যেতে বাকি তা হচ্ছে ‘ওয়েব ঠিকানা বাংলায় লেখা’। দু-এক বছরের মধ্যে সেটা হয়ে যাবে বলে কম্পিউটার বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এখন বাংলা ওয়েবসাইট, সার্চইঞ্জিন, ইংরেজির মতোই ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু বর্ণনানুক্রমে বা কালেকশন সিকোয়েন্স, বানান সংশোধক (স্পেলিং চেকার), ব্যাকরণ সংশোধক, বাংলা লেখার ভান্ডার (Corpus), বাংলা বলা থেকে লেখা এবং লেখা থেকে বলা প্রভৃতি তৈরি করা প্রয়োজন। আর তা হলেই আমরা বাংলায় যেমন কম্পিউটার পাব, তেমনি ইন্টারনেটের দুনিয়ায় ইংরেজির মতোই প্রতিষ্ঠা পাবে মায়ের ভাষা বাংলা ভাষা।
মুনির হাসান লিখেছেন, ‘কম্পিউটার-ইন্টারনেট আসার সঙ্গে সঙ্গে আমরা বুঝেছি, আমাদের ভাষার লড়াই শুরু হয়েছে আরেকবার।’ এটা যেমন সত্য, তেমনি এও সত্য যে এ লড়াইয়ে বাংলা ভাষা অনেক দূর এগিয়েছে। সামনে যাওয়ার এ চেষ্টায় যাদের সহযোগিতা ও উদ্যোগ প্রয়োজন ছিল—সেই সরকার বা বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল কতটা ভূমিকা পালন করেছে তাও প্রশ্নসাপেক্ষ। পশ্চিমবঙ্গে ভাষাবিজ্ঞানী পবিত্র সরকার এবং কম্পিউটার বিশেষজ্ঞরা মিলে ২০০৮ সালে ‘ভাষা প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদ’ গঠন করে বাংলা ভাষানির্ভর প্রযুক্তি গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়েছেন। আমাদের বাংলাদেশে সরকারি উদ্যোগে তথ্য-কম্পিউটার-প্রযুক্তি বাংলাভাষী সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়ে বাংলা ভাষার অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর উদ্যোগ কবে নেওয়া হবে?
এ প্রসঙ্গে একটি কথা না বললেই নয়, তরুণ প্রজন্মসহ সবাইকে রোমান হরফে বাংলা লেখার মানসিকতা এবং ফ্যাশন ত্যাগ করে মায়ের ভাষার অক্ষরগুলো ভালোবাসতে হবে। তা হলেই একুশে ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ভাষার বিশ্বজয় সার্থক হবে।
সৌরভ সিকদার: অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments