আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-২২-এগিয়ে চলি বহমান নদীর মতো by আলী যাকের

গেণ্ডারিয়া মহিলা সমিতি নারী সচেতনতার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল সেই পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে। আমরা গেণ্ডারিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করার পর মা ও দিদি গেণ্ডারিয়া মহিলা সমিতির নানা কাজে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিতে লাগলেন।


আমার যতদূর মনে পড়ে, তখন গেণ্ডারিয়া মহিলা সমিতির সভাপতি ছিলেন আশালতা সেন এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বদরুন্নেসা আহমেদ। আশা মাসিমা অত্যন্ত বিদুষী রমণী ছিলেন। আমাদের সঙ্গে যখন তাঁর পরিচয়, তখন তিনি একটি একতলা বাড়িতে একা বসবাস করতেন। আশা মাসিমার বাড়ির সামনেই একটা বেশ বড়সড় উঠান ছিল, যেখানে প্রায়ই আমরা দাঁড়িয়াবান্ধা ও গোল্লাছুট খেলতে যেতাম। তাঁর একমাত্র ছেলে সমর সেন ভারত নিবাসী হয়েছিলেন এবং ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হয়ে জাতিসংঘের উচ্চপদে আসীন ছিলেন। আশা মাসিমা কিন্তু একাই থাকতেন ঢাকায়। এই বিদুষী বিধবা রমণী নিরামিষাশি ছিলেন এবং তাঁর রান্নার হাত ছিল অসাধারণ। তাঁর রান্না করা ফুলকো লুচি আর নিরামিষ খাওয়ার জন্য আমরা উন্মুখ হয়ে থাকতাম। দিদি আশা মাসিমার কাছ থেকে এই নিরামিষ রান্নার বিদ্যাটি অর্জন করেছিলেন। তিনিও চমৎকার রাঁধতেন নিরামিষ। মা ছিলেন গেণ্ডারিয়া মহিলা সমিতির সহসভাপতি। আশা মাসিমা পরবর্তী সময়ে তাঁর ছেলের কাছে চলে যান। বদরুন্নেসা আহমেদ হলেন গেণ্ডারিয়া মহিলা সমিতির পরবর্তী সভাপতি। মহিলা সমিতির সঙ্গে মায়ের সম্পৃক্ততার কারণে তখনকার অনেক বিখ্যাত নারীর সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ, নুরজাহান বেগম, আশালতা সেন, বদরুন্নেসা আহমেদ তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। গেণ্ডারিয়া মহিলা সমিতি সে সময় প্রায়ই নানা অনুষ্ঠান করত। বিশেষ করে নৃত্যগীতের অনুষ্ঠান। আমরা সেসব অনুষ্ঠানে মঞ্চে দড়ি বাঁধা থেকে শতরঞ্জি টানা_এই ধরনের ফুটফরমাশ খাটতাম। তবে তাতেই ছিল প্রচুর আনন্দ। এমন অনেক সময় হয়েছে যে একজন গুণী মানুষের কাছে বসে থাকতেই অনেক আনন্দ পেয়েছি। সে রকম কয়েকজনের মধ্যে আমার এ মুহূর্তে মনে পড়ছে রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষক ভক্তিময় দাসগুপ্ত, নৃত্য শিক্ষক অজিত স্যানাল এবং সেতার শিক্ষক খাদেম হোসেন খানের কথা। তাঁদের সবার কাছেই দিদি এবং আমার ছোট বোন অল্পবিস্তর সংগীত-নৃত্য শিক্ষালাভ করেছিল। যদিও কালেভদ্রে দেখা হয়েছে এবং মানুষটি অত্যন্ত মিতবাক ছিলেন তবুও বুলবুল চৌধুরীর বিধবা স্ত্রী আফরোজা বুলবুলের প্রতিও অত্যন্ত আকৃষ্ট ছিলাম আমরা তাঁর ব্যক্তিত্বের কারণেই। ওই সময়টিতে বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত অনেক গুণী মানুষ কলকাতা থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রামে এসেছেন বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষে অথবা শিক্ষাদান করার জন্য। চট্টগ্রাম শহরে এসব কাজে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন তখনকার তরুণ কবি এবং সংস্কৃতিজন, অধুনা প্রয়াত শ্রদ্ধেয় মাহবুবুল আলম চৌধুরী। তখনো অবশ্য ওয়াহিদুল হক অথবা সন্জীদা খাতুনের সংস্পর্শে আমি আসিনি।
তারুণ্যের যে ধর্ম, সেটা সর্বব্যাপী ও সর্বগ্রাসী। এই যে মহিলা সমিতির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এগিয়ে যেতাম, এর পেছনে কাজ করে প্রশংসা পাওয়ার লোভ যেমন ছিল, তেমনি সুন্দরী শিল্পীদের সানি্নধ্য একটি প্রধান কারণ ছিল বৈকি। আমার এখনো মনে পড়ে লোকসংগীত শিল্পী নিনা হামিদ বালিকা কণ্ঠে লতা মুঙ্গেশকরের 'আকাশ প্রদীপ জ্বলে দূরের তারার পানে চেয়ে'_গানটি এমনই সুমধুর কণ্ঠে গেয়েছিলেন যে ওই সুর ঘুমের মধ্যেও আমাকে উত্ত্যক্ত করত। তবে ওই সময় নাওয়া-খাওয়া ভুলে গিয়ে গেণ্ডারিয়া মহিলা সমিতি প্রযোজিত 'চণ্ডালিকা' নাটকের মহড়া দেখেছি সন্ধ্যার পর সন্ধ্যা। চণ্ডালিকায় রবীন্দ্রদর্শন কতখানি বুঝেছিলাম তা বলতে পারব না। তবে চণ্ডালিকার ভূমিকায় মন্দিরা নন্দীর ভুবনমোহন রূপ এবং নৃত্যশৈলী আমৃত্যু মনে থাকবে। যে কথাগুলো আজকে লিখছি, এগুলো অতি সত্য এবং সৎ কথা। আজকের এই সামাজিক অবস্থানে পেঁৗছে আমার ভাবমূর্তির সঙ্গে কথাগুলো বিব্রতকর বলে মনে হতে পারে, তবুও সত্য লুকিয়ে রেখে একজন মানুষকে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করা সম্ভব বলে আমি মনে করি না। ওই গেণ্ডারিয়াতেই আমার যৌবনের স্ফুরণ। সেখানেই অনেক সুখের প্লাবন আমায় কানায় কানায় পরিপূর্ণ করেছে। অনেক দুঃখ আমার ভেতরটাকে ঝাঁজরা করে দিয়েছে। যৌবনের উপলব্ধিই এমন যে পরিমিত অনুভূতি বলে কোনো অভিব্যক্তি নেই_থাকতে পারে না। এভাবেই এগিয়ে চলি বহমান নদীর মতো এখন প্রচণ্ড উন্মত্ততায়, তখন ক্ষীণকায় জলধারার মতো পরিণতির পথে।
ফিরে যাই কৈশোরের দুরন্তপনায়। আসাফউদ্দৌলা, আমাদের কলি ভাই এবং আমার বড় ভাইয়া উভয়ই সাঁতারে সমান আগ্রহী ছিলেন। যতদূর মনে পড়ে, কলি ভাই ব্যাক স্ট্রোক সাঁতারে দক্ষ ছিলেন এবং আন্তকলেজ প্রতিযোগিতায় বিশেষ সম্মানও অর্জন করেছিলেন। আমরা সাঁতার কাটতাম গেণ্ডারিয়ার আমজনতার পুকুরে, যেটির অবস্থান ছিল রেললাইনের ধারে। সাধারণত রবিবার দিন সকালবেলায় পুকুরে নেমে শেষ দুপুর পর্যন্ত দাপাদাপি করা আমাদের অত্যন্ত প্রিয় খেলা ছিল। আমার এক জ্যাঠাতো ভাই ছিলেন, যিনি গেণ্ডারিয়ায় আমাদের সঙ্গে বাস করতেন। মাঝেমধ্যে রবিবার দিন দুপুরবেলা সাঁতার কাটতে কাটতে যখন খাওয়ার কথা ভুলে যেতাম, মা অস্থির হয়ে আমাদের এই ছোড়দাকে পাঠাতেন পুকুর থেকে আমাদের তুলে আনতে। পুকুরপাড়ে তাঁকে দেখলেই আমরা বুঝতে পারতাম, বাড়ি থেকে সমন এসেছে। তিনি পুকুরঘাটে এসে অকৃত্রিম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভাষায় বলতেন, 'এই যে মইষেরা, এইবারে গা তোলেন। বাড়িতে পাংখার ডাণ্ডা হাতে মা বইসা আছে।' তাঁর ধারণা ছিল, এতক্ষণ ধরে পানিতে যারা বসবাস করতে পারে, তারা মোষভিন্ন আর কিছুই হতে পারে না। আমরা সুবোধ বালকের মতো ছোড়দার সঙ্গে গুটি গুটি পায়ে বাড়ি ফিরতাম।
(চলবে...)

লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.