গণমাধ্যম-সংবাদমাধ্যম কি জবাবদিহির ঊর্ধ্বে? by মশিউল আলম

‘সঠিক তথ্যপ্রমাণ ছাড়া সংবাদ প্রচার বন্ধ করার উদ্দেশ্যে নতুন একটি আইন প্রণয়নের সুপারিশ করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। গণমাধ্যমের স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে তথ্য মন্ত্রণালয়কে এ আইন প্রণয়ন করতে বলা হয়েছে।


ওই আইনে তথ্যপ্রমাণ ছাড়া সংবাদ প্রকাশ করা হলে তা দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য করার প্রস্তাব করা হয়েছে।’ [প্রথম আলো, ২৮ জানুয়ারি ২০১০]
গত ২৭ জানুয়ারি সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ওই সভায় এক প্রস্তাবে বলা হয়, সরকারের সব কাজের জবাবদিহি থাকা উচিত বলে গণমাধ্যম সব সময় বলে আসছে। অথচ অনেক সময়ই তারা সঠিক তথ্যপ্রমাণ ছাড়া বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লিখছে বা সংবাদ প্রচার করছে। গণমাধ্যমেরও দায়বদ্ধতা থাকা উচিত।
সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলো সরকারের অংশ নয়। কিন্তু কমিটিগুলোতে সরকারি দলের সাংসদদের প্রাধান্য বেশি থাকে বলে মনে হয় যেন তাঁরা সরকারের হয়েই কথা বলছেন, নীতি নির্ধারণ করছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় কেন সংবাদমাধ্যমকে জবাবদিহির মধ্যে আনার লক্ষ্যে একটা শক্ত আইন করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হলো, তা জানা যায়নি। তবে তাঁরা যখন আইনপ্রণেতা, তাই যে-মন্ত্রণালয় সংক্রান্তই হোন না কেন, যেকোনো বিষয়ে আইন প্রণয়নের প্রস্তাব-সুপারিশ অবশ্যই করতে পারেন।
সংবাদমাধ্যম বা সাংবাদিকদের ব্যাপারে কঠোর আইন-কানুন করার কথা ওঠে সাধারণত সরকার বা শাসকদের তরফ থেকে। সাধারণ নাগরিকদের পক্ষ থেকে বরং বলা হয়, সংবাদমাধ্যমের আরও স্বাধীনতা প্রয়োজন। শাসকমহলের কাছে যখন সংবাদমাধ্যমের আচরণ বিব্রতকর, অসুবিধাজনক ও মুশকিলের ব্যাপার হয়ে ওঠে, তখন তারা বলে, সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে, একে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা নিতে হবে। সব সরকারের আমলেই এ রকম লক্ষ করা যায়। ২০০৫ সালের শেষের দিকে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সাংসদ ও নেতারা প্রেস কাউন্সিল আইন সংশোধন করে কিছু কঠোর বিধান করার জন্য সংসদের ভেতরে-বাইরে বেশ শোরগোল তুলেছিলেন। সাংবাদিকদের ওপর খেপে গিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া একবার বলেছিলেন, অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট সংশোধন করে আরও কঠোর করা হবে। আর সে-সময়ের প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান প্রস্তাব করেছিলেন, ভিত্তিহীন সংবাদ প্রকাশের জন্য সম্পাদক ও সাংবাদিকদের শুধু ‘সতর্ক, ভর্ত্সনা আর তিরস্কার’ (warn, admonish and censure) জানালেই চলছে না, তাঁদের জরিমানা ও চরম ক্ষেত্রে এক দিনের জন্য প্রকাশনা বন্ধ করার এখতিয়ার প্রেস কাউন্সিলকে দিয়ে আইন সংশোধন করা হোক। সে সময়ের সংসদের স্পিকার জমিরউদ্দিন সরকার মন্তব্য করেছিলেন, একটা নতুন আইন না করা পর্যন্ত সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, কারণ সংবাদমাধ্যম স্বাধীনতা ভোগ করছে সংবিধানের দেওয়া গ্যারান্টির বলে।
অর্থাত্, এই দেশে সংবাদমাধ্যম কতটা স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবে—এই প্রশ্ন এবং এর সঙ্গে আনুষঙ্গিক দায়িত্বশীলতা, জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার প্রশ্নগুলো কখন ওঠে আর কখন ওঠে না, তা নির্ভর করে সরকার বা শাসকশক্তির সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের সম্পর্কের ওপর। জনসাধারণ বা নাগরিকদের অধিকারের প্রশ্নগুলো সরকারের কাছে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে না। সংবাদমাধ্যমের স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতা কোনোভাবে সরকারের স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু সংবাদমাধ্যম সরকারের স্বচ্ছতা-জবাবদিহি দাবি করলেই (এমন খবর, মন্তব্য, বিশ্লেষণ, মতামত প্রকাশ করে যা সরকারের জন্য বিব্রতকর/অস্বস্তিকর হয়) সরকারকে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে সংবাদমাধ্যমের জন্য নিয়ন্ত্রণমূলক কঠোর আইন করতে হবে—এই মানসিকতা ঠিক নয়। সংবাদমাধ্যমের দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহি পরিস্থিতি-নিরপেক্ষ সব সময়ের বিষয়। বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির সমর্থক সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণহীন মনে করা, আর নিজেদের সমর্থক সংবাদমাধ্যমকে স্বাধীন মনে করা অগণতান্ত্রিক মানসিকতা।
সঠিক তথ্য-প্রমাণ ছাড়া সংবাদ প্রকাশ/প্রচার করা (সত্)সাংবাদিকতা নয়। কিন্তু আমাদের দেশে অনেক সংবাদমাধ্যম আছে যেগুলো অনেক সময় সঠিক তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই অনেক লেখা প্রকাশ করে। সেগুলো খবর নয়, জল্পনা-কল্পনা বা খবরের আদলে ভিত্তিহীন প্রচারণা। এই চর্চা সাংবাদিকতার নৈতিকতার বিরোধী। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সংবাদমাধ্যমের আচরণ ‘রেগুলেট’ (প্রচলিত অর্থে ‘নিয়ন্ত্রণ’ নয়) করার জন্য প্রেস কাউন্সিল নামে একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান থাকে। তারা সরকারের অধীনে থেকে কাজ করে না, সরকারের হুকুমমতো চলে না, চলে স্বাধীনভাবে, একটি আইনের দ্বারা। বাংলাদেশেও ১৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রেস কাউন্সিল আছে। এটির চেয়ারম্যান ও বাকি সব সদস্য নিয়োজিত হন মূলত রাজনৈতিক বিবেচনায়; সরকার ও সরকারি দলের পছন্দমতো। দিনে দিনে সংবাদমাধ্যমের কাছে প্রেস কাউন্সিলের অভিভাবকসুলভ মর্যাদার অবনমন ঘটেছে। সংবাদমাধ্যমে অসত্য ও ভিত্তিহীন খবর প্রকাশের ফলে যাঁরা সংক্ষুব্ধ হন, তাঁরা সাধারণত প্রেস কাউন্সিলে নালিশ জানাতে যান না, ফৌজদারি আদালতে মামলা করেন। ১৯৭৪ সালে প্রেস কাউন্সিল গঠিত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত কোনো দিন কোনো সরকারের পক্ষ থেকে প্রেস কাউন্সিলে অভিযোগ নিয়ে যাওয়া হয়নি। অর্থাত্ সরকারি নেতাদের নিজেরই প্রেস কাউন্সিলের ওপর যথেষ্ট আস্থা নেই।
দেশে দেশে অনেক আইন থাকে যেগুলো সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতিবন্ধক। বাংলাদেশেও এমন অনেক আইন-বিধান আছে। প্রয়াত আইনবিদ ও একসময়কার প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান গাজী শামসুর রহমান তাঁর কমেন্ট্রি অন প্রেস কাউন্সিল অ্যাক্ট ১৯৭৪ শীর্ষক বইতে মোট ১৬টি আইনি বিধানের একটি তালিকা দিয়েছেন, যেগুলো বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে প্রতিবন্ধক। সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য: (১) সংবিধানের ৩৯, ৪৩ ও ১০৮ অনুচ্ছেদ, (২) দণ্ডবিধির ১২৪-ক, ১৫৩-ক, ১৫৩-খ, ২২৮, ২৯২, ২৯৩, ২৯৫ ও ৪৯৯ ধারা; (৩) আদালত অবমাননা আইন ১৯২৬; (৪) ফৌজদারি কার্যবিধির ৪-ক ধারা; (৫) বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ (বর্তমানে এটি নেই, সাহাবুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করেছে); (৬) মুদ্রণ ও প্রকাশনা আইন ১৯৭৩; (৭) দাপ্তরিক গোপনীয়তা আইন ১৯২৩; (৮) সংবাদপত্রের ডিক্লারেশন বাতিল আইন ১৯৭৫, ইত্যাদি।
যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক গণতান্ত্রিক দেশেই এ ধরনের আইন আছে; কিন্তু সেগুলো সেকেলে হয়ে ক্রমশ প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলেছে। অনেক আইন বহু বছর ধরেই প্রয়োগ হয় না। অনেক আইন ক্রমশ শিথিল ও বাতিল হচ্ছে এবং সেসবের বিপরীতে বরং সংবাদমাধ্যমের ও নাগরিকদের তথ্য জানার অধিকার নিশ্চিত করতে নতুন নতুন আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে। বাংলাদেশেও তথ্য অধিকার আইন পাস হয়েছে। একদিকে তথ্য অধিকার আইন পাস, অন্যদিকে সংবাদমাধ্যমের জন্য কঠোর আইন পাসের প্রস্তাব স্ববিরোধী চিন্তাভাবনার বহিঃপ্রকাশ।
সংবাদমাধ্যমে জনমতের প্রতিফলন ঘটে। নির্বাচিত সরকারের পাশাপাশি সংবাদমাধ্যমও জনগণেরই সার্বক্ষণিক প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। উপরন্তু একটি নির্বাচিত সরকার যখন জনজীবনের কঠিন সমস্যাগুলো সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়ে, জনগণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভুলে যায়, তখন সংবাদমাধ্যমের দ্বারাই জনগণের সত্যিকারের প্রতিনিধিত্ব ঘটে। তবে অসদাচরণ, উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা, ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক সম্মানহানির চেষ্টা যেকোনো সংবাদমাধ্যম করে না, তা নয়। এ দেশে সংবাদমাধ্যমে পেশাদারির অভাব এখনো প্রকট, নৈতিকতার বিষয়গুলোকে কম গুরুত্বের সঙ্গে দেখার প্রবণতা রয়েছে। পেশাদারি ও নৈতিকতার মান বাড়ানোর দায়িত্ব প্রধানত সংবাদমাধ্যমের নিজেরই। প্রেস কাউন্সিলকে সত্যিকারের অভিভাবকসুলভ একটি বিচারিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গুরুত্ব দিয়ে সাংবাদিকতার নৈতিকতা রক্ষা করতে একে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়া একান্ত প্রয়োজন। সম্পাদক, সংবাদমাধ্যমের মালিক, সংবাদ ব্যবস্থাপক ও নীতি-নির্ধারকদের মধ্যে রাজনৈতিক মতাদর্শের পার্থক্য থাকতেই পারে, কিন্তু দলীয় লাইনে বিভাজন কাটিয়ে ওঠা দরকার সাংবাদিকতা পেশার মান-মর্যাদা বাড়ানোর খাতিরে। কোনো সংবাদমাধ্যম উদ্দেশ্যমূলক, তথ্য-প্রমাণহীন প্রচারণা চালালে আইনি পন্থায় আদালতের মাধ্যমে তার প্রতিকারের রাস্তা খোলাই আছে; কিন্তু তার আগে যদি প্রেস কাউন্সিলের মাধ্যমে বিষয়গুলোর যৌক্তিক ও ন্যায্য সুরাহা করা যায়, তাহলে সংবাদমাধ্যমের দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহির পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে। প্রেস কাউন্সিলের ১৪ জন সদস্যকে যেহেতু সংবাদমাধ্যমের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের মধ্য থেকেই মনোনীত করা হয়, তাই এই প্রতিষ্ঠানটি হতে পারে সংবাদমাধ্যমের স্বনিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে উত্কৃষ্ট যন্ত্র। আলোচনা-পরামর্শ ও সালিসের মাধ্যমে অভিযোগগুলোর যৌক্তিক নিষ্পত্তি, ক্ষেত্রবিশেষে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়া সাপেক্ষে শাস্তিমূলক বা ক্ষতিপূরণমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ এখানে থাকবে। এভাবেই ধীরে ধীরে এ দেশে সত্, নৈতিকতাপূর্ণ, বস্তুনিষ্ঠ, অপরের সম্মান ও অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাপূর্ণ দায়িত্বশীল জবাবদিহিমূলক সাংবাদিকতার সংস্কৃতি গড়ে উঠতে পারে।
সংবাদমাধ্যমের দায়িত্বশীলতা বা জবাবদিহি কোনো গৌণ বিষয় নয়। গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে সংবাদমাধ্যমের আচরণ মূলত একটি স্বনিয়ন্ত্রিত বিষয়। তারা চলে আইন দিয়ে নয়, প্রধানত প্রথা বা কনভেনশন দিয়ে।
মশিউল আলম: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.