প্রতিক্রিয়া-পারিবারিক আইন সংস্কারের চিন্তাভাবনা
আইন কমিশনের আয়োজনে পারিবারিক আইন সংস্কার বিষয়ে জাতীয় কর্মশালা নিয়ে গত ২২ এপ্রিল আইন অধিকার পাতায় বিশেষ আয়োজন করা হয়। এ নিয়ে ফেসবুক, ই-মেইল এবং চিঠিতে পাঠক প্রতিক্রিয়া পাঠিয়েছেন। এর কয়েকটি ছাপা হলো।
০১.
বিবাহবিচ্ছেদ আইন
মুসলিম আইনে বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে পুরুষের একচ্ছত্র অধিকার রয়েছে, যা পরিবর্তনের সময় এসেছে। বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীদের বেশি অধিকার দিয়ে নতুন আইন করা উচিত। কারণ, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বিবাহবিচ্ছেদের কারণে পুরুষের চেয়ে নারী বেশি নিগ্রহের শিকার হন। আমাদের সমাজব্যবস্থা, মানসিকতা এর মূল কারণ। তালাকপ্রাপ্ত নারীকে আমাদের সমাজ বাঁকা চোখে দেখে। পুরুষের দ্বিতীয় বিয়ে সমাজ সহজে মেনে নিলেও নারীর দ্বিতীয় বিয়ে সমাজ ভালোভাবে মেনে নিতে চায় না। তাই বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে নারী যেন বেশি অগ্রাধিকার পান, সেভাবেই আইন করা উচিত।
দত্তক
মুসলিম পারিবারিক আইনে সন্তান দত্তক নেওয়ার বিধান নেই। কিন্তু দত্তক নেওয়ার বিধান চালু করা উচিত। দত্তক নেওয়া সন্তান কেন সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে? কোনো বাচ্চাকে দত্তক নিয়ে তার বড় হওয়া পর্যন্ত পরিবারের সন্তানের মতো যদি তাকে অধিকার না দেওয়া যায়, তবে আমরা কেমন মানুষ? অবশ্যই সম্পত্তিতে তার অধিকার রাখতে হবে। সন্তান জন্ম দেওয়াই কি সবকিছু? সন্তান জন্ম তো যেকোনো মানুষই দিতে পারে, তার অধিকার যদি দিতে না পারি, তবে আমরা কেমন মানুষ? কোনো একটি বাচ্চাকে দত্তক নিয়ে বড় করে তাকে যদি সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হয়, সেটা মানবাধিকার লঙ্ঘিত হবে বলে আমার মনে হয়। যদি কোনো নিঃসন্তান ব্যক্তি কোনো বাচ্চা দত্তক নিয়ে নিজের সন্তানের মতো বড় করতে থাকেন এবং এরই মধ্যে দ্বিতীয় বিয়ের পর বা যেকোনোভাবে নিজের সন্তান লাভ করেন, তখন কি দত্তক নেওয়া সন্তানকে ত্যাগ করবেন? আর আইনে তার জন্য কিছুই থাকবে না?
আল মাসঊদ খান
(ফেসবুক পেজ থেকে)
০২.
বাংলাদেশের প্রাচীন ও সংস্কারযোগ্য পারিবারিক আইনগুলোর হালনাগাদ করার সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত সাধুবাদ পাওয়ার দাবি রাখে। যে প্রস্তাবগুলো উঠে এসেছে, বেশ ভালো এবং তা সময়ের দাবি। বড় কথা হলো, বাস্তব প্রয়োগ কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থাকলে কোনো লাভ নেই। আমার প্রস্তাব মূলত মুসলিম আইনকে কেন্দ্র করে—
১. প্রস্তাবিত সংযোজন যেন যেকোনো ধর্মীয় অনুভূতি এবং ধর্মগ্রন্থের বিধিবিধানবিরোধী না হয়।
২. নিজ নিজ আলাদা বিধানের বাইরে সব ধর্মেরই সাধারণ কিছু বিষয়ের ওপর একই বিধান থাকা উচিত।
৩. দত্তক আইন থাকা যুক্তিসংগত। তবে শর্ত থাকে, তা শরিয়তে সমর্থনযোগ্য হতে হবে। যদি পোষ্য সন্তান মা-বাবার অনুগত বা সম্পদ পাওয়ার যোগ্য হয়, তবে উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে তার দাবি থাকতে পারে।
৪. ভরণপোষণ ও বিচ্ছেদ বেশ সূক্ষ্ম এবং স্পর্শকাতর বিষয়। উভয় ক্ষেত্রেই যুক্তির প্রয়োগ থাকা বাঞ্ছনীয়। বিচ্ছেদ করার যে ক্ষমতা একজন স্বামী উপভোগ করেন, সমান এ ক্ষমতা স্ত্রীকে দিতে হবে। স্বামী-স্ত্রী উভয়ের খেয়াল-খুশিমতো বিচ্ছেদ বন্ধে শক্ত বিধান সংযোজিত হলে ভালো। আর পরবর্তী সময়ে বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত আগের স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ পাবেন স্ত্রী—এ প্রস্তাবটি মানানসই। সে ক্ষেত্রে শুধু খেয়ালি কারণের ভিত্তিতে স্ত্রী যদি বিচ্ছেদ ঘটান, তবে দীর্ঘ দিন ভরণপোষণের যৌক্তিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। জীবিকানির্বাহী স্ত্রীর জন্যও একই কথা প্রযোজ্য।
৫. অভিভাবকত্ব মায়ের দিকে বেশি ঝোঁকা উচিত। তবে আদালতের ক্ষমতা থাকবে তা নির্ধারণ করার। অবশ্যই পর্যাপ্ত নিরীক্ষণ এবং যাচাই-বাছাই করতে হবে।
৬. এই আইনগুলো নির্দিষ্ট সময় পর পর হালনাগাদ করার বিধান থাকলে ভালো হয়। খায়রুল ইসলাম
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
০৩.
২৪ মার্চ, ২০১২ সালের আইন কমিশনের আয়োজনে পারিবারিক আইন সংস্কারের বিষয়ে জাতীয় কর্মশালার আয়োজকদের আমি একজন আইনের ছাত্র হিসেবে এবং দেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে সাধুবাদ জানাই। আইন বিষয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে প্রতিনিয়তই অনুভব করেছি—পারিবারিক আইনগুলোর সংস্কার কতটা প্রয়োজনীয়। দেরিতে হলেও এ রকম আয়োজনে আমি আশাবাদী, ওই বিষয়ে হয়তো নিকট ভবিষ্যতে পরিবর্তন আসবেই। তবে হিন্দু পারিবারিক আইনের ক্ষেত্রে আমার পরামর্শ হলো, সব সংস্কার একসঙ্গে তাড়াহুড়ার মধ্যে না করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে হিন্দু বিয়ে ও বিবাহবিচ্ছেদ রেজিস্ট্রেশন, স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে সুযোগ সৃষ্টি, কন্যাশিশু দত্তক নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি, পৈতৃক সম্পত্তিতে নারীর অধিকার নিশ্চিত আর জাতপ্রথা বিলোপ—এ কাজগুলো যত দ্রুত সম্ভব করা উচিত। আশা করি, সংশ্লিষ্ট সবাই এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেবে।
তাপস পাল
আইন ও বিচার বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
০৪.
নাবালকের অভিভাবকত্ব (গার্ডিয়ানশিপ) ও হেফাজতাধিকার (কাস্টডি বা হিজানত) কিন্তু এক নয়। অভিভাবকত্ব নাবালকের শরীর বা সম্পত্তি কিংবা উভয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়; কিন্তু হিজানতের বিষয়টি শুধু শরীরের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কোনো নাবালকের স্বাভাবিক বা ন্যাচারাল অভিভাবক হচ্ছেন বাবা, যিনি জীবিত থাকতে ও আইনগতভাবে অক্ষম না হলে অন্য কারও অভিভাবকত্ব লাভের সুযোগ বা প্রয়োজন ঘটে না। কিন্তু বাবা জীবিত ও সক্ষম থাকতেও নাবালকের হিজানত অন্য কারও কাছে দেওয়ার সুযোগ বা প্রয়োজন ঘটতে পারে। সাধারণত একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত নাবালকের স্বাভাবিক হিজানতাধিকারী হচ্ছেন তার মাতা; তবে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এর আগেও যেমন মা সে অধিকার হারাতে পারেন, তেমনি এর পরও তা ধরে রাখতে পারেন। তবে সেটি নির্ধারণ করবে পারিবারিক আদালত। কিন্তু স্বাভাবিক নিয়মে এক দিনের জন্যও কোনো মা তাঁর সন্তানের অভিভাবক নন; বাবার অবর্তমানে বা অক্ষমতায় এবং তাঁর কর্তৃক নিযুক্ত অন্য কোনো অভিভাবক না থাকলেই কেবল তিনি আদালতে গিয়ে অভিভাবকত্বের আগ্রহ ব্যক্ত করতে পারেন। নাবালকের মা বা অন্য কোনো আত্মীয় অভিভাবকত্ব বা হিজানত, যে দাবিই আদালতের কাছে করে থাকুন না কেন, যাঁর দ্বারা নাবালকের সর্বাধিক স্বার্থ ও মঙ্গল রক্ষিত হবে বলে আদালত মনে করেন, তাঁকেই অভিভাবক বা জিম্মাদার করা হবে। আদালত কর্তৃক ‘ওয়েলফেয়ার ডকট্রিন’ হিসেবে চর্চিত এ নীতিটি আরও সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য নতুন বিধিবদ্ধ আইনের প্রয়োজন আছে বলে ওই কর্মশালায় যে বক্তব্য প্রকাশিত হয় তা অপ্রয়োজনীয়। কারণ, ১৮৯০ সালের ‘দ্য গার্ডিয়ানস অ্যান্ড ওয়ার্ডস অ্যাক্ট’ নামক যে আইন দ্বারা অভিভাবকত্ব বা হিজানতের বিষয়গুলো চালিত হয়, তাতেই (ধারা ১৭) ওই নীতির কথা বলা আছে।
স্বাভাবিক নিয়মে মা এক দিনের জন্যও সন্তানের অভিভাবকত্ব পাচ্ছেন না বিধায় স্বাভাবিক অভিভাবক থাকার ক্ষেত্রে তাঁর ক্ষমতাও বাবার মতোই সমান করার যে প্রস্তাব কর্মশালায় গৃহীত হয়, তা-ও বাস্তবায়ন করতে গেলে জটিলতা আরও বেড়ে যাবে। কারণ, তার জন্য বিধিবদ্ধ আইনের সাহায্য নিতে হবে এবং তা হবে ব্যক্তিগত আইনের (ধর্মীয় বিধান) সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তা ছাড়া, একটি বিষয় উপলব্ধি করারও প্রয়োজন রয়েছে যে মুসলিম পারিবারিক আইনে কতিপয় ক্ষেত্রে পুরুষকে যে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে সেটিকে বৈষম্যমূলক হিসেবে দেখা বোকামি। এটা তো মানতেই হবে যে প্রতিটি ‘অধিকার’র বিপরীতে ‘দায়িত্ব’ জড়িত থাকবে; যার অধিকার বেশি তার দায়িত্বও বেশি। এবং এর অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে মুসলিম পারিবারিক আইনেও। মুসলিম আইনে মাকে না দিয়ে বাবাকে যেমন স্বাভাবিক অভিভাবকত্বের অধিকার দেওয়া হয়েছে, তেমনি ওই সন্তানের যাবতীয় চাহিদা মেটানোর দায়িত্বও কিন্তু মায়ের নয়, বাবার ।
সোহেল রানা
সিনিয়র সহকারী জজ, গাইবান্ধা।
বিবাহবিচ্ছেদ আইন
মুসলিম আইনে বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে পুরুষের একচ্ছত্র অধিকার রয়েছে, যা পরিবর্তনের সময় এসেছে। বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীদের বেশি অধিকার দিয়ে নতুন আইন করা উচিত। কারণ, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বিবাহবিচ্ছেদের কারণে পুরুষের চেয়ে নারী বেশি নিগ্রহের শিকার হন। আমাদের সমাজব্যবস্থা, মানসিকতা এর মূল কারণ। তালাকপ্রাপ্ত নারীকে আমাদের সমাজ বাঁকা চোখে দেখে। পুরুষের দ্বিতীয় বিয়ে সমাজ সহজে মেনে নিলেও নারীর দ্বিতীয় বিয়ে সমাজ ভালোভাবে মেনে নিতে চায় না। তাই বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে নারী যেন বেশি অগ্রাধিকার পান, সেভাবেই আইন করা উচিত।
দত্তক
মুসলিম পারিবারিক আইনে সন্তান দত্তক নেওয়ার বিধান নেই। কিন্তু দত্তক নেওয়ার বিধান চালু করা উচিত। দত্তক নেওয়া সন্তান কেন সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে? কোনো বাচ্চাকে দত্তক নিয়ে তার বড় হওয়া পর্যন্ত পরিবারের সন্তানের মতো যদি তাকে অধিকার না দেওয়া যায়, তবে আমরা কেমন মানুষ? অবশ্যই সম্পত্তিতে তার অধিকার রাখতে হবে। সন্তান জন্ম দেওয়াই কি সবকিছু? সন্তান জন্ম তো যেকোনো মানুষই দিতে পারে, তার অধিকার যদি দিতে না পারি, তবে আমরা কেমন মানুষ? কোনো একটি বাচ্চাকে দত্তক নিয়ে বড় করে তাকে যদি সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হয়, সেটা মানবাধিকার লঙ্ঘিত হবে বলে আমার মনে হয়। যদি কোনো নিঃসন্তান ব্যক্তি কোনো বাচ্চা দত্তক নিয়ে নিজের সন্তানের মতো বড় করতে থাকেন এবং এরই মধ্যে দ্বিতীয় বিয়ের পর বা যেকোনোভাবে নিজের সন্তান লাভ করেন, তখন কি দত্তক নেওয়া সন্তানকে ত্যাগ করবেন? আর আইনে তার জন্য কিছুই থাকবে না?
আল মাসঊদ খান
(ফেসবুক পেজ থেকে)
০২.
বাংলাদেশের প্রাচীন ও সংস্কারযোগ্য পারিবারিক আইনগুলোর হালনাগাদ করার সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত সাধুবাদ পাওয়ার দাবি রাখে। যে প্রস্তাবগুলো উঠে এসেছে, বেশ ভালো এবং তা সময়ের দাবি। বড় কথা হলো, বাস্তব প্রয়োগ কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থাকলে কোনো লাভ নেই। আমার প্রস্তাব মূলত মুসলিম আইনকে কেন্দ্র করে—
১. প্রস্তাবিত সংযোজন যেন যেকোনো ধর্মীয় অনুভূতি এবং ধর্মগ্রন্থের বিধিবিধানবিরোধী না হয়।
২. নিজ নিজ আলাদা বিধানের বাইরে সব ধর্মেরই সাধারণ কিছু বিষয়ের ওপর একই বিধান থাকা উচিত।
৩. দত্তক আইন থাকা যুক্তিসংগত। তবে শর্ত থাকে, তা শরিয়তে সমর্থনযোগ্য হতে হবে। যদি পোষ্য সন্তান মা-বাবার অনুগত বা সম্পদ পাওয়ার যোগ্য হয়, তবে উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে তার দাবি থাকতে পারে।
৪. ভরণপোষণ ও বিচ্ছেদ বেশ সূক্ষ্ম এবং স্পর্শকাতর বিষয়। উভয় ক্ষেত্রেই যুক্তির প্রয়োগ থাকা বাঞ্ছনীয়। বিচ্ছেদ করার যে ক্ষমতা একজন স্বামী উপভোগ করেন, সমান এ ক্ষমতা স্ত্রীকে দিতে হবে। স্বামী-স্ত্রী উভয়ের খেয়াল-খুশিমতো বিচ্ছেদ বন্ধে শক্ত বিধান সংযোজিত হলে ভালো। আর পরবর্তী সময়ে বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত আগের স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ পাবেন স্ত্রী—এ প্রস্তাবটি মানানসই। সে ক্ষেত্রে শুধু খেয়ালি কারণের ভিত্তিতে স্ত্রী যদি বিচ্ছেদ ঘটান, তবে দীর্ঘ দিন ভরণপোষণের যৌক্তিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। জীবিকানির্বাহী স্ত্রীর জন্যও একই কথা প্রযোজ্য।
৫. অভিভাবকত্ব মায়ের দিকে বেশি ঝোঁকা উচিত। তবে আদালতের ক্ষমতা থাকবে তা নির্ধারণ করার। অবশ্যই পর্যাপ্ত নিরীক্ষণ এবং যাচাই-বাছাই করতে হবে।
৬. এই আইনগুলো নির্দিষ্ট সময় পর পর হালনাগাদ করার বিধান থাকলে ভালো হয়। খায়রুল ইসলাম
শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
০৩.
২৪ মার্চ, ২০১২ সালের আইন কমিশনের আয়োজনে পারিবারিক আইন সংস্কারের বিষয়ে জাতীয় কর্মশালার আয়োজকদের আমি একজন আইনের ছাত্র হিসেবে এবং দেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে সাধুবাদ জানাই। আইন বিষয়ে পড়াশোনা করতে গিয়ে প্রতিনিয়তই অনুভব করেছি—পারিবারিক আইনগুলোর সংস্কার কতটা প্রয়োজনীয়। দেরিতে হলেও এ রকম আয়োজনে আমি আশাবাদী, ওই বিষয়ে হয়তো নিকট ভবিষ্যতে পরিবর্তন আসবেই। তবে হিন্দু পারিবারিক আইনের ক্ষেত্রে আমার পরামর্শ হলো, সব সংস্কার একসঙ্গে তাড়াহুড়ার মধ্যে না করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে হিন্দু বিয়ে ও বিবাহবিচ্ছেদ রেজিস্ট্রেশন, স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে সুযোগ সৃষ্টি, কন্যাশিশু দত্তক নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি, পৈতৃক সম্পত্তিতে নারীর অধিকার নিশ্চিত আর জাতপ্রথা বিলোপ—এ কাজগুলো যত দ্রুত সম্ভব করা উচিত। আশা করি, সংশ্লিষ্ট সবাই এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেবে।
তাপস পাল
আইন ও বিচার বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
০৪.
নাবালকের অভিভাবকত্ব (গার্ডিয়ানশিপ) ও হেফাজতাধিকার (কাস্টডি বা হিজানত) কিন্তু এক নয়। অভিভাবকত্ব নাবালকের শরীর বা সম্পত্তি কিংবা উভয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়; কিন্তু হিজানতের বিষয়টি শুধু শরীরের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কোনো নাবালকের স্বাভাবিক বা ন্যাচারাল অভিভাবক হচ্ছেন বাবা, যিনি জীবিত থাকতে ও আইনগতভাবে অক্ষম না হলে অন্য কারও অভিভাবকত্ব লাভের সুযোগ বা প্রয়োজন ঘটে না। কিন্তু বাবা জীবিত ও সক্ষম থাকতেও নাবালকের হিজানত অন্য কারও কাছে দেওয়ার সুযোগ বা প্রয়োজন ঘটতে পারে। সাধারণত একটি নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত নাবালকের স্বাভাবিক হিজানতাধিকারী হচ্ছেন তার মাতা; তবে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এর আগেও যেমন মা সে অধিকার হারাতে পারেন, তেমনি এর পরও তা ধরে রাখতে পারেন। তবে সেটি নির্ধারণ করবে পারিবারিক আদালত। কিন্তু স্বাভাবিক নিয়মে এক দিনের জন্যও কোনো মা তাঁর সন্তানের অভিভাবক নন; বাবার অবর্তমানে বা অক্ষমতায় এবং তাঁর কর্তৃক নিযুক্ত অন্য কোনো অভিভাবক না থাকলেই কেবল তিনি আদালতে গিয়ে অভিভাবকত্বের আগ্রহ ব্যক্ত করতে পারেন। নাবালকের মা বা অন্য কোনো আত্মীয় অভিভাবকত্ব বা হিজানত, যে দাবিই আদালতের কাছে করে থাকুন না কেন, যাঁর দ্বারা নাবালকের সর্বাধিক স্বার্থ ও মঙ্গল রক্ষিত হবে বলে আদালত মনে করেন, তাঁকেই অভিভাবক বা জিম্মাদার করা হবে। আদালত কর্তৃক ‘ওয়েলফেয়ার ডকট্রিন’ হিসেবে চর্চিত এ নীতিটি আরও সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য নতুন বিধিবদ্ধ আইনের প্রয়োজন আছে বলে ওই কর্মশালায় যে বক্তব্য প্রকাশিত হয় তা অপ্রয়োজনীয়। কারণ, ১৮৯০ সালের ‘দ্য গার্ডিয়ানস অ্যান্ড ওয়ার্ডস অ্যাক্ট’ নামক যে আইন দ্বারা অভিভাবকত্ব বা হিজানতের বিষয়গুলো চালিত হয়, তাতেই (ধারা ১৭) ওই নীতির কথা বলা আছে।
স্বাভাবিক নিয়মে মা এক দিনের জন্যও সন্তানের অভিভাবকত্ব পাচ্ছেন না বিধায় স্বাভাবিক অভিভাবক থাকার ক্ষেত্রে তাঁর ক্ষমতাও বাবার মতোই সমান করার যে প্রস্তাব কর্মশালায় গৃহীত হয়, তা-ও বাস্তবায়ন করতে গেলে জটিলতা আরও বেড়ে যাবে। কারণ, তার জন্য বিধিবদ্ধ আইনের সাহায্য নিতে হবে এবং তা হবে ব্যক্তিগত আইনের (ধর্মীয় বিধান) সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তা ছাড়া, একটি বিষয় উপলব্ধি করারও প্রয়োজন রয়েছে যে মুসলিম পারিবারিক আইনে কতিপয় ক্ষেত্রে পুরুষকে যে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে সেটিকে বৈষম্যমূলক হিসেবে দেখা বোকামি। এটা তো মানতেই হবে যে প্রতিটি ‘অধিকার’র বিপরীতে ‘দায়িত্ব’ জড়িত থাকবে; যার অধিকার বেশি তার দায়িত্বও বেশি। এবং এর অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে মুসলিম পারিবারিক আইনেও। মুসলিম আইনে মাকে না দিয়ে বাবাকে যেমন স্বাভাবিক অভিভাবকত্বের অধিকার দেওয়া হয়েছে, তেমনি ওই সন্তানের যাবতীয় চাহিদা মেটানোর দায়িত্বও কিন্তু মায়ের নয়, বাবার ।
সোহেল রানা
সিনিয়র সহকারী জজ, গাইবান্ধা।
No comments