আমার ভাষা আমার একুশ-বাংলা উচ্চারণ: সমস্যা ও সাম্প্রতিক প্রবণতা by সৌরভ সিকদার

ভাষাবিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা গেছে, ভাষা আট কিলোমিটার পরপর বদলায়। সাধারণত ভাষার এই বদল মুখের ভাষায় হয়। বিশেষ করে উচ্চারণে। তাই একই বাংলা ভাষাভাষী মানুষ হয়েও রাজশাহী অঞ্চলের মানুষ ‘শ’ ধ্বনি উচ্চারণ করতে না পেরে ‘ছ’ বলে, ময়মনসিংহে ‘দোষ’কে ‘দুষ’ বলে।


নোয়াখালী অঞ্চলের মানুষ ‘প’ উচ্চারণ করতে পারে না, তারা ‘পানি’কে ‘ফানি’/‘হানি’ বলে। পৃথিবীর প্রত্যেক ভাষায় এই উচ্চারণ-পার্থক্য থাকে। বাংলা ভাষাতেও আছে। কিন্তু সবার ব্যবহারের জন্য একটি মানভাষা বা মান-উচ্চারণ থাকে। ব্রিটিশশাসিত ভারতে বাংলা ভাষার এই মান উচ্চারণ গ্রহণ করা হয়েছিল মূলত কলকাতার পার্শ্ববর্তী কৃষ্ণনগর-নবদ্বীপের উপভাষা থেকে। এ সম্পর্কে ধ্বনিবিজ্ঞানী মুহম্মদ আবদুল হাই বলেছেন, ‘তার কারণ এ উচ্চারণ সুস্পষ্ট, ধ্বনির পরিবর্তনশীলতা এর অগ্রগতির পরিচায়ক এবং ব্যঞ্জনা আজ পর্যন্ত মধুর শ্রুতিব্যঞ্জক।’ দেশ ভাগের পর এবং আরও পরে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীন মানচিত্র তৈরি হওয়ায় বাংলা ভাষার রাজধানী কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয় অলক্ষ্যেই। ঢাকাকেন্দ্রিক শিক্ষিত সচেতন মানুষের মুখের ভাষা ক্রমে ক্রমে মান ভাষার মর্যাদা লাভ করে। কলকাতার কথ্য বাংলায় উচ্চারণজনিত যে সমস্যা তৈরি হয়েছিল তা নিয়ে কবিতা আছে:
ভাষা মারলে তিন সেনেপার্টিসেনে ক্যাল- কেসেনে ডায়োসেশেনে।
পার্টিসেনে হচ্ছে দেশভাগ, ক্যালকেসেনে হচ্ছে কলকাতাইদের প্রভাব এবং ডায়াসেশন হচ্ছে ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়গুলোর প্রভাব।
বাংলাদেশেও বাংলা উচ্চারণে এক ‘খিচুড়ি’ অবস্থা বলা যায়। মান বাংলার প্রয়োগ সীমিত হয়ে পড়েছে ক্রমেই। এমনকি উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও বাংলা উচ্চারণে আঞ্চলিক প্রভাব এবং সাম্প্রতিক সময়ে তড়িত্ গণমাধ্যমের প্রভাবে নবসৃষ্ট নাগরিক কথ্য বাংলা প্রয়োগের প্রবণতা বাড়ছে।
১৮৮৫ সালে বাঙালিদের মধ্যে প্রথম রবীন্দ্রনাথ বাংলা উচ্চারণ সমস্যা উপলব্ধি করে ‘বাংলা উচ্চারণ’ শিরোনামে প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। তিনি ইংল্যান্ডে থাকাকালে একজন ইংরেজকে বাংলা শেখাতে গিয়ে বাংলা ভাষার লিখিত রূপ এবং উচ্চারণের মধ্যে যে পার্থক্য তা টের পান ‘দেখা’ এবং ‘দেখি’ শব্দের এ-কারের উচ্চারণ-পার্থক্য রয়েছে। ‘হরি’ শব্দের ‘হ’ এবং ‘হর’ শব্দে ‘হ’-এ অনেক পার্থক্য। অর্থাত্ বাংলা ভাষার একটা ধ্বনি ভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন উচ্চারিত হয়। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—‘বাংলা ভাষার এরূপ উচ্চারণের বিশৃঙ্খলা যখন নজরে পড়িল তখন আমার জানিতে কৌতূহল হইল, এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে একটা নিয়ম আছে কি না’? শেষ পর্যন্ত তিনি বেশ কিছু নিয়ম তুলে ধরেন। রবীন্দ্রনাথের উচ্চারণ-ভাবনা ও সূত্র সন্ধানের একশ বছর পর ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয় (পা-লিপি প্রস্তুত ১৯৮৫ সালে) ১৬ হাজার শব্দের প্রথম বাংলা উচ্চারণ অভিধান ‘ব্যবহারিক বাংলা উচ্চারণ অভিধান’ (সম্পাদনা—আনিসুজ্জামান, ওয়াহিদুল হক, জামিল চৌধুরী এবং নরেন বিশ্বাস)। এর আগে রচিত হয়েছিল ‘বাংলা উচ্চারণ কোষ’ (১৩৬১), ‘বাংলা উচ্চারণ অভিধান’ (১৩৭৫) প্রভৃতি সীমিত আয়তনের গ্রন্থ। ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নরেন বিশ্বাসের সম্পাদনায় বাংলা একাডেমী প্রকাশ করে ত্রিশ হাজার শব্দের ‘বাংলা একাডেমী বাংলা উচ্চারণ অভিধান’। এই গ্রন্থ পূরণ করে বাংলা ভাষাভাষীদের দীর্ঘদিনের এক প্রত্যাশা।
ভাষা হচ্ছে বহতা নদীর মতো। ক্রমাগত এগিয়ে চলে আর বদলায়। এই একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে বদলে যাওয়া ভাষার মান উচ্চারণ নির্ধারণ এবং তারই ভিত্তিতে এর ভাষাবৈজ্ঞানিক উচ্চারণ অভিধান তৈরি করবে কে? বিশেষ করে উচ্চারণ নির্দেশের জন্য আন্তর্জাতিক ধ্বনিমূলক বর্ণমালা (আইপিএ), ভাষা শিক্ষণের আধুনিক নিয়মাবলি এবং নতুন করে বাংলা উচ্চারণসূত্রসহ পূর্ণাঙ্গ উচ্চারণ অভিধান সংকলন করা প্রয়োজন।
বাংলা উচ্চারণ প্রসঙ্গে ভাষাবিজ্ঞানী মুহম্মদ দানীউল হক আমাদের জানান, ‘উচ্চারণ সৌকর্যের কযেকটি দিক আছে। প্রথমটি অবশ্য বিধিদত্ত। জন্ম থেকেই মানুষের উচ্চারণ উত্কর্ষ কিছুটা হলেও থাকে। বাগযন্ত্রের নিখুঁত গঠনও একটি কারণ। কিন্তু শৈশব-কৈশোর-বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত উচ্চারণের ক্ষেত্রে প্রভাব থাকে। এ সময়ের মধ্যে যথাযথ আনুকূল্য পেলে এবং ভাষা ব্যবহারকারী সচেতন হলে উচ্চারণ সৌকর্য ঘটতে পারে। শিশু যে পরিবেশ-প্রতিবেশে অর্থাত্ ঘরে যাদের সঙ্গ পেয়ে বেড়ে ওঠে তাদের বাচন ও উচ্চারণ দ্বারা সরাসরি সে প্রভাবিত হয়। আবার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রচলিত ভাষা এবং উচ্চারণ শিশু শ্রোতা-বক্তা হিসেবে সরাসরি গ্রহণ করে। তার শিক্ষক এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। ছড়া-কবিতা-গান-আবৃত্তি প্রভৃতি উচ্চারণের বিষয়ে এক বড় ফ্যাক্টর। আর আধুনিক যুগে উচ্চারণের ক্ষেত্রে অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে গণমাধ্যম’।
নানা কারণে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের ভাষার মধ্যে ক্রমশ পার্থক্য বাড়ছে। এই পার্থক্য মুখের ভাষায়ও কম নয়। আমাদের জুতা-মোজা, ধূলা, বিকাল, সুবিধা, পূজা প্রভৃতি ওখানে জুতো-মুজো, ধূলো, বিকেল, সুবিধে, পুজো হয়ে গেছে (বাংলাদেশে আ-কার প্রবণতা, পশ্চিমবঙ্গে একার ও ও-কার প্রবণতা)। আর এলুম, খেলুম, এসেচি, গেচি উচ্চারণের ক্রিয়াপদ ওখানে হর-হামেশাই প্রয়োগ হচ্ছে। ঢাকায় একসময় প্রয়াত ওয়াহিদুল হকের নেতৃত্বে শুদ্ধ উচ্চারণের চর্চা ও আন্দোলন শুরু হয়েছিল। এখন আবৃত্তি সংগঠনগুলো সেই চর্চা কিছুটা হলেও ধরে রেখেছে। কিন্তু যে সমস্যার সূচনা গোড়াতে সেখানে সমাধান না করে মান বাংলার উচ্চারণ শুধু নতুন নতুন অভিধান তৈরি করে ঠিক করা যাবে না। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শুধু পুঁথিগত বাংলা ভাষা বা ব্যাকরণ না পড়িয়ে, শুদ্ধ উচ্চারণের ব্যবহারিক ক্লাস করানোটা জরুরি। না হলে ভবিষ্যতের বাংলাভাষী নাগরিকদের মধ্যে শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলতে পারে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। মনে রাখতে হবে বিশ্বায়ন এবং তড়িত্-গণমাধ্যমের কারণে যে ইংরেজি তার উচ্চারণ ভঙ্গি নিয়ে শিক্ষিত পরিবারের বৈঠকখানায় ঢুকে গেছে তা শোবার ঘরে ঢুকতে বেশি দিন লাগবে না ।
সৌরভ সিকদার: অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.