অধিক ফসলে চাষিদের বিপদ by এ এম এম শওকত আলী
কৃষিতে সরকার ঘোষিত নীতি হলো, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। এ জন্য সরকার অধিক ফসল উৎপাদন সহায়কনীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এ প্রসঙ্গে একাধিক পদক্ষেপ উল্লেখযোগ্য। এক. সহজলভ্য মূল্যে কৃষি উপকরণ কৃষকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। দুই. বোরো ফসলের অধিক চাষের জন্য সেচসুবিধার সম্প্রসারণ।
তিন. কৃষি উপকরণে ভর্তুকি প্রদান, যা প্রথমোক্ত বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এসবের মিলিত প্রভাবে কৃষকদের উৎপাদন খরচ হ্রাস পায়। এর ফলে তাঁরা ফসল উৎপাদনে লাভবান হয়। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বাস্তবে কৃষকের খুব বেশি লাভ হয় না। বর্তমান বছরে বোরো চাষিদের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয়েছে। একটি প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী কৃষি উপকরণে অধিকতর ভর্তুকি প্রদান সত্ত্বেও এ বছর বোরো চাষে উৎপাদন খরচ বেড়েছে ২০ শতাংশ। ধানের দাম মণপ্রতি কমেছে ১০০ থেকে ২০০ টাকা। পক্ষান্তরে সব ধরনের চালের দাম কমেছে। প্রতিকেজি মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ২৮ থেকে ৩২ টাকা। এতে কৃষকের ক্ষতি হলেও ভোক্তারা হয়তো তুষ্ট। সরকারও হয়তো খুশি।
উল্লেখ্য, কৃষকদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য প্রদানের বিষয়ে সব সরকারের নীতি অনেকটা পরস্পরবিরোধী। সরকারের মূল নীতি অধিক ফসল উৎপাদনে কৃষকদের জন্য সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি। অন্যদিকে খাদ্যশস্যের, বিশেষ করে চালের দাম বাড়লেই সরকার উদ্বিগ্ন হয়। এ কারণে সরকার গুদামজাত করা শস্য সহজলভ্য মূল্যে বাজারে বিক্রি করে এবং বিনা মূল্যে ও বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে দিয়ে থাকে। এর ফলে খোলাবাজারের মূল্য কতটুকু কমে তা নিয়েও গবেষকদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। এক মত অনুযায়ী এ ধরনের কার্যক্রম খোলাবাজারের মূল্যে কোনো ইতিবাচক প্রভাব থাকে না। ভিন্নমত হলো, কিছু ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে, তবে তা নিতান্তই সামান্য।
কৃষকদের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার প্রতিবছর খাদ্যশস্য (চাল ও গম) নির্ধারিত মূল্যে ক্রয় করে। এ অভিযানের প্রত্যাশা হলো, কৃষকদের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা। এ বিষয়টিও অনিশ্চিত। প্রতিবছর এর ফলে কৃষকরা লাভের মুখ দেখতে পান না। মূল কারণ, সরকার সরাসরি কৃষকদের থেকে ধান ক্রয় করে না। কৃষকদের ধান ক্রয় করে চালকল মালিকরা। তাও আবার সরাসরি নয়। বিদ্যমান বাজার কাঠামোর ফড়িয়া ও ব্যাপারীদের কাছ থেকেই চালকল মালিকরা ধান ক্রয় করেন। পরে চালকল মালিকদের কাছ থেকে খাদ্য বিভাগ চাল ক্রয় করে। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সরকার নির্ধারিত মূল্যে চালকল মালিকরা চাল বিক্রিতে আগ্রহী নয়। কারণ তাঁদের মতে, সরকারি ক্রয়মূল্য চালকল মালিকদের জন্য লাভজনক নয়। অন্যদিকে সরকারি গুদামে অধিক পরিমাণ খাদ্যশস্য মজুদের কারণেও সরকারের ইচ্ছা থাকলেও ধান-চাল যথাসময়ে সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়। এমনই ঘটনা ঘটেছে বর্তমান বছরে।
সরকারিসূত্রে জনগণকে জানানো হয়েছে যে অধিক মজুদের কারণে এ বছর অভিযান পিছিয়ে দেওয়া হবে। অর্থাৎ মৌসুমের শুরুতেই সরকার ক্রয় অভিযান শুরু করবে না। সরকারিসূত্রে আরো জানানো হয়েছে যে বিকল্প হিসেবে সরকার চাল আমদানি বন্ধ রাখবে। সম্পূর্ণ বিষয়টিই গুদামজাত খাদ্যশস্যের মজুদ পরিস্থিতির নিবিড় পরিবীক্ষণসংক্রান্ত। এটা হয়নি। সরকার ইতিমধ্যে বোরো চাল সংগ্রহ করার লক্ষ্যে মূল্য নির্ধারণ করেছে কেজিপ্রতি ২৮ টাকা। সব ধরনের চাল ২৮ টাকায় সংগ্রহ করা যাবে না। ফলে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্থাৎ ১০ লাখ টন চাল সংগ্রহ করার বিষয়টি অনেকটা অনিশ্চিত। তবে ভবিষ্যতেই জানা যাবে সঠিক অবস্থা। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অনিশ্চয়তার মূল হুমকি চালকল মালিকদের আচরণ। অতীতে অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, তাঁদের সরবরাহ করার তেমন উৎসাহ দেখা যায়নি। তাঁদের অভিযোগ, নির্ধারিত মূল্যে চাল সরবরাহ করা সম্ভব নয়।
এর জন্য প্রায় প্রতিবছর খাদ্য অধিদপ্তর নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। অধিক মূল্যে বিদেশ থেকে চাল আমদানি করতে সরকার বাধ্য হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে খাদ্য খাতে ভর্তুকিও দিতে হয়েছে প্রচুর। কোনো কোনো বছর সরকার নিজেই সংগ্রহ অভিযান করেনি। চাল ও গম আমদানি সরকার যে কেবল বাজারমূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্যই করে তা নয়। প্রকৃতপক্ষে এর মাধ্যমে বাজারমূল্য সম্পূর্ণ স্থিতিশীল হয় না। তাহলে সরকারি পর্যায়ে খাদ্যশস্য সংগ্রহ অভিযান কেন? এর মুখ্য উদ্দেশ্য রাজনৈতিক। এ ধরনের অভিযানের মাধ্যমে রাজনৈতিক দর্শন প্রতিফলিত হয়। বিগত দশক ধরে এ দর্শনের সঙ্গে অন্য একটি বিষয় যুক্ত হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, সরকারি গুদামে মজুদ খাদ্যশস্যের প্রায় ৭৪ শতাংশ (এখন বেশি হবে)। খাদ্যভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর জন্য বিচরণ করতে হয়। এ ছাড়া এ মজুদকে আপৎকালীন মজুদ (Buffer Stock) বলা হয়। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে কোনো কারণে গুদামে প্রয়োজনীয় মজুদ না থাকার জন্য যথাসময়ে আমদানি করা সম্ভব হয় না। এর ফলে বাজারে সংকট সৃষ্টি হয়। বাজারমূল্যও বেড়ে যায়, যা সরকারের জন্য বিব্রতকর। নিম্ন আয়ের জনমানুষের ভোগান্তিও হয়। চরম অবস্থা হলে, হয় রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা।
জানা যায়, সরকারি গুদামে বর্তমানে ১০ লাখ ৫০ হাজার টন চাল ও দুই লাখ টন গম মজুদ আছে। সংগ্রহ অভিযান সর্বমোট ৬৪ জেলায় কখনো সফলভাবে হয় না। কারণ অনেক জেলায় জেলাভিত্তিক চাহিদার তুলনায় কম চাল উৎপাদিত হয়। অর্থাৎ এসব জেলায় খাদ্য ঘাটতি রয়েছে। উৎপাদনের দৃষ্টিকোণে খাদ্য অধিদপ্তরের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী দেশের সর্বমোট ২৫টি জেলা থেকে চাল সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে রাজশাহী ও বর্তমানে রংপুর বিভাগের মোট ১৬টি জেলা, খুলনার কুষ্টিয়া ও যশোর, বরিশাল বিভাগে সংগ্রহ অভিযান অতীতে সফল হয়নি; চট্টগ্রামে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লা; সিলেটে অতি নগণ্য এবং ঢাকার ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, জামালপুর, শেরপুর ও কিশোরগঞ্জে সংগ্রহ হয়।
সরকারি গুদামের ধারণক্ষমতা ১৪ লাখ টন। এখন হয়তো অল্প কিছু নতুন গুদামের জন্য ১৫ লাখ টন হতে পারে। কিন্তু এ নিয়েও প্রশ্ন আছে। গুদামে এক বস্তার ওপরে আরেক বস্তা রাখা হয়। এতে ৫০ থেকে ১০০ বস্তা গুদামভেদে রাখা যায়। ২৫টি জেলায় বর্তমানে দুই থেকে আড়াই লাখ টন রাখা যাবে। গুদামের বেশির ভাগই রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে। এ অঞ্চলে মোট ধারণক্ষমতা আট লাখ টন। গম আমদানির চূড়ান্ত এলসি প্রায় দেড় লাখ টন। সব মিলিয়ে ১০ লাখ টন সংগ্রহ সম্ভব হলেও রাখার জায়গার অভাব হওয়ার আশঙ্কাই অধিকতর।
বিকল্প পদক্ষেপ কী হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, চাল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পদক্ষেপ। এর সঙ্গে অন্য একটি পন্থা রয়েছে। তা হলো, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর চাল দ্রুত বিতরণ করা, যে বিষয়টিও বর্তমানে হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ বর্ষা আসন্ন। বর্ষাকালে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি সংগত কারণেই বাস্তবায়িত হয় না। এ ছাড়া মাঠ পর্যায়ে এসব কর্মসূচি উপজেলা পর্যায়ে ত্রিমুখী দ্বন্দ্বের কারণে অতিমন্থর। চালের দাম বাজারে কিছুটা নিম্নগতির। চালকল মালিকদের কাছেও চাল মজুদ রয়েছে। চালের দাম কমলে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিতে অনেকেই অংশগ্রহণ করবেন না। জোর করে গুদামে জায়গা করার জন্য এসব কর্মসূচিতে খাদ্যের ব্যবহারে বাজারে চালের দাম আরো কমে যাবে। কৃষকদের বিপদ হবে।
প্রয়োজন সার্বিক বিষয়টি নিবিড়ভাবে পরিবীক্ষণ করা এবং দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এ কাজটি সঠিকভাবে ও সময়মতো করলে আশঙ্কার কারণ ছিল না। যথাসময়ে কাজটি করা হয়নি। হলে এসব প্রশ্ন মিডিয়ায় উত্থাপিত হতো না। জানা যায়, এ বছরের কোনো একসময় সুগন্ধি চাল রপ্তানির ওপর সরকার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। এখন এ সিদ্ধান্ত বহাল থাকলে তা অবিলম্বে রদ করা প্রয়োজন। এ বছর হয়তো বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করবে। পত্রিকান্তরে বলা হয়েছে, এ বছর বোরোর মোট উৎপাদন হবে এক কোটি ৮৭ লাখ টন। এটা প্রাথমিক অনুমান। পরিসংখ্যান ব্যুরোর চূড়ান্ত হিসাব পাওয়ার পরই এটা সঠিকভাবে বলা যাবে, যদিও প্রতিবছর এ নিয়ে সরকারের অভ্যন্তরেও মতবিরোধ হয়। এ বছরও যে হবে না, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। উৎপাদনের চূড়ান্ত পরিমাণ যাই হোক না কেন, মূল লক্ষ্য হবে কৃষকদের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা। সম্পদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কৃষি খাতে যথেষ্ট ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু উৎপাদন ব্যয় কমানো সম্ভব হয়নি। এখন শোনা যাচ্ছে, আগামী বাজেটে ভর্তুকি যৌক্তিককরণ করা হবে। কৃষি খাতের কী হবে তা এখনো নিশ্চিত নয়। যদি কমানো হয়, তাহলেই আশঙ্কার কথা। একই সঙ্গে যোগ্য কৃষকরা যাতে ভর্তুকি পান সে বিষয়টিও দেখা প্রয়োজন।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও কলামিস্ট
উল্লেখ্য, কৃষকদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মূল্য প্রদানের বিষয়ে সব সরকারের নীতি অনেকটা পরস্পরবিরোধী। সরকারের মূল নীতি অধিক ফসল উৎপাদনে কৃষকদের জন্য সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি। অন্যদিকে খাদ্যশস্যের, বিশেষ করে চালের দাম বাড়লেই সরকার উদ্বিগ্ন হয়। এ কারণে সরকার গুদামজাত করা শস্য সহজলভ্য মূল্যে বাজারে বিক্রি করে এবং বিনা মূল্যে ও বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে দিয়ে থাকে। এর ফলে খোলাবাজারের মূল্য কতটুকু কমে তা নিয়েও গবেষকদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। এক মত অনুযায়ী এ ধরনের কার্যক্রম খোলাবাজারের মূল্যে কোনো ইতিবাচক প্রভাব থাকে না। ভিন্নমত হলো, কিছু ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে, তবে তা নিতান্তই সামান্য।
কৃষকদের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার প্রতিবছর খাদ্যশস্য (চাল ও গম) নির্ধারিত মূল্যে ক্রয় করে। এ অভিযানের প্রত্যাশা হলো, কৃষকদের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা। এ বিষয়টিও অনিশ্চিত। প্রতিবছর এর ফলে কৃষকরা লাভের মুখ দেখতে পান না। মূল কারণ, সরকার সরাসরি কৃষকদের থেকে ধান ক্রয় করে না। কৃষকদের ধান ক্রয় করে চালকল মালিকরা। তাও আবার সরাসরি নয়। বিদ্যমান বাজার কাঠামোর ফড়িয়া ও ব্যাপারীদের কাছ থেকেই চালকল মালিকরা ধান ক্রয় করেন। পরে চালকল মালিকদের কাছ থেকে খাদ্য বিভাগ চাল ক্রয় করে। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সরকার নির্ধারিত মূল্যে চালকল মালিকরা চাল বিক্রিতে আগ্রহী নয়। কারণ তাঁদের মতে, সরকারি ক্রয়মূল্য চালকল মালিকদের জন্য লাভজনক নয়। অন্যদিকে সরকারি গুদামে অধিক পরিমাণ খাদ্যশস্য মজুদের কারণেও সরকারের ইচ্ছা থাকলেও ধান-চাল যথাসময়ে সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়। এমনই ঘটনা ঘটেছে বর্তমান বছরে।
সরকারিসূত্রে জনগণকে জানানো হয়েছে যে অধিক মজুদের কারণে এ বছর অভিযান পিছিয়ে দেওয়া হবে। অর্থাৎ মৌসুমের শুরুতেই সরকার ক্রয় অভিযান শুরু করবে না। সরকারিসূত্রে আরো জানানো হয়েছে যে বিকল্প হিসেবে সরকার চাল আমদানি বন্ধ রাখবে। সম্পূর্ণ বিষয়টিই গুদামজাত খাদ্যশস্যের মজুদ পরিস্থিতির নিবিড় পরিবীক্ষণসংক্রান্ত। এটা হয়নি। সরকার ইতিমধ্যে বোরো চাল সংগ্রহ করার লক্ষ্যে মূল্য নির্ধারণ করেছে কেজিপ্রতি ২৮ টাকা। সব ধরনের চাল ২৮ টাকায় সংগ্রহ করা যাবে না। ফলে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্থাৎ ১০ লাখ টন চাল সংগ্রহ করার বিষয়টি অনেকটা অনিশ্চিত। তবে ভবিষ্যতেই জানা যাবে সঠিক অবস্থা। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অনিশ্চয়তার মূল হুমকি চালকল মালিকদের আচরণ। অতীতে অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, তাঁদের সরবরাহ করার তেমন উৎসাহ দেখা যায়নি। তাঁদের অভিযোগ, নির্ধারিত মূল্যে চাল সরবরাহ করা সম্ভব নয়।
এর জন্য প্রায় প্রতিবছর খাদ্য অধিদপ্তর নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। অধিক মূল্যে বিদেশ থেকে চাল আমদানি করতে সরকার বাধ্য হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে খাদ্য খাতে ভর্তুকিও দিতে হয়েছে প্রচুর। কোনো কোনো বছর সরকার নিজেই সংগ্রহ অভিযান করেনি। চাল ও গম আমদানি সরকার যে কেবল বাজারমূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্যই করে তা নয়। প্রকৃতপক্ষে এর মাধ্যমে বাজারমূল্য সম্পূর্ণ স্থিতিশীল হয় না। তাহলে সরকারি পর্যায়ে খাদ্যশস্য সংগ্রহ অভিযান কেন? এর মুখ্য উদ্দেশ্য রাজনৈতিক। এ ধরনের অভিযানের মাধ্যমে রাজনৈতিক দর্শন প্রতিফলিত হয়। বিগত দশক ধরে এ দর্শনের সঙ্গে অন্য একটি বিষয় যুক্ত হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, সরকারি গুদামে মজুদ খাদ্যশস্যের প্রায় ৭৪ শতাংশ (এখন বেশি হবে)। খাদ্যভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর জন্য বিচরণ করতে হয়। এ ছাড়া এ মজুদকে আপৎকালীন মজুদ (Buffer Stock) বলা হয়। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে কোনো কারণে গুদামে প্রয়োজনীয় মজুদ না থাকার জন্য যথাসময়ে আমদানি করা সম্ভব হয় না। এর ফলে বাজারে সংকট সৃষ্টি হয়। বাজারমূল্যও বেড়ে যায়, যা সরকারের জন্য বিব্রতকর। নিম্ন আয়ের জনমানুষের ভোগান্তিও হয়। চরম অবস্থা হলে, হয় রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা।
জানা যায়, সরকারি গুদামে বর্তমানে ১০ লাখ ৫০ হাজার টন চাল ও দুই লাখ টন গম মজুদ আছে। সংগ্রহ অভিযান সর্বমোট ৬৪ জেলায় কখনো সফলভাবে হয় না। কারণ অনেক জেলায় জেলাভিত্তিক চাহিদার তুলনায় কম চাল উৎপাদিত হয়। অর্থাৎ এসব জেলায় খাদ্য ঘাটতি রয়েছে। উৎপাদনের দৃষ্টিকোণে খাদ্য অধিদপ্তরের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী দেশের সর্বমোট ২৫টি জেলা থেকে চাল সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে রাজশাহী ও বর্তমানে রংপুর বিভাগের মোট ১৬টি জেলা, খুলনার কুষ্টিয়া ও যশোর, বরিশাল বিভাগে সংগ্রহ অভিযান অতীতে সফল হয়নি; চট্টগ্রামে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লা; সিলেটে অতি নগণ্য এবং ঢাকার ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, জামালপুর, শেরপুর ও কিশোরগঞ্জে সংগ্রহ হয়।
সরকারি গুদামের ধারণক্ষমতা ১৪ লাখ টন। এখন হয়তো অল্প কিছু নতুন গুদামের জন্য ১৫ লাখ টন হতে পারে। কিন্তু এ নিয়েও প্রশ্ন আছে। গুদামে এক বস্তার ওপরে আরেক বস্তা রাখা হয়। এতে ৫০ থেকে ১০০ বস্তা গুদামভেদে রাখা যায়। ২৫টি জেলায় বর্তমানে দুই থেকে আড়াই লাখ টন রাখা যাবে। গুদামের বেশির ভাগই রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে। এ অঞ্চলে মোট ধারণক্ষমতা আট লাখ টন। গম আমদানির চূড়ান্ত এলসি প্রায় দেড় লাখ টন। সব মিলিয়ে ১০ লাখ টন সংগ্রহ সম্ভব হলেও রাখার জায়গার অভাব হওয়ার আশঙ্কাই অধিকতর।
বিকল্প পদক্ষেপ কী হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, চাল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পদক্ষেপ। এর সঙ্গে অন্য একটি পন্থা রয়েছে। তা হলো, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর চাল দ্রুত বিতরণ করা, যে বিষয়টিও বর্তমানে হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ বর্ষা আসন্ন। বর্ষাকালে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি সংগত কারণেই বাস্তবায়িত হয় না। এ ছাড়া মাঠ পর্যায়ে এসব কর্মসূচি উপজেলা পর্যায়ে ত্রিমুখী দ্বন্দ্বের কারণে অতিমন্থর। চালের দাম বাজারে কিছুটা নিম্নগতির। চালকল মালিকদের কাছেও চাল মজুদ রয়েছে। চালের দাম কমলে কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিতে অনেকেই অংশগ্রহণ করবেন না। জোর করে গুদামে জায়গা করার জন্য এসব কর্মসূচিতে খাদ্যের ব্যবহারে বাজারে চালের দাম আরো কমে যাবে। কৃষকদের বিপদ হবে।
প্রয়োজন সার্বিক বিষয়টি নিবিড়ভাবে পরিবীক্ষণ করা এবং দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এ কাজটি সঠিকভাবে ও সময়মতো করলে আশঙ্কার কারণ ছিল না। যথাসময়ে কাজটি করা হয়নি। হলে এসব প্রশ্ন মিডিয়ায় উত্থাপিত হতো না। জানা যায়, এ বছরের কোনো একসময় সুগন্ধি চাল রপ্তানির ওপর সরকার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। এখন এ সিদ্ধান্ত বহাল থাকলে তা অবিলম্বে রদ করা প্রয়োজন। এ বছর হয়তো বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করবে। পত্রিকান্তরে বলা হয়েছে, এ বছর বোরোর মোট উৎপাদন হবে এক কোটি ৮৭ লাখ টন। এটা প্রাথমিক অনুমান। পরিসংখ্যান ব্যুরোর চূড়ান্ত হিসাব পাওয়ার পরই এটা সঠিকভাবে বলা যাবে, যদিও প্রতিবছর এ নিয়ে সরকারের অভ্যন্তরেও মতবিরোধ হয়। এ বছরও যে হবে না, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। উৎপাদনের চূড়ান্ত পরিমাণ যাই হোক না কেন, মূল লক্ষ্য হবে কৃষকদের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা। সম্পদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কৃষি খাতে যথেষ্ট ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু উৎপাদন ব্যয় কমানো সম্ভব হয়নি। এখন শোনা যাচ্ছে, আগামী বাজেটে ভর্তুকি যৌক্তিককরণ করা হবে। কৃষি খাতের কী হবে তা এখনো নিশ্চিত নয়। যদি কমানো হয়, তাহলেই আশঙ্কার কথা। একই সঙ্গে যোগ্য কৃষকরা যাতে ভর্তুকি পান সে বিষয়টিও দেখা প্রয়োজন।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও কলামিস্ট
No comments