পঞ্চম সংশোধনী-রায়ের জন্য অপেক্ষা যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ by মিজানুর রহমান খান

পঞ্চম সংশোধনী প্রশ্নে এখন আপিল বিভাগের রায়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এর তাত্পর্য হাইকোর্টের রায়ের চেয়ে কম নয়। পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হলো ঠিকই; কিন্তু এখন নতুন করে সংবিধান কীভাবে ছাপা হবে, সেটাই প্রধান আকর্ষণ।


হাইকোর্ট সংবিধানের প্রস্তাবনাসহ ৬, ৮, ৯, ১০, ১২, ২৫, ৩৮ ও ১৪২—এই আটটি অনুচ্ছেদের আদি পাঠ পুনর্বহাল করে। এখন আসন্ন রায়ে কি সবগুলো টিকবে, নাকি দু-একটি বাদ যাবে? গেলে সেটি হবে কোনটি? এটা একটা শ্বাসরুদ্ধকর অপেক্ষা।
গতকালের পত্রপত্রিকায় ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়টি ফলাও করে ছাপা হয়েছে। কিন্তু আপিল বিভাগ এ-সংক্রান্ত ১২ অনুচ্ছেদ যে ফিরিয়ে আনবেনই, তা হলফ করে বলা যায় না। বিএনপির নেতা রফিকুল ইসলাম মিয়া দিগন্ত টিভি চ্যানেলে এদিকে ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, যদি এই অনুচ্ছেদ বাদ পড়ে, তাহলে তো বিতর্ক উঠবে না! ১৯৭৭ সালে ১২ অনুচ্ছেদ বিলোপ হয়। এটি এখনো বিলুপ্ত। এটি এলে একটি শূন্যস্থান পূরণ হবে।
সংবেদনশীল তিনটি বিষয় সামনে। এক. ধর্মনিরপেক্ষতাসহ চার মূলনীতির পুনঃপ্রতিষ্ঠা (অনু. ৮), দুই. ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়া (অনু. ১২) এবং তিন. নাগরিকদের জাতীয়তা বাংলাদেশির পরিবর্তে বাঙালি হওয়া (অনু. ৬)। ওই আটটির মধ্যে পাঁচটিই (৮, ৯, ১০, ১২ ও ২৫) তাত্ত্বিক। এক অর্থে দুর্বল। কারণ, সংবিধানই বলছে এগুলো আদালতের মাধ্যমে বলবেযাগ্য নয়।
বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী বলেছেন, ‘মূল সংবিধানের অনুচ্ছেদগুলো আপনাআপনি পুনর্বহাল হবে।’ (কালের কণ্ঠ, ৩ ফেব্রুয়ারি)। কিন্তু সবগুলো তো আসবে না। আসার কথা সাকল্যে ওই আটটি। আপিল বিভাগ অবশ্য কোনো নির্দিষ্ট অনুচ্ছেদের বাক্য বা বাক্যাংশে হাত দিতে পারবেন বলে মনে হয় না। হয় পুরো অনুচ্ছেদ রাখবেন, না হয় পুরোপুরি বাদ দেবেন। খুশি হব যদি আটটি অটুট থাকে, সংখ্যা আরও বাড়ে। যদি যোগ যৌক্তিক না হয়, তাহলে হয়তো বিয়োগও নয়।
আদালতের আদেশে সংবিধান পরিবর্তনে আমরা দ্বিতীয় নজির পেতে যাচ্ছি। একটি অরাজনৈতিক অনুচ্ছেদ (১০০) নিয়ে যে ধরনের অনবদ্য শুনানি হয়েছিল, এবার তার ব্যত্যয় ঘটে। অষ্টম সংশোধনীর চেয়ে হাজার গুণ গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও এবার আপিল বিভাগে ব্যাপকভিত্তিক ও গভীরতাপূর্ণ শুনানি কিন্তু হলো না।
পরিমার্জনার পরিধি: রায় কবে মিলবে, সে জন্য কোনো সময়সীমা বাঁধা নেই। প্রধান বিচারপতি ৮ ফেব্রুয়ারি অবসরে যাচ্ছেন। অবসরে যাওয়ার পরও বিচারকেরা রায় লেখেন। তবে প্রকাশ্য আদালতে ঘোষিত তারিখেই ওই রায় দেওয়া হলো বলে গণ্য হয়। হাইকোর্টের ২৪২ পৃষ্ঠার রায়টির পূর্ণাঙ্গ বিবরণ আদালত কক্ষে পাঠ করা হয়েছিল। এবার আপিল বিভাগ মাত্র একটি বাক্যে লিভ আবেদনগুলো খারিজ করেছেন। তাই ঠিক কী ‘পরিমার্জন ও পর্যবেক্ষণ’ আসবে, তা অনুমান করাও কঠিন।
সাম্প্রতিক সময়ে ১০ বিচারকের মামলায় লিভ মঞ্জুর না করেও আপিল বিভাগ হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চের রায়ের যথেষ্ট পরিবর্তন ঘটান। বিস্তারিত বিচারক নিয়োগ নীতিমালা তৈরি করেছিলেন হাইকোর্ট। কিন্তু প্রায় ১০ মাস পর দেওয়া আপিল বিভাগের রায় থেকে দেখা যায়, অনেক মৌলিক পরিবর্তন করেছেন তাঁরা। সে পরিবর্তন দেখে দারুণ অবাক হয়েছি। কারণ, যেসব বিষয় শুনানিতে আদৌ আসেনি, সেখানেও হাত দিয়েছেন আপিল বিভাগ। সে মামলাতেও লিভ আবেদনকারীদের আইনজীবী ছিলেন টি এইচ খান।
আপাতত বলা যায়, আপিল বিভাগে পঞ্চম সংশোধনী বাতিলে হাইকোর্টের রায় আপিল বিভাগের ওই পরিমার্জন সাপেক্ষে বহাল হলো। হাইকোর্ট সাধারণভাবে ১৯৭৫-১৯৭৯ পর্যন্ত সময়ে সব ধরনের সামরিক ফরমান, প্রবিধান আদেশ ইত্যাদিকে বেআইনি, এখতিয়ারবহির্ভূত ঘোষণা করেন। পঞ্চম সংশোধনী হলো ফরমানের সংকলন। ফরমান দিয়েই বাকশালের বিলোপ ঘটে। এ কারণেই বিএনপি প্রচার চালায়, পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হলে বাকশাল ফিরে আসবে। এটা ছিল আসলে অপপ্রচার। কারণ, সামরিক ফরমান দিয়ে বিচারপতি সায়েমের দ্বারা বাকশাল বিলোপকে হাইকোর্ট মার্জনা করেন। হাইকোর্ট সব ফরমানকে একদিকে ‘অনন্তকালের’ জন্য অবৈধ আখ্যা দেন, আবার অন্যদিকে সামরিক ফরমান দিয়ে আনা কিছু পরিবর্তন বহাল রাখেন। আপিল বিভাগ সেই মার্জনা সমুন্নত রাখতে আবার হয়তো কিছু ক্ষেত্রে নতুন কিছু যোগ-বিয়োগ করতে পারেন। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ফরমানগুলোর বিভিন্ন বিধানকে ‘প্রভিশনালি কন্ডোন’ বা সাময়িক মার্জনা করলাম বলেও মন্তব্য করেন। এর অর্থ হলো, তাঁর মার্জনা করা কোনো বিধানের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করার পথ তিনি খোলা রেখেছেন।
কাজ ও আইন: হাইকোর্ট ‘আইন’ হিসেবে সামরিক ফরমান ও তার অধীনে যেসব ‘কাজ’ বা ঘটনা ঘটে গেছে, তার মধ্যে পার্থক্য এনেছেন। সব ধরনের ফরমান বা সামরিক আইনকে তিনি অবৈধ বলেছেন। কিন্তু তার অধীনে যেসব কাজ ঘটে গেছে, তাকে মার্জনা করেছেন। বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ মাহমুদুল ইসলাম আদালতে তিনটি ক্ষেত্রে মার্জনা প্রযোজ্য বলে অভিমত দেন। প্রথমত, ‘যেসব কাজ অতীত হয়ে গেছে এবং তার কার্যকরতা রুদ্ধ হয়ে গেছে।’ (যেমন সামরিক আইনের অধীনে কারও ফাঁসি হলো ও তা কার্যকর হলো) দ্বিতীয়ত, ‘এমন ধরনের কৃতকর্ম, যা নাগরিকের অধিকার খর্ব করে না।’ তৃতীয়ত, ‘রাষ্ট্র পরিচালনার দৈনন্দিন কাজ, যা যেকোনো বৈধ সরকারও করে থাকে।’ যেমন আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, বাজেট প্রণয়ন, অফিস-আদালত পরিচালনা করা ইত্যাদি। তাই ‘ডকট্রিন অব কন্ডোনেশন’কে আপিল বিভাগ কীভাবে দেখেন, সেটা একটা বিরাট ব্যাপার।
হাইকোর্ট সব ফরমানকে জন্ম থেকে বাতিল বলেছেন। অষ্টম সংশোধনী মামলায় আইনের অবৈধতার ক্ষণ গণনার ক্ষেত্রে আদালত প্রসপেক্টিভ অর্থাত্ ভবিষ্যত্ বিবেচনায় নেন বলে মাহমুদুল ইসলাম যুক্তি দেন। এর অর্থ, আদালত যে তারিখে রায় দেবেন, সেই তারিখ থেকে তা অবৈধ হবে। কিন্তু এখানে তফাত আছে। অষ্টম সংশোধনীতে সংসদের, কিন্তু পঞ্চম সংশোধনীতে ফরমানের এখতিয়ার যাচাই হয়।
মৌলিক কাঠামো: বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক কাঠামো। বেসিক স্ট্রাকচার বা মৌলিক কাঠামো পরিবর্তনের এখতিয়ার সংসদের নেই। কিন্তু কোনগুলো মৌলিক কাঠামো আর কোনগুলো নয়, সে বিষয়ে উপমহাদেশের উচ্চ আদালতের ভিন্নমত রয়েছে। তবে সবাই একমত যে, সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে মৌলিক কাঠামো ধ্বংস করা যাবে না। পারভেজ মোশাররফের মামলাতেও পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট এটা কবুল করলেন। তাঁরা বললেন যে, ফরমান দিয়ে মৌলিক কাঠামো বদলানো যাবে না। মওদুদ আহমদেরা সেটুকুও স্বীকার করেননি।
১৯৭৫ সালে চতুর্থ সংশোধনীতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অনেকটা ধ্বংস করা হয়েছিল। এতে বিচারপতি নিয়োগে ৯৫ অনুচ্ছেদে বর্ণিত প্রধান বিচারপতির পরামর্শের বিধান রহিত ও ৯৬ অনুচ্ছেদে বিচারক অপসারণে ইমপিচমেন্টের বিধান রদ করা হয়। সুপ্রিম কোর্ট বাদ দিয়ে সরকার দ্বারা অধস্তন আদালত নিয়ন্ত্রণের জন্য ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হয় (এটা আজও বহাল)।
১৯৭৬ সালে সায়েম ফরমান দিয়ে ৯৫ অনুচ্ছেদে মূল সংবিধান থেকে প্রধান বিচারপতির পরামর্শের বিধান ফিরিয়ে আনেন। জিয়া পরে তা কেড়ে নেন। হাইকোর্ট সায়েমের ফরমানটিকে মার্জনা করেন। এর অর্থ, ‘প্রধান বিচারপতির পরামর্শ’ কথাটি ফিরিয়ে আনেন। কিন্তু তিনি জিয়ার আনা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ও ১১৬ অনুচ্ছেদ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেননি। এর অর্থ, এটা বর্তমান অবস্থায় টিকে থাকবে। এখন এখানে আপিল বিভাগ মৌলিক কাঠামো বিবেচনায় ইমপিচমেন্ট ও সাবেক ১১৬ অনুচ্ছেদ ফিরিয়ে আনেন কি না, সেটাও হবে দেখার বিষয়। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খণ্ডিত হয় না।
১৫০ অনুচ্ছেদে ১৮ নম্বর প্যারাগ্রাফ ও ৩ক নামে একটি নতুন অনুচ্ছেদ যুক্ত করা হয়। মূলত এটাই সব ফরমানের অভয়াশ্রম। বলা হয় ‘‘এসবই ‘সংসদের আইন’ বলে গণ্য হবে। এর বৈধতা কোনো আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না।’’ হাইকোর্টের রায়ে নির্দিষ্টভাবে ৩ক ও ১৮ নম্বর প্যারাগ্রাফ বিলোপে নির্দেশনা নেই বলে প্রতীয়মান হয়।
আরেকটি কথা। পঞ্চম সংশোধনীতে ১৪২ অনুচ্ছেদে বলা হলো, প্রস্তাবনা, ৮, ৪৮ ও ৫৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনে গণভোটও লাগবে। হাইকোর্ট এটা বাতিল করেন। গণভোট বিলোপের রায় বহাল থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান সংসদ গণভোট ছাড়া সংবিধানের প্রস্তাবনা ও ৮ অনুচ্ছেদ সংশোধন করতে পারবে না।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.