রমণীয় নয়-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখে কেন এই কথার বুলেট? by মালেকা বেগম

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, আপনার কি মনে পড়ে একসময় নারী আন্দোলনের বহু চড়াই-উতরাই পথে আমরা হেঁটেছি একসঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে কিশোরী-উত্তীর্ণ বয়সে আইয়ুব খান-ইয়াহিয়ার সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম শুরু করে ১৯৭৫-এ যখন বিশ্ব নারীবর্ষ পালনের জন্য আপনি যোগ দিলেন সংগঠক-নেত্রীরূপে, বাংলাদেশ মহিলা


সমিতির নেত্রীরূপে, যখন পরবর্তী সময়ে আরও প্রতিবাদী হয়েছেন জিয়াউর রহমান, স্বৈরাচারী এরশাদের সামরিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, আওয়ামী লীগের মহিলা শাখার নেত্রীরূপে দেদীপ্যমান থেকেছেন, যখন আইন-আদালতের কোর্ট-কাচারিতে আহত-নিহত ছাত্রদের, রাজনীতিবিদদের ওপর পুলিশি নির্যাতনের হত্যাকাণ্ডের মামলা সুচারুভাবে পরিচালনা করেছেন আইনজীবীরূপে—আমরা নারী আন্দোলনে আপনার বয়োজ্যেষ্ঠ সহযোগী নেত্রী-কর্মীরা গর্ব বোধ করতাম। নির্বাচিত হয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরূপে আপনার নিয়োগ আমাদের নারীবাদীদের আহ্লাদিত করেছিল, এমন গুরুত্বপূর্ণ পদে একজন ‘নারী’কে দেখে।
আজ যা বললেন আপনি বকরের হত্যাকাণ্ডের পর এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরূপে যেসব আইনবহির্ভূত কথা বলছেন, তাতে বলতে বাধ্য হচ্ছি উচ্চক্ষমতাধর পদে নারী যদি গণতন্ত্রী, মানবতাবাদী না হন, তবে নিষ্ঠুরতার চরম শাসননীতি চালাতে পারেন। মায়ের মনের বেদনা বুঝলে আজ আপনি নিহত বকরের মায়ের পাশে দাঁড়াতেন, সন্তানহারা মা-বাবার শোকাকুল হূদয়ে আরেকটি রূঢ় কথার ‘বুলেট’ ছুড়ে দিতেন না, বলতেন না ‘এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এটা কোনো ব্যাপার না। এমনটি ঘটতেই পারে।’ [সূত্র: ৬ ফেব্রুয়ারি প্রায় সব পত্রিকায় প্রকাশিত আইন মন্ত্রণালয়ে তিন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় বৈঠকের পরে সাংবাদিকদের বলা খবর]
ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সশস্ত্র সংঘাত এবং পুলিশের অভিযানের ওই রাতে বকর যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপদ হলে [নিরাপদ কি না ভিসি, প্রভোস্ট, সিনেট, সিন্ডিকেট, শিক্ষক সমিতি ও প্রক্টর, ডিন মহোদয়েরা বলতে পারেন] থেকেও আহত হলেন এবং পরে হাসপাতালে মারা গেলেন, সে ঘটনাটিকে ‘বিচ্ছিন্ন’ এবং ‘ব্যাপার না’ বলা তাঁরই সাজে, যিনি নিষ্ঠুরতা লালন করেন, দলীয় সন্ত্রাসকে চর্চা করেন প্রতিনিয়ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগে আমি পড়াচ্ছি কয়েক বছর ধরে। প্রতিনিয়ত শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতির নির্বাচন-চর্চা দেখছি, ছাত্রদের দলীয় উন্মত্ততা দেখছি, শিক্ষার্থীদের হাতে অস্ত্র দেখে শিউরে উঠছি। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাধারণ ছাত্ররা বলছে, ওরা হলে থাকতে পারছে না আতঙ্কে; প্রতিটি হলে বাইরের দলীয় (বর্তমানে ছাত্রলীগ, আগে ছাত্রদল, জামায়াতই প্রধান সন্ত্রাসী ছিল)
সন্ত্রাসীরা অস্ত্র নিয়ে থাকছে; দলীয় ছাত্ররা প্রভোস্ট, হাউস টিউটরদের হল তদারকির কাজে বিরত থাকতে বাধ্য করছে।
নিম্নমধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত শিক্ষার্থীরা পরিবারের ভবিষ্যত্ আয়-ভরসাস্থল। ওরা হলে থেকে পড়তে পারছে না। অকালে তাজা প্রাণ ঝরে যাচ্ছে দরিদ্র বাবা-মায়ের বুক খালি করে। এই আর্তনাদ কি শিক্ষামন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সবাই শুনছেন না?
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আপনার জানা আছে ষাটের দশকে, ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনের সময়ও মোনায়েম খান, সেনাশাসকদের তল্পিবাহক হয়ে হলগুলোতে ‘এনএসএফ’ দল লালন করতেন এবং হকিস্টিক হাতে সাপ গলায় পেঁচিয়ে ওরা যাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস করত, তারা আপনার পাশে বসে জাতীয় সংসদে মন্ত্রিসভায় রাজনীতি করছেন (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ সদস্যরা তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রমুখ, রাশেদ খান মেনন, নুরুল ইসলাম নাহিদ, আসাদুজ্জামান নূর প্রমুখ)। আমরা যারা সে সময় দেশাত্মমূলক ছাত্র আন্দোলন করতাম, তারা বিনা অস্ত্রে, বিনা সন্ত্রাসে সেনা, পুলিশ ও সন্ত্রাসী বেনামী ছাত্রদের দমন করতাম প্রবল সাহসে—সততা, শিক্ষার বিষয়ে নিয়মনিষ্ঠা, শিক্ষা পরিবেশ-হলের পরিবেশ সাধারণ শিক্ষার্থীদের সহযোগিতায়, প্রভোস্টদের সহযোগিতায় সুষ্ঠু রাখার চর্চা অব্যাহত রাখতাম। কলম, খাতা, বই হাতে মনের বলিষ্ঠতায় আমরা সাধারণ প্রগতিশীল ছাত্রছাত্রী সমাজ সমন্বিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষাকেন্দ্রে দলীয় রাজনৈতিক সন্ত্রাসীদের আখড়া গুঁড়িয়ে দিতাম। আর আজ? সরকারের রাজনৈতিক দলের শীর্ষে থেকে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অলিখিত নির্দেশ বহন করে পুলিশ বাহিনী দলের বাহিনী হয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে শিক্ষার্থীদের প্রতি বুলেট ছুড়ছে? কেন সন্ত্রাসী-শিক্ষার্থীদের শিক্ষার পরিবেশ দিয়ে, আদর্শ দিয়ে ফিরিয়ে আনতে পারছেন না শিক্ষার চর্চায়? কেন ওরা অস্ত্রের চর্চা করবে?
আর মাত্র এক মাসের মতো ব্যবধানে অনুষ্ঠিত হবে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের (৮ মার্চ) শতবর্ষ পালনের মধ্য দিয়ে নারী আন্দোলনের শতবর্ষের ইতিহাস অনুশীলন-চর্চার ‘পিছু ফিরে দেখা’। শ্রমজীবী নারী থেকে শুরু করে দরিদ্র-মধ্যবিত্ত নিরক্ষর-শিক্ষিত, পেশাজীবী-রাজনীতি নারীদের এগিয়ে আনার ক্ষেত্রে এ দিবসের যেমন প্রেরণা আছে, তেমনি নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাজনীতিতে পুরুষের সমমর্যাদায় নারীর অংশগ্রহণ-নেতৃত্বে বিকাশ ঘটানোর ক্ষেত্রেও ৮ মার্চ, নারীবর্ষ, নারীদশক, বেইজিং কর্মপরিকল্পনা, বেইজিং+৫+১০+১৫, সিডও সনদ বাস্তবায়নের কর্মসূচি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশের নারী আন্দোলন থেকে এই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা হয়েছে বলেই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আজ উচ্চপদে নারীর আসন বাস্তবায়িত হয়েছে। কিন্তু সেটা রাজনৈতিক শীর্ষস্থানীয় নারীরা যদি সন্তানহারা মায়েদের বুকে আঘাত করেন, তাহলে নারী আন্দোলন বলতে বাধ্য যে জবাব চাই—কেন এই বুলেট-রাজনীতি মায়েদের বুক খালি করছে? বন্ধ করতে হবে এই রাজনীতির সন্ত্রাস।
মালেকা বেগম: নারী আন্দোলনের নেত্রী।

No comments

Powered by Blogger.