চারদিক-মনিরের হাতেই ঢেঁকিকল by মাইনউদ্দিন হাসান

৭ জানুয়ারি সকাল ১০টা। পৌষের কনকনে শীত। কোথাও একটু রোদ, আবার কোথাও কুয়াশা। সামনেও তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। কুয়াশা ভেদ করে পৌঁছে গেলাম কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার পশ্চিম বড় ভেওলা ইউনিয়নের দরবেশকাটা গ্রামে। কয় দিন ধরে এখানেই আসার ইচ্ছে পোষণ করে আসছিলাম।


আর সেই প্রবল ইচ্ছের বাস্তবায়ন হলো দরবেশকাটা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ সাজ্জাদের সহযোগিতায়। তিনি আগের দিন আচমকা তাঁর বিদ্যালয়ে বই বিতরণে আমন্ত্রণ জানালেন। চকরিয়া পৌর শহর চিরিঙ্গা থেকে দরবেশকাটার দূরত্ব ১২ কিলোমিটার। সাজ্জাদ সাহেবের মোটরসাইকেলে করে ছুটে চললাম। শীতে দুজনেরই জবুথবু অবস্থা।
চকরিয়া-বদরখালী-মহেশখালী সড়কের চোঁয়ারফাঁড়ি পৌঁছাতেই চোখে পড়ল বিস্তীর্ণ লবণমাঠ। কুয়াশার চাদরে তখনো ঢাকা মাঠগুলো। চলতে চলতে তাঁর কাছ থেকেই লবণচাষিদের অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলাম। এককথায় উত্তর তাঁর, অবস্থা মোটেও ভালো নয়। চাষিরা মাঠে নামছেন না। লবণের দাম নেই। এর মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম দরবেশকাটা গ্রামে। দরবেশকাটাই দেশের সবচেয়ে বড় লবণ উত্পাদন কেন্দ্র (অর্থাত্ কক্সবাজারের বৃহত্তর লবণ মাঠ)।
প্রধান শিক্ষকের কক্ষেই এলাকার কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ হলো। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ছলিমুল্লাহ চৌধুরী আক্ষেপ করে বললেন, লবণ চাষ নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। সরকারও এদিকে সুনজর দিচ্ছে না। অথচ কক্সবাজারের লবণ নিয়েই সারা দেশের চাহিদা মেটানো হয়। এ বছর লবণ চাষের ভরমৌসুমেও চাষিরা মাঠে নামছেন না। তাঁর কথা শেষ হতে না হতেই লবণচাষি শফিউল আলম বললেন, ‘শুনছি, লবণ আমদানির কারণে আমাদের লবণের দাম কমে গেছে।’ তাঁদের সঙ্গে যতই আলাপ বাড়ছে, মনটাও খারাপ হয়ে যাচ্ছে। প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ সাজ্জাদ বললেন, ‘আমার মোটরসাইকেল নিয়ে একটু মাঠ থেকে ঘুরে আসুন।’ একটু লজ্জা লাগল; ‘ভাই, আমি তো মোটরসাইকেল চালাতে জানি না।’ এলাকার লবণমাঠের মালিক মিজানুর রাহমান রাশেদ সঙ্গে যেতে আগ্রহী হলেন।
এ গ্রামের চৌদ্দপুরুষের পেশা লবণ চাষ। শুষ্ক মৌসুমে লবণ চাষ করেই পুরো বছরের খরচ জোগাড় হয় তাদের। কেউ জমি লাগিয়ত করে, কেউ ব্যবসা করে আর কেউ লবণমাঠে শ্রমিক খাটে। তাই তো কেউ যাচ্ছে আর কেউ ফিরছে মাঠের কাজ সেরে। চকরিয়া-মহেশখালী সড়কের পূর্বদিকে একটি ইট বিছানো সড়ক। শ খানেক বাড়ি-ঘর ফেলেই দিগন্তজোড়া লবণমাঠ। তখন দুপুর ১২টা। সামনে-বাঁয়ে-ডানে যত দূর চোখ যায়, শুধু লবণের মাঠ আর মাঠ। মনে করেছিলাম, এত দিনে মাঠগুলো সাদা সোনায় (লবণ) চিকচিক করছে। মাঠে ঢুকতেই একটি শিশু ঢেঁকিকল (দোন) দিয়ে পানি তুলছে। বয়স বড়জোর আট-নয়। তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। কী করো? ‘এই দেখেন না, মাঠে পানি দিচ্ছি।’ তোমার নাম? ‘মনির রহমান’। স্কুলে যাও না? জিজ্ঞেস করতেই, তার চেহারা লজ্জায় লাল হয়ে যায়। মনির বলে, ‘হ্যাঁ যাই। ক্লাস টুতে পড়ি।’ কখনো যায়, কখনো যায় না। মনিরের স্কুলে যাওয়ার মন থাকলেও পারে না। মানে তার স্কুলে যাওয়াটা আধাআধি!
বাবা জসিম উদ্দিন দরিদ্র কৃষক। আর্থিক সংকটের কারণে চাচা মোহাম্মদ শফির বাড়িতে থাকে সে। মাঠে চাচাকে সহযোগিতা করে। ‘এ বছর লবণের দাম কম হওয়ায় চাচা অন্য কাজে বেশি সময় দিচ্ছেন। গত বছর তিন-চারজন আইল্লা (শ্রমিক) ছিল। এ বছর এখনো কাউকে রাখেনি। তাই আমি কোনোমতে মাঠ তৈরির কাজ করছি। বুঝেন না, লাভ না হলে, মানুষ রাখবে কীভাবে।’ বলল মনির রহমান। মনির রহমান কথা বলে আর রশি ধরে পা চাপে ঢেঁকিকলে। জপর জপর লোনা পানি আইল চাপিয়ে জমি ভরছে। তার পাশেই অন্য জমিতে কাজ করছে দিদারুল ইসলাম ও বোরহান উদ্দিন। দিদার তৃতীয় শ্রেণীতে আর বোরহান পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। তারাও বাবার মাঠে সহযোগিতা করছে। ওরা ছাড়া বিস্তীর্ণ লবণমাঠে তেমন কারও দেখা মেলেনি। সঙ্গী রাশেদকে নিয়ে একটু সামনে এগোতেই আবদুল মোনাফ (৪০) নামের এক চাষি পাট্টি নিয়ে মাঠ পরিষ্কার করছেন। তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে করতে আরও চার-পাঁচজন চাষি মাঠ থেকে ফেরার সময় জড়ো হলেন। সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর তাঁরা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বললেন, ‘কীভাবে লবণমাঠ হবে? এক মণ লবণের দাম এখন ৬০-৭০ টাকা। উত্পাদন শুরু হলে কত টাকা হয়, তা কেউ জানে না! এ বছর আমরার খাওউন-দাওউন কোত্থেকে হবে, আল্লাই জানে! ভাই, আমাদের দুঃখের কথাগুলো পত্রিকায় ছাপিয়ে দিবেন?’
কামাল উদ্দিন নামের একজন জানালেন, জমির মালিক অগ্রিম চালের বস্তা আর দেড় হাজার খোরাকি দিয়ে মাঠে নামিয়েছে। লাভ হলে দুজনের সমান সমান। লোকসান হলে আমার শ্রম বৃথা যাবে।
মাঠ থেকে ফিরতেই দেখা হলো বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) লবণচাষ প্রকল্পের চকরিয়া কার্যালয়ের অফিস সহকারী মো. আবু তাহেরের সঙ্গে। তাঁদের কার্যালয়ও দরবেশকাটায়। তিনি জানালেন, গত বছর এ সময় লবণ উত্পাদন শুরু হয়েছিল। কিন্তু এ বছর এখনো চাষিরা পুরোপুরি মাঠে নামেননি। এবার ফিরতে ফিরতে মনে হলো মনিরের কথা। হায়রে লবণচাষ, মনিরের মতোই আধাআধি।

No comments

Powered by Blogger.