চরাচর-মাছ ধরাতেই আনন্দ by সাইফুল ইসলাম
এ দেশের মানুষের কাছে মাছ খাওয়ার চেয়ে ধরার আনন্দটাই যেন বেশি ছিল। তাই মৎস্য শিকারিরা মাছ ধরতে কত যে বুদ্ধি বের করত তার কোনো ইয়ত্তা ছিল না। কখনো জাল, কখনো বড়শি, কখনোবা দুই হাতের ওপর ভরসা করেই নেমে পড়ত মাছ শিকারে।
ঋতুভেদে, পানির পরিমাণে অথবা কাজের চাপে এ দেশে মানুষ পাল্টাত তাদের মাছ ধরার কৌশল। আষাঢ়ে নতুন পানি যখন আসতে শুরু করে তখন এ দেশের মানুষ হালকা স্রোতে পেতে দিত চারু, ধিয়াল, দ্বারকি, আদি, দোয়ার, বোচনা, সরগা, পাউস, হোচা, খাদন ইত্যাদি। ঘরের আদলে বাঁশে চিকন 'শলা' বা 'খিল' এবং পাটের সুতলি অথবা নৈ-লতা (একধরনের শক্ত বন্য লতা) দিয়ে তৈরি করা হতো মাছ ধরার এসব ফাঁদ। এর দুই বা ততোধিক দরজা এমনভাবে তৈরি হতো যে তা দিয়ে মাছ অনায়াসে ঢুকে পড়ত, কিন্তু বের হতে পারত না। নির্দিষ্ট সময় পর পর এসব ফাঁদ ঝেড়ে বের করে নিত মাছ। একসময় অতিবর্ষণে ঢল নামত। এতে নদীনালা, খালবিল, এমনকি কিষানের ফসলের ক্ষেত পর্যন্ত পানিতে টইটম্বুর হয়ে পড়ত। উজান স্রোত ঠেলে আসত আষাঢ়ে বোয়াল, শোল, গজার, আইড়, বাঘাইড় ইত্যাদি বড় মাছ। এ সময় গ্রামের মানুষ মাছ শিকার করত জুত, কোঁচ, টেটা দিয়ে। বাঁশের ডগায় কখনো একটি, কখনোবা পাঁচ-ছয়টি লোহার 'শলা' জুড়ে দিয়ে তৈরি করা হতো এসব। মানুষ তখন নদীর পাড়ে, কখনোবা পানির ওপরে মাচা করে বসে থাকত ধ্যানি বকের মতো। আর উজান ঠেলে আসা বড় মাছ দেখতে পেলেই ছুড়ে দিত জুত, কোঁচ বা টেটা। কেউ কেউ আবার মাচার সামনে পানিতে পুঁতে দিত পাটকাঠি, যাতে পাটকাঠির নড়াচড়া দেখলেই পাওয়া যায় বড় মাছের আগমন বার্তা। একসময় বর্ষাকাল শেষ হতো, পানি গিয়ে ঠেকত নদীনালা, খালবিলের তলায়। বাঙালির মাছ ধরার ধরন পাল্টাত আবারও। এ সময় নামানো হতো জালি, খেওয়াজাল, ঝাঁকিজাল, ফাঁসজাল, ছিপজাল, সংলাজাল, বাউলিজালসহ বিভিন্ন ধরনের জাল। দুই বা তিনটি বাঁশ আড়াআড়ি বেঁধে ত্রিকোনা জাল লাগিয়ে বানিয়ে নেওয়া হতো জালি। এ জালি পানির মধ্যে কিছুদূর ঠেলে তুললেই ধরা পড়ত ছোট ছোট মাছ। ছিপজাল বাওয়াও তেমন কঠিন কাজ ছিল না। চারকোনার এ জালকে চারটি ছিপে বাঁধা হতো। এরপর চারটি ছিপের গোড়া এক জায়গায় বেঁধে তা বাঁশে ঝুলিয়ে পানিতে ডুবিয়ে দেওয়া হতো। বড় ছিপজাল হলে তা খুঁটিতে বেঁধে ভর দিয়ে তুলতে হতো। কিছুক্ষণ পর পর তুললেই পাওয়া যেত কালবাউশ, গুজা, ছোট বোয়াল, পাবদা ইত্যাদি। ঝাঁকি বা খেওয়াজাল একটি কেন্দ্র থেকে পর্যায়ক্রমে বৃত্ত হয়ে ছড়ানো। সাত-আট হাত লম্বা এ জালের নিচে লাগানো হতো ছোট ছোট লোহার কাঠি। শরীরে দুলুনি তুলে পানিতে ছুড়ে দেওয়া হতো এ জাল। জাল ছড়িয়ে পড়ত বেশ কিছু জায়গাজুড়ে। কাঠিগুলো জালকে দ্রুত নিয়ে যেত পানির গভীরে। আটকে ফেলত বেশ কিছু মাছ। পরে তা টেনে তোলা হতো ডাঙায়। এ ছাড়া বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হতো ত্রিভুজাকৃতির 'হোচা', যাতে গাছের ডাল দিয়ে রেখে দেওয়া হতো নদী বা খালে। কয়েক দিন পর পর হোচা তুলেও আহরণ করা যেত মাছ। কখনো কখনো বাঁশের লম্বা চোঙা ফেলে রাখা হতো নদী-বিল-খালে। কয়েক দিন পর পর তা তুলেও মানুষ পেয়ে যেত অনেক বাইন, শিং, মাগুর মাছ। এ ছাড়া কার্তিক থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত বছরের এই ছয় মাস বিভিন্ন বিল-ঝিলে 'পলোবাওয়া' বা 'বাউতনামার' প্রচলন ছিল। কয়েক গ্রামের মানুষ নির্দিষ্ট দিনে গ্রামের আশপাশের বিলে মেতে উঠত মাছ ধরার উৎসবে। আর এসব মাছ ধরা উৎসবে বাঙালিরা ব্যবহার করত পলো, জালি, খেওয়াজাল, হোচা ইত্যাদি। যাদের কিছুই ছিল না, তারাও মাছ ধরায় নেমে পড়ত শুধু দুই হাতের ওপর ভরসা করে।
সাইফুল ইসলাম
সাইফুল ইসলাম
No comments