ভারসাম্য রাখতে হবে by হারুন-অর-রশীদ

সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রম (ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স) নির্ধারণ করতে উচ্চ আদালত যে আটটি নির্দেশনা দিয়েছেন, তাতে জেলা জজের অবস্থান সচিব ও তিন বাহিনীর প্রধানের ওপরে বলে ঠিক করা হয়েছে। এখানে এ বিষয়ে দুটি মতামত প্রকাশকরা হলো।


রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রম (ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স) নির্ধারণ করতে উচ্চ আদালত যে আটটি নির্দেশনা দিয়েছেন, তাতে জেলা জজের অবস্থান সচিব ও তিন বাহিনীর প্রধানের ওপরে বলে ঠিক করা হয়েছে। এই রায় কাউকে খুশি করেছে, আবার কাউকে অখুশিও করতে পারে।
রাষ্ট্রের মূল অঙ্গ তিনটি। এগুলো হলো যথাক্রমে: আইন প্রণয়নকারী সংস্থা তথা সংসদ, বিচার বিভাগ ও প্রশাসন। কার্যক্রমের দিক থেকে এগুলোর কোনোটির অবস্থানই ছোট নয়। সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্যই এগুলোর সৃষ্টি হয়েছে। আবার এগুলোর প্রতিটির মধ্যে নিজস্ব স্তরায়ণ বা হায়ারার্কিও রয়েছে। জেলা, বিভাগ ও জাতীয় পর্যায়ে এই স্তরায়ণ আমরা লক্ষ করি। বিচার বিভাগের বেলায় আঞ্চলিক বা নিম্নপর্যায়ে জেলা আদালত এবং জাতীয় পর্যায়ে উচ্চ আদালত ও সুপ্রিম কোর্ট রয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই আবার ওই ক্ষেত্রের জন্য মানানসই পদ এবং তার মর্যাদা ও এখতিয়ার সাব্যস্ত করা আছে। বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে এই স্তরগুলোর সর্বনিম্ন পর্যায় হলো জেলা জজ এবং সর্বোচ্চ পর্যায় হলো প্রধান বিচারপতি।
রাষ্ট্রের নেতৃত্বকে ওই তিনটি অঙ্গই পরস্পরের সম্পূরক বলে মনে করতে হবে। একটি বাদ দিয়ে অন্যটি সাবলীল হতে পারে না। এই তিনের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও সহযোগিতা ভালো করে দেখা যায় রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়। সে সময় রাজনৈতিক তথা বেসামরিক প্রশাসনের সহযোগিতার জন্য সামরিক বাহিনীকে ডাকা হয়। এর অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে। তাই কোনো কারণে এই নির্ভরশীলতা ও সহযোগিতার সম্পর্কে চিড় ধরানো বা পরস্পরের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ার মতো কোনো কাজ করা উচিত নয়। জাতীয় সমৃদ্ধি ও রাষ্ট্রের লক্ষ্য অর্জনের জন্য এ বিষয়টি মনে রাখা বাঞ্ছনীয়।
মাননীয় উচ্চ আদালত থেকে যে রায় দেওয়া হয়েছে এবং তার যে আইনি দিক রয়েছে, সে ব্যাপারে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। কিন্তু প্রায়োগিক ক্ষেত্রে, আমি মনে করি, এটা অবাস্তব ও অকার্যকর। এটা কার্যকর করতে গেলে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হতে পারে। এখন জেলা পর্যায়ে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁরা যদি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ স্তরের সমপর্যায়ে চলে আসেন, তাহলে চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়তে পারে।
রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বেলায় পদমর্যাদাক্রম বা ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স ঠিক করার ক্ষেত্রে সাধারণভাবে যে বিবেচনাটি কাজ করে, তা হলো, বিশেষ ক্ষেত্রের বিশেষ দায়িত্বের বা সেবা প্রদানের বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব। এর অর্থ দাঁড়ায়, ওই সব দায়িত্ব ও ভূমিকায় যেসব কর্মকর্তা রয়েছেন তাঁদের পদের যথাযথ গুরুত্ব নির্ধারণ এবং সেগুলো অন্যান্য ক্ষেত্রের দায়িত্বশীল পদগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করা। এটা যদি যথাযথভাবে বিন্যস্ত ও সমন্বিত না হয়, তাহলে তাঁদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে তো বটেই, সামগ্রিক বিন্যাসেও অসংগতি চলে আসতে পারে। তাতে তাঁদের কাজের পরিবেশ ও দায়িত্ব পালনের নিশ্চয়তা—উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সচিবই বলি বা একজন সামরিক কর্মকর্তা বা তিন বাহিনীর প্রধানের যে কারও কথাই বলি, তাঁদের পদমর্যাদা ও এখতিয়ারের বিষয়টি আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ও পদমর্যাদাক্রমের সঙ্গেও সংগতিপূর্ণ হওয়া চাই। প্রায়ই তাঁদের অন্য দেশের একই পদমর্যাদার কারও সঙ্গে কাজ করতে হয়, পারস্পরিক মতবিনিময় করতে হয়। এখন যদি অন্য দেশের একজন সচিব যে পদমর্যাদা পান এবং তাঁর জন্য যে রাষ্ট্রাচার (প্রটোকল) নির্ধারিত, সেই একই পদমর্যাদা ও রাষ্ট্রাচার যদি আমাদের একজন সচিব না পান, তাহলে তিনি কীভাবে কাজ চালাবেন? এতে তাঁর কাজেরই ক্ষতি হবে। এসব বিবেচনা থেকে পদমর্যাদাক্রমের বিষয়টি ঠিক করাই সংগত ও যৌক্তিক।
এ বিষয়গুলো জাতির জন্য স্পর্শকাতর। তাই কাজ করতে হবে সব দিক চিন্তা করে এবং ভারসাম্য বজায় রেখে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মানমর্যাদার দিকটিও বিবেচনার মধ্যে থাকতে হবে। আমার মনে হয়, শুধু আইনি রায় দিয়ে রাষ্ট্রীয় পদমর্যাদাক্রম ঠিক করা যাবে না; বাস্তব বিবেচনা ও প্রায়োগিক কার্যকারিতাও এখানে মুখ্য বিষয়।
হারুন-অর-রশীদ: অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল। সাবেক সেনাপ্রধান।

No comments

Powered by Blogger.