সরল গরল-বন্দুকের নল সরিয়ে নিন by মিজানুর রহমান খান
একটি কবির লড়াই হলে কেমন হয়। সেখানে একদিকে থাকবেন পঞ্চম সংশোধনী সমর্থক আইনবিদেরা, অন্যদিকে এর বিরোধীরা। টস নয়, সমর্থক পণ্ডিতেরা আগে বলার সুযোগ পাবেন। জানা কথা, তাঁরা তারস্বরে বলবেন, পঞ্চম সংশোধনী খুবই জরুরি বিষয়। সুপ্রিম কোর্টের সাধ্যি নেই এর গায়ে আঁচড় কাটে।
হয়তো তাঁরা বলবেন, পঞ্চম সংশোধনী আরও জাতে ওঠে ১৯৯১ সালে। তখন আমরা রাষ্ট্রপতি-পদ্ধতি বাতিল করেছি, এনেছি সংসদীয় গণতন্ত্র। আমরা গণভোট করেছি। সুতরাং পঞ্চম সংশোধনীর গায়ে সামরিক শাসনের কালিঝুলি যদি লেগেও থাকে, তা তো এখন ফকফকা। এর গায়ে আর কোনো দুর্গন্ধ নেই। বারুদের গন্ধ নেই।
এ ধরনের যুক্তিতে কাল্পনিক ওই ‘কবির লড়াই’ বেশ জমে উঠবে। জনতা মুখ চাওয়াচাওয়ি করবে। হয়তো বিরোধী শিবিরেও কিছুটা নীরবতা নামবে। সত্যিই তো, ১৯৯১ সালে গণভোট হয়েছে। জিয়াউর রহমান সামরিক ফরমান দিয়ে গণভোটের বিধান সংবিধানে ঢোকান। তাঁরা দূরদর্শী ছিলেন। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ২০০৫ সালে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে যে রায় দেন, তেমন দুর্যোগ তাঁরা ১৯৭৯ সালে কল্পনা করেছিলেন। তাই সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদে তাঁরা সামরিক ফরমানগুলোর জন্য একটি বাড়ি বানান।
সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদটা একটা ব্যতিক্রম। নামেই এর পরিচয়। শিরোনাম: অস্থায়ী ও ক্রান্তিকালীন বিধানাবলি। এখানে লেখা: চতুর্থ তফসিলে বর্ণিত বিধানাবলি সংবিধানের অন্যান্য বিধানাবলি সত্ত্বেও কার্যকর হবে। পঞ্চম সংশোধনী দিয়ে এখানে ১৮ নম্বর প্যারাগ্রাফ যুক্ত করা হয়। এই প্যারাগ্রাফটিতে সব ধরনের সামরিক ফরমানকে নির্বিচারে বৈধতা দেওয়া হয়।
সবারই জানা যে সংসদ যখন কোনো আইন পাস করে, তখন তার বৈধতা আদালতে চ্যালেঞ্জযোগ্য। কেউ এমন কোনো আইন দেখাতে পারবেন না যে যেখানে লেখা আছে, এই আইনটা কোনো আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। কিন্তু জেনারেল জিয়া তেমন আইন তৈরি করলেন। আদালতের এখতিয়ার খর্বকারী আইন বিষয়ে বিএনপিপন্থী আইনবিদেরা কোন ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখান, তা আমরা সম্প্রতি লক্ষ করেছি। জরুরি অবস্থায় প্রণীত আইনে লেখা ছিল, দ্রুত বিচারের স্বার্থে বিচার চলাকালে অভিযুক্তরা জামিন পাবেন না। এর প্রতিক্রিয়ায় বিএনপিপন্থীসহ আইনজীবীরা হাইকোর্টে হাত-পা ছুড়ে চিত্কার জুড়ে দিয়েছিলেন। কী সর্বনাশ, কী সর্বনাশ। উচ্চ আদালতের হাত-পা বাঁধা। কেউ কেউ এতে মধ্যযুগীয় ইংল্যান্ডের তাণ্ডব দেখলেন। বললেন, এই হলো জংলি আইন।
বিএনপিপন্থী এই আইনজীবীরাই এখন আবার আদালতের ক্ষমতা খর্বকারী ওই ১৮ নম্বর প্যারাগ্রাফের সমর্থক। এখানে বন্দুকের নল থেকে বেরোনো আইনকে বিরাট মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। বলা হলো, সংসদে পাস হওয়া আইনই কেবল আইন নয়, বন্দুকের নল থেকে বেরোলেও তা ‘আইন’। নির্দিষ্ট করে লেখা হলো, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল সেনাশাসন তুলে নেওয়া পর্যন্ত সময়ে, যেখানে যত প্রকার ফরমান ও প্রবিধান তো বটেই, এমনকি যত প্রকার ‘আদেশ ও বিজ্ঞপ্তিসমূহ’ জারি করা হয়েছে, তাও আইন হিসেবে টিকে থাকবে। এমনকি ১৮ নম্বর প্যারাগ্রাফের মাধ্যমে যুক্ত ৩ক অনুচ্ছেদের ১০ দফায় স্পষ্ট বলা হলো, সামরিক আদেশ ও বিজ্ঞপ্তিসমূহ এমনভাবে বিবেচিত হবে যেন এগুলো সবই সংসদের আইন ছিল!
জেনারেল জিয়ার আইন-বিষয়ক সহযোগীরা তখন বন্দুকের নলের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন। তাই সংসদ নিজেদের মনের মাধুরী দিয়ে সাজিয়েও তাঁরা স্বস্তি পাননি। মনে ডর ছিল। পঞ্চম সংশোধনী বিল পাস করা হলো সামরিক আইন বহাল রেখে। অতঃপর শেষ ফরমান হিসেবে মহা আজব সামরিক ফরমানটি জন্ম নিলো। সংবিধান ও গণতন্ত্রের ওপর এটা ছিল একটা মরণছোবল। মওদুদ আহমদ আদালতে বলেছেন, চতুর্থ সংশোধনীর কারণেই পঞ্চম সংশোধনী অনিবার্য হয়ে পড়ে। মুজিব যদি চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে আগের তুলনায় ঢের বেশি মাত্রায় সাংবিধানিক স্বৈরশাসক হন, তাহলে বলব তাঁর হত্যা-পরবর্তী শাসকেরা শুধু স্বৈরশাসক নন, ভয়ংকর দানব হয়ে উঠেছিলেন। শেষ ফরমানের মাধ্যমে জেনারেল জিয়া সংবিধান এফোঁড়-ওফোঁড় করেন। শেষবারের মতো ট্রিগারে চাপ দেন। আর এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সংবিধানকে চিরকালের জন্য বন্দুকের নলের কাছে নতমুখ করে রাখার ব্যবস্থা পাকা করেন। আমার ব্যক্তিগত মত হলো, এই ব্যবস্থাটা হাস্যকরভাবে হলেও আক্ষরিক অর্থে এখনো টিকে আছে।
জিয়া সামরিক আইন তুলে নেন ৬ এপ্রিল ১৯৭৯ রাত আটটায়। ঠিক এ দিন লে. জে. জিয়া প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে একটি ফরমান জারি করেন। সম্ভবত এটিই ছিল তাঁর শেষ ফরমান। বিচারপতি খায়রুল হক তাঁর রায়ে এই ফরমানটি সম্পর্কে ‘সম্ভবত’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এটি গেজেটে ছাপা হয় ৭ এপ্রিল ১৯৭৯। এ দিনই সংসদ অধিবেশনের সমাপ্তি ঘটে। এবারে আমরা ৭ এপ্রিলের ওই প্রজ্ঞাপনের কথাটি মনে রেখে ১৮ নম্বর প্যারাগ্রাফটি লক্ষ করব। এতে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল তারিখের (উভয় দিনসহ) মধ্যে প্রণীত সকল ফরমান....বৈধভাবে প্রণীত, কৃত বা গৃহীত হইয়াছে বলিয়া ঘোষিত হইল, এবং তত্সম্পর্কে কোন আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষের নিকট কোন কারণেই কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’ ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিলের সর্বশেষ ফরমানটির রাজনৈতিক ও আইনগত তাত্পর্য অপরিসীম ও সংবেদনশীল।
জিয়া মুজিব হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন কি না, এটি একটি বিতর্কিত প্রশ্ন। কিন্তু এই সামরিক ফরমানটি সাক্ষ্য দিচ্ছে যে তিনি ১৫ আগস্টের রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানকে ‘দেশের শান্তি, শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা, সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের স্বার্থে’ প্রয়োজনীয় বলে ঘোষণা করেছিলেন। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেলের সই করা এই দলিলটি নতুন প্রজন্মকে মুজিব হত্যাকাণ্ডে জিয়ার ভূমিকা মূল্যায়নে পথ নির্দেশ করতে পারে।
১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পরবর্তী পাঁচ দিন দেশে সংবিধান বা সামরিক আইন কোনোটিই ছিল না। ২০ আগস্ট সামরিক আইন জারি করেন মোশতাক। জিয়া ছিলেন মোশতাক ও সায়েমের পর তৃতীয় সিএমএলএ। ১৫ আগস্টের পরিবর্তন ‘জাতির শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য’ আনা হয়েছিল—এই ঘোষণা মোশতাক-ফারুক-রশিদ চক্রের দ্বারা ৩ নভেম্বরের আগেই এসেছিল। চার বছর পর তথাকথিত বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক জিয়ার সামনে ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করার কোনো দরকার ছিল না। উপরন্তু, তখন তিনি নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি। ওই ফরমানেই তিনি বলেন, ‘আমি ৩ জুন ১৯৭৮ অনুষ্ঠিত ভোটে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হয়েছি।’ সুতরাং কোনো বিচারেই প্রায় চার বছর পর ১৯৭৯ সালের ৬ জুলাই পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সম্পর্কে ওই মন্তব্য করে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়ার কোনো দরকার ছিল না। উপরন্তু, তখনো দেশের প্রধান বিরোধী শক্তি আওয়ামী লীগই ছিল। ‘গণতন্ত্রে উত্তরণের’ সময় কোনো রাষ্ট্রনায়কের পক্ষে এ রকম একটা কৌশলগত ঝুঁকি কবুল করা কি স্বাভাবিক মনে হয়? তবে কি তিনি বিশেষ দায় থেকেই ১৫ আগস্টকে সমর্থন করেছিলেন? এই দলিলটি তিনি সংবিধানের অংশে পরিণত করতে সচেষ্ট হন। ১৫ আগস্টের প্রতি জিয়াউর রহমানের দৃষ্টিভঙ্গি মূল্যায়নের এটি একটি দালিলিক প্রমাণ। শুধু দালিলিক নয়, সাংবিধানিক প্রমাণ!
তবে এর তাত্পর্যের কাহিনি এখানেই শেষ নয়, এই সেই সামরিক ফরমান, যেখানে বাংলাদেশের সংবিধান পঞ্চম সংশোধনীর পর কাগজে-কলমে কার্যকর হওয়ার পরও সেখানে ছদ্মবেশী প্রধান সামরিক আইন প্রশাসককে টিকিয়ে রাখা হয়। পঞ্চম সংশোধনী পাসের পরেও জেনারেল জিয়া যাতে সব সময় সংবিধানের ওপরে থাকেন, সে জন্য একটি বিশেষ রক্ষাকবচ তৈরি করা হয়। কী পরিহাস, মুজিব কত বড় স্বৈরশাসক ছিল, সেই গল্প বিএনপির মুখে শুনতে হয়। ১৯৭৯ সালে জিয়া তাঁর সর্বশেষ ফরমানে লিখেন, ‘সংবিধান বা অন্য আইনে যা আছে তা সত্ত্বেও রাষ্ট্রপতি যেকোনো অসুবিধা দূর করার স্বার্থে সময়ে সময়ে আদেশ দিয়ে বিধান জারি করতে পারবেন।’ পাঠক লক্ষ করবেন, জিয়া এক হাতে সামরিক আইন তুললেন, সংবিধানের প্রাণ দিলেন আর চুপিসারে যা তিনি লিখে নিলেন, তার সরল মানে দাঁড়াল: পঞ্চম সংশোধনী পাস হলেও কুছ পরোয়ানা নেই। চেনা সাফারিতে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির লেবাস নিলে কি হবে, উর্দিটাই আসল। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের চাবিটা নেয় কে? আগের মতোই তিনি জাতির ‘অসুবিধা’ দূর করবেন। সময়ে সময়ে সংবিধানের শ্রাদ্ধ ঘটিয়ে হলেও নতুন বিধান দেবেন।
বিচারপতি খায়রুল হক তাঁর রায়ে মন্তব্য করেন যে ‘সংবিধান অগ্রাহ্য করে যখন খুশি তেমন আদেশ জারি করার ক্ষমতা বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির কখনো ছিল না। বাহাত্তরেও নয়, এখনো নয়। কিন্তু বাংলাদেশের তখনকার রাষ্ট্রপতির (জিয়া) হাতে ওই ক্ষমতা ছিল।’ কিন্তু তিনি যা বলেননি, সেটাই কাল্পনিক কবির লড়াইয়ে পঞ্চম সংশোধনী বিরোধী আইনজ্ঞরা তাঁদের প্রতিপক্ষের বন্ধুদের শুনিয়ে দিতে পারেন। সমর্থকেরা ঢাকঢোল পিটিয়ে ঈষত্ রঙ্গ করে বলতে পারেন, ‘‘আচ্ছা, তর্কে আপনাদেরই জিত হলো। মানলাম, আপনারাই বড় পণ্ডিত। কিন্তু এটা তো ঠিক যে, ওই ফরমানটা আপনাদের যুক্তিমতেই সংবিধানের অংশ। সত্য বটে শাসনপদ্ধতি বদলেছে। কিন্তু সেই আজব ফরমান তো রাষ্ট্রপতিকে সংজ্ঞায়িত করেনি। এখন বর্তমান রাষ্ট্রপতি যদি বলেন, আমি সেই ‘পবিত্র ফরমান’ অনুযায়ী ‘রাষ্ট্রপতি’ হব। জাতির ‘অসুবিধা’ দূর করব। সংবিধান বেঁটে উপযুক্ত বিধান দেব। তাহলে প্রতিপক্ষের বন্ধুরা কী বলবেন?’’ সেই কাল্পনিক লড়াইয়ের পর্বে পঞ্চম সংশোধনী সমর্থকদের একই সঙ্গে আরেকটি মোক্ষম দাওয়াই দিতে হবে। রাষ্ট্রপতির জারি করা উক্তরূপ ‘নতুন বিধানের’ বৈধতার প্রশ্নে আপনারা কী কহেন? আপনাদের এবং সংবিধানের কথামতোই এ বিষয়ে ‘কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না।’
এ রকম একটা কবির লড়াই এই তীব্র শীতে বেশ জমবে এবং দারুণ উপভোগ্য হবে বলেই কল্পনা করা চলে!
কখনো মনে হয়, পঁচাত্তরের পনেরো আগস্টে ফারুক-রশিদরা যে ট্যাংক বের করেছিলেন, সে ট্যাংক ফিরে গেছে, তাঁরাও পরপারে গেলেন, কিন্তু তাঁদের বন্দুকের নল আজও তাক করা। পঞ্চম সংশোধনীর রায় আপিলে টিকলে ওই ১৮ প্যারাগ্রাফ হয়তো বিলোপ হতে পারে। বিশিষ্ট সংবিধান-বিশেষজ্ঞ মাহমুদুল ইসলাম গতকাল আপিল বিভাগে আলোচ্য প্যারাগ্রাফটির সংযোজনকে ‘সংবিধানের সঙ্গে প্রতারণা’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রবর্তন থেকে সংবিধানের সঙ্গে এ যাবত্ যত প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে, তা এক রায়ে কিংবা আদালতে নিঃশেষ হওয়ার নয়। রায়ে যদি ১৮ নম্বর প্যারাগ্রাফের বিলোপ ঘটে, তাহলেও বন্দুকের নল তাক করা থাকবে। সেটা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ঘাতক ফারুক রহমানের সাবেক রানিংমেট জেনারেল এরশাদের বন্দুকের নল। ১৯ নম্বর প্যারাগ্রাফে বিএনপির নির্বাচিত সরকার উত্খাত-পরবর্তী আমলের (১৯৮২-১৯৮৬) সামরিক ফরমান ও আদেশগুলোকে অভিন্ন ভাষায় রক্ষাকবচ দেওয়া আছে। এই বন্দুকের নলও সরাতে হবে। এক এগারোতে পোড় খাওয়া রাজনীতিকদের আত্মমর্যাদার স্বার্থে বর্তমান সংসদেরই সেটা করা উচিত।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
এ ধরনের যুক্তিতে কাল্পনিক ওই ‘কবির লড়াই’ বেশ জমে উঠবে। জনতা মুখ চাওয়াচাওয়ি করবে। হয়তো বিরোধী শিবিরেও কিছুটা নীরবতা নামবে। সত্যিই তো, ১৯৯১ সালে গণভোট হয়েছে। জিয়াউর রহমান সামরিক ফরমান দিয়ে গণভোটের বিধান সংবিধানে ঢোকান। তাঁরা দূরদর্শী ছিলেন। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ২০০৫ সালে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে যে রায় দেন, তেমন দুর্যোগ তাঁরা ১৯৭৯ সালে কল্পনা করেছিলেন। তাই সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদে তাঁরা সামরিক ফরমানগুলোর জন্য একটি বাড়ি বানান।
সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদটা একটা ব্যতিক্রম। নামেই এর পরিচয়। শিরোনাম: অস্থায়ী ও ক্রান্তিকালীন বিধানাবলি। এখানে লেখা: চতুর্থ তফসিলে বর্ণিত বিধানাবলি সংবিধানের অন্যান্য বিধানাবলি সত্ত্বেও কার্যকর হবে। পঞ্চম সংশোধনী দিয়ে এখানে ১৮ নম্বর প্যারাগ্রাফ যুক্ত করা হয়। এই প্যারাগ্রাফটিতে সব ধরনের সামরিক ফরমানকে নির্বিচারে বৈধতা দেওয়া হয়।
সবারই জানা যে সংসদ যখন কোনো আইন পাস করে, তখন তার বৈধতা আদালতে চ্যালেঞ্জযোগ্য। কেউ এমন কোনো আইন দেখাতে পারবেন না যে যেখানে লেখা আছে, এই আইনটা কোনো আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। কিন্তু জেনারেল জিয়া তেমন আইন তৈরি করলেন। আদালতের এখতিয়ার খর্বকারী আইন বিষয়ে বিএনপিপন্থী আইনবিদেরা কোন ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখান, তা আমরা সম্প্রতি লক্ষ করেছি। জরুরি অবস্থায় প্রণীত আইনে লেখা ছিল, দ্রুত বিচারের স্বার্থে বিচার চলাকালে অভিযুক্তরা জামিন পাবেন না। এর প্রতিক্রিয়ায় বিএনপিপন্থীসহ আইনজীবীরা হাইকোর্টে হাত-পা ছুড়ে চিত্কার জুড়ে দিয়েছিলেন। কী সর্বনাশ, কী সর্বনাশ। উচ্চ আদালতের হাত-পা বাঁধা। কেউ কেউ এতে মধ্যযুগীয় ইংল্যান্ডের তাণ্ডব দেখলেন। বললেন, এই হলো জংলি আইন।
বিএনপিপন্থী এই আইনজীবীরাই এখন আবার আদালতের ক্ষমতা খর্বকারী ওই ১৮ নম্বর প্যারাগ্রাফের সমর্থক। এখানে বন্দুকের নল থেকে বেরোনো আইনকে বিরাট মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। বলা হলো, সংসদে পাস হওয়া আইনই কেবল আইন নয়, বন্দুকের নল থেকে বেরোলেও তা ‘আইন’। নির্দিষ্ট করে লেখা হলো, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল সেনাশাসন তুলে নেওয়া পর্যন্ত সময়ে, যেখানে যত প্রকার ফরমান ও প্রবিধান তো বটেই, এমনকি যত প্রকার ‘আদেশ ও বিজ্ঞপ্তিসমূহ’ জারি করা হয়েছে, তাও আইন হিসেবে টিকে থাকবে। এমনকি ১৮ নম্বর প্যারাগ্রাফের মাধ্যমে যুক্ত ৩ক অনুচ্ছেদের ১০ দফায় স্পষ্ট বলা হলো, সামরিক আদেশ ও বিজ্ঞপ্তিসমূহ এমনভাবে বিবেচিত হবে যেন এগুলো সবই সংসদের আইন ছিল!
জেনারেল জিয়ার আইন-বিষয়ক সহযোগীরা তখন বন্দুকের নলের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন। তাই সংসদ নিজেদের মনের মাধুরী দিয়ে সাজিয়েও তাঁরা স্বস্তি পাননি। মনে ডর ছিল। পঞ্চম সংশোধনী বিল পাস করা হলো সামরিক আইন বহাল রেখে। অতঃপর শেষ ফরমান হিসেবে মহা আজব সামরিক ফরমানটি জন্ম নিলো। সংবিধান ও গণতন্ত্রের ওপর এটা ছিল একটা মরণছোবল। মওদুদ আহমদ আদালতে বলেছেন, চতুর্থ সংশোধনীর কারণেই পঞ্চম সংশোধনী অনিবার্য হয়ে পড়ে। মুজিব যদি চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে আগের তুলনায় ঢের বেশি মাত্রায় সাংবিধানিক স্বৈরশাসক হন, তাহলে বলব তাঁর হত্যা-পরবর্তী শাসকেরা শুধু স্বৈরশাসক নন, ভয়ংকর দানব হয়ে উঠেছিলেন। শেষ ফরমানের মাধ্যমে জেনারেল জিয়া সংবিধান এফোঁড়-ওফোঁড় করেন। শেষবারের মতো ট্রিগারে চাপ দেন। আর এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সংবিধানকে চিরকালের জন্য বন্দুকের নলের কাছে নতমুখ করে রাখার ব্যবস্থা পাকা করেন। আমার ব্যক্তিগত মত হলো, এই ব্যবস্থাটা হাস্যকরভাবে হলেও আক্ষরিক অর্থে এখনো টিকে আছে।
জিয়া সামরিক আইন তুলে নেন ৬ এপ্রিল ১৯৭৯ রাত আটটায়। ঠিক এ দিন লে. জে. জিয়া প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে একটি ফরমান জারি করেন। সম্ভবত এটিই ছিল তাঁর শেষ ফরমান। বিচারপতি খায়রুল হক তাঁর রায়ে এই ফরমানটি সম্পর্কে ‘সম্ভবত’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এটি গেজেটে ছাপা হয় ৭ এপ্রিল ১৯৭৯। এ দিনই সংসদ অধিবেশনের সমাপ্তি ঘটে। এবারে আমরা ৭ এপ্রিলের ওই প্রজ্ঞাপনের কথাটি মনে রেখে ১৮ নম্বর প্যারাগ্রাফটি লক্ষ করব। এতে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল তারিখের (উভয় দিনসহ) মধ্যে প্রণীত সকল ফরমান....বৈধভাবে প্রণীত, কৃত বা গৃহীত হইয়াছে বলিয়া ঘোষিত হইল, এবং তত্সম্পর্কে কোন আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষের নিকট কোন কারণেই কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’ ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিলের সর্বশেষ ফরমানটির রাজনৈতিক ও আইনগত তাত্পর্য অপরিসীম ও সংবেদনশীল।
জিয়া মুজিব হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন কি না, এটি একটি বিতর্কিত প্রশ্ন। কিন্তু এই সামরিক ফরমানটি সাক্ষ্য দিচ্ছে যে তিনি ১৫ আগস্টের রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানকে ‘দেশের শান্তি, শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা, সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের স্বার্থে’ প্রয়োজনীয় বলে ঘোষণা করেছিলেন। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেলের সই করা এই দলিলটি নতুন প্রজন্মকে মুজিব হত্যাকাণ্ডে জিয়ার ভূমিকা মূল্যায়নে পথ নির্দেশ করতে পারে।
১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পরবর্তী পাঁচ দিন দেশে সংবিধান বা সামরিক আইন কোনোটিই ছিল না। ২০ আগস্ট সামরিক আইন জারি করেন মোশতাক। জিয়া ছিলেন মোশতাক ও সায়েমের পর তৃতীয় সিএমএলএ। ১৫ আগস্টের পরিবর্তন ‘জাতির শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য’ আনা হয়েছিল—এই ঘোষণা মোশতাক-ফারুক-রশিদ চক্রের দ্বারা ৩ নভেম্বরের আগেই এসেছিল। চার বছর পর তথাকথিত বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক জিয়ার সামনে ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করার কোনো দরকার ছিল না। উপরন্তু, তখন তিনি নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি। ওই ফরমানেই তিনি বলেন, ‘আমি ৩ জুন ১৯৭৮ অনুষ্ঠিত ভোটে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হয়েছি।’ সুতরাং কোনো বিচারেই প্রায় চার বছর পর ১৯৭৯ সালের ৬ জুলাই পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সম্পর্কে ওই মন্তব্য করে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়ার কোনো দরকার ছিল না। উপরন্তু, তখনো দেশের প্রধান বিরোধী শক্তি আওয়ামী লীগই ছিল। ‘গণতন্ত্রে উত্তরণের’ সময় কোনো রাষ্ট্রনায়কের পক্ষে এ রকম একটা কৌশলগত ঝুঁকি কবুল করা কি স্বাভাবিক মনে হয়? তবে কি তিনি বিশেষ দায় থেকেই ১৫ আগস্টকে সমর্থন করেছিলেন? এই দলিলটি তিনি সংবিধানের অংশে পরিণত করতে সচেষ্ট হন। ১৫ আগস্টের প্রতি জিয়াউর রহমানের দৃষ্টিভঙ্গি মূল্যায়নের এটি একটি দালিলিক প্রমাণ। শুধু দালিলিক নয়, সাংবিধানিক প্রমাণ!
তবে এর তাত্পর্যের কাহিনি এখানেই শেষ নয়, এই সেই সামরিক ফরমান, যেখানে বাংলাদেশের সংবিধান পঞ্চম সংশোধনীর পর কাগজে-কলমে কার্যকর হওয়ার পরও সেখানে ছদ্মবেশী প্রধান সামরিক আইন প্রশাসককে টিকিয়ে রাখা হয়। পঞ্চম সংশোধনী পাসের পরেও জেনারেল জিয়া যাতে সব সময় সংবিধানের ওপরে থাকেন, সে জন্য একটি বিশেষ রক্ষাকবচ তৈরি করা হয়। কী পরিহাস, মুজিব কত বড় স্বৈরশাসক ছিল, সেই গল্প বিএনপির মুখে শুনতে হয়। ১৯৭৯ সালে জিয়া তাঁর সর্বশেষ ফরমানে লিখেন, ‘সংবিধান বা অন্য আইনে যা আছে তা সত্ত্বেও রাষ্ট্রপতি যেকোনো অসুবিধা দূর করার স্বার্থে সময়ে সময়ে আদেশ দিয়ে বিধান জারি করতে পারবেন।’ পাঠক লক্ষ করবেন, জিয়া এক হাতে সামরিক আইন তুললেন, সংবিধানের প্রাণ দিলেন আর চুপিসারে যা তিনি লিখে নিলেন, তার সরল মানে দাঁড়াল: পঞ্চম সংশোধনী পাস হলেও কুছ পরোয়ানা নেই। চেনা সাফারিতে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির লেবাস নিলে কি হবে, উর্দিটাই আসল। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের চাবিটা নেয় কে? আগের মতোই তিনি জাতির ‘অসুবিধা’ দূর করবেন। সময়ে সময়ে সংবিধানের শ্রাদ্ধ ঘটিয়ে হলেও নতুন বিধান দেবেন।
বিচারপতি খায়রুল হক তাঁর রায়ে মন্তব্য করেন যে ‘সংবিধান অগ্রাহ্য করে যখন খুশি তেমন আদেশ জারি করার ক্ষমতা বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির কখনো ছিল না। বাহাত্তরেও নয়, এখনো নয়। কিন্তু বাংলাদেশের তখনকার রাষ্ট্রপতির (জিয়া) হাতে ওই ক্ষমতা ছিল।’ কিন্তু তিনি যা বলেননি, সেটাই কাল্পনিক কবির লড়াইয়ে পঞ্চম সংশোধনী বিরোধী আইনজ্ঞরা তাঁদের প্রতিপক্ষের বন্ধুদের শুনিয়ে দিতে পারেন। সমর্থকেরা ঢাকঢোল পিটিয়ে ঈষত্ রঙ্গ করে বলতে পারেন, ‘‘আচ্ছা, তর্কে আপনাদেরই জিত হলো। মানলাম, আপনারাই বড় পণ্ডিত। কিন্তু এটা তো ঠিক যে, ওই ফরমানটা আপনাদের যুক্তিমতেই সংবিধানের অংশ। সত্য বটে শাসনপদ্ধতি বদলেছে। কিন্তু সেই আজব ফরমান তো রাষ্ট্রপতিকে সংজ্ঞায়িত করেনি। এখন বর্তমান রাষ্ট্রপতি যদি বলেন, আমি সেই ‘পবিত্র ফরমান’ অনুযায়ী ‘রাষ্ট্রপতি’ হব। জাতির ‘অসুবিধা’ দূর করব। সংবিধান বেঁটে উপযুক্ত বিধান দেব। তাহলে প্রতিপক্ষের বন্ধুরা কী বলবেন?’’ সেই কাল্পনিক লড়াইয়ের পর্বে পঞ্চম সংশোধনী সমর্থকদের একই সঙ্গে আরেকটি মোক্ষম দাওয়াই দিতে হবে। রাষ্ট্রপতির জারি করা উক্তরূপ ‘নতুন বিধানের’ বৈধতার প্রশ্নে আপনারা কী কহেন? আপনাদের এবং সংবিধানের কথামতোই এ বিষয়ে ‘কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না।’
এ রকম একটা কবির লড়াই এই তীব্র শীতে বেশ জমবে এবং দারুণ উপভোগ্য হবে বলেই কল্পনা করা চলে!
কখনো মনে হয়, পঁচাত্তরের পনেরো আগস্টে ফারুক-রশিদরা যে ট্যাংক বের করেছিলেন, সে ট্যাংক ফিরে গেছে, তাঁরাও পরপারে গেলেন, কিন্তু তাঁদের বন্দুকের নল আজও তাক করা। পঞ্চম সংশোধনীর রায় আপিলে টিকলে ওই ১৮ প্যারাগ্রাফ হয়তো বিলোপ হতে পারে। বিশিষ্ট সংবিধান-বিশেষজ্ঞ মাহমুদুল ইসলাম গতকাল আপিল বিভাগে আলোচ্য প্যারাগ্রাফটির সংযোজনকে ‘সংবিধানের সঙ্গে প্রতারণা’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রবর্তন থেকে সংবিধানের সঙ্গে এ যাবত্ যত প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে, তা এক রায়ে কিংবা আদালতে নিঃশেষ হওয়ার নয়। রায়ে যদি ১৮ নম্বর প্যারাগ্রাফের বিলোপ ঘটে, তাহলেও বন্দুকের নল তাক করা থাকবে। সেটা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ঘাতক ফারুক রহমানের সাবেক রানিংমেট জেনারেল এরশাদের বন্দুকের নল। ১৯ নম্বর প্যারাগ্রাফে বিএনপির নির্বাচিত সরকার উত্খাত-পরবর্তী আমলের (১৯৮২-১৯৮৬) সামরিক ফরমান ও আদেশগুলোকে অভিন্ন ভাষায় রক্ষাকবচ দেওয়া আছে। এই বন্দুকের নলও সরাতে হবে। এক এগারোতে পোড় খাওয়া রাজনীতিকদের আত্মমর্যাদার স্বার্থে বর্তমান সংসদেরই সেটা করা উচিত।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments