আমার ভাষা আমার একুশ-বানান নিয়ে আমরা সচেতন হব কবে by সৌরভ সিকদার

একুশে ফেব্রুয়ারির মাধ্যমে আমাদের বাংলা ভাষার জয়পতাকা উড়ছে আজ বিশ্বে। অথচ আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষা আমরা কজন শুদ্ধ বানানে লিখছি? সাইনবোর্ড, ব্যানার, বিজ্ঞাপন, সরকারি দপ্তরের নথি, সংবাদপত্র, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার খাতা থেকে শুরু করে পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বইয়ে পর্যন্ত বানান ভুলের ছড়াছড়ি। বাংলা বানানের নিয়ম আছে।


আমরা জানি না, জানার চেষ্টা করি না, জানলেও মানি না। সেই ১৯৩৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, এরপর ১৯৯৪ সালে বাংলা একাডেমী প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম করেছে, অথচ আমরা বাংলা লিখছি যে যার ইচ্ছেমতো। ঢাকার একটি সড়কের নাম গ্রিন রোড। কিন্তু এ সড়কের দুই পাশের নব্বই ভাগ সাইনবোর্ডে লেখা ভুল বানানে গ্রীণ/গ্রিণ/গ্রীন রোড। একই চিত্র স্টেডিয়াম পাড়ায়, সেখানে স্টেডিয়াম হয়েছে ‘ষ্টেডিয়াম’। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ডিন লেখা হচ্ছে ‘ডীন’, ইংরেজি লেখা হচ্ছে ‘ইংরেজী’। অথচ সব অতত্সম (বিদেশি তো বটেই) শব্দের ক্ষেত্রে ‘ ী, ূ, ষ, ণ’ (শুধু খ্রিষ্ট ছাড়া) প্রয়োগ নিষিদ্ধ করেছে প্রমিত বাংলা বানানবিধি। এ যদি হয় ঢাকা শহরের অবস্থা, তাহলে সারা দেশের বানানচিত্রের দশা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আর ‘নীরব’ নামের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই নীরবে লিখে যাচ্ছে ‘নিরব’। অথচ সেই ১৯৩৬ সালের সুপারিশে কাঠি, কেরামতি, পাগলামি হ্রস্ব-ইকার দিয়ে লিখতে বলা হলেও আমরা দীর্ঘ-ঈকার দিয়ে লিখেই যাচ্ছি। এমনকি অপ্রয়োজনে গাড়ি, বাড়ি, শাড়িতেও দীর্ঘ-ঈকার প্রয়োগ করছি। বাংলায় প্রকাশিত জাতীয় দৈনিকের দু-একটির কথা বাদ দিলে ভুল বানানের প্রতিযোগিতা চোখে পড়ে। শুধু ভুলই নয়, বিকৃত বানানেও লিখছেন কেউ কেউ। মাত্র ছয় পৃষ্ঠার ‘বাংলা একাডেমীর প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ কেউ পড়ার এবং মানার চেষ্টা পর্যন্ত করেন না।
একসময় বাংলা বানানের সমস্যা, সংস্কার, সমতা বিধান প্রভৃতি নিয়ে বহু বিতর্ক-বিশ্লেষণ হয়েছে। বাংলা বানান বিশারদ পবিত্র সরকার ভুল বানানের উত্স আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, বানান ভুলের প্রাথমিক উত্স ভাষার লিপিপদ্ধতি ও বর্ণমালা। এর সঙ্গে উচ্চারণ ও লিখনের মধ্যে অসংগতি এবং ‘বানানের সুনির্দিষ্ট গৃহীত রূপটি সম্পর্কে অজ্ঞতা’ (বাংলা বানান সংস্কার: সমস্যা ও সম্ভাবনা; ১৯৯২)। এই একুশ শতকে আমাদের ব্যবহারিক বাংলা বানান ভুলের প্রধান কারণ নিঃসন্দেহে ‘অজ্ঞতা’। না হলে ‘ষ্টেডিয়াম’ ‘গ্রীণ’ হবে কেন?
বানানের সঙ্গে শব্দার্থের সম্পর্ক রয়েছে। ভুল বানানের কারণে শব্দের অর্থের পরিবর্তন ঘটতে পারে, যা ভাষার ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করে। ‘তুমি কি খাবে’? এবং ‘তুমি কী খাবে’? এই দুই বাক্যের অর্থ দুই রকম। এখানে ক-এর পর কখন হ্রস্ব-ইকার এবং কখন দীর্ঘ-ঈকার হবে, তা না জানা থাকলে অর্থ-বিভ্রান্তি হবেই। আমরা মাতৃভাষা শুদ্ধ শেখার চেষ্টা করি না, লেখারও না। এ কারণে বাংলা বানানে ভুলের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের শিক্ষায় প্রমিত বাংলা ভাষাজ্ঞান লাভের স্থান সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ।
বাংলা বানান বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মাহবুবুল হক বাংলা বানানের বর্তমান সমস্যা ও করণীয় বিষয়ে আমাদের জানান, ‘এক সময় বাংলা বানানের সমস্যা ছিল, এখন নেই। বাংলা একাডেমী, পশ্চিমবঙ্গ আকাদেমি, পাঠ্যপুস্তক বোর্ড প্রমিত বানানের নিয়ম তৈরি করেছে এবং এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোনো বিভেদ নেই। নিয়ম মেনে চললেই সমাধান। বানান বিষয়ে আমাদের সচেতনতার অভাব রয়েছে। আমরা নতুন প্রযুক্তি নতুন কলম (বলপয়েন্ট) গ্রহণ করি, কিন্তু বানানের ক্ষেত্রে আগ্রহের অভাব তো বটেই, উদাসীনতাও রয়েছে। তাই এ বিষয়ে ব্যাপক প্রচারণা দরকার। কম্পিউটারে যারা কম্পোজ করে তাদের থেকে শুরু করে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পত্রিকা, সরকারি অফিস সবাই যদি প্রমিত বানানের নিয়ম মেনে চলি, তাহলেই হয়।’
বিশ শতকের বাংলা বানান রীতি কোনো ব্যক্তিবিশেষের উদ্ভাবিত সূত্র নয়। এই সংস্কারের ভিত্তি এবং প্রকৃতি ভাষাবৈজ্ঞানিক ও প্রগতিশীল, এমনকি এটি সর্বস্বীকৃতও। এর ফলে ভাষার ব্যবহার অনেক সহজ হয়েছে। তাই আমাদের উচিত, বাংলা বানানের নিয়ম মেনে চলা। সমাজের শিক্ষিত মানুষ হিসেবে আমরা যদি সচেতন হই, তাহলেই বাংলা ভাষা যেমন শুদ্ধ রূপ ফিরে পাবে, তেমনি গতিশীলও হবে।
সৌরভ সিকদার: অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.