অভিমত

কেন্দ্রীয় সরকারের বিপরীতে স্থানীয় সরকার ডেনমার্কের আয়তন ১৬ হাজার ৬৪০ বর্গমাইল, জনসংখ্যা প্রায় ৫৫ লাখ ৩২ হাজার। তার মধ্যে কোপেনহেগেন নগরের জনসংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ ১৯ হাজার। ওই সামান্য জনসংখ্যার দেশটিতে রয়েছে দুই ধরনের সরকার: কেন্দ্রীয় সরকার ও স্থানীয় সরকার।


কেন্দ্রীয় সরকার একটি। স্থানীয় সরকার ৯৮টি। এগুলো নগর সরকার।
বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি, এখানে সরকার মাত্র একটি এবং সে সরকার অতিমাত্রায় কেন্দ্রীভূত কেন্দ্রীয় সরকার। এখানে স্থানীয় সরকার বলতে কার্যত কিছু নেই। যা আছে সেটাকে, আকবর আলি খানের ভাষায়, বলা যায় কেন্দ্রীয় সরকারের শাখা।
গত বছর ১৭ অক্টোবর রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘নগরায়ণে ভবিষ্যত্ পরিকল্পনা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন, কয়েকজন খ্যাতনামা প্রকৌশলী, স্থপতি, পরিকল্পনাবিদ, উন্নয়নকর্মী, রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের অধিকাংশই নগর উন্নয়নে সিটি করপোরেশন, রাজউক, ওয়াসা, ডেসা, ফায়ার সার্ভিস, গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ, গণপূর্ত নামে সরকারের যে প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে সেগুলোর সমন্বয়ের কথা বলেছেন। কেউই একক নগর কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠার জন্য অধুনিক ‘নগর সরকার’ব্যবস্থা বাস্তবায়নের কথা বলেননি। মেয়র সাদেক হোসেন বলেন, ‘সরকারি বিভিন্ন সংস্থার কাজের মধ্যে সমন্বয়ের জন্য মেট্রোপলিটন গভর্নমেন্টের প্রয়োজনীয়তার কথা আমার আগে দায়িত্ব পালনকারী মেয়র সাহেব বলেছেন, আমিও বিষয়টির গুরুত্ব বিভিন্ন ফোরামে বিভিন্ন সময় উপস্থাপন করেছি।’ আর গত ৬ জানুয়ারি চট্টগ্রামের মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী এক জনসভায় বলেন, ‘সিটি গভর্নমেন্ট করব—এটা আমার নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল।’ মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল, মেট্রোপলিটন গভর্নমেন্ট ইত্যাদির কথা বলা হলেও সেগুলো বাস্তবায়নের রূপরেখা স্পষ্ট করা হচ্ছে না।
স্থানীয় সরকার ও গণতন্ত্রায়ণবিষয়ক গবেষক আবু তালেব ১৯৯৭ সালের ১৩ জানুয়ারি ঢাকায় ‘স্বশাসিত স্থানীয় সরকার, গণতন্ত্রের অন্যতম ভিত’ শীর্ষক এক সেমিনারে নগর সরকারের রূপরেখা উপস্থাপন করেন। বলা হয়, প্রত্যেক নগরে তিনটি বিভাগ নিয়ে একটি নগর সরকার গঠিত হবে: বিধানিক বিভাগ বা নগর সংসদ, নগর নির্বাহিক বিভাগ ও বিচারিক বিভাগ বা নগর আদালত। নগর বিধানিক বিভাগ নগর সাংসদদের সমন্বয়ে গঠিত হবে। মেয়র ভোটারদের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। তাঁর পদ হবে পূর্ণকালীন। তিনি নগর নির্বাহিক বিভাগের প্রধান। বিচারিক দায়িত্ব আলাদাভাবে নির্বাচিত কিংবা মনোনীত ব্যক্তিবর্গের ওপর ন্যস্ত থাকবে। নগর সরকারের বাইরে নির্বাচনিক বোর্ড থাকবে, যার মাধ্যমে নগরের সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করা হবে। নগর ন্যায়পাল থাকবেন, যিনি নির্বাচিত ও অনির্বাচিত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ মীমাংসা করবেন। নগর সরকারের মেয়াদ হবে চার বছর।
প্রতিটি নগর সরকার অর্থাত্ পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনগুলো স্বয়ংসম্পূর্ণ স্থানীয় সরকার ইউনিট হিসেবে কাজ করবে। তারা নিজেদের বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করবে, তাদের থাকবে নিজস্ব আয়-ব্যয়ের স্বাধীনতা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানসহ যাবতীয় দায়িত্ব যা বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে তার জেলা-উপজেলার দপ্তরগুলোর মাধ্যমে পালিত হয়, সেগুলো পালন করবে নগর সরকার। নগর সরকারগুলোর সব কাজের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা নাগরিকদের পক্ষে অনেক সহজ হবে। এভাবে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটবে এবং শক্তিশালী স্থানীয় সরকারব্যবস্থার মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিত করা সহজতর। রাজনৈতিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও আসবে বিরাট ইতিবাচক পরিবর্তন।
মোশাররফ হোসেন, পাবনা।
musharraf_pcdc@yahoo.com

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রচার প্রয়োজন
আমরা কিছু দিন আগে ‘ভোরের স্বপ্নে’ নামের একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক চলচ্চিত্র, প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। যদিও কয়েক জায়গায় দেখানোর পর প্রক্ষেপণ যন্ত্রের অভাবে আর সম্ভব হয়নি, তবে যে কদিন প্রর্দশনী চলেছে, অনেক মানুষ অবাক হয়ে দেখেছে। কেউ কেউ বলেছে, ‘আমরা তো আগে কখনো এসব দেখিনি। এত দিন এসব দেখানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি কেন?’ এক কলেজছাত্র আমাদের বলেছেন, ‘ভাই, আল-বদরের চেহারাটা একটু দেখান তো। তাকে কোনো দিন দেখিনি।’ তার ধারণা, আল-বদর কোনো ব্যক্তির নাম।
এ দেশের প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী সব সময় স্বাধীনতা-সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরির চেষ্টা চালিয়ে এসেছে।
গ্রামের সহজ-সরল মানুষ মুক্তিযুদ্ধ, লাখ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ সম্পর্কে অনেক কিছু জানে না। এ জন্য যেমন দায়ী ইতিহাস বিকৃতকারীরা, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিগুলোর উদ্যোগহীনতাও কম দায়ী নয়। সব প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সব ধরনের সংগঠনের কাছে অনুরোধ, আপনারা এসব প্রামাণ্যচিত্র দেশের প্রতিটি স্কুল, কলেজ ও গ্রামের জনসমাগম হয় এমন জায়গায় দেখানোর ব্যবস্থা করুন। হানাদার বাহিনী, রাজাকার ও আল-বদরেরা কী নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল, এ দেশের মানুষ তার বাস্তব চিত্র দেখুক। রাজাকার, আল-বদরদের এ দেশের মানুষ চিনুক-জানুক। সময় এসেছে প্রতিটি মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস জানানোর ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার।
শাহাজান সিরাজ
কক্সবাজার।

পর্যটনশিল্পকে খোলসের বাইরে আনতে হবে
পর্যটনশিল্প নিয়ে নানা মহলে আলোচনা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি সংসদে এক সাংসদের সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে কিছু ভবিষ্যত্ পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন। যেমন, বিদেশিদের জন্য বিশেষ পর্যটন এলাকা গঠন, পর্যটন আইন ও পর্যটন বোর্ড প্রতিষ্ঠা, পর্যটন পুলিশকে আরও গতিশীল করা, পর্যটন খাতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে নানামুখী কর্মসূচি নেওয়া, পর্যটনশিল্পের মাধ্যমে আরও বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য বিমোচন ইত্যাদি।
সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে নির্দেশনা এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হলে পর্যটনশিল্পে উন্নয়ন হওয়া সম্ভব; যেমনটি ঘটেছে মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ নানা দেশে। প্রধানমন্ত্রীর উল্লিখিত পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ শুরু করা প্রয়োজন। পর্যটনমন্ত্রী জি এম কাদের পর্যটনশিল্পের উন্নয়নের প্রতি মনোযোগী বলেই মনে হচ্ছে। সরকারের এক বছর পূর্তির সময় তিনি সরকারের যেসব ভাবনা ও কর্মসূচির বিবরণ দিয়েছেন, তা উত্সাহব্যঞ্জক।
আমাদের পর্যটন মন্ত্রণালয় ঘোষণা দিয়েছে, সাউথ এশিয়ান গেমস উপলক্ষে ফেব্রুয়ারি পর্যটন মাস হিসেবে পালিত হবে। এই ক্রীড়া উত্সবে অনেক বিদেশি খেলোয়াড় ও সাংবাদিক এসেছেন, আসছেন। এ দেশের পর্যটনশিল্পের নানা দিক তুলে ধরার উদ্দেশ্যে শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরি চত্বরে পর্যটন মেলা আয়োজনের খবরও জানা গেল। এ সবই আশার দিক। আমরা যারা পর্যটনশিল্পের সঙ্গে জড়িত, তারা এই সরকারের সময় পর্যটনশিল্পের উন্নয়নের ব্যাপারে বিশেষভাবে আশাবাদী। আমরা চাই, আমাদের পর্যটনশিল্প তার পুরোনো খোলস থেকে বের হয়ে নতুনরূপে বিকশিত হোক। বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন, প্রচুর কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সেবা খাতের প্রসার, সর্বোপরি বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার ক্ষেত্রে পর্যটনশিল্প অবশ্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, যদি এই শিল্পটিকে সঠিকভাবে বিকশিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
তৌফিক রহমান
ঢাকা।

খলনায়কদের বিরুদ্ধে লড়াই
১২ জানুয়ারি ‘বাংলাদেশের তিন নায়ক’ শিরোনামের লেখায় সোহরাব হাসান সঠিকভাবে তুলে এনেছেন ২০০৯ সালে আমাদের অর্থনীতির প্রধান তিন চালক—কৃষক, শিল্পশ্রমিক ও প্রবাসীশ্রমিকদের অর্জনের কথা। আরও কিছু বিষয়ের অবতারণা করার উদ্দেশ্যে আমার এ লেখা।
লেখাটিতে যথার্থভাবে বলা হয়েছে, এখনো আমাদের অধিকাংশ প্রবাসীশ্রমিক অদক্ষ। ৪০ বছরে এ অবস্থার বিশেষ উন্নতি হয়নি। কেবল প্রচুর কথা শোনা গেছে, কাজের কাজ কিছুই হয়নি। কোনো সরকার মানবসম্পদের উন্নয়নে নীতি প্রণয়ন করেনি; প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে ব্যবস্থা নেয়নি।
বিপুলসংখ্যক শ্রমিক ও কারিগরকে নানা পেশায় প্রশিক্ষিত করা গেলে বর্তমানে তাঁদের আয়ের পাঁচ থেকে ১০ গুণ বেশি উপার্জন করতে সক্ষম হতেন তাঁরা। নির্মাণশ্রমিক, প্লাম্বার, ইলেকট্রিশিয়ান, টাইল লেয়ার ও সূত্রধরের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা গেলে বা মেডিকেল টেকনিশিয়ান যেমন, সেবিকাদের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মান ও যোগ্যতাসম্পন্ন হিসেবে তৈরি করা গেলে তা সম্ভব। বর্তমানে যেসব পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট আছে, সেগুলোকে ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে রূপান্তর (বা নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি) করা যেতে পারে; যেখান থেকে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো ও মধ্যপ্রাচ্যে স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য মানবসম্পদ তৈরি করা সম্ভব হয়। এ কাজে দাতা সংস্থাগুলোর সহায়তাও নেওয়া যায়। সম্ভাব্য চাকরির বাজার লক্ষ্য করে ইংরেজি, আরবি ও অন্যান্য ভাষায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও সরকারি উদ্যোগে নিতে হবে। ইংরেজি ভাষায় দক্ষ ও আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেবিকারাই এককভাবে প্রতিবছর কোটি কোটি ডলার আয় করতে পারবেন।
সোহরাব হাসানের লেখাটিতে যথার্থভাবেই ‘খলনায়ক’দের কথাও উঠে এসেছে। সরকারের লাল ফিতা পয়লা নম্বর ‘খলনায়ক’। এটি সব ক্ষেত্রে উন্নতির সবচেয়ে বড় বাধা। শিল্পায়ন থেকে রপ্তানি—সব ক্ষেত্রই এর দ্বারা আক্রান্ত। মানবসম্পদ রপ্তানি এর বাইরে নয়।
তরুণ বয়সে প্রকৌশলী হিসেবে সত্তর ও আশির দশকের শুরুর দিকে মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করে আমি দেশে ফিরি। তখন পেশা হিসেবে বেছে নিই বাংলাদেশে জ্বালানিসাশ্রয়ী সোডিয়াম বাতি নিয়ে আসাসহ বেশ কিছু নতুন প্রযুক্তির ব্যবসা। একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানও স্থাপন করি। নিজ দেশে সত্ভাবে, সম্মানের সঙ্গে বাঁচার চেষ্টা চালিয়ে গেছি। চেষ্টা করেছি একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করতে (কিন্তু বারবার ডিক্লারেশন না পেয়ে ফিরতে হয়েছে)। ১৬ বছর এসবের চেষ্টা চালিয়ে প্রথমে আমি নিউজিল্যান্ড ও পরে অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসী হই। যে বাংলাদেশের জন্য কিশোর বয়সে আমি লড়াই করেছি, জীবন বাজি রেখেছি, সেই দেশ নিয়ে আমার এতটাই মোহমুক্তি ঘটে যে ১৩ বছর আমি আর বাংলাদেশে যাই না। আমাদের স্বপ্ন আজ পরিণত হয়েছে হতাশায়, দুঃস্বপ্নে। আমাকে হয়তো পাঠক সংগতভাবেই পলায়নবাদী মনে করবেন; কিন্তু তাঁদের এটাও স্বীকার করতে হবে যে আমরা (আমার মতো বহু মানুষ আছেন) ‘খলনায়ক’দের বিরুদ্ধে লড়েছি, কিন্তু সে লড়াইয়ে আমরা জিততে পারিনি।
সাঈদ চৌধুরী, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।

প্রাথমিক শিক্ষকদের সমস্যা
প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ ২০০৯-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদ্যমান পাঠ্যক্রমকে বয়সের তুলনায় বোঝা হিসেবে অভিহিত করে এর পরিসর কমিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছে বলেছেন, সুবিশাল পরিসরের পাঠ্যসূচি ও বেশি বেশি বই হলেই শিশুদের সুশিক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত হবে না। একদিকে তাদের পাঠ্য বিষয়বস্তু হবে সংক্ষিপ্ত ও কার্যকর এবং অন্যদিকে তাদের শেখানোর পদ্ধতি হতে হবে মজার ও আনন্দদায়ক। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন, ‘প্রচুর বই দিয়ে আমরা আশা করতে পারি না যে শিশুরা পণ্ডিত হয়ে যাবে।’
বিগত সরকারগুলোর আমলে টাকার অভাবের অজুহাত দেখিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের অর্ধেক পুরোনো বই দেওয়া হতো। দীর্ঘদিনের পুরোনো বই ছেঁড়া থাকত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার এবার প্রথম থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত বিনা মূল্যে নতুন বই দিয়েছে। সরকার ২০০৯ সালে স্বল্পসময়ে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা সন্তোষজনকভাবে সমাপ্ত করে শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করার এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেয়। এতে সারা দেশে প্রাথমিক শিক্ষায় ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে।
বর্তমান সরকার জাতীয় শিক্ষানীতি ঘোষণা করেছে। পঞ্চম শ্রেণী সমাপ্ত হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি দিতে হবে না। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক করা হয়েছে। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষকদের সম্মানজনক বেতন-ভাতা দেওয়া হচ্ছে না। স্বাধীনতার পর থেকে প্রাথমিক শিক্ষকদের সঙ্গে অন্যান্য মাধ্যমের শিক্ষক-কর্মচারীদের বিশাল বেতনবৈষম্য চলে আসছে। বিগত সরকারের আমলে আন্দোলনের মুখে শিক্ষকদের ন্যূনতম বেতন বাড়ানো হয়। সহকারী শিক্ষকদের তিন হাজার টাকার স্কেল তিন হাজার ১০০ টাকা করা হয়। বেতন নির্ধারণী প্রক্রিয়ায় জটিলতা সৃষ্টি করে শতকরা ৮০ জন শিক্ষকের বেতন কমিয়ে ন্যূনতম দুই হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা ওভারড্রন করানো হয়। বিগত বিএনপি, তত্ত্বাবধায়ক ও বর্তমান সরকারের আমলে বহু আবেদন-নিবেদন, পত্রিকায় লেখালেখি করেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি। বেতন স্কেল বৃদ্ধি করার পর বেতন কমে যায়—এই নজির প্রাথমিক শিক্ষকদের ক্ষেত্রে সৃষ্টি করা হয়েছে। উচ্চশিক্ষিত বিএড বা এমএড পাস শিক্ষকদের প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতির জটিলতা আজও নিরসন হয়নি। বহু জেলায় বিএড বা এমএড পাস শিক্ষকেরা পদোন্নতি পেয়েছেন। ফলে শিক্ষকদের মধ্যে সরাসরি নিয়োগে প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হলেও ১৫ থেকে ৩০ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা নিয়েও প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি না পেয়ে শিক্ষকদের হতাশা ও ক্ষোভ দিন দিন বাড়ছে। অন্যদিকে প্রকল্পের অধীন বহু শিক্ষক জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অসতর্কতা ও অসাবধানতায় জ্যেষ্ঠতা পাননি। জ্যেষ্ঠতার খোঁড়া অজুহাত দেখিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রধান শিক্ষকদের পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। বিষয়টি দীর্ঘদিন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তহীনতায় পড়ে আছে।
প্রাথমিক শিক্ষকেরা স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের নামে বিগত সময়ের মতো শুভঙ্করের ফাঁকি দেখতে চান না। তাঁরা বৈষম্যহীন সন্তোষজনক বেতন স্কেল চান। বিগত সময়ে প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণীর মর্যাদা না দিয়ে ক্ষমতাসীনেরা শুধু বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন। আর কোনো আশ্বাস নয়, আমরা চাই সমস্যার সমাধান।
মো. সিদ্দিকুর রহমান
সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি।

হুজুগে বাঙালির জলবায়ু-দর্শন
হুজুগে বাঙালি বলে পুরো একটি জাতিগোষ্ঠীকে দাগিয়ে দেওয়ার ব্যাখ্যা আমার জ্ঞানকাণ্ডের শিক্ষার সঙ্গে যায় না। তার পরও খুব একটা ভুল বলছি বলে মনে হচ্ছে না। কারণ, আমাদের হুজুগের মাত্রা এমন একটা পর্যায়ে চলে গেছে যে তা এখন আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সব নীতির মূল চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার সমাজ ও স্বাস্থ্য বিষয়ে পড়াশোনা করতে জার্মানির হাইডেলবার্গ নামের একটি শহরে ছিলাম বছর দেড়েক। সেখানে প্রবাসী বাঙালিদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়মিত অংশগ্রহণকারী হয়ে উঠি। সেসব অনুষ্ঠানের একটা বড় দিক থাকে দেশের রাজনীতি ও ভবিষ্যত্ নিয়ে। একটা ভবিষ্যত্ ভাবনা ছিল দেশের ডুবে যাওয়া নিয়ে। একজন আমাকে পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝালেন, ২০৭১ সালে বাংলাদেশ নামের কোনো দেশ এই পৃথিবীর বুকে থাকবে না। স্বাধীনতার মাত্র ১০০ বছরের মধ্যে এ রকম একটা চরম মৃত্যু আমি কোনোভাবেই মেনে নিচ্ছিলাম না। তখন তিনি আমাকে স্থানীয় টেলিভিশনে প্রচারিত নানা অনুষ্ঠানের সূত্র দিয়ে বোঝালেন, এখন থেকে আগামী কোন সালে আমরা কতটা ডুবব। তিনিসহ আরও অনেকে, যাঁদের জার্মানির পাসপোর্ট হয়েছে, তাঁদের দেখলাম বেশ একটা স্বস্তিভাব। দেশ ডুবলেও তাঁদের থাকার জায়গা তো আছে। একজন তো বলেই বসলেন, তিনি দেশে টাকা পাঠানো বন্ধ করেছেন এবং দেশে যে জমি কিনেছিলেন, তাও বিক্রি করে টাকা জার্মানিতে নিয়ে নেবেন। আমাকেও পরামর্শ দেওয়া হলো জার্মানিতে স্থায়ীভাবে বসবাসের পথ খুঁজতে। প্রবাসীদের এ রকম ভাবনা আমাকে চিন্তিত করে তুলেছিল।
কিন্তু না। দেশে এসে দেখি, প্রবাসী ওই ভাইটির চেয়ে এগিয়ে আছেন আরও অনেকে। ২০৭১ তো অনেক দূর—এত দেরি সহ্য হচ্ছে না, যত তাড়াতাড়ি পারা যায় দেশ ডোবাতে হবে। দেশ ডুবলেই যেন মঙ্গল। সভা, সমিতি চলছে, ঢাকঢোল পেটানো হচ্ছে—কবে, কখন কতটা ডুবল, তা নিয়ে। সব নীতিতে জলবায়ু যেন এক নম্বর বিষয় হিসেবে যোগ হয়, তার জোরালো নীতি প্রণয়ন চলছে। আমরা যারা তথাকথিত সামাজিক গবেষণা দিয়ে পেট চালাই, তারা অনেকে সামাজিক গবেষণায় এক নম্বর বিষয় হিসেবে বেছে নিচ্ছি জলবায়ু। এক বন্ধু দীর্ঘদিন এইডস নিয়ে দুই পয়সা রোজগার করছিল। হঠাত্ করে একদিন পরামর্শ চাইল, এইডস বাদ দিয়ে জলবায়ু ধরবে কি না। এই যখন পরিস্থিতি, তখন কি আর হুজুগে কান না দিয়ে বসে থাকা যায়? আমরাও তাই গবেষণা করব, প্রতিবেদন লিখব—যেভাবে হুজুগে পড়ে আমরা অনেকেই মেতে উঠি এইডস নিয়ে, নির্দিষ্ট একটা মৌসুমে মাঠ গরম করি মঙ্গা নিয়ে। যেভাবে আমরা আবেগাপ্লুত হই সংস্কার আর উন্নয়ন নিয়ে; আবার থেমে যাই অন্য কোনো স্লোগান এলে, সেভাবেই আমরা মজেছি জলবায়ুর হুজুগে। হিসাব কষছি কত এল, আর কে কত পেল। আর কত আসছে, কোন দিকে সেটা যাচ্ছে। জলবায়ুর গতিপথ যা-ই হোক না কেন, আমাদের গতিপথে জলবায়ুর জল ও বায়ু বের করেই ছাড়ব।
মুজীবুল আনাম লাবীব, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

রংপুর বিভাগ: উন্নয়নই হোক চূড়ান্ত লক্ষ্য
রংপুর বিভাগ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে প্রায় দেড় কোটি মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হলো। এখন শুধু প্রশাসনিক সুবিধা বাড়লেই চলবে না, আসলে প্রয়োজন অর্থনৈতিক উন্নয়ন।
সর্বপ্রথম রংপুর বিভাগকে দেশের কৃষিভিত্তিক বিশেষ অর্থনৈতিক জোন গঠনের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। কেননা রংপুরের যেমন আছে অদম্য জনশক্তি, তেমনি আছে উর্বর ভূমি। বিপণন ও সংরক্ষণ অব্যবস্থাপনার কারণে প্রতিবছর রংপুরে আলু, কলা, সবজিসহ কয়েক কোটি টাকার রবিশস্য নষ্ট হয়। ক্ষেত থেকে নষ্ট ফসল তুলতে না পারায় মৌসুমি চাষাবাদ বন্ধ রাখার ঘটনাও ঘটছে। অথচ ১০ বছর ধরে পতিতপ্রায় অবস্থায় পড়ে আছে উত্তরা ইপিজেড।
রংপুরের নীলফামারী জেলায় ২৩০ দশমিক ২১ একর এলাকাজুড়ে প্রতিষ্ঠিত উত্তরা ইপিজেডে ১৫৫টি ইন্ডাস্ট্রি প্লান্ট নির্মাণ করা হয়েছে। প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য ১৮ হাজার বর্গমিটার এলাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। প্রকৌশলী, কর্মকর্তা ও তাদের আবাসন ব্যবস্থাসহ ইপিজেড হিসেবে যেসব সুযোগ-সুবিধা থাকা দরকার তার কোনোটির কমতি নেই। তবু ১৫৫টি প্লান্টের মধ্যে শতাধিক আজও ফাঁকা পড়ে আছে। শ্রমিকের সংখ্যা কমতে কমতে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ৭১ জনে দাঁড়িয়েছে।
উত্তরা ইপিজেডের ভগ্নদশার কারণ দুটি: গ্যাস সরবরাহ না থাকা এবং স্থানীয় স্থলবন্দরগুলো বন্ধ করে রাখা। গ্যাস সরবরাহ না থাকায় স্থানীয়ভাবে শিল্প কারখানা গড়ে উঠছে না। আবার বিভিন্ন স্থানের উত্পাদিত পণ্য এখানে এনে প্রক্রিয়াজাত করে আবার ৬৫০ কিলোমিটার দূরত্বে চট্টগ্রাম বন্দর বা ৫৮৬ কিলোমিটার দূরে মংলা বন্দর থেকে রপ্তানিতে পরিবহন ব্যয় অনেক বেশি হওয়ায় শিল্পোদ্যোক্তারা উত্তরা ইপিজেডের প্রতি আগ্রহী হচ্ছেন না। অথচ ৫০ কিলোমিটার কম দূরত্বের চিলাহাটি এবং ১০০ কিলোমিটারের কম দূরত্বে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এখানে কৃষিভিত্তিক শিল্পকে কোনোভাবে উত্সাহিত করা হয়নি। হলে মাঝারি উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে এগিয়ে আসতেন। রক্ষা হতে পারত বিপণন ও সংরক্ষণ অব্যবস্থাপনার কারণে আলু, কলা, সবজিসহ কয়েক কোটি টাকার নানা ধরনের রবিশস্য। সৃষ্টি হতো লাখ মানুষের কর্মসংস্থান। মঙ্গার কালিমা দূর করার একটি বড় উপায় হতে পারত উত্তরা ইপিজেড।
বিভাগ বাস্তবায়নের ফলে রংপুর অঞ্চলের পরিশ্রমী মানুষ তাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট পাল্টে দিতে প্রস্তুত। তাদের প্রস্তুতিকে কাজে লাগিয়ে জাতীয় উন্নয়নের গতি বাড়াতে হবে সরকারকে। এ জন্য শিল্পায়নের স্বার্থে কমপক্ষে উত্তরা ইপিজেড পর্যন্ত গ্যাস সংযোগ সম্প্রসারণ করতে হবে। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পরও বন্ধ হয়ে থাকা রংপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় চালু করে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য উচ্চতর কারিগরি ও প্রকৌশল শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। ঐতিহ্যবাহী সৈয়দপুর বিমানবন্দরের উন্নয়ন ও নিয়মিত বিমান যোগাযোগ নিশ্চিত করতে হবে। প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যগুলো সংরক্ষণের পাশাপাশি পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তুলে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দ্বার উন্মোচন করতে হবে। তিস্তার পানি বণ্টন বিষয়ে ভারতের সঙ্গে চুক্তির বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত প্রতিবছর তিস্তা ব্যারেজের জন্য অকার্যকর ক্যানেল কাটা বন্ধ করে কৃষিজমি রক্ষা এবং অর্থের অপচয় রোধ করতে হবে।
আগামী ১৫-১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দ্বিতীয় দারিদ্র্য নিরসন কৌশলপত্র (পিআরএসপি) ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং পরিপ্রেক্ষিত-২০২১ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ উন্নয়ন ফোরামের (বিডিএফ) বৈঠক। বৈঠকে আঞ্চলিক উন্নয়নবৈষম্য রোধ ও ন্যায্য উন্নয়নের মাধ্যমে সারা দেশের অভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা গৃহীত হবে বলে দেশবাসী আশা করে। এ বৈঠকেই রংপুর বিভাগের ন্যায্য উন্নয়নের বিষয়গুলোর সুরাহা করা হোক।
রানা ভিক্ষু, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.