বিশেষ সাক্ষাত্কার-সাংবিধানিক জগাখিচুড়ির অবসান ঘটতে যাচ্ছে by টি এইচ খান ও মাহ্বুবে আলম

সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সম্প্রতি পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে দেওয়া হাইকোর্ট বিভাগের রায় বহাল রেখেছেন। এ বিষয়ে বিশিষ্ট আইনজীবী টি এইচ খান ও অ্যাটর্নি জেনারেল মাহ্বুবে আলমের সাক্ষাত্কার ছাপা হলো। গত শুক্রবার সাক্ষাত্কার দুটি নেওয়া হয়েছে।


সাক্ষাত্কার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান
প্রথম আলো  আপিল বিভাগ লিভ মঞ্জুর করলেন না। খারিজ করলেন। এখন তাঁরা পরিমার্জন করবেন। এটা কি ত্াদের রায়, না আদেশ বলে গণ্য হবে?
মাহ্বুবে আলম  অবশ্যই রায়।
প্রথম আলো  এর কোনো সময়সীমা আছে কি না। এটা আমরা কবে পেতে পারি?
মাহ্বুবে আলম  আদেশ তো প্রচারিত হয়েছে। এ ধরনের মামলায় হয়তো অনেক সময় মাসখানেক লেগে যায়। অনেক সময় বেশিও লাগতে পারে। এটা যেহেতু একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা, তাই বিচারপতিদের কাছে অনুরোধ হবে, যাতে তাড়াতাড়ি এর রায় বের হয়।
প্রথম আলো  লিভ যেহেতু খারিজ হয়েছে, তাই আমরা কি ধরে নিতে পারি যে হাইকোর্টের রায় আপিল বিভাগ সমুন্নত রেখেছেন? পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হয়েছে—এ কথা আমরা চূড়ান্তভাবে বলতে পারি কি না?
মাহ্বুবে আলম  অবশ্যই। যদি হাইকোর্টের রায়ে তাঁরা হস্তক্ষেপ করতে চাইতেন, তাহলে তো তাঁরা লিভ দিতেন। প্রতীয়মান হচ্ছে যে হাইকোর্টের রায়টাই তাঁরা অব্যাহত রেখেছেন।
প্রথম আলো  কিন্তু ১০ জন বিচারকের সাম্প্রতিক মামলায় আমরা দেখলাম, তাঁরা লিভ মঞ্জুর না করেও হাইকোর্টের রায়ের বড় পরিবর্তন ঘটালেন। জ্যেষ্ঠতা দেননি। তা ছাড়া বিচারক নিয়োগের নীতি উল্লেখযোগ্যভাবে বদলে দেন। সুতরাং একটা আশঙ্কা আছে। মওদুদ আহমদ বলছেন যে হাইকোর্টের রায় পরিমার্জনের যথেষ্ট সুযোগ আছে। আমরা অপেক্ষায় আছি, আপিল বিভাগ কী সিদ্ধান্ত দেন। আপনার কী মত?
মাহ্বুবে আলম  আবেদনকারীর আইনজীবীরা পাঁচ দিন শুনানিতে অংশ নেন। আমরা যুক্তি নিবেদন করেছি অর্ধেক দিন। ১০ জন বিচারকের ব্যাপারে আমাদের আপিল বিভাগ মূল নীতি ঠিকই রাখলেন। হাইকোর্ট বলেছিলেন দ্বিতীয়বার শপথ নিতে হবে না। আপিল বিভাগ বলেছেন, এটা লাগবে। শপথ নেওয়ার প্রশ্ন এল, তাই তাঁরা জ্যেষ্ঠতা পেলেন না।
প্রথম আলো  সামরিক ফরমান দিয়ে আনা কিছু সংশোধনী হাইকোর্ট মার্জনা করেছেন। কিছু বিষয় করেননি। এখন আপিল বিভাগ কি এখানে হেরফের ঘটানোর এখতিয়ার রাখেন?
মাহ্বুবে আলম  নিশ্চয় রাখেন। রাখবেন না কেন? কিন্তু শুনানির সময়ে প্রশ্নোত্তরে যা প্রকাশ পেয়েছে, তাতে এ রকম মনে হয় না। বড় প্রশ্ন যেটি ছিল তা হলো, গণপরিষদ সংবিধান তৈরি করেছে। পরে সংসদ যদি পরিবর্তন আনতে চায়, আনবে। কিন্তু সামরিক ফরমান দিয়ে তা করা যায় কি যায় না? সংবিধান তখন স্থগিত বা বাতিল করা হয়নি। সুতরাং প্রশ্ন হলো, ফরমান দিয়ে সংবিধানের কোনো বিধান পাল্টানো যায় কি না? কথিত পঞ্চম সংশোধনী বলল, ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ থেকে ৯ এপ্রিল ১৯৭৯ পর্যন্ত জারি করা সব ফরমান বৈধ। এখানে যদি নির্দিষ্টভাবে সংবিধান সংশোধনের কথা বলা হতো, তবু না হয় একটা কথা ছিল। উপরন্তু সামরিক শাসন বহাল রেখে পঞ্চম সংশোধনী পাস হলো। সামরিক আইন থাকলে সংসদ কী করে চলে? এ রকম জগাখিচুড়ি জাতির ওপর চাপিয়ে রাখা একটি অবিশ্বাস্য ঘটনা।
প্রথম আলো  আমাদের জিজ্ঞাসা হলো, আপনি কি মার্জনার জায়গায় কোনো পরিবর্তন আশা করেন?
মাহ্বুবে আলম  শুনানিকালে একজন মাননীয় বিচারক আবেদনকারীদের প্রশ্ন করেছিলেন যে তাঁরা মার্জনার বিষয়ে যুক্তিতর্ক পেশ করবেন কি না। যেমন হাইকোর্ট ফরমান দিয়ে আনা ৯৫ অনুচ্ছেদের কিছু অংশের সংশোধন মার্জনা করেছেন। তাঁরা এর পরিধি বাড়ানো-কমানো নিয়ে যুক্তিতর্ক দেবেন কি না। কিন্তু তাঁরা তো সেদিকে যাননি। মার্জনার বিষয়ে তাঁরা একটা কথাও বলেননি।
প্রথম আলো  তাঁরা কি নির্দিষ্ট কোনো অনুচ্ছেদ নিয়ে কথা বলেননি?
মাহ্বুবে আলম  না, তাঁরা তা করেননি। তাঁরা একটা কথাই বলেছেন যে এটা একটা রাজনৈতিক বিষয়, এটা বিচার বিভাগের কাজ নয়। যেমন হাইকোর্ট কিন্তু বিসমিল্লাহ প্রশ্নে কোনো বক্তব্য দেননি। কিন্তু তাঁরা শুনানিতে এ বিষয়েও কোনো বক্তব্য দেননি। একটাই কথা তাঁদের, এসব ফরমানের বৈধতা এত কাল কেউ চ্যালেঞ্জ করেনি। জাতি এসব মেনে নিয়েছে। এখন আপনারা হস্তক্ষেপ করবেন কেন?
প্রথম আলো  পঞ্চম সংশোধনী কেন অসামঞ্জস্যপূর্ণ?
মাহ্বুবে আলম  এটা ছিল একটা প্রতারণা। প্রথমত দেখুন, জিয়া গণভোট করলেন। কিন্তু সংবিধান সংশোধনের প্রশ্ন গণভোটে দিলেন না। কিন্তু নিজের খেয়ালে যে সংশোধনী আনলেন, তা যাতে রক্ষা পায়, সে জন্য গণভোট দিয়ে আটকাতে চাইলেন। দ্বিতীয়ত, সংবিধানে বলেছে, বাংলা ও ইংরেজি পাঠের মধ্যে বিরোধ হলে বাংলা পাঠ প্রাধান্য পাবে। কিন্তু ১৯৭৭ সালে সংবিধানের পরিবর্তন কেবল ইংরেজি ভাষ্যে করা হলো। ১৯৭৮ সালে সেই ভাষ্যে নতুন কিছু যোগ করে বাংলা করা হলো। তৃতীয়ত, ৫ এপ্রিলের রাত সোয়া নটায় পঞ্চম সংশোধনী পাস হলো। পরদিন রাত আটটা থেকে সামরিক আইন চলে গেল। এখন দেখেন, পঞ্চম সংশোধনীতে বলা হলো, ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ থেকে ৯ এপ্রিল ১৯৭৯ পর্যন্ত সামরিক ফরমান বৈধ হবে। এর মানে সার্বভৌম সংসদ থাকা সত্ত্বেও এর ওপর তাঁর (জিয়াউর রহমান) কোনো ভরসা ছিল না। তাই সামরিক আইন উঠে যাওয়ার পরও সামরিক ফরমান যদি লাগে, সেই ভয়ে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত তারিখ হাতে রাখলেন। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক সে কারণেই তাঁর রায়ের বহু স্থানে বলেছেন, জাতির সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে।
প্রথম আলো  এই রায় তাত্ক্ষণিক বিপদ ডেকে আনছে শুধু জামায়াতের মতো সংগঠনগুলোর ওপর। কারণ তাদের রাজনীতিই নিষিদ্ধের কথা উঠেছে। কিন্তু সংবিধানের ১২ ও ৩৮ পুনরুজ্জীবিত হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ হবে না। সে জন্য নতুন আইন লাগবে বলে মনে হচ্ছে। আপনি কীভাবে দেখছেন?
মাহ্বুবে আলম  এটা নির্ভর করছে জামায়াত বা এ ধরনের সংগঠনের ওপর। তারা কী পদক্ষেপ নেয়, সেটা দেখার বিষয়। তারা নিজেদের কীভাবে রাজনীতিতে আনতে চায়। তারা যদি মূলধারায় আসতে চায়, কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িক স্লোগান যদি তাদের না থাকে এবং তাদের গঠনতন্ত্র
যদি জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়, তাহলে এক রকম কথা হবে। আর যদি দেখা যায়, সংবিধানের সঙ্গে সংঘাত বাঁধছে, তাহলে অন্য রকম কথা হবে।
প্রথম আলো  বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার একটি কথা আছে। এই রায় কার্যকর হলে হয়তো প্রস্তাবনাসহ আটটি আদি অনুচ্ছেদ আমরা ফিরে পাব। কিন্তু বাকিগুলো কীভাবে আসবে? বিশেষ করে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা-সংক্রান্ত ১১৬ অনুচ্ছেদ কীভাবে আমরা ফিরে পাব? এটা মৌলিক কাঠামোর অবিচ্ছেদ্য অংশ। অথচ চতুর্থ ও পঞ্চম উভয় সংশোধনীতে এটা বিধ্বস্ত।
মাহ্বুবে আলম  সংবিধানের মৌলিক কাঠামো চারটি কি পাঁচটি। এর মধ্যে সংসদের আইন রিভিউ করতে আদালতের ক্ষমতা একটি। সংবিধান সংশোধনে সংসদের ক্ষমতা তো সব সময় আছে। আমরা রায় পাব। কোন অনুচ্ছেদের পরিবর্তে কোনটা কোথায় বসবে, সেটা তখন স্পষ্ট হবে। সরকার যদি কয়েকটির ক্ষেত্রে বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যেতে চায়, তাহলে তো বাধা থাকবে না।

No comments

Powered by Blogger.