বিচারের বাণী-পঞ্চম সংশোধনীর দশা by মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী
হ্যাঁ, প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর কথা লিখছি, যেটা ১৯৭৯ সালের ৫ এপ্রিল জাতীয় সংসদে পাস হয়। পঞ্চম সংশোধনীর উদ্দেশ্য ছিল সামরিক শাসন (১৫ আগস্ট ১৯৭৫ থেকে ৯ এপ্রিল ১৯৭৯) আমলকে এবং সামরিক আদেশ দ্বারা সংবিধানের পরিবর্তন, সংযোজন ও সংশোধনকে বৈধ করা।
ওই সামরিক শাসনকালে বাংলাদেশের সংবিধানের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো ক্ষতবিক্ষত করা হয় একজন স্বৈরশাসক কর্তৃক তাঁর শাসন বলবত্ রাখার ব্যক্তিগত স্বার্থে। সেগুলোর কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক। ধর্মনিরপেক্ষতা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অন্যতম আদর্শ ছিল এবং সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদে ধর্মনিরপেক্ষতার সম্পূর্ণ সংজ্ঞা দেওয়া ছিল। ১৯৭৭ সালে প্রথম সামরিক প্রজ্ঞাপন দ্বারা ওই অনুচ্ছেদটি বিলুপ্ত করা হয়, অতঃপর ১৯৭৮ সালে দ্বিতীয় সামরিক প্রজ্ঞাপন দ্বারা সংবিধানের প্রস্তাবনার উপরে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানের রহিম’ সংযোজন করা হয়, ৮ অনুচ্ছেদে উল্লিখিত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ পরিবর্তন করে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ সংযোজন করা হয় এবং ৩৮ অনুচ্ছেদের অন্তর্গত শর্তটি বিলুপ্ত করে ধর্মীয় রাজনীতি করার সুযোগ দেওয়া হয়। ৮ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ‘সমাজতন্ত্র’কে সংকীর্ণ করে ‘সমাজতন্ত্র অর্থাত্ অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার’ শব্দগুলো যোগ করা হয় এবং ৪২ অনুচ্ছেদে ‘ক্ষতিপূরণসহ বা বিনা ক্ষতিপূরণে’ রাষ্ট্রায়ত্ত করার বিধান থেকে ‘বা বিনা ক্ষতিপূরণে’ বিধানটি বাদ দেওয়া হয়।
ইংল্যান্ডের খ্যাতনামা বিচারপতি লর্ড ডেনিং তাঁর লেখা দ্য চেঞ্জিং ল (পরিবর্তমান আইন) বইটির ভূমিকায় লিখেছেন, ‘লোকজনের ধারণা, আইনগুলো স্পষ্ট এবং সেগুলো সংসদ কর্তৃক কেবল পরিবর্তন করা যায়। সত্যটি হচ্ছে, আইনগুলো প্রায়ই অস্পষ্ট থাকে এবং এগুলো ক্রমাগত পরিবর্তিত, কিংবা হয়তো আমার বলা উচিত, বিচারপতিরা কর্তৃক পূর্ণতর করা হয়। তত্ত্বীয় মতে, বিচারপতিরা আইন প্রণয়ন করেন না, তাঁরা সেগুলোর অর্থ পরিষ্কার করেন। কিন্তু কেউ জানেন না আইনটি কী হতে পারে, যে পর্যন্ত না বিচারপতিরা তার অর্থ পরিষ্কার করেন। অতএব বলা যায়, তাঁরা এটা প্রণয়ন করেন।’ লর্ড ডেনিংয়ের যুক্তির অনুসরণে বলা যায়, বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট পরিষ্কার করেছেন যে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ থেকে ৯ এপ্রিল ১৯৭৯ পর্যন্ত সামরিক শাসন বেআইনি ও অবৈধ ছিল এবং সে সময়ের সব সামরিক প্রজ্ঞাপন ও আদেশও বেআইনি ও অবৈধ গণ্য হবে। অতএব সেগুলো বৈধ করার উদ্দেশ্যে জাতীয় সংসদ কর্তৃক পঞ্চম সংশোধনী বিলটি পাস করাও বেআইনি ও অবৈধ হয়েছে, যেহেতু জাতীয় সংসদের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সংবিধান নিয়ন্ত্রণ করে এবং সামরিক আইন কিংবা শাসন সংবিধানে নেই। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়ের পর পঞ্চম সংশোধনীর দশা যে বেহাল সেটা আর বলার দরকার নেই।
এখন লাখ টাকার প্রশ্নটি হচ্ছে, পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হওয়ার পর সামরিক প্রজ্ঞাপন দ্বারা সংবিধানের যে অনুচ্ছেদগুলো বিলুপ্ত কিংবা সংযোজন কিংবা পরিবর্তনের শিকার হয়েছিল, এখন সেগুলো পূর্বাবস্থা কীভাবে ফিরে পাবে, সেটাই। আইনজীবীদের কাছে উত্তরটি খুবই সোজা। কারণ এ বিষয়ে আইনি নজির আছে এবং সেটা, প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, আপনাকে বলছি। ১৯৮৮ সালে আর এক সামরিক শাসক বাংলাদেশের সংবিধানের ১০০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন করে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, যশোর, রংপুর ও সিলেটে হাইকোর্ট বিভাগের একটি করে স্থায়ী বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা করেন। অতঃপর এই পরিবর্তনের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগে রিট পিটিশন হয়। শেষ পর্যন্ত আপিল বিভাগে বিষয়টির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়। আপিল বিভাগের রায়ে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়, ঢাকাসহ সাতটি স্থানে সাতটি স্থায়ী হাইকোর্ট বিভাগ গঠন করায় সংবিধানে প্রদত্ত সুপ্রিম কোর্টের মৌলিক নির্মিতি অর্থাত্ একত্ব ও অবিভাজ্যতা বিনষ্ট হয়ে গেছে হেতু ১০০ অনুচ্ছেদের সংশোধনী বেআইনি। উল্লেখ্য, ১০০ অনুচ্ছেদের আদি পাঠ—‘রাজধানীতে সুপ্রিম কোর্টের স্থায়ী আসন থাকিবে।’ ওই রায়টির ফলে সংবিধানের আদি অনুচ্ছেদটি পুনর্বহাল হয়। রায়টি ঢাকা ল’ রিপোর্টস-এর ৪১ খণ্ডে ১৬৫ পৃষ্ঠায় ছাপা আছে। অতএব যখন আপিল বিভাগের বিচারপতিরা তাঁদের লিখিত রায়ে স্বাক্ষর দেবেন এবং সেটা প্রকাশিত হবে, সে সময়ই আপনা-আপনি ওই সব বেআইনি সংশোধনী আইনের দৃষ্টিতে সংবিধান থেকে মুছে যাবে এবং সেই জায়গায় আদি পাঠ পুনর্বহাল হবে।
বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী: অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আপিল বিভাগ, সুপ্রিম কোর্ট।
ইংল্যান্ডের খ্যাতনামা বিচারপতি লর্ড ডেনিং তাঁর লেখা দ্য চেঞ্জিং ল (পরিবর্তমান আইন) বইটির ভূমিকায় লিখেছেন, ‘লোকজনের ধারণা, আইনগুলো স্পষ্ট এবং সেগুলো সংসদ কর্তৃক কেবল পরিবর্তন করা যায়। সত্যটি হচ্ছে, আইনগুলো প্রায়ই অস্পষ্ট থাকে এবং এগুলো ক্রমাগত পরিবর্তিত, কিংবা হয়তো আমার বলা উচিত, বিচারপতিরা কর্তৃক পূর্ণতর করা হয়। তত্ত্বীয় মতে, বিচারপতিরা আইন প্রণয়ন করেন না, তাঁরা সেগুলোর অর্থ পরিষ্কার করেন। কিন্তু কেউ জানেন না আইনটি কী হতে পারে, যে পর্যন্ত না বিচারপতিরা তার অর্থ পরিষ্কার করেন। অতএব বলা যায়, তাঁরা এটা প্রণয়ন করেন।’ লর্ড ডেনিংয়ের যুক্তির অনুসরণে বলা যায়, বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট পরিষ্কার করেছেন যে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ থেকে ৯ এপ্রিল ১৯৭৯ পর্যন্ত সামরিক শাসন বেআইনি ও অবৈধ ছিল এবং সে সময়ের সব সামরিক প্রজ্ঞাপন ও আদেশও বেআইনি ও অবৈধ গণ্য হবে। অতএব সেগুলো বৈধ করার উদ্দেশ্যে জাতীয় সংসদ কর্তৃক পঞ্চম সংশোধনী বিলটি পাস করাও বেআইনি ও অবৈধ হয়েছে, যেহেতু জাতীয় সংসদের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা সংবিধান নিয়ন্ত্রণ করে এবং সামরিক আইন কিংবা শাসন সংবিধানে নেই। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়ের পর পঞ্চম সংশোধনীর দশা যে বেহাল সেটা আর বলার দরকার নেই।
এখন লাখ টাকার প্রশ্নটি হচ্ছে, পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হওয়ার পর সামরিক প্রজ্ঞাপন দ্বারা সংবিধানের যে অনুচ্ছেদগুলো বিলুপ্ত কিংবা সংযোজন কিংবা পরিবর্তনের শিকার হয়েছিল, এখন সেগুলো পূর্বাবস্থা কীভাবে ফিরে পাবে, সেটাই। আইনজীবীদের কাছে উত্তরটি খুবই সোজা। কারণ এ বিষয়ে আইনি নজির আছে এবং সেটা, প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, আপনাকে বলছি। ১৯৮৮ সালে আর এক সামরিক শাসক বাংলাদেশের সংবিধানের ১০০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন করে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, যশোর, রংপুর ও সিলেটে হাইকোর্ট বিভাগের একটি করে স্থায়ী বেঞ্চ প্রতিষ্ঠা করেন। অতঃপর এই পরিবর্তনের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগে রিট পিটিশন হয়। শেষ পর্যন্ত আপিল বিভাগে বিষয়টির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়। আপিল বিভাগের রায়ে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়, ঢাকাসহ সাতটি স্থানে সাতটি স্থায়ী হাইকোর্ট বিভাগ গঠন করায় সংবিধানে প্রদত্ত সুপ্রিম কোর্টের মৌলিক নির্মিতি অর্থাত্ একত্ব ও অবিভাজ্যতা বিনষ্ট হয়ে গেছে হেতু ১০০ অনুচ্ছেদের সংশোধনী বেআইনি। উল্লেখ্য, ১০০ অনুচ্ছেদের আদি পাঠ—‘রাজধানীতে সুপ্রিম কোর্টের স্থায়ী আসন থাকিবে।’ ওই রায়টির ফলে সংবিধানের আদি অনুচ্ছেদটি পুনর্বহাল হয়। রায়টি ঢাকা ল’ রিপোর্টস-এর ৪১ খণ্ডে ১৬৫ পৃষ্ঠায় ছাপা আছে। অতএব যখন আপিল বিভাগের বিচারপতিরা তাঁদের লিখিত রায়ে স্বাক্ষর দেবেন এবং সেটা প্রকাশিত হবে, সে সময়ই আপনা-আপনি ওই সব বেআইনি সংশোধনী আইনের দৃষ্টিতে সংবিধান থেকে মুছে যাবে এবং সেই জায়গায় আদি পাঠ পুনর্বহাল হবে।
বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী: অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আপিল বিভাগ, সুপ্রিম কোর্ট।
No comments