রম্য-'বাঘ ঘুরবে সীমান্ত মাড়িয়ে' by আনোয়ারা সৈয়দ হক
দু'দেশের চুক্তি স্বাক্ষরের সময় এসব কথা ভাবতে হবে। আর যদি এ চুক্তি সফল হয়, যদি বাইচান্স কোনো কারণে সফল হয়ে যায়, অর্থাৎ আমাদের বাংলাদেশের বাঘগুলো যদি পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনে ইচ্ছামতো বেড়িয়ে আবার দেশের মাটি, থুড়ি সুন্দরবনে ফিরে আসতে পারে, যদি ওদেশে গিয়ে হারিয়ে না যায় অথবা ভালো খাবার, ভালো চিকিৎসার
লোভে ওখানে লুকিয়ে পড়ে না থাকে এবং জোর করে তাদের 'পুশ আউট' না করতে হয়; তাহলে দুই দেশের সরকার আরেকটি প্রটোকল স্বাক্ষর করতে পারে অনায়াসে। আর তা হলো, দু'দেশের মানুষের ভেতরেও আর কোনো ভিসা সিস্টেম থাকবে না। কারণ, ভিসা পেতে বড়ই ঝামেলা। ততদিনে রোগী মরে ভূত হয়ে যায়
বিনা পাসপোর্ট ও ভিসায় বাংলাদেশের রয়াল বেঙ্গল টাইগার এখন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনে বিচরণ করতে পারবে! গত ৩০ এপ্রিল একটি দৈনিকে সংবাদটি পড়ে আমরা বাংলাদেশের বাঘমামাদের হয়ে প্রচুর আনন্দ উপভোগ করলাম। এখন আর নিজ দেশের সীমানা লঙ্ঘনে বাংলাদেশের বাঘমামাদের কোনো বাধা নেই। বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনজুড়ে রয়াল বেঙ্গল টাইগারদের অবাধ বিচরণ নিশ্চিত করতে প্রতিবেশী এ দুটি দেশ সম্প্রতি নাকি যৌথ প্রটোকলে স্বাক্ষর করেছে।
বাংলাদেশের বাঘমামাদের জন্য এটি যে প্রচণ্ড একটি সুখবর_ তাতে আর কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। তারা এখন নিদ্বর্িধায় সুন্দরবনজুড়ে ঘুরে বেড়াবেন, পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনের মামা-মাসি-দাদা বাঘদের সঙ্গে দেখা করবেন, তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করবেন; সুখ-দুঃখের কথা হবে। ব্যাঘ্রজীবনে এর চেয়ে বেশি আর কী তারা চান!
না, তারা এর বেশি কিছু চান না।
তবে পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনের বাঘমামা-মাসিরা এবং গম্ভীরমুখো বাঘদাদারা তাদের দেশের সীমান্ত মাড়িয়ে আমাদের বাংলাদেশের সুন্দরবন ভ্রমণে আসবেন কি-না, সেটা এখনও ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। আর যদি কোনোদিন আসেনও, তাহলেও তাদের চেহারা দেখে আমাদের শনাক্ত করা মুশকিল হবে। কারণ উভয় বঙ্গের সুন্দরবনের রয়াল বেঙ্গল টাইগারদের চেহারা-ছবি আবার সব এক। বাঘমামাদের বা দাদাবাঘদের না হয় বাদই দিলাম, বাঘমাসিদেরও কপালে বা মাথায় সিঁদুরের চিহ্ন নেই; যেটা দেখে বোঝা যাবে যে, তারা পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন থেকে এ দেশের সুন্দরবনে তাদের পা, থুড়ি থাবা রেখেছেন। তাদের গোঁফ বা লেজ দিয়েও চেনার কোনো উপায় নেই। কারণ দুই দেশের সুন্দরবনের বাঘদের গোঁফ ও লেজের চেহারা একই রকম। লম্বাতেও লেজগুলো প্রায় সমান সমান। আর দাঁত? দাঁতের অবস্থা তথৈবচ। পোশাক? তাও নেই! উভয় বঙ্গের বাঘেরাই উলঙ্গ। অবশ্য যদি গায়ের ডোরা কাটাগুলোকে তাদের পোশাক বলে চালানো যায়, সেটা ভিন্ন কথা; কিন্তু সেখানেও ভীষণ মিল।
তবে এর ওপরও কথা আছে। আর তা হলো, পশ্চিমবঙ্গের দাদাবাঘেরা এত জ্ঞানী এবং গুরুগম্ভীর যে, বাংলাদেশের সুন্দরবনের মূর্খ এবং বাচাল বাঘগুলোর সঙ্গে মিশবেন কি-না সে ব্যাপারে আমাদের সন্দেহ থেকে যাচ্ছে! এমনও হতে পারে, পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনের মামা-মাসি এবং দাদাবাঘেরা হয়তো তাদের নিজস্ব ডেরা ছেড়ে বেরোবেনই না। তার কারণ হিসেবে এটুকু বলা যায় যে, বাংলাদেশের সুন্দরবনে বিচরণ করে তাদের লাভটা কী হবে? বাংলাদেশের সুন্দরবনে আহামরি আছেই-বা কী? সব তো সেই কতদিন আগে 'সিডর' হয়ে ম্যাসাকার। রুক্ষ, নীরস, সৌন্দর্যহীন বন-জঙ্গলের চেহারা। তার ওপর চোর-ডাকাত আর ধূর্ত শিকারি এবং শিকারিদের চ্যালাচামুণ্ডায় ভর্তি। জঙ্গলের ভেতরেও এমন বেশি কিছু জীবন্ত নেই যে, সেসব মেরে খেয়ে উদরপূর্তি করবেন। যেটুকু জীবন্ত খাবার আমাদের সুন্দরবনে আছে তা দিয়ে তো এখানকার বাঘমামাদেরই উদরপূর্তি হয় না। সেখানে পশ্চিমবঙ্গের দাদাবাঘেরা এসে ভাগ বসাবেন কোথায়?
তাছাড়া সীমান্ত মাড়িয়ে দাদা-মামা-মাসিবাঘেরা এলেও সীমান্ত মাড়িয়ে জল বা পানি তো স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসতে পারছে না। সেখানে তো অনেক বিধিনিষেধ। এ দেশের সুন্দরবনে বেড়াতে এসে দাদাবাঘেরা তৃষ্ণার্ত হয়ে যদি নদীর পানিতে তৃষ্ণা নিবারণ করতে যান তো পানি পাবেন কোথায়? পশ্চিমবঙ্গের মমতা দিদিকে অনুরোধ করেও তো কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। অর্থাৎ ন্যায্য পানির হিস্সা পাওয়া যাচ্ছে না। সুতরাং সীমান্ত মাড়িয়ে যখন বাঘমামা-মাসি-দাদারা আসবেন, সঙ্গে সঙ্গে পানির জলাশয়টাও নিয়ে আসতে পারেন তো বড়ই উপকার হয়।
তবে এ কথা স্বীকার করতে হয় যে, ওদেশের সুন্দরবনের দাদা, মামা, মাসিদের মনোভাব যা-ই থাকুক না কেন, আমাদের দেশের রয়াল বেঙ্গল বাঘেরা যে পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন বিচরণে মহাউৎসাহী হয়ে উঠেছে, তা তাদের ঘনঘন ল্যাজ নাড়ানো দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তার একটি কারণ হয়তো এই যে, পশ্চিমবঙ্গের ব্যাঘ্রকুলের অসুখ-বিসুখে ওদেশের সরকারের তৎপরতা এবং সুচিকিৎসা ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা বাংলাদেশের বাঘমামাদের জন্য একেবারেই নেই। তারা প্রায় বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মরে। দ্বিতীয় কারণ হয়তো খাদ্য। পশ্চিমবঙ্গের রয়াল বেঙ্গল টাইগারদের জন্য যে ধরনের খাদ্যসম্ভার জঙ্গলে মজুদ থাকে, যেমন দেদার বিচরণকারী হরিণ, হরিয়াল, হায়েনা, খরগোশ, শূকর, বানর, বেজি ও শিয়াল_ সে রকম অফুরন্ত সাপ্লাই আমাদের সুন্দরবনে নেই। তাছাড়া জঙ্গলের হরিণ তো আমরা সুযোগ পেলেই শিকার করে খেয়ে ফেলি। হরিয়াল, বক, খরখোশও আমাদের শিকারির সুনজরে প্রায়ই পড়ে যায়। বানর ও শিয়ালের মাংস খেতে কটু গন্ধ বলে এখনও তা খাওয়া হয় না। হয়তো ভবিষ্যতে হবে। তবে সুযোগ পেলে তাদের মেরে হাতের তাক বা নিশানা ঠিক রাখে আমাদের শিকারপ্রিয় শিকারিরা।
আর তিন নম্বর কারণ হয়তো নিরাপত্তা। এখানে আমাদের দেশের সুন্দরবনে বাঘমামাদের কোনো নিরাপত্তা নেই। যদি তারা বয়সের কারণে চোখে ধন্ধ লেগে বা কম অভিজ্ঞতা ও বয়সের কারণে ভুলবশত জঙ্গলের বাইরে বেরিয়ে আসে, তাহলে আমরা গ্রামবাসীরা হৈ হৈ রৈ রৈ করে লাঠিসোটা বাগিয়ে তাদের মেরে ফেলি। তারপর চ্যাংদোলা করে ঝুলিয়ে গ্রামবাসীকে মজা করে দেখাই। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে মামা-মাসি-দাদাবাঘদের জন্য সুন্দরবন তো বটেই, তার বাইরের সীমানাও হচ্ছে অভয়ারণ্য।
সুতরাং দু'দেশের চুক্তি স্বাক্ষরের সময় এসব কথা ভাবতে হবে। আর যদি এ চুক্তি সফল হয়, যদি বাইচান্স কোনো কারণে সফল হয়ে যায়, অর্থাৎ আমাদের বাংলাদেশের বাঘগুলো যদি পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনে ইচ্ছামতো বেড়িয়ে আবার দেশের মাটি, থুড়ি সুন্দরবনে ফিরে আসতে পারে; যদি ওদেশে গিয়ে হারিয়ে না যায় অথবা ভালো খাবার, ভালো চিকিৎসার লোভে ওখানে লুকিয়ে পড়ে না থাকে এবং জোর করে তাদের 'পুশ আউট' না করতে হয়; তাহলে দুই দেশের সরকার আরেকটি প্রটোকল স্বাক্ষর করতে পারে অনায়াসে। আর তা হলো, দু'দেশের মানুষের ভেতরেও আর কোনো ভিসা সিস্টেম থাকবে না। কারণ, ভিসা পেতে বড়ই ঝামেলা। ততদিনে রোগী মরে ভূত হয়ে যায়। তাই ভিসাহীন হয়ে বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ ঘুরে বেড়াক। দু'দেশের ভাই, দাদা ও মামা-মাসিরা আবার পরস্পর বড়ই সংবেদনশীল। অধিকাংশের ভিটেমাটি বা পূর্বপুরুষ আবার বাংলাদেশে বা পশ্চিমবঙ্গে। তাই রয়াল বেঙ্গল টাইগারদের ওপর পরীক্ষা সফল হওয়ার পর এটা কি দু'দেশের মানুষের ওপর প্রযোজ্য হতে পারে? বিষয়টি দু'দেশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ভেবে দেখতে অনুরোধ করি।
আনোয়ারা সৈয়দ হক : মনোচিকিৎসক ও কথাসাহিত্যিক
বিনা পাসপোর্ট ও ভিসায় বাংলাদেশের রয়াল বেঙ্গল টাইগার এখন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনে বিচরণ করতে পারবে! গত ৩০ এপ্রিল একটি দৈনিকে সংবাদটি পড়ে আমরা বাংলাদেশের বাঘমামাদের হয়ে প্রচুর আনন্দ উপভোগ করলাম। এখন আর নিজ দেশের সীমানা লঙ্ঘনে বাংলাদেশের বাঘমামাদের কোনো বাধা নেই। বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনজুড়ে রয়াল বেঙ্গল টাইগারদের অবাধ বিচরণ নিশ্চিত করতে প্রতিবেশী এ দুটি দেশ সম্প্রতি নাকি যৌথ প্রটোকলে স্বাক্ষর করেছে।
বাংলাদেশের বাঘমামাদের জন্য এটি যে প্রচণ্ড একটি সুখবর_ তাতে আর কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। তারা এখন নিদ্বর্িধায় সুন্দরবনজুড়ে ঘুরে বেড়াবেন, পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনের মামা-মাসি-দাদা বাঘদের সঙ্গে দেখা করবেন, তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করবেন; সুখ-দুঃখের কথা হবে। ব্যাঘ্রজীবনে এর চেয়ে বেশি আর কী তারা চান!
না, তারা এর বেশি কিছু চান না।
তবে পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনের বাঘমামা-মাসিরা এবং গম্ভীরমুখো বাঘদাদারা তাদের দেশের সীমান্ত মাড়িয়ে আমাদের বাংলাদেশের সুন্দরবন ভ্রমণে আসবেন কি-না, সেটা এখনও ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। আর যদি কোনোদিন আসেনও, তাহলেও তাদের চেহারা দেখে আমাদের শনাক্ত করা মুশকিল হবে। কারণ উভয় বঙ্গের সুন্দরবনের রয়াল বেঙ্গল টাইগারদের চেহারা-ছবি আবার সব এক। বাঘমামাদের বা দাদাবাঘদের না হয় বাদই দিলাম, বাঘমাসিদেরও কপালে বা মাথায় সিঁদুরের চিহ্ন নেই; যেটা দেখে বোঝা যাবে যে, তারা পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন থেকে এ দেশের সুন্দরবনে তাদের পা, থুড়ি থাবা রেখেছেন। তাদের গোঁফ বা লেজ দিয়েও চেনার কোনো উপায় নেই। কারণ দুই দেশের সুন্দরবনের বাঘদের গোঁফ ও লেজের চেহারা একই রকম। লম্বাতেও লেজগুলো প্রায় সমান সমান। আর দাঁত? দাঁতের অবস্থা তথৈবচ। পোশাক? তাও নেই! উভয় বঙ্গের বাঘেরাই উলঙ্গ। অবশ্য যদি গায়ের ডোরা কাটাগুলোকে তাদের পোশাক বলে চালানো যায়, সেটা ভিন্ন কথা; কিন্তু সেখানেও ভীষণ মিল।
তবে এর ওপরও কথা আছে। আর তা হলো, পশ্চিমবঙ্গের দাদাবাঘেরা এত জ্ঞানী এবং গুরুগম্ভীর যে, বাংলাদেশের সুন্দরবনের মূর্খ এবং বাচাল বাঘগুলোর সঙ্গে মিশবেন কি-না সে ব্যাপারে আমাদের সন্দেহ থেকে যাচ্ছে! এমনও হতে পারে, পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনের মামা-মাসি এবং দাদাবাঘেরা হয়তো তাদের নিজস্ব ডেরা ছেড়ে বেরোবেনই না। তার কারণ হিসেবে এটুকু বলা যায় যে, বাংলাদেশের সুন্দরবনে বিচরণ করে তাদের লাভটা কী হবে? বাংলাদেশের সুন্দরবনে আহামরি আছেই-বা কী? সব তো সেই কতদিন আগে 'সিডর' হয়ে ম্যাসাকার। রুক্ষ, নীরস, সৌন্দর্যহীন বন-জঙ্গলের চেহারা। তার ওপর চোর-ডাকাত আর ধূর্ত শিকারি এবং শিকারিদের চ্যালাচামুণ্ডায় ভর্তি। জঙ্গলের ভেতরেও এমন বেশি কিছু জীবন্ত নেই যে, সেসব মেরে খেয়ে উদরপূর্তি করবেন। যেটুকু জীবন্ত খাবার আমাদের সুন্দরবনে আছে তা দিয়ে তো এখানকার বাঘমামাদেরই উদরপূর্তি হয় না। সেখানে পশ্চিমবঙ্গের দাদাবাঘেরা এসে ভাগ বসাবেন কোথায়?
তাছাড়া সীমান্ত মাড়িয়ে দাদা-মামা-মাসিবাঘেরা এলেও সীমান্ত মাড়িয়ে জল বা পানি তো স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসতে পারছে না। সেখানে তো অনেক বিধিনিষেধ। এ দেশের সুন্দরবনে বেড়াতে এসে দাদাবাঘেরা তৃষ্ণার্ত হয়ে যদি নদীর পানিতে তৃষ্ণা নিবারণ করতে যান তো পানি পাবেন কোথায়? পশ্চিমবঙ্গের মমতা দিদিকে অনুরোধ করেও তো কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। অর্থাৎ ন্যায্য পানির হিস্সা পাওয়া যাচ্ছে না। সুতরাং সীমান্ত মাড়িয়ে যখন বাঘমামা-মাসি-দাদারা আসবেন, সঙ্গে সঙ্গে পানির জলাশয়টাও নিয়ে আসতে পারেন তো বড়ই উপকার হয়।
তবে এ কথা স্বীকার করতে হয় যে, ওদেশের সুন্দরবনের দাদা, মামা, মাসিদের মনোভাব যা-ই থাকুক না কেন, আমাদের দেশের রয়াল বেঙ্গল বাঘেরা যে পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন বিচরণে মহাউৎসাহী হয়ে উঠেছে, তা তাদের ঘনঘন ল্যাজ নাড়ানো দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তার একটি কারণ হয়তো এই যে, পশ্চিমবঙ্গের ব্যাঘ্রকুলের অসুখ-বিসুখে ওদেশের সরকারের তৎপরতা এবং সুচিকিৎসা ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা বাংলাদেশের বাঘমামাদের জন্য একেবারেই নেই। তারা প্রায় বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মরে। দ্বিতীয় কারণ হয়তো খাদ্য। পশ্চিমবঙ্গের রয়াল বেঙ্গল টাইগারদের জন্য যে ধরনের খাদ্যসম্ভার জঙ্গলে মজুদ থাকে, যেমন দেদার বিচরণকারী হরিণ, হরিয়াল, হায়েনা, খরগোশ, শূকর, বানর, বেজি ও শিয়াল_ সে রকম অফুরন্ত সাপ্লাই আমাদের সুন্দরবনে নেই। তাছাড়া জঙ্গলের হরিণ তো আমরা সুযোগ পেলেই শিকার করে খেয়ে ফেলি। হরিয়াল, বক, খরখোশও আমাদের শিকারির সুনজরে প্রায়ই পড়ে যায়। বানর ও শিয়ালের মাংস খেতে কটু গন্ধ বলে এখনও তা খাওয়া হয় না। হয়তো ভবিষ্যতে হবে। তবে সুযোগ পেলে তাদের মেরে হাতের তাক বা নিশানা ঠিক রাখে আমাদের শিকারপ্রিয় শিকারিরা।
আর তিন নম্বর কারণ হয়তো নিরাপত্তা। এখানে আমাদের দেশের সুন্দরবনে বাঘমামাদের কোনো নিরাপত্তা নেই। যদি তারা বয়সের কারণে চোখে ধন্ধ লেগে বা কম অভিজ্ঞতা ও বয়সের কারণে ভুলবশত জঙ্গলের বাইরে বেরিয়ে আসে, তাহলে আমরা গ্রামবাসীরা হৈ হৈ রৈ রৈ করে লাঠিসোটা বাগিয়ে তাদের মেরে ফেলি। তারপর চ্যাংদোলা করে ঝুলিয়ে গ্রামবাসীকে মজা করে দেখাই। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে মামা-মাসি-দাদাবাঘদের জন্য সুন্দরবন তো বটেই, তার বাইরের সীমানাও হচ্ছে অভয়ারণ্য।
সুতরাং দু'দেশের চুক্তি স্বাক্ষরের সময় এসব কথা ভাবতে হবে। আর যদি এ চুক্তি সফল হয়, যদি বাইচান্স কোনো কারণে সফল হয়ে যায়, অর্থাৎ আমাদের বাংলাদেশের বাঘগুলো যদি পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনে ইচ্ছামতো বেড়িয়ে আবার দেশের মাটি, থুড়ি সুন্দরবনে ফিরে আসতে পারে; যদি ওদেশে গিয়ে হারিয়ে না যায় অথবা ভালো খাবার, ভালো চিকিৎসার লোভে ওখানে লুকিয়ে পড়ে না থাকে এবং জোর করে তাদের 'পুশ আউট' না করতে হয়; তাহলে দুই দেশের সরকার আরেকটি প্রটোকল স্বাক্ষর করতে পারে অনায়াসে। আর তা হলো, দু'দেশের মানুষের ভেতরেও আর কোনো ভিসা সিস্টেম থাকবে না। কারণ, ভিসা পেতে বড়ই ঝামেলা। ততদিনে রোগী মরে ভূত হয়ে যায়। তাই ভিসাহীন হয়ে বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ ঘুরে বেড়াক। দু'দেশের ভাই, দাদা ও মামা-মাসিরা আবার পরস্পর বড়ই সংবেদনশীল। অধিকাংশের ভিটেমাটি বা পূর্বপুরুষ আবার বাংলাদেশে বা পশ্চিমবঙ্গে। তাই রয়াল বেঙ্গল টাইগারদের ওপর পরীক্ষা সফল হওয়ার পর এটা কি দু'দেশের মানুষের ওপর প্রযোজ্য হতে পারে? বিষয়টি দু'দেশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ভেবে দেখতে অনুরোধ করি।
আনোয়ারা সৈয়দ হক : মনোচিকিৎসক ও কথাসাহিত্যিক
No comments