সুদের হার-ব্যাংকব্যবস্থার অদক্ষতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে by মনজুর হোসেন
বর্তমানে বাংলাদেশে সুদের হারের ব্যাপ্তি (স্প্রেড) অর্থাত্ ঋণ ও আমানতের সুদের হারের পার্থক্য ব্যাংকভেদে পাঁচ থেকে আট শতাংশ। উন্নয়নশীল দেশের হিসেবে এটি খুব বেশি নয়। তবুও এ ব্যবধান নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বিনিয়োগকারীরা সন্তুষ্ট নন।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে অনেকেই বর্তমান সুদহারের ব্যাপ্তিকে কাঙ্ক্ষিত মনে করেন না। আর তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক কয়েক বছর ধরে ব্যাংকগুলোকে তাদের ঋণ ও আমানতের সুদের হারের মধ্যকার ব্যবধান কমিয়ে আনার তাগাদা দিয়ে আসছিল। কিন্তু ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে আশানুরূপ সাড়া না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ১৩ শতাংশ এবং আমানতের সুদহার সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয়। বর্তমানে এ ব্যবস্থা বহাল রয়েছে।
অর্থনীতিতে সুদহারের স্প্রেডের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এর ওপর ভিত্তি করে একটি ব্যাংকিং ব্যবস্থার দক্ষতা এবং কার্যক্ষমতা নিরূপণ করা যায়। যদি ব্যবধান বেশি হয়, তাহলে আমানতকারীরা আমানতের কম সুদের কারণে অর্থ জমা রাখায় নিরুত্সাহিত হয়। অন্যদিকে ভালো বিনিয়োগকারীরা ঋণের উচ্চ সুদের হারের কারণে বিনিয়োগে নিরুত্সাহিত হয়। এভাবে সঞ্চয় ও বিনিয়োগকে প্রভাবিত করার কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর সুদহারের ব্যবধানের প্রভাব রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে এই স্প্রেড বিষয়ে কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজা প্রয়োজন। এগুলো হলো: বাংলাদেশে সুদের হারের স্প্রেড কত এবং তা উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় কত বেশি? যদি বেশি হয়, তাহলে তার কারণ কী? সে ক্ষেত্রে এর প্রতিকারই বা কী? আর যদি স্প্রেড উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় বেশি না হয়, তাহলে সমস্যাগুলো কোথায়?
বিভিন্ন প্রকার ঋণের (যেমন: বড় ঋণ, ছোট ঋণ, কৃষিঋণ ইত্যাদি) এবং আমানতের (যেমন: সঞ্চয়ী, পেনশন স্কিম, স্থায়ী আমানত ইত্যাদি) প্রকারভেদে সুদের হারের ভিন্নতা রয়েছে। তাই বিভিন্ন ধরনের ঋণের সুদের এবং আমানতের সুদের ভারিত গড়ের (ওয়েটেড এভারেজ) পার্থক্য নির্ণয়ের মাধ্যমে সুদের হারের ব্যবধান নির্ণয় করা হয়। এ পদ্ধতি অনুসারে বর্তমানে সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে ছয় শতাংশ; বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে (যারা ১৯৯৯ সালের আগে প্রতিষ্ঠিত) সাড়ে পাঁচ শতাংশ; নতুন বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে (যারা ১৯৯৯ সালের পরে প্রতিষ্ঠিত) সাড়ে তিন শতাংশ; বৈদেশিক বাণিজ্যিক ব্যাংকে আট শতাংশ; বিশেষায়িত ব্যাংকে ছয় শতাংশ ।
এখন সুদের হারের এ ব্যবধান উন্নত দেশে তিন থেকে চার শতাংশ । তবে বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের তুলনায়, এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায়ও সুদহারের এ ব্যবধানকে বেশি বলা যাবে না। এর অর্থ আবার এই নয় যে আমাদের সুদের হারের ব্যবধান কমানোর কোনো প্রয়োজন নেই। তা ছাড়া অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে একই রকম ব্যবধান বজায় থাকলেও অর্থনীতির আকার ও আচরণের ভিন্নতার কারণে সুদহারের ব্যবধান তুলনা করা সব সময় সমীচীন হবে না। তাই বাংলাদেশের সুদহারে স্প্রেডের বিষয়ে সম্যক ধারণা লাভ করার জন্য স্প্রেডের আচরণ, বিভিন্ন প্রকার সুদের হারের সঙ্গে এর ওঠা-নামার সম্পর্ক এবং এর নির্ণায়কসমূহ পর্যালোচনা করতে হবে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, সুদের হারের ব্যবধান পরিবর্তন হয়ে থাকে মূলত আমানতের সুদের হারের পরিবর্তনের কারণে। ঋণের সুদহার পরিবর্তনের সঙ্গে স্প্রেডের পরিবর্তনের কোনো সম্পর্ক দীর্ঘমেয়াদে পাওয়া যায়নি। এ থেকে বলা যায়, ঋণের সুদহার নিয়ন্ত্রণ করে সাময়িকভাবে স্প্রেড কমানো যেতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদে স্প্রেডের ওপর এর কোনো প্রভাব পড়বে না। কারণ, ব্যাংকগুলো সে ক্ষেত্রে আমানতের সুদহার কমিয়ে ব্যবধান আগের মতোই রাখবে। বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা করেও এ রকম একটি অবস্থাই লক্ষ করা যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের সুদের সর্বোচ্চ হার ১৩ শতাংশ নির্ধারণ করায় ব্যাংকগুলো বর্তমানে আমানতের সুদের হার কমাচ্ছে। এমতাবস্থায় শুধু ঋণের সুদ নিয়ন্ত্রণ করে কার্যকর ফলাফল পাওয়া যাবে না। বরং আমানতের সুদের হারের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। এ ছাড়া ঋণ ও আমানতের পরিমাণের সঙ্গে তাদের স্ব স্ব সুদের হারের কোনো সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয় না।
এ থেকে প্রমাণিত হয়, বাংলাদেশের ব্যাংকিংব্যবস্থা প্রতিযোগিতামূলক নয়। এখানে আমানত সংগ্রহ বা বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য ব্যাংকগুলো সুদের হারের পরিবর্তনের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে তেমন কোনো প্রতিযোগিতা করে না। ফলে জাতীয় সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমিয়ে আনলে সুদের হারের ব্যবধান কমে আসবে বলে যাঁরা মতামত দিয়ে থাকেন, তা গ্রহণযোগ্য নয় বলেই প্রতীয়মান হয়। বরং আশঙ্কা করা হয়, প্রয়োজনে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদের হার শূন্য ভাগে নামিয়ে আনতেও পিছপা হবে না তাদের লভ্যাংশ বজায় রাখার স্বার্থে। কারণ, বাংলাদেশে এখনো ব্যাংকিং ব্যবস্থার বিকল্প তেমন কোনো ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি, যেখানে মানুষ তাদের আমানত রাখতে পারে। শেয়ারবাজারের প্রতি সাধারণ জনগণের তেমন আস্থাও নেই, এ সম্পর্কে তারা বিশেষভাবে অবহিতও নয়। ব্যাংকগুলো এ অবস্থার সুযোগ নিতেই পারে।
উচ্চ পরিচালনা ব্যয় ও মন্দ ঋণের হারকে সুদের হারের ব্যবধানের অন্যতম কারণ হিসেবে বিআইডিএসের গবেষণায় দেখানো হয়েছে। এ দুটি বিষয়ই ব্যাংকিংব্যবস্থায় ব্যবস্থাপনার অদক্ষতাকে নির্দেশ করে। ব্যাংকগুলোর শাখার সাজসজ্জা, কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা এবং পরিচালক কর্তৃক গৃহীত সুযোগ-সুবিধাকে একটি গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে নিয়ে আসা প্রয়োজন। অন্যদিকে অতিরিক্ত এবং অপ্রয়োজনীয় শাখা ও লোকবল কমিয়ে আনতে হবে। সর্বোপরি সেবার মান কীভাবে আরও বাড়ানো যায় সেদিকে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে বর্তমানে কু-ঋণের পরিমাণ মোট ঋণের পাঁচ থেকে ছয় শতাংশ। সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে এই হার ২০ শতাংশের বেশি। উচ্চ স্প্রেডের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো তাদের অদক্ষতা ঢাকার প্রয়াস পায় (লভ্যাংশ বজায় রাখার মাধ্যমে)। অথচ জনগণকে এর মূল্য দিতে হচ্ছে। তাই পরিচালনাগত ব্যয় এবং কু-ঋণের পরিমাণ কমানোর মাধ্যমে বর্তমান স্প্রেড আরও কিছুটা কমিয়ে আনা সম্ভব। গবেষণায় আরও দেখা যায়, বর্তমানে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোই (যারা ১৯৯৯ সালের আগে প্রতিষ্ঠিত) বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। অর্থাত্ তারাই সুদের হার নির্ধারণে ভূমিকা রাখছে। তাই এসব ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও বেশি করে তদারক করা উচিত। তদুপরি, তাদের গ্রাহক কারা এবং কাদের কী হারে ঋণ দেওয়া হয়, তা ভালোভাবে নিরীক্ষা করা প্রয়োজন। কারণ, এসব ব্যাংক অর্থবাজারে একটি একচেটিয়ামূলক ব্যবস্থা তৈরির পেছনে ভূমিকা রাখছে।
আয়কর হারের সঙ্গেও সুদহারের ব্যবধানের কোনো তাত্পর্যপূর্ণ সম্পর্ক পাওয়া যায়নি। কাজেই, ব্যাংকাররা যে প্রায়শই উচ্চ প্রাতিষ্ঠানিক আয়করকে তাদের উচ্চ স্প্রেডের কারণ হিসেবে দেখান, তার কোনো ভিত্তি নেই।
আবার এখন সময় এসেছে বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিষয়ে আরও খতিয়ে দেখার। বৈদেশিক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে এ দেশে অনুমতি দেওয়া হয় মূলত দুটি কারণে। প্রথমত, ব্যাংকিং ব্যবস্থায় প্রযুক্তির বিকাশ ঘটানো; দ্বিতীয়ত, ব্যাংকিং ব্যবস্থায় প্রতিযোগিতা বাড়ানোর। প্রযুক্তি বিকাশে বিদেশি ব্যাংকগুলো ভূমিকা রাখলেও তাদের ব্যাংকিংব্যবস্থা অনেকটাই অস্বচ্ছ। তারা বাংলাদেশের ব্যাংকিং জগতে প্রতিযোগিতা বাড়াতে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সুদবহির্ভূত আয় (কমিশন, ফি, মাশুল ইত্যাদি) অন্যান্য ব্যাংকের তুলনায় অনেক বেশি। তাদের ঋণ ও আমানতের সুদহারের ব্যবধানও অনেক বেশি। তাই তাদের ভূমিকা প্রতিযোগিতামূলক ব্যাংকিং ব্যবস্থার জন্য কতটা ফলদায়ক তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
সুতরাং, বাংলাদেশে সুদের হারের ব্যবধান আরও কমানোর সুযোগ রয়েছে। এর পেছনে যে কারণগুলো পাওয়া গেছে তা বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার জন্য মোটেও ভালো খবর নয়। দেশের অর্থনীতিকে আরও বেগবান করার জন্য ব্যাংকিংব্যবস্থাকে অধিকতর প্রতিযোগিতামূলক করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন ব্যাংকিংব্যবস্থায় পরিচালনাগত দক্ষতা বাড়ানো এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি জোরদার করা। বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান তদারকিব্যবস্থায় যথেষ্ট দুর্বলতা রয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে হবে।
স্বল্পমেয়াদে ঋণের সুদের হার নিয়ন্ত্রণ করার চেয়ে সুদের হারের স্প্রেড নিয়ন্ত্রণ অধিকতর সুফলদায়ক হতে পারে। বাংলাদেশের ব্যাংকিংব্যবস্থাকে প্রতিযোগিতামূলক করার জন্য সরকারি ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী করার কোনো বিকল্প নেই। এটি অবশ্য একটি দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ। দীর্ঘমেয়াদে মূলধনী বাজার ও বন্ড বাজার শক্তিশালী করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
ড. মনজুর হোসেন: গবেষক, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)।
monzur@sdnbd.org
অর্থনীতিতে সুদহারের স্প্রেডের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এর ওপর ভিত্তি করে একটি ব্যাংকিং ব্যবস্থার দক্ষতা এবং কার্যক্ষমতা নিরূপণ করা যায়। যদি ব্যবধান বেশি হয়, তাহলে আমানতকারীরা আমানতের কম সুদের কারণে অর্থ জমা রাখায় নিরুত্সাহিত হয়। অন্যদিকে ভালো বিনিয়োগকারীরা ঋণের উচ্চ সুদের হারের কারণে বিনিয়োগে নিরুত্সাহিত হয়। এভাবে সঞ্চয় ও বিনিয়োগকে প্রভাবিত করার কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর সুদহারের ব্যবধানের প্রভাব রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে এই স্প্রেড বিষয়ে কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজা প্রয়োজন। এগুলো হলো: বাংলাদেশে সুদের হারের স্প্রেড কত এবং তা উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় কত বেশি? যদি বেশি হয়, তাহলে তার কারণ কী? সে ক্ষেত্রে এর প্রতিকারই বা কী? আর যদি স্প্রেড উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় বেশি না হয়, তাহলে সমস্যাগুলো কোথায়?
বিভিন্ন প্রকার ঋণের (যেমন: বড় ঋণ, ছোট ঋণ, কৃষিঋণ ইত্যাদি) এবং আমানতের (যেমন: সঞ্চয়ী, পেনশন স্কিম, স্থায়ী আমানত ইত্যাদি) প্রকারভেদে সুদের হারের ভিন্নতা রয়েছে। তাই বিভিন্ন ধরনের ঋণের সুদের এবং আমানতের সুদের ভারিত গড়ের (ওয়েটেড এভারেজ) পার্থক্য নির্ণয়ের মাধ্যমে সুদের হারের ব্যবধান নির্ণয় করা হয়। এ পদ্ধতি অনুসারে বর্তমানে সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে ছয় শতাংশ; বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে (যারা ১৯৯৯ সালের আগে প্রতিষ্ঠিত) সাড়ে পাঁচ শতাংশ; নতুন বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে (যারা ১৯৯৯ সালের পরে প্রতিষ্ঠিত) সাড়ে তিন শতাংশ; বৈদেশিক বাণিজ্যিক ব্যাংকে আট শতাংশ; বিশেষায়িত ব্যাংকে ছয় শতাংশ ।
এখন সুদের হারের এ ব্যবধান উন্নত দেশে তিন থেকে চার শতাংশ । তবে বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের তুলনায়, এমনকি আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায়ও সুদহারের এ ব্যবধানকে বেশি বলা যাবে না। এর অর্থ আবার এই নয় যে আমাদের সুদের হারের ব্যবধান কমানোর কোনো প্রয়োজন নেই। তা ছাড়া অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে একই রকম ব্যবধান বজায় থাকলেও অর্থনীতির আকার ও আচরণের ভিন্নতার কারণে সুদহারের ব্যবধান তুলনা করা সব সময় সমীচীন হবে না। তাই বাংলাদেশের সুদহারে স্প্রেডের বিষয়ে সম্যক ধারণা লাভ করার জন্য স্প্রেডের আচরণ, বিভিন্ন প্রকার সুদের হারের সঙ্গে এর ওঠা-নামার সম্পর্ক এবং এর নির্ণায়কসমূহ পর্যালোচনা করতে হবে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, সুদের হারের ব্যবধান পরিবর্তন হয়ে থাকে মূলত আমানতের সুদের হারের পরিবর্তনের কারণে। ঋণের সুদহার পরিবর্তনের সঙ্গে স্প্রেডের পরিবর্তনের কোনো সম্পর্ক দীর্ঘমেয়াদে পাওয়া যায়নি। এ থেকে বলা যায়, ঋণের সুদহার নিয়ন্ত্রণ করে সাময়িকভাবে স্প্রেড কমানো যেতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদে স্প্রেডের ওপর এর কোনো প্রভাব পড়বে না। কারণ, ব্যাংকগুলো সে ক্ষেত্রে আমানতের সুদহার কমিয়ে ব্যবধান আগের মতোই রাখবে। বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা করেও এ রকম একটি অবস্থাই লক্ষ করা যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণের সুদের সর্বোচ্চ হার ১৩ শতাংশ নির্ধারণ করায় ব্যাংকগুলো বর্তমানে আমানতের সুদের হার কমাচ্ছে। এমতাবস্থায় শুধু ঋণের সুদ নিয়ন্ত্রণ করে কার্যকর ফলাফল পাওয়া যাবে না। বরং আমানতের সুদের হারের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। এ ছাড়া ঋণ ও আমানতের পরিমাণের সঙ্গে তাদের স্ব স্ব সুদের হারের কোনো সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয় না।
এ থেকে প্রমাণিত হয়, বাংলাদেশের ব্যাংকিংব্যবস্থা প্রতিযোগিতামূলক নয়। এখানে আমানত সংগ্রহ বা বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য ব্যাংকগুলো সুদের হারের পরিবর্তনের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে তেমন কোনো প্রতিযোগিতা করে না। ফলে জাতীয় সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমিয়ে আনলে সুদের হারের ব্যবধান কমে আসবে বলে যাঁরা মতামত দিয়ে থাকেন, তা গ্রহণযোগ্য নয় বলেই প্রতীয়মান হয়। বরং আশঙ্কা করা হয়, প্রয়োজনে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদের হার শূন্য ভাগে নামিয়ে আনতেও পিছপা হবে না তাদের লভ্যাংশ বজায় রাখার স্বার্থে। কারণ, বাংলাদেশে এখনো ব্যাংকিং ব্যবস্থার বিকল্প তেমন কোনো ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি, যেখানে মানুষ তাদের আমানত রাখতে পারে। শেয়ারবাজারের প্রতি সাধারণ জনগণের তেমন আস্থাও নেই, এ সম্পর্কে তারা বিশেষভাবে অবহিতও নয়। ব্যাংকগুলো এ অবস্থার সুযোগ নিতেই পারে।
উচ্চ পরিচালনা ব্যয় ও মন্দ ঋণের হারকে সুদের হারের ব্যবধানের অন্যতম কারণ হিসেবে বিআইডিএসের গবেষণায় দেখানো হয়েছে। এ দুটি বিষয়ই ব্যাংকিংব্যবস্থায় ব্যবস্থাপনার অদক্ষতাকে নির্দেশ করে। ব্যাংকগুলোর শাখার সাজসজ্জা, কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা এবং পরিচালক কর্তৃক গৃহীত সুযোগ-সুবিধাকে একটি গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে নিয়ে আসা প্রয়োজন। অন্যদিকে অতিরিক্ত এবং অপ্রয়োজনীয় শাখা ও লোকবল কমিয়ে আনতে হবে। সর্বোপরি সেবার মান কীভাবে আরও বাড়ানো যায় সেদিকে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে বর্তমানে কু-ঋণের পরিমাণ মোট ঋণের পাঁচ থেকে ছয় শতাংশ। সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে এই হার ২০ শতাংশের বেশি। উচ্চ স্প্রেডের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো তাদের অদক্ষতা ঢাকার প্রয়াস পায় (লভ্যাংশ বজায় রাখার মাধ্যমে)। অথচ জনগণকে এর মূল্য দিতে হচ্ছে। তাই পরিচালনাগত ব্যয় এবং কু-ঋণের পরিমাণ কমানোর মাধ্যমে বর্তমান স্প্রেড আরও কিছুটা কমিয়ে আনা সম্ভব। গবেষণায় আরও দেখা যায়, বর্তমানে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোই (যারা ১৯৯৯ সালের আগে প্রতিষ্ঠিত) বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। অর্থাত্ তারাই সুদের হার নির্ধারণে ভূমিকা রাখছে। তাই এসব ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংকের আরও বেশি করে তদারক করা উচিত। তদুপরি, তাদের গ্রাহক কারা এবং কাদের কী হারে ঋণ দেওয়া হয়, তা ভালোভাবে নিরীক্ষা করা প্রয়োজন। কারণ, এসব ব্যাংক অর্থবাজারে একটি একচেটিয়ামূলক ব্যবস্থা তৈরির পেছনে ভূমিকা রাখছে।
আয়কর হারের সঙ্গেও সুদহারের ব্যবধানের কোনো তাত্পর্যপূর্ণ সম্পর্ক পাওয়া যায়নি। কাজেই, ব্যাংকাররা যে প্রায়শই উচ্চ প্রাতিষ্ঠানিক আয়করকে তাদের উচ্চ স্প্রেডের কারণ হিসেবে দেখান, তার কোনো ভিত্তি নেই।
আবার এখন সময় এসেছে বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বিষয়ে আরও খতিয়ে দেখার। বৈদেশিক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে এ দেশে অনুমতি দেওয়া হয় মূলত দুটি কারণে। প্রথমত, ব্যাংকিং ব্যবস্থায় প্রযুক্তির বিকাশ ঘটানো; দ্বিতীয়ত, ব্যাংকিং ব্যবস্থায় প্রতিযোগিতা বাড়ানোর। প্রযুক্তি বিকাশে বিদেশি ব্যাংকগুলো ভূমিকা রাখলেও তাদের ব্যাংকিংব্যবস্থা অনেকটাই অস্বচ্ছ। তারা বাংলাদেশের ব্যাংকিং জগতে প্রতিযোগিতা বাড়াতে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সুদবহির্ভূত আয় (কমিশন, ফি, মাশুল ইত্যাদি) অন্যান্য ব্যাংকের তুলনায় অনেক বেশি। তাদের ঋণ ও আমানতের সুদহারের ব্যবধানও অনেক বেশি। তাই তাদের ভূমিকা প্রতিযোগিতামূলক ব্যাংকিং ব্যবস্থার জন্য কতটা ফলদায়ক তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
সুতরাং, বাংলাদেশে সুদের হারের ব্যবধান আরও কমানোর সুযোগ রয়েছে। এর পেছনে যে কারণগুলো পাওয়া গেছে তা বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার জন্য মোটেও ভালো খবর নয়। দেশের অর্থনীতিকে আরও বেগবান করার জন্য ব্যাংকিংব্যবস্থাকে অধিকতর প্রতিযোগিতামূলক করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন ব্যাংকিংব্যবস্থায় পরিচালনাগত দক্ষতা বাড়ানো এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি জোরদার করা। বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান তদারকিব্যবস্থায় যথেষ্ট দুর্বলতা রয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে হবে।
স্বল্পমেয়াদে ঋণের সুদের হার নিয়ন্ত্রণ করার চেয়ে সুদের হারের স্প্রেড নিয়ন্ত্রণ অধিকতর সুফলদায়ক হতে পারে। বাংলাদেশের ব্যাংকিংব্যবস্থাকে প্রতিযোগিতামূলক করার জন্য সরকারি ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী করার কোনো বিকল্প নেই। এটি অবশ্য একটি দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ। দীর্ঘমেয়াদে মূলধনী বাজার ও বন্ড বাজার শক্তিশালী করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
ড. মনজুর হোসেন: গবেষক, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)।
monzur@sdnbd.org
No comments