আমার ভাষা আমার একুশ-লিপি সংস্কার: সিদ্ধান্ত নেবে কে by সৌরভ সিকদার
আমাদের মুখের ভাষা মূলত ধ্বনির সমষ্টি। সাধারণত ১২ থেকে ৬০টি ধ্বনি ব্যবহূত হয় পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায়। আর এই ধ্বনির প্রতীক হচ্ছে অক্ষর বা লিপি। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ‘বর্ণ’ শব্দটি এসেছে অনেক কাল আগে যখন বিভিন্ন বর্ণে বা রঙে অক্ষর লেখা হতো সেই বর্ণ বা রং থেকে। লিপি হচ্ছে ধ্বনির প্রতীক।
প্রত্যেক ভাষায় এই ধ্বনিগুলোর বৈচিত্র্য বা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য প্রকাশের জন্য স্বতন্ত্র লিপি ব্যবহার করা হয়। যদিও এই লিপি তার জন্য নির্ধারিত উচ্চারণ বা বৈশিষ্ট্য থেকে কখনো কখনো সরে আসে, তা সত্ত্বেও ভাষার অভ্যন্তরীণ গঠনের মধ্যে একটা শৃঙ্খলা আছে। সেই শৃঙ্খলা বা নিয়ম অনুসন্ধানের কাজ করেন ভাষাবিজ্ঞানী।
বাংলা লিপির জন্ম ব্রাহ্মী লিপি থেকে। কিন্তু প্রথম থেকে এটি গড়ে তোলা হয়েছিল পুরোপুরি সংস্কৃতের আদলে। সে কারণে এর বর্ণগুলোয় সংস্কৃতের প্রভাব রয়ে গেছে। হাজার বছরে বদলে গেছে বাঙালির মুখের ভাষা, তবে তেমন একটা বদলায়নি এর লিপি। হ্যালহেডের ব্যাকরণ ছাপতে গিয়ে হুগলির পঞ্চানন কর্মকারের হাতে তৈরি হয়েছিল সচল বাংলা হরফ বা লিপি। সেই লিপিই এখনো আদর্শ ধরে এগিয়ে চলছে, সচল রেখেছে লেখার বাংলা ভাষা।
বাংলা লিপি সংস্কারের প্রসঙ্গে এলে প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো যে আমরা বাংলা ভাষায় প্রচলিত লিপি পরিবর্তন করে রোমান হরফ গ্রহণের কথা আদৌ ভাবছি না। যেমনটি মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়া বা সাম্প্রতিক সময়ে ভিয়েতনাম করেছে। বাংলা লিপি বানান, উচ্চারণ ও পঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কাজেই লিপি সংস্কারের সঙ্গে এ বিষয়গুলোও বিবেচনায় রাখতে হবে। লিখন ও পঠনের দিক থেকে বিবেচনা করলে এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে বাংলা লিপি বেশ জটিল এবং অসুবিধাজনকও। আর এর প্রধান কারণ যুক্তবর্ণের আধিক্য এবং স্বর ও ব্যঞ্জন বর্ণ। শুধু চিহ্নই নয়, এক বর্ণের একাধিক চিহ্ন বিদ্যমান। যেমন দীর্ঘ ঊ-কারের ( ূ) চিহ্ন: কখনো ‘রূপ’, কখনো‘ রূপ’। যুক্ত ব্যঞ্জনের ক্ষেত্রে এ সমস্যা আরও প্রকট: ‘ক’ ও ‘ত’ বর্ণ যুক্ত হলে ‘ক্ত’ হয়, ক+ষ=ক্ষ, হ+ম= হ্ম। এ রকম অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে যেখানে দুটি ব্যঞ্জন যুক্ত হয়ে নতুন ও সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ লাভ করে। ইংরেজি ভাষায় এ ধরনের অসুবিধা না হলেও চীনা বা জাপানি ভাষায় বর্ণমালা আরও জটিল। বাংলা লিপি সংস্কার অবশ্যই যুক্তাক্ষর বর্জন করে নয়। (বিদেশি শব্দ লেখার ক্ষেত্রে কখনো কখনো যুক্তাক্ষর ভাঙার পরামর্শ দিয়েছে বাংলা একাডেমী, যেমন অকেটাবর)।
ভাষাবিজ্ঞানের গবেষক অধ্যাপক সাখাওয়াত্ আনসারী এ বিষয়ে বলেন, ‘লিপি সংস্কার বিষয়টি বাংলা লেখনরীতি সংস্কারের পূর্ণ সমার্থক নয়। বস্তুত, লিপি সংস্কার হচ্ছে বাংলা লেখনরীতির একটি দিক মাত্র। অন্য দুটি দিক হচ্ছে বর্ণ সংস্কার এবং বানান সংস্কার। লিপি সংস্কার হচ্ছে বর্তমানে বাংলা লেখায় ব্যবহূত যে কোন চিহ্ন বা লিপিমূলের আকৃতিগত পরিবর্তন সাধন। বর্ণ সংস্কার হল ৫০টি বর্ণের যে কোন ধরনের সংযোজন-বিয়োজন। আর বানান সংস্কার হচ্ছে লৈখিক শব্দ গঠনে ব্যবহূত লিপিমূলসমূহের বিন্যাসগত পরিবর্তন সাধন। এই তিনের সম্পর্ক যেমন আছে, পার্থক্যও রয়েছে তেমনি। সমাজ-সংস্কৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে লেখনরীতির সংস্কারও অবশ্যই কাম্য। তবে পরিবর্তন প্রয়াস হতে হবে বাংলা ভাষা ঐক্যকামী এবং কোন ক্রমেই ঐক্যবিনাশী নয়। সংস্কারের নামে বাংলাভাষী অঞ্চলের পূর্বাংশকে পশ্চিমাংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা যাবে না। পরিবর্তন প্রয়াস হতে হবে পরিপূর্ণ ভাষাবিজ্ঞান অনুগামী এবং ভাষা পরিকল্পনার তাত্ত্বিক কাঠামো সমর্থিত’...।
একসময় সাধুভাষার প্রচলন ছিল। প্রমথ চৌধুরী এবং আরও অনেকে সংগ্রাম করে চলিত ভাষার পক্ষ নিয়েছিলেন। নানা বিবাদ-বিতর্কের পর শেষ পর্যন্ত চলিত বা কথ্য ভাষারই জয় হয়েছে। এর জন্য সময়ও লেগেছে অনেক। প্রমিত ভাষা লেখার ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে প্রায় ১০০ বছর লেগেছে। বাংলা লিপি নিয়ে কথা বললে বিশেষ করে লিপি সংস্কারের প্রসঙ্গে একই বিতর্ক রয়েছে। এই বিতর্ক দুটি পক্ষের মধ্যে। একদল সংস্কারের পক্ষে, অন্যরা বিপক্ষে। বাংলা লিপির হাজার বছরের ঐতিহ্য ও মর্যাদা রেখে যদি একে যুগের উপযোগী করে সংস্কার করা হয়, বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে, তাহলে আমাদের লাভ ছাড়া কোনো ক্ষতি দেখি না।
বাংলা লিপি ধ্বনিমূলক না হয়ে অক্ষরমূলক হওয়ায় লেখা ও পড়ার ক্ষেত্রে যেমন পার্থক্য তৈরি হয়েছে, তেমনি মুদ্রণশিল্প প্রসারের আগে লিপিকরদের হাতে (তাদের লেখার সুবিধা ও শ্রম লাঘবের জন্য) যে বিকৃতি ঘটেছে, আজ এই কম্পিউটার কম্পোজ প্রযুক্তির যুগে তা রাখার যৌক্তিকতা কতটুকু এ বিষয়ে ভাবার প্রয়োজন আছে। ফারসি ভাষা যখন আরবি হরফ নিয়েছিল তখন ফারসিতে সুবিধামতো সংযোজন করেছিল, একইভাবে উর্দু যখন আরবি হরফ গ্রহণ করে তখন তাদের ভাষায়ও অনুরূপ ঘটেছিল। অর্থাত্ প্রত্যেক ভাষাই তার প্রয়োজন অনুসারে লিপিসংস্কার করার অধিকার রাখে। ১৭৭৮ সালে হ্যালহেড বাংলা লিপি বিষয়ে তাঁর এ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ বইয়ে লিখেছিলেন, ‘প্রত্যেক বিজ্ঞানেরই প্রাথমিক সূত্র হওয়া উচিত সরল, সহজ ও সুবোধ্য। অক্ষরবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এ কথাটি বিশেষভাবে প্রযোজ্য। অক্ষর মানুষ শৈশবে শেখে। তাই এমন কিছু থাকা উচিত নয় যা অপ্রয়োজনীয়। মনোযোগ ব্যাহত করে অথবা স্মৃতিকে পঙ্গু করে দেয়।’ আমাদের বাংলা লিপির বর্তমান অবস্থা এবং সংস্কার প্রসঙ্গে এ বিষয়টি বিবেচনার অবকাশ রয়েছে। প্রায় আড়াই শ বছর আগে হ্যালহেড যুক্ত ব্যঞ্জনের দুর্বোধ্য রূপ ত্যাগ করে (ঙ্গ>ঙ্গ, গু>গু, রু>রু প্রভৃতি) স্বচ্ছ রূপ দিয়েছিলেন। রামমোহন হ্যালহেডকে সমর্থন করলেও তা চালু করা যায়নি। কিন্তু ১৯৮৪ সালে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও টেক্সটবুক বোর্ড শেষ পর্যন্ত ফিরে গেল হ্যালহেডের কাছেই। কাজেই সংস্কার নিয়ে যত বিতর্কই থাক, দুই-আড়াই শ বছর আগের সিদ্ধান্ত যদি আমরা একালে বাস্তবায়নে উদ্যোগী হই এবং প্রয়োজন মনে করি, তাহলে লিপিবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক দিক বিবেচনা করে উত্তরপুরুষের হাতে ছেড়ে দেওয়া বিদ্যাসাগরের অপূর্ণ সংস্কার পাঁচটি [১. উ-কারের একাধিক চিহ্ন বর্জন, ২. হাতল চিহ্নের ( ূ) বহুরূপ বর্জন, ৩. যুক্তবর্ণে ‘ণ’-এর স্পষ্ট রূপ গ্রহণ, ৪. তু বোঝাতে ত্ত (স্তু/ন্তু) বাতিল করে স্তু/ন্তু নির্ধারণ, ৫. ক+ত=ক্ত বাতিল করে ক্ত প্রচলন] নিয়ে একুশ শতকের বাংলা ভাষাতাত্ত্বিকেরা ভেবে দেখতে পারেন।
বাংলা বর্ণমালার অনেক বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেমন কোণওয়ালা, অগোল, মাত্রাযুক্ত, মাত্রাছাড়া প্রভৃতি। এগুলো আমাদের আলোচনার বিষয় নয়। মূলত, বাংলা লিপি বা বর্ণমালার কোন রূপ কেমন হওয়া উচিত এবং কোনো কিছু সংযোজন-বিয়োজন প্রয়োজন কি না সেটাই আলোচ্য। বাংলা লিপি কেমন হলে আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য সহজ হয়, কম্পিউটার ব্যবহার করতে সুবিধা হয়, অল্প কালি আর কাগজে অনেক লেখা সম্ভব সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে ভাষাবিজ্ঞানীদের বিস্তর গবেষণা করার প্রয়োজন রয়েছে। হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, ‘কোন লিপি বিজ্ঞানসম্মত? ভাষা যে-লিপি সহজতম উপায়ে নির্ভুলভাবে ধরে রাখতে পারে, তাই সর্বাধিক বিজ্ঞানসম্মত’...।
১৭৭৮ সালের পর বাংলা বর্ণমালায় নতুন যোগ হয় ‘ড়’ ‘ঢ়’ এবং ‘য়’ এই তিনটি বর্ণ। উনিশ শতকে আমাদের বর্ণ থেকে ঝরে গেছে লি (৯) বর্ণটি। বাংলা বর্ণমালায় এমন কতগুলো লিপি আছে যেগুলোর উচ্চারণ কথ্য বাংলায় নেই। আবার ধ্বনি উচ্চারিত হয় ‘অ্যা’ কিন্তু তা লিপিকোষে নেই। একই ধ্বনি উচ্চারণের জন্য দুটি বর্ণ রয়েছে, যেমন ‘ত’ এবং ‘ত্’। ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক বাংলা লিপি সংস্কারের ক্ষেত্রে বর্ণহ্রাসবিরোধী কিন্তু তিনি লিপির বিন্যাস পরিবর্তনের পক্ষে। বিশেষ করে বিভিন্ন ‘কার’। যুক্ত ব্যঞ্জন ভেঙে অর্থাত্ তিন বর্ণের যুক্তকের প্রথম বর্ণকে হসন্ত দিয়ে পৃথক করার পক্ষে। যেমন যন্ত্র> যন্ত্র (মনীষা-মঞ্জুষা, ১৯৭৬)। অন্যদিকে মনসুর মুসার মত হচ্ছে, কোনোক্রমেই যুক্তবর্ণ ভাঙা চলবে না। অথচ ১৯৬১ সালে মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী যুক্ত ব্যঞ্জন ভাঙার পর প্রত্যেকটি ধ্বনিবর্গের জন্য একটি চিহ্ন প্রয়োগ এবং ১৫টি বর্ণ বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন (বাংলা বানান ও লিপি সংস্কার)। পবিত্র সরকার ‘কার’, ‘ফলা’ সংস্কারসহ বর্ণের স্বচ্ছ রূপের পক্ষে। আমরা মনে করি, ভাষার লিখিত রূপ যেমন সহজ, সরল ও স্পষ্ট হতে হবে তেমনি অনিবার্য বা বোঝা না হলে ঐতিহ্যময় প্রচলিত বাংলা লিপি বাদ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। লিপির সৌকর্যের দিকটিও বিবেচ্য।
সৌরভ সিকদার: অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলা লিপির জন্ম ব্রাহ্মী লিপি থেকে। কিন্তু প্রথম থেকে এটি গড়ে তোলা হয়েছিল পুরোপুরি সংস্কৃতের আদলে। সে কারণে এর বর্ণগুলোয় সংস্কৃতের প্রভাব রয়ে গেছে। হাজার বছরে বদলে গেছে বাঙালির মুখের ভাষা, তবে তেমন একটা বদলায়নি এর লিপি। হ্যালহেডের ব্যাকরণ ছাপতে গিয়ে হুগলির পঞ্চানন কর্মকারের হাতে তৈরি হয়েছিল সচল বাংলা হরফ বা লিপি। সেই লিপিই এখনো আদর্শ ধরে এগিয়ে চলছে, সচল রেখেছে লেখার বাংলা ভাষা।
বাংলা লিপি সংস্কারের প্রসঙ্গে এলে প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো যে আমরা বাংলা ভাষায় প্রচলিত লিপি পরিবর্তন করে রোমান হরফ গ্রহণের কথা আদৌ ভাবছি না। যেমনটি মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়া বা সাম্প্রতিক সময়ে ভিয়েতনাম করেছে। বাংলা লিপি বানান, উচ্চারণ ও পঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কাজেই লিপি সংস্কারের সঙ্গে এ বিষয়গুলোও বিবেচনায় রাখতে হবে। লিখন ও পঠনের দিক থেকে বিবেচনা করলে এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে বাংলা লিপি বেশ জটিল এবং অসুবিধাজনকও। আর এর প্রধান কারণ যুক্তবর্ণের আধিক্য এবং স্বর ও ব্যঞ্জন বর্ণ। শুধু চিহ্নই নয়, এক বর্ণের একাধিক চিহ্ন বিদ্যমান। যেমন দীর্ঘ ঊ-কারের ( ূ) চিহ্ন: কখনো ‘রূপ’, কখনো‘ রূপ’। যুক্ত ব্যঞ্জনের ক্ষেত্রে এ সমস্যা আরও প্রকট: ‘ক’ ও ‘ত’ বর্ণ যুক্ত হলে ‘ক্ত’ হয়, ক+ষ=ক্ষ, হ+ম= হ্ম। এ রকম অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে যেখানে দুটি ব্যঞ্জন যুক্ত হয়ে নতুন ও সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ লাভ করে। ইংরেজি ভাষায় এ ধরনের অসুবিধা না হলেও চীনা বা জাপানি ভাষায় বর্ণমালা আরও জটিল। বাংলা লিপি সংস্কার অবশ্যই যুক্তাক্ষর বর্জন করে নয়। (বিদেশি শব্দ লেখার ক্ষেত্রে কখনো কখনো যুক্তাক্ষর ভাঙার পরামর্শ দিয়েছে বাংলা একাডেমী, যেমন অকেটাবর)।
ভাষাবিজ্ঞানের গবেষক অধ্যাপক সাখাওয়াত্ আনসারী এ বিষয়ে বলেন, ‘লিপি সংস্কার বিষয়টি বাংলা লেখনরীতি সংস্কারের পূর্ণ সমার্থক নয়। বস্তুত, লিপি সংস্কার হচ্ছে বাংলা লেখনরীতির একটি দিক মাত্র। অন্য দুটি দিক হচ্ছে বর্ণ সংস্কার এবং বানান সংস্কার। লিপি সংস্কার হচ্ছে বর্তমানে বাংলা লেখায় ব্যবহূত যে কোন চিহ্ন বা লিপিমূলের আকৃতিগত পরিবর্তন সাধন। বর্ণ সংস্কার হল ৫০টি বর্ণের যে কোন ধরনের সংযোজন-বিয়োজন। আর বানান সংস্কার হচ্ছে লৈখিক শব্দ গঠনে ব্যবহূত লিপিমূলসমূহের বিন্যাসগত পরিবর্তন সাধন। এই তিনের সম্পর্ক যেমন আছে, পার্থক্যও রয়েছে তেমনি। সমাজ-সংস্কৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে লেখনরীতির সংস্কারও অবশ্যই কাম্য। তবে পরিবর্তন প্রয়াস হতে হবে বাংলা ভাষা ঐক্যকামী এবং কোন ক্রমেই ঐক্যবিনাশী নয়। সংস্কারের নামে বাংলাভাষী অঞ্চলের পূর্বাংশকে পশ্চিমাংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা যাবে না। পরিবর্তন প্রয়াস হতে হবে পরিপূর্ণ ভাষাবিজ্ঞান অনুগামী এবং ভাষা পরিকল্পনার তাত্ত্বিক কাঠামো সমর্থিত’...।
একসময় সাধুভাষার প্রচলন ছিল। প্রমথ চৌধুরী এবং আরও অনেকে সংগ্রাম করে চলিত ভাষার পক্ষ নিয়েছিলেন। নানা বিবাদ-বিতর্কের পর শেষ পর্যন্ত চলিত বা কথ্য ভাষারই জয় হয়েছে। এর জন্য সময়ও লেগেছে অনেক। প্রমিত ভাষা লেখার ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে প্রায় ১০০ বছর লেগেছে। বাংলা লিপি নিয়ে কথা বললে বিশেষ করে লিপি সংস্কারের প্রসঙ্গে একই বিতর্ক রয়েছে। এই বিতর্ক দুটি পক্ষের মধ্যে। একদল সংস্কারের পক্ষে, অন্যরা বিপক্ষে। বাংলা লিপির হাজার বছরের ঐতিহ্য ও মর্যাদা রেখে যদি একে যুগের উপযোগী করে সংস্কার করা হয়, বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে, তাহলে আমাদের লাভ ছাড়া কোনো ক্ষতি দেখি না।
বাংলা লিপি ধ্বনিমূলক না হয়ে অক্ষরমূলক হওয়ায় লেখা ও পড়ার ক্ষেত্রে যেমন পার্থক্য তৈরি হয়েছে, তেমনি মুদ্রণশিল্প প্রসারের আগে লিপিকরদের হাতে (তাদের লেখার সুবিধা ও শ্রম লাঘবের জন্য) যে বিকৃতি ঘটেছে, আজ এই কম্পিউটার কম্পোজ প্রযুক্তির যুগে তা রাখার যৌক্তিকতা কতটুকু এ বিষয়ে ভাবার প্রয়োজন আছে। ফারসি ভাষা যখন আরবি হরফ নিয়েছিল তখন ফারসিতে সুবিধামতো সংযোজন করেছিল, একইভাবে উর্দু যখন আরবি হরফ গ্রহণ করে তখন তাদের ভাষায়ও অনুরূপ ঘটেছিল। অর্থাত্ প্রত্যেক ভাষাই তার প্রয়োজন অনুসারে লিপিসংস্কার করার অধিকার রাখে। ১৭৭৮ সালে হ্যালহেড বাংলা লিপি বিষয়ে তাঁর এ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গলি ল্যাংগুয়েজ বইয়ে লিখেছিলেন, ‘প্রত্যেক বিজ্ঞানেরই প্রাথমিক সূত্র হওয়া উচিত সরল, সহজ ও সুবোধ্য। অক্ষরবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এ কথাটি বিশেষভাবে প্রযোজ্য। অক্ষর মানুষ শৈশবে শেখে। তাই এমন কিছু থাকা উচিত নয় যা অপ্রয়োজনীয়। মনোযোগ ব্যাহত করে অথবা স্মৃতিকে পঙ্গু করে দেয়।’ আমাদের বাংলা লিপির বর্তমান অবস্থা এবং সংস্কার প্রসঙ্গে এ বিষয়টি বিবেচনার অবকাশ রয়েছে। প্রায় আড়াই শ বছর আগে হ্যালহেড যুক্ত ব্যঞ্জনের দুর্বোধ্য রূপ ত্যাগ করে (ঙ্গ>ঙ্গ, গু>গু, রু>রু প্রভৃতি) স্বচ্ছ রূপ দিয়েছিলেন। রামমোহন হ্যালহেডকে সমর্থন করলেও তা চালু করা যায়নি। কিন্তু ১৯৮৪ সালে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও টেক্সটবুক বোর্ড শেষ পর্যন্ত ফিরে গেল হ্যালহেডের কাছেই। কাজেই সংস্কার নিয়ে যত বিতর্কই থাক, দুই-আড়াই শ বছর আগের সিদ্ধান্ত যদি আমরা একালে বাস্তবায়নে উদ্যোগী হই এবং প্রয়োজন মনে করি, তাহলে লিপিবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক দিক বিবেচনা করে উত্তরপুরুষের হাতে ছেড়ে দেওয়া বিদ্যাসাগরের অপূর্ণ সংস্কার পাঁচটি [১. উ-কারের একাধিক চিহ্ন বর্জন, ২. হাতল চিহ্নের ( ূ) বহুরূপ বর্জন, ৩. যুক্তবর্ণে ‘ণ’-এর স্পষ্ট রূপ গ্রহণ, ৪. তু বোঝাতে ত্ত (স্তু/ন্তু) বাতিল করে স্তু/ন্তু নির্ধারণ, ৫. ক+ত=ক্ত বাতিল করে ক্ত প্রচলন] নিয়ে একুশ শতকের বাংলা ভাষাতাত্ত্বিকেরা ভেবে দেখতে পারেন।
বাংলা বর্ণমালার অনেক বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেমন কোণওয়ালা, অগোল, মাত্রাযুক্ত, মাত্রাছাড়া প্রভৃতি। এগুলো আমাদের আলোচনার বিষয় নয়। মূলত, বাংলা লিপি বা বর্ণমালার কোন রূপ কেমন হওয়া উচিত এবং কোনো কিছু সংযোজন-বিয়োজন প্রয়োজন কি না সেটাই আলোচ্য। বাংলা লিপি কেমন হলে আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য সহজ হয়, কম্পিউটার ব্যবহার করতে সুবিধা হয়, অল্প কালি আর কাগজে অনেক লেখা সম্ভব সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে ভাষাবিজ্ঞানীদের বিস্তর গবেষণা করার প্রয়োজন রয়েছে। হুমায়ুন আজাদ বলেছেন, ‘কোন লিপি বিজ্ঞানসম্মত? ভাষা যে-লিপি সহজতম উপায়ে নির্ভুলভাবে ধরে রাখতে পারে, তাই সর্বাধিক বিজ্ঞানসম্মত’...।
১৭৭৮ সালের পর বাংলা বর্ণমালায় নতুন যোগ হয় ‘ড়’ ‘ঢ়’ এবং ‘য়’ এই তিনটি বর্ণ। উনিশ শতকে আমাদের বর্ণ থেকে ঝরে গেছে লি (৯) বর্ণটি। বাংলা বর্ণমালায় এমন কতগুলো লিপি আছে যেগুলোর উচ্চারণ কথ্য বাংলায় নেই। আবার ধ্বনি উচ্চারিত হয় ‘অ্যা’ কিন্তু তা লিপিকোষে নেই। একই ধ্বনি উচ্চারণের জন্য দুটি বর্ণ রয়েছে, যেমন ‘ত’ এবং ‘ত্’। ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক বাংলা লিপি সংস্কারের ক্ষেত্রে বর্ণহ্রাসবিরোধী কিন্তু তিনি লিপির বিন্যাস পরিবর্তনের পক্ষে। বিশেষ করে বিভিন্ন ‘কার’। যুক্ত ব্যঞ্জন ভেঙে অর্থাত্ তিন বর্ণের যুক্তকের প্রথম বর্ণকে হসন্ত দিয়ে পৃথক করার পক্ষে। যেমন যন্ত্র> যন্ত্র (মনীষা-মঞ্জুষা, ১৯৭৬)। অন্যদিকে মনসুর মুসার মত হচ্ছে, কোনোক্রমেই যুক্তবর্ণ ভাঙা চলবে না। অথচ ১৯৬১ সালে মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী যুক্ত ব্যঞ্জন ভাঙার পর প্রত্যেকটি ধ্বনিবর্গের জন্য একটি চিহ্ন প্রয়োগ এবং ১৫টি বর্ণ বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন (বাংলা বানান ও লিপি সংস্কার)। পবিত্র সরকার ‘কার’, ‘ফলা’ সংস্কারসহ বর্ণের স্বচ্ছ রূপের পক্ষে। আমরা মনে করি, ভাষার লিখিত রূপ যেমন সহজ, সরল ও স্পষ্ট হতে হবে তেমনি অনিবার্য বা বোঝা না হলে ঐতিহ্যময় প্রচলিত বাংলা লিপি বাদ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। লিপির সৌকর্যের দিকটিও বিবেচ্য।
সৌরভ সিকদার: অধ্যাপক, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments