বাফুফের নির্বাচনী শিক্ষা by মেজবাহ উদ্দীন
সবকিছু খুব কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতাই আলাদা। গতবারের মতো এবারও বাফুফের নির্বাচনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলাম। তাই অনেক কিছুই আমার চোখের সামনে হয়েছে। এই নির্বাচন নিয়ে অসন্তোষ আছে অনেকেরই। কিছু গুরুতর অভিযোগও শোনা যাচ্ছে। ২০০৮-এর নির্বাচনটা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। প্রশংসিতও। এবারের নির্বাচন তা নয়।
যদিও এ জন্য কেউ নির্বাচন কমিশনকে দায়ী করেননি। কিন্তু নির্বাচনী যেকোনো ব্যর্থতার দায় নির্বাচন কমিশনেরই। তাই অভিযোগ খতিয়ে দেখা দরকার। ভবিষ্যৎ করণীয় ঠিক করাও সময়ের দাবি।
আমার অভিজ্ঞতা হলো—ফিফার মডেল গঠনতন্ত্রের অধীনে বাফুফে নির্বাচন খুব দৃঢ় ভিত্তি পায়নি। এটি এখনো অনেকাংশে পরীক্ষামূলক এবং আজও ‘যৎকালে তৎব্যবস্থা’ মনোভাবে আটকে আছে। প্রয়োজনীয় অনেক বিধিবিধানই নেই। নির্বাচনী বিধিমালার অনুপস্থিতি বড় বেশি চোখ লাগে।
নির্বাচন এলেই তড়িঘড়ি একটা বিধিমালা দাঁড় করানো হয়। অনেক সময় বিধিমালা শিথিল করতে চাপ বাড়ে। ফলে একটা অনিশ্চয়তা সব সময়ই ভর করে। নীতিমালা পাস করার কথা কংগ্রেসে। কেননা কংগ্রেসই সব ক্ষমতার অধিকারী। কংগ্রেসকে পাশ কাটিয়ে নির্বাহী কমিটি অনুমোদিত বিধিমালার বৈধতা প্রশ্নসাপেক্ষই।
এবার সভাপতি পদে প্রার্থিতা প্রত্যাহার নিয়ে সবচেয়ে অস্বস্তিকর অবস্থা হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করলে পরে আর সুযোগ থাকে না। এটাই বিধিমালা। নির্বাচন কমিশন সেই অবস্থানই নিয়েছিল। সংবাদমাধ্যমও তা সমর্থন করেছে। কিন্তু পরে দেখা গেল, ফিফা প্রতিনিধি এ নিয়ে মধ্যস্থতায় নেমেছেন। সংশ্লিষ্ট প্রার্থীকে কংগ্রেসে সামনে হাজির করে স্বেচ্ছায় সরে যাওয়ার প্রমাণ দিয়েছেন। কিন্তু নিয়ম নিয়মই। অনিচ্ছুক প্রার্থীকে জোর করে ভোটে টেনে আনার চেয়ে তাঁকে সরে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া ভালো—এটা নীতিমালার সঙ্গে যায় না। তাই পুরো নির্বাচনই প্রশ্নবিদ্ধ। সালাউদ্দিনের সভাপতি নির্বাচিত হওয়া ছিল সময়ের ব্যাপার। ভোটে নির্বাচিত হলে তাঁর সম্মান আরও অনেক বাড়ত।
সালাউদ্দিনের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বীর নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার বোধোদয় এত দেরিতে কেন হলো? প্রশ্ন থেকেই যাবে। কংগ্রেস অনুমোদিত একটি স্থায়ী নির্বাচনী বিধিমালা থাকলে নিয়মের হেরফের হওয়ার সুযোগই থাকত না। এত বিতর্কও হতো না। বাইরের হস্তক্ষেপ প্রশ্রয় দেওয়া হলে বিতর্ক বাড়বেই। যা কারও জন্যই ভালো নয়।
এই নির্বাচনের মাত্র কয়েক দিন আগে জেলা ও বিভাগীয় ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন মানে ডিএফএ নির্বাচনের জন্য বাফুফে নির্দেশ দিয়েছিল। তড়িঘড়ি করে ডিএফএতে আদৌ নির্বাচন হয়েছে কি না, প্রশ্ন সাপেক্ষ। এ নিয়ে কোথাও কোথাও মামলাও হয়েছে। অভিযোগ আছে, কেন্দ্রের আস্থাভাজন অনেক পকেট কমিটি হয়েছে। কেন্দ্রের আস্থাভাজন না হলে বাদ দেওয়ার চেষ্টাও হয়েছে বলে শুনেছি।
বাফুফে থেকে ডিএফএ নিয়ন্ত্রণ করা ব্যক্তিরা পরে প্রার্থী হয়েছেন। সুতরাং তাঁদের ভূমিকা প্রশ্ন সাপেক্ষ। স্থানীয় সংস্থাগুলোর নির্বাচনী বিধিমালা থাকা খুবই দরকার। তাহলে তারা নিজ সংস্থার নির্বাচন সময়মতো করতে পারত। পকেট কমিটির কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না। বাফুফে থেকেও কিছু আদায়ের সামর্থ্যও ওই সব পকেট কমিটি রাখে না। দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহির দায় থেকে অলিখিত ছাড় পেয়ে যায় বাফুফে।
জবাবদিহির আইনি কাঠামো গড়ে না ওঠায় বাফুফেতে এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। মাঠপর্যায়ে ফুটবল অবহেলিত থাকা, অনেক দিন ধরে এজিএমে অডিট রিপোর্ট পাস না করা এর বড় উদাহরণ।
ভোট বিক্রয়যোগ্য পণ্য হলে ধনাঢ্যরা আকৃষ্ট হবেনই। জেলায় প্রকৃত নির্বাচন হলে সচেতন ভোটার আসত। অভিযোগ আছে, কোনো কোনো প্রার্থী ভোটারদের নামী হোটেলে রেখেছেন। টাকা লেনদেনের অভিযোগের কথা তো এখন খবরের কাগজে দেখছি।
আজকাল মুঠোফোনে ওই সব অনৈতিক কাজ সহজেই ক্যামেরাবন্দী করা যায়। কিন্তু তা কেউ করেননি। তাহলে বিষয়টি প্রমাণ করা যেত। কিন্তু অনৈতিক কাজ ধরিয়ে দেওয়ার মানসিকতা কারও মধ্যেই দেখা গেল না। যদি তাঁর বাক্সে ভোট না পড়ে! এই ভয়ে।
এভাবে নীরব দর্শক থাকলে আর চলবে না। বাংলাদেশের ফুটবলের দুরবস্থাও ঘুচবে না। সহসাই যোগ্য ফুটবল সংগঠকদের জায়গা নেবে ধনাঢ্যরা। তাই ফুটবল প্রশাসনের আপাদমস্তক নিয়ম প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। বাফুফের নতুন কমিটির এটি অন্যতম দায়িত্ব।
লেখক: প্রধান নির্বাচন কমিশনার, বাফুফে নির্বাচন-২০১২।
আমার অভিজ্ঞতা হলো—ফিফার মডেল গঠনতন্ত্রের অধীনে বাফুফে নির্বাচন খুব দৃঢ় ভিত্তি পায়নি। এটি এখনো অনেকাংশে পরীক্ষামূলক এবং আজও ‘যৎকালে তৎব্যবস্থা’ মনোভাবে আটকে আছে। প্রয়োজনীয় অনেক বিধিবিধানই নেই। নির্বাচনী বিধিমালার অনুপস্থিতি বড় বেশি চোখ লাগে।
নির্বাচন এলেই তড়িঘড়ি একটা বিধিমালা দাঁড় করানো হয়। অনেক সময় বিধিমালা শিথিল করতে চাপ বাড়ে। ফলে একটা অনিশ্চয়তা সব সময়ই ভর করে। নীতিমালা পাস করার কথা কংগ্রেসে। কেননা কংগ্রেসই সব ক্ষমতার অধিকারী। কংগ্রেসকে পাশ কাটিয়ে নির্বাহী কমিটি অনুমোদিত বিধিমালার বৈধতা প্রশ্নসাপেক্ষই।
এবার সভাপতি পদে প্রার্থিতা প্রত্যাহার নিয়ে সবচেয়ে অস্বস্তিকর অবস্থা হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করলে পরে আর সুযোগ থাকে না। এটাই বিধিমালা। নির্বাচন কমিশন সেই অবস্থানই নিয়েছিল। সংবাদমাধ্যমও তা সমর্থন করেছে। কিন্তু পরে দেখা গেল, ফিফা প্রতিনিধি এ নিয়ে মধ্যস্থতায় নেমেছেন। সংশ্লিষ্ট প্রার্থীকে কংগ্রেসে সামনে হাজির করে স্বেচ্ছায় সরে যাওয়ার প্রমাণ দিয়েছেন। কিন্তু নিয়ম নিয়মই। অনিচ্ছুক প্রার্থীকে জোর করে ভোটে টেনে আনার চেয়ে তাঁকে সরে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া ভালো—এটা নীতিমালার সঙ্গে যায় না। তাই পুরো নির্বাচনই প্রশ্নবিদ্ধ। সালাউদ্দিনের সভাপতি নির্বাচিত হওয়া ছিল সময়ের ব্যাপার। ভোটে নির্বাচিত হলে তাঁর সম্মান আরও অনেক বাড়ত।
সালাউদ্দিনের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বীর নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার বোধোদয় এত দেরিতে কেন হলো? প্রশ্ন থেকেই যাবে। কংগ্রেস অনুমোদিত একটি স্থায়ী নির্বাচনী বিধিমালা থাকলে নিয়মের হেরফের হওয়ার সুযোগই থাকত না। এত বিতর্কও হতো না। বাইরের হস্তক্ষেপ প্রশ্রয় দেওয়া হলে বিতর্ক বাড়বেই। যা কারও জন্যই ভালো নয়।
এই নির্বাচনের মাত্র কয়েক দিন আগে জেলা ও বিভাগীয় ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন মানে ডিএফএ নির্বাচনের জন্য বাফুফে নির্দেশ দিয়েছিল। তড়িঘড়ি করে ডিএফএতে আদৌ নির্বাচন হয়েছে কি না, প্রশ্ন সাপেক্ষ। এ নিয়ে কোথাও কোথাও মামলাও হয়েছে। অভিযোগ আছে, কেন্দ্রের আস্থাভাজন অনেক পকেট কমিটি হয়েছে। কেন্দ্রের আস্থাভাজন না হলে বাদ দেওয়ার চেষ্টাও হয়েছে বলে শুনেছি।
বাফুফে থেকে ডিএফএ নিয়ন্ত্রণ করা ব্যক্তিরা পরে প্রার্থী হয়েছেন। সুতরাং তাঁদের ভূমিকা প্রশ্ন সাপেক্ষ। স্থানীয় সংস্থাগুলোর নির্বাচনী বিধিমালা থাকা খুবই দরকার। তাহলে তারা নিজ সংস্থার নির্বাচন সময়মতো করতে পারত। পকেট কমিটির কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না। বাফুফে থেকেও কিছু আদায়ের সামর্থ্যও ওই সব পকেট কমিটি রাখে না। দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহির দায় থেকে অলিখিত ছাড় পেয়ে যায় বাফুফে।
জবাবদিহির আইনি কাঠামো গড়ে না ওঠায় বাফুফেতে এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। মাঠপর্যায়ে ফুটবল অবহেলিত থাকা, অনেক দিন ধরে এজিএমে অডিট রিপোর্ট পাস না করা এর বড় উদাহরণ।
ভোট বিক্রয়যোগ্য পণ্য হলে ধনাঢ্যরা আকৃষ্ট হবেনই। জেলায় প্রকৃত নির্বাচন হলে সচেতন ভোটার আসত। অভিযোগ আছে, কোনো কোনো প্রার্থী ভোটারদের নামী হোটেলে রেখেছেন। টাকা লেনদেনের অভিযোগের কথা তো এখন খবরের কাগজে দেখছি।
আজকাল মুঠোফোনে ওই সব অনৈতিক কাজ সহজেই ক্যামেরাবন্দী করা যায়। কিন্তু তা কেউ করেননি। তাহলে বিষয়টি প্রমাণ করা যেত। কিন্তু অনৈতিক কাজ ধরিয়ে দেওয়ার মানসিকতা কারও মধ্যেই দেখা গেল না। যদি তাঁর বাক্সে ভোট না পড়ে! এই ভয়ে।
এভাবে নীরব দর্শক থাকলে আর চলবে না। বাংলাদেশের ফুটবলের দুরবস্থাও ঘুচবে না। সহসাই যোগ্য ফুটবল সংগঠকদের জায়গা নেবে ধনাঢ্যরা। তাই ফুটবল প্রশাসনের আপাদমস্তক নিয়ম প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। বাফুফের নতুন কমিটির এটি অন্যতম দায়িত্ব।
লেখক: প্রধান নির্বাচন কমিশনার, বাফুফে নির্বাচন-২০১২।
No comments