গ্রামীণ জীবন-তিন নারীর জীবনে দিনবদল by বদিউল আলম মজুমদার
দিনবদলের অঙ্গীকারের ভিত্তিতে ক্ষমতায় আসা মহাজোট সরকার তার মেয়াদের তিন বছর শেষ করেছে। এ উপলক্ষে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্যের দাবি করা হচ্ছে। পক্ষান্তরে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ। কার দাবি সত্য? সরকারের সফলতা-ব্যর্থতা কি সাধারণ মানুষের জীবনে খুব একটা প্রভাব ফেলেছে?
গত ৭ জানুয়ারি ময়মনসিংহ জেলার সদর উপজেলার চর নিলক্ষ্মীয়া ইউনিয়নের চর পুলিয়ামারী গ্রামের তিনজন নারীর সঙ্গে এ ব্যাপারে আমি আলাপ করি। জানতে চাই, গত তিন বছরে তাঁদের জীবনে কী কী গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে। আর সেসব পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সরকারের কোনো ভূমিকা ছিল কি না।
প্রথমে কথা হয় সেলিনা নামের একজন নারীর সঙ্গে, যাঁর বয়স আনুমানিক ৩২-৩৩ বছর। তাঁর তিন মেয়ে—রেহানা (১১), সাহানা (৬) ও জুমা (১)। সাহানা প্রথম শ্রেণীতে পড়ে, কিন্তু প্রতিবন্ধিতার কারণে রেহানা স্কুলে যায় না বলে মা দাবি করেন। সেলিনার মাও তার সঙ্গে থাকেন। সেলিনার স্বামী, ফয়জুল হক, দেড় বছর আগে হঠাৎ করে ঘুমের মধ্যে মারা যান, সম্ভবত হূদরোগে। সেলিনার ভাষ্যমতে, টেম্পোচালক ফয়জুল হক একজন স্থূলকায় ও অনেকটা অলস প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন ভূমিহীন এবং স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে অন্য একজনের দেওয়া জায়গায় ঘর করে থাকতেন। সেলিনা বর্তমানে আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের থেকে অর্ডার নিয়ে বিভিন্ন ধরনের খাদ্যদ্রব্য আট কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ময়মনসিংহ থেকে এনে কোনোভাবে জীবননির্বাহ করেন। তাঁর কোনো পুঁজি নেই—অর্ডার দাতাদের থেকে অগ্রিম টাকা নিয়েই তিনি মালামাল সরবরাহ করেন। সেলিনা গত ঈদের আগে প্রথমবারের মতো সরকারি সহযোগিতা হিসেবে আট কেজি চাল পান।
এরপর কথা হয় রাবিয়া আখতারের (২০) সঙ্গে। রাবিয়া মমিনুন্নেসা কলেজে অনার্স প্রথমবর্ষের ছাত্রী। ‘এমডিজি ইউনিয়ন’ গড়ার লক্ষ্যে হাঙ্গার প্রজেক্ট-ব্র্যাক কর্তৃক ময়মনসিংহের চারটি ইউনিয়নে পরিচালিত একটি কর্মসূচির আওতায় একজন উজ্জীবক হিসেবে তিনি স্বেচ্ছাশ্রম দিচ্ছেন। প্রসঙ্গত, প্রাথমিকভাবে দুই বছরের জন্য পরিচালিত এই কর্মসূচির উদ্দেশ্য হলো সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের জন্য ইউনিয়ন পরিষদের নেতৃত্বে সমাজের বিভিন্ন স্তরের জনগণকে—সাধারণ জনগণ, ছাত্রছাত্রী, চিন্তাশীল নাগরিক, নারী প্রমুখকে উদ্বুদ্ধ ও সংগঠিত করে উন্নয়ন প্রচেষ্টাকে ‘আন্দোলন’-এ পরিণত করা। ২০০৮ সালে হাঙ্গার প্রজেক্ট পরিচালিত একটি সেলাই প্রশিক্ষণেও তিনি অংশ নেন।
সেলাই প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর রাবিয়া একটি সেলাই মেশিন ক্রয় করেন। তিনি গত রোজার ঈদে ছয় হাজার এবং কোরবানির ঈদে তিন হাজার টাকা আয় করেন। এ ছাড়া তিনি নিজের পরিবারের অন্যান্য সদস্যের জামা-কাপড় তৈরি করেন। তাঁর আকাঙ্ক্ষা আরও চারটি সেলাই মেশিন কিনে এবং কিছু নারীকে সংগঠিত করে একটি মিনি গার্মেন্টস স্থাপনের। উজ্জীবক হওয়ার পর রাবিয়া স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলে ‘প্যারা টিচার’ হিসেবে স্বেচ্ছাশ্রম দিতে থাকেন, যার জন্য মাঝেমধ্যে শ পাঁচেক টাকা পান। তিনি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হতে চান, কিন্তু তা হওয়া যাবে কি না সে সম্পর্কে তিনি সন্দিহান। কারণ, এর জন্য মামা-চাচা লাগবে, আরও লাগবে পাঁচ লাখ টাকার মতো উৎকোচ প্রদান।
গ্রামকে নিরক্ষরমুক্ত করার লক্ষ্যে তিনি মাসব্যাপী একটি বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র পরিচালনা করেছেন। ইতিমধ্যে রাবিয়া ও অন্যান্য স্বেচ্ছাব্রতী মিলে তাঁর চাচাতো বোনসহ বেশ কয়েকটি বাল্যবিবাহ রোধ করতে সক্ষম হয়েছেন। ২০১০ সালে রাবিয়ার জীবেনও একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে—তিনি নিজে পছন্দ করে গ্রামের বাইজীদ ইসলাম নামের এক ছেলেকে বিয়ে করেন। উভয় পরিবার প্রথমে সম্মত না হলেও পরে তাঁদের বিয়ে মেনে নেয়। রাবিয়ার স্বামীও একজন উজ্জীবক। তিনি কৃষিতে ডিপ্লোমা শেষ করেছেন, কিন্তু চাকরি পাননি। এখন তিনি পানের আড়তের অংশীদার হিসেবে কিছু আয় করছেন। একই সঙ্গে জাহাজের কাটিং মাস্টার হিসেবে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন বিদেশ যাওয়ার আশায়। পাশাপাশি তিনি সমাজসেবাও করেন এবং রাবিয়ার কাজে উৎসাহ দেন।
সবশেষে কথা বলি মাহমুদা খাতুনের (২৯) সঙ্গে। ক্লাস টেনে পড়াকালে তাঁর বিয়ে হয় স্বামী আবদুল আউয়ালের সঙ্গে। তাঁদের ১৩ ও সাত বছর বয়স্ক দুই ছেলে এবং উভয়েই স্কুলে যায়। বিয়ের পর মাহমুদা সরকারের টিএলএম কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত হন, পরে ব্র্যাকের নন-ফরমাল স্কুলে পড়ান। মাহমুদাও হাঙ্গার প্রজেক্ট-ব্র্যাক এমডিজি ইউনিয়ন গড়ার কর্মসূচির আওতায় উজ্জীবক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। গ্রহণ করেন নারীনেত্রী ও পার ট্রেনিং। তিনি রাবিয়ার সঙ্গেই গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে প্যারা টিচার হিসেবে কাজ করেন। ফলে পঞ্চম শ্রেণীতে পাসের হার যেখানে আগে ছিল ২০-৩০ শতাংশ, সেখানে এখন ১০০ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। মাহমুদা বিভিন্ন উন্নয়ন কাজে গ্রামবাসীকে উজ্জীবিত করেন। তিনি গত জুলাই মাসে ১২ জনকে নিয়ে মহিলা উন্নয়ন সমিতি করেছেন। তিনিও গণশিক্ষা ও সচেতনতা সৃষ্টিমূলক কাজে জড়িত।
ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ুয়া মাহমুদার স্বামী কেয়ারের একটি এইচআইভি প্রকল্পে কাজ করতেন, কিন্তু প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় দুই বছর আগে তাঁর চাকরি চলে যায়। পরে তিনি আত্মকর্মসংস্থানে নিজেকে নিয়োজিত করেন। ১০ হাজার টাকায় দুটি পুকুর ইজারা নিয়ে তিনি গত বছর মাছ চাষ শুরু করেন।
দিনবদলে অঙ্গীকারবদ্ধ মহাজোট সরকারের মেয়াদকালে সেলিনা, রাবিয়া ও মাহমুদার জীবনেও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে। সেলিনার স্বামী মারা গেছেন এবং তিনি বৃদ্ধা মা ও তিন সন্তান নিয়ে অতি কষ্টে কালাতিপাত করছেন। রাবিয়া নিজ ইচ্ছায় বিয়ে এবং সীমিত পরিমাণের হলেও আয়ের উৎস সৃষ্টি করেছেন। মাহমুদার স্বামী চাকরি হারিয়েছেন এবং আত্মকর্মসংস্থান করেছেন। তবে এসব পরিবর্তনে সরকারের নীতি ও কর্মসূচির উল্লেখযোগ্য কোনো প্রভাব নেই। বস্তুত, সরকারের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক। তিনজনের ক্ষেত্রে ব্যক্তির উদ্যোগই সমস্যা সমাধানে এবং আয়ের উৎস সৃষ্টিতে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তাঁদের মতে, সরকার সমাজের প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তিদের স্বার্থরক্ষা ও নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নেই ব্যস্ত। এমনকি বিরোধী দল যেসব ইস্যু নিয়ে বর্তমানে আন্দোলনরত, তাও তাঁদের কল্যাণ বয়ে আনবে কি না সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
সরকারি সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচির অত্যন্ত সীমিত প্রভাব দেখা যায় সেলিনার জীবনে। গত কোরবানির ঈদের আগে তিনি প্রথমবারের মতো আট কেজি চাল পান। প্রায় নিঃস্ব হলেও তাঁর মা বয়স্ক ভাতা পান না। তাঁর কন্যাও প্রতিবন্ধী ভাতা থেকে বঞ্চিত। অর্থাৎ হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পরিচালিত এসব কর্মসূচি প্রকৃত প্রাপ্যদের কাছে পৌঁছায় না। এর মূল কারণ, বিদ্যমান ইউনিয়ন পরিষদ আইনে এসব কর্মসূচির ‘উপকারভোগী’ সুনির্দিষ্ট মানদণ্ডের ভিত্তিতে প্রকাশ্য ‘ওয়ার্ডসভা’য় নির্ধারিত হওয়ার বিধান থাকলেও তা মানা হয় না। এ ছাড়া দ্রব্যমূল্য ও দুর্বৃত্তায়নের কশাঘাত মানুষ এড়াতে না পারলেও, বর্তমান সরকারের আমলে বিদ্যুৎ-পরিস্থিতির উন্নয়নের সুফল এ গ্রামের মানুষের কাছে এখনো পৌঁছায়নি।
তিন নারীর জীবনে বর্তমান সরকারের নীতি ও কর্মসূচির উল্লেখযোগ্য কোনো প্রভাব না থাকলেও, বেসরকারি সংস্থাগুলোর কার্যক্রমের প্রভাব রাবিয়া ও মাহমুদার জীবনে দৃশ্যমান। এসব কার্যক্রমের প্রভাবে চর পুলিয়ামারী গ্রামটি এখন নিরক্ষরতা, বাল্যবিবাহ ও খোলা পায়খানা মুক্ত হওয়ার পথে। এখানে প্রায় সব ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়, এখানে অনেকে আত্মকর্মসংস্থান করেছে এবং অনেকগুলো সংগঠন গড়ে উঠেছে।
চর পুলিয়ামারীর তিনজন নারীর সঙ্গে আলাপের পরিপ্রেক্ষিতে আরও তিনটি বিষয় আমার কাছে পরিষ্কার হয়েছে। প্রথমত, চাকরি পেতে এখনো গাদা গাদা টাকা ঘুষ দিতে হয়। বস্তুত, ঘুষ প্রদান এখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে এবং সর্বস্তরের মানুষ এ ব্যাপারে আতঙ্কিত। দ্বিতীয়ত, মোবাইল ফোন এখন প্রত্যেকের হাতে হাতে। তৃতীয়ত, হূদরোগের মতো সমৃদ্ধির ব্যাধি এখন বাংলাদেশের দরিদ্রদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে, চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা যাকে ‘ফিটাল প্রোগ্রামিং’-এর ফল বলে মনে করেন। ফিটাল প্রোগ্রামিংয়ের মূল কথা হলো ভ্রূণ থেকে মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়তি নির্ধারিত হয়ে যায়। অর্থাৎ যেসব শিশু স্বল্প ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করে তাদের পরবর্তী জীবনে বহুমূত্র ও হূদরোগ, যেগুলো সাধারণত সমৃদ্ধির—ব্যাধি হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। আর ব্যাপক অপুষ্টির কারণেই বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জেও হূদরোগ ও বহুমূত্র রোগ এখন ছড়িয়ে পড়েছে। তাই পুষ্টির সমস্যা আমাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দূর করতে হবে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
প্রথমে কথা হয় সেলিনা নামের একজন নারীর সঙ্গে, যাঁর বয়স আনুমানিক ৩২-৩৩ বছর। তাঁর তিন মেয়ে—রেহানা (১১), সাহানা (৬) ও জুমা (১)। সাহানা প্রথম শ্রেণীতে পড়ে, কিন্তু প্রতিবন্ধিতার কারণে রেহানা স্কুলে যায় না বলে মা দাবি করেন। সেলিনার মাও তার সঙ্গে থাকেন। সেলিনার স্বামী, ফয়জুল হক, দেড় বছর আগে হঠাৎ করে ঘুমের মধ্যে মারা যান, সম্ভবত হূদরোগে। সেলিনার ভাষ্যমতে, টেম্পোচালক ফয়জুল হক একজন স্থূলকায় ও অনেকটা অলস প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তিনি ছিলেন ভূমিহীন এবং স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে অন্য একজনের দেওয়া জায়গায় ঘর করে থাকতেন। সেলিনা বর্তমানে আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের থেকে অর্ডার নিয়ে বিভিন্ন ধরনের খাদ্যদ্রব্য আট কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ময়মনসিংহ থেকে এনে কোনোভাবে জীবননির্বাহ করেন। তাঁর কোনো পুঁজি নেই—অর্ডার দাতাদের থেকে অগ্রিম টাকা নিয়েই তিনি মালামাল সরবরাহ করেন। সেলিনা গত ঈদের আগে প্রথমবারের মতো সরকারি সহযোগিতা হিসেবে আট কেজি চাল পান।
এরপর কথা হয় রাবিয়া আখতারের (২০) সঙ্গে। রাবিয়া মমিনুন্নেসা কলেজে অনার্স প্রথমবর্ষের ছাত্রী। ‘এমডিজি ইউনিয়ন’ গড়ার লক্ষ্যে হাঙ্গার প্রজেক্ট-ব্র্যাক কর্তৃক ময়মনসিংহের চারটি ইউনিয়নে পরিচালিত একটি কর্মসূচির আওতায় একজন উজ্জীবক হিসেবে তিনি স্বেচ্ছাশ্রম দিচ্ছেন। প্রসঙ্গত, প্রাথমিকভাবে দুই বছরের জন্য পরিচালিত এই কর্মসূচির উদ্দেশ্য হলো সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের জন্য ইউনিয়ন পরিষদের নেতৃত্বে সমাজের বিভিন্ন স্তরের জনগণকে—সাধারণ জনগণ, ছাত্রছাত্রী, চিন্তাশীল নাগরিক, নারী প্রমুখকে উদ্বুদ্ধ ও সংগঠিত করে উন্নয়ন প্রচেষ্টাকে ‘আন্দোলন’-এ পরিণত করা। ২০০৮ সালে হাঙ্গার প্রজেক্ট পরিচালিত একটি সেলাই প্রশিক্ষণেও তিনি অংশ নেন।
সেলাই প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর রাবিয়া একটি সেলাই মেশিন ক্রয় করেন। তিনি গত রোজার ঈদে ছয় হাজার এবং কোরবানির ঈদে তিন হাজার টাকা আয় করেন। এ ছাড়া তিনি নিজের পরিবারের অন্যান্য সদস্যের জামা-কাপড় তৈরি করেন। তাঁর আকাঙ্ক্ষা আরও চারটি সেলাই মেশিন কিনে এবং কিছু নারীকে সংগঠিত করে একটি মিনি গার্মেন্টস স্থাপনের। উজ্জীবক হওয়ার পর রাবিয়া স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলে ‘প্যারা টিচার’ হিসেবে স্বেচ্ছাশ্রম দিতে থাকেন, যার জন্য মাঝেমধ্যে শ পাঁচেক টাকা পান। তিনি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হতে চান, কিন্তু তা হওয়া যাবে কি না সে সম্পর্কে তিনি সন্দিহান। কারণ, এর জন্য মামা-চাচা লাগবে, আরও লাগবে পাঁচ লাখ টাকার মতো উৎকোচ প্রদান।
গ্রামকে নিরক্ষরমুক্ত করার লক্ষ্যে তিনি মাসব্যাপী একটি বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র পরিচালনা করেছেন। ইতিমধ্যে রাবিয়া ও অন্যান্য স্বেচ্ছাব্রতী মিলে তাঁর চাচাতো বোনসহ বেশ কয়েকটি বাল্যবিবাহ রোধ করতে সক্ষম হয়েছেন। ২০১০ সালে রাবিয়ার জীবেনও একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে—তিনি নিজে পছন্দ করে গ্রামের বাইজীদ ইসলাম নামের এক ছেলেকে বিয়ে করেন। উভয় পরিবার প্রথমে সম্মত না হলেও পরে তাঁদের বিয়ে মেনে নেয়। রাবিয়ার স্বামীও একজন উজ্জীবক। তিনি কৃষিতে ডিপ্লোমা শেষ করেছেন, কিন্তু চাকরি পাননি। এখন তিনি পানের আড়তের অংশীদার হিসেবে কিছু আয় করছেন। একই সঙ্গে জাহাজের কাটিং মাস্টার হিসেবে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন বিদেশ যাওয়ার আশায়। পাশাপাশি তিনি সমাজসেবাও করেন এবং রাবিয়ার কাজে উৎসাহ দেন।
সবশেষে কথা বলি মাহমুদা খাতুনের (২৯) সঙ্গে। ক্লাস টেনে পড়াকালে তাঁর বিয়ে হয় স্বামী আবদুল আউয়ালের সঙ্গে। তাঁদের ১৩ ও সাত বছর বয়স্ক দুই ছেলে এবং উভয়েই স্কুলে যায়। বিয়ের পর মাহমুদা সরকারের টিএলএম কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত হন, পরে ব্র্যাকের নন-ফরমাল স্কুলে পড়ান। মাহমুদাও হাঙ্গার প্রজেক্ট-ব্র্যাক এমডিজি ইউনিয়ন গড়ার কর্মসূচির আওতায় উজ্জীবক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। গ্রহণ করেন নারীনেত্রী ও পার ট্রেনিং। তিনি রাবিয়ার সঙ্গেই গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে প্যারা টিচার হিসেবে কাজ করেন। ফলে পঞ্চম শ্রেণীতে পাসের হার যেখানে আগে ছিল ২০-৩০ শতাংশ, সেখানে এখন ১০০ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। মাহমুদা বিভিন্ন উন্নয়ন কাজে গ্রামবাসীকে উজ্জীবিত করেন। তিনি গত জুলাই মাসে ১২ জনকে নিয়ে মহিলা উন্নয়ন সমিতি করেছেন। তিনিও গণশিক্ষা ও সচেতনতা সৃষ্টিমূলক কাজে জড়িত।
ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ুয়া মাহমুদার স্বামী কেয়ারের একটি এইচআইভি প্রকল্পে কাজ করতেন, কিন্তু প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় দুই বছর আগে তাঁর চাকরি চলে যায়। পরে তিনি আত্মকর্মসংস্থানে নিজেকে নিয়োজিত করেন। ১০ হাজার টাকায় দুটি পুকুর ইজারা নিয়ে তিনি গত বছর মাছ চাষ শুরু করেন।
দিনবদলে অঙ্গীকারবদ্ধ মহাজোট সরকারের মেয়াদকালে সেলিনা, রাবিয়া ও মাহমুদার জীবনেও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে। সেলিনার স্বামী মারা গেছেন এবং তিনি বৃদ্ধা মা ও তিন সন্তান নিয়ে অতি কষ্টে কালাতিপাত করছেন। রাবিয়া নিজ ইচ্ছায় বিয়ে এবং সীমিত পরিমাণের হলেও আয়ের উৎস সৃষ্টি করেছেন। মাহমুদার স্বামী চাকরি হারিয়েছেন এবং আত্মকর্মসংস্থান করেছেন। তবে এসব পরিবর্তনে সরকারের নীতি ও কর্মসূচির উল্লেখযোগ্য কোনো প্রভাব নেই। বস্তুত, সরকারের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে প্রায় অপ্রাসঙ্গিক। তিনজনের ক্ষেত্রে ব্যক্তির উদ্যোগই সমস্যা সমাধানে এবং আয়ের উৎস সৃষ্টিতে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তাঁদের মতে, সরকার সমাজের প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তিদের স্বার্থরক্ষা ও নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নেই ব্যস্ত। এমনকি বিরোধী দল যেসব ইস্যু নিয়ে বর্তমানে আন্দোলনরত, তাও তাঁদের কল্যাণ বয়ে আনবে কি না সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
সরকারি সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচির অত্যন্ত সীমিত প্রভাব দেখা যায় সেলিনার জীবনে। গত কোরবানির ঈদের আগে তিনি প্রথমবারের মতো আট কেজি চাল পান। প্রায় নিঃস্ব হলেও তাঁর মা বয়স্ক ভাতা পান না। তাঁর কন্যাও প্রতিবন্ধী ভাতা থেকে বঞ্চিত। অর্থাৎ হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পরিচালিত এসব কর্মসূচি প্রকৃত প্রাপ্যদের কাছে পৌঁছায় না। এর মূল কারণ, বিদ্যমান ইউনিয়ন পরিষদ আইনে এসব কর্মসূচির ‘উপকারভোগী’ সুনির্দিষ্ট মানদণ্ডের ভিত্তিতে প্রকাশ্য ‘ওয়ার্ডসভা’য় নির্ধারিত হওয়ার বিধান থাকলেও তা মানা হয় না। এ ছাড়া দ্রব্যমূল্য ও দুর্বৃত্তায়নের কশাঘাত মানুষ এড়াতে না পারলেও, বর্তমান সরকারের আমলে বিদ্যুৎ-পরিস্থিতির উন্নয়নের সুফল এ গ্রামের মানুষের কাছে এখনো পৌঁছায়নি।
তিন নারীর জীবনে বর্তমান সরকারের নীতি ও কর্মসূচির উল্লেখযোগ্য কোনো প্রভাব না থাকলেও, বেসরকারি সংস্থাগুলোর কার্যক্রমের প্রভাব রাবিয়া ও মাহমুদার জীবনে দৃশ্যমান। এসব কার্যক্রমের প্রভাবে চর পুলিয়ামারী গ্রামটি এখন নিরক্ষরতা, বাল্যবিবাহ ও খোলা পায়খানা মুক্ত হওয়ার পথে। এখানে প্রায় সব ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়, এখানে অনেকে আত্মকর্মসংস্থান করেছে এবং অনেকগুলো সংগঠন গড়ে উঠেছে।
চর পুলিয়ামারীর তিনজন নারীর সঙ্গে আলাপের পরিপ্রেক্ষিতে আরও তিনটি বিষয় আমার কাছে পরিষ্কার হয়েছে। প্রথমত, চাকরি পেতে এখনো গাদা গাদা টাকা ঘুষ দিতে হয়। বস্তুত, ঘুষ প্রদান এখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে এবং সর্বস্তরের মানুষ এ ব্যাপারে আতঙ্কিত। দ্বিতীয়ত, মোবাইল ফোন এখন প্রত্যেকের হাতে হাতে। তৃতীয়ত, হূদরোগের মতো সমৃদ্ধির ব্যাধি এখন বাংলাদেশের দরিদ্রদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে, চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা যাকে ‘ফিটাল প্রোগ্রামিং’-এর ফল বলে মনে করেন। ফিটাল প্রোগ্রামিংয়ের মূল কথা হলো ভ্রূণ থেকে মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়তি নির্ধারিত হয়ে যায়। অর্থাৎ যেসব শিশু স্বল্প ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করে তাদের পরবর্তী জীবনে বহুমূত্র ও হূদরোগ, যেগুলো সাধারণত সমৃদ্ধির—ব্যাধি হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। আর ব্যাপক অপুষ্টির কারণেই বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জেও হূদরোগ ও বহুমূত্র রোগ এখন ছড়িয়ে পড়েছে। তাই পুষ্টির সমস্যা আমাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দূর করতে হবে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
No comments