শিক্ষাঙ্গন-উপাচার্যগণের ফাউস্টীয় বাতিক by জোবাইদা নাসরীন
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী জুবায়ের হত্যার বিচারের দাবিতে এক হয়েছে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের এক বড় অংশ। ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই’—এমন বক্তব্য দিয়ে ক্ষমতাসীন দলের আশীর্বাদধন্য ছাত্রসংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক এই মৃত্যুর দায়ভার এড়াতে চেয়েছেন। জুবায়ের নিহতের খবর যখন পত্রিকায় দেখছিলাম তখনই মনে পড়ছিল আনন্দের কথা।
আমাদের সহপাঠী আনন্দ একই ভাবে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী লীগের আগের শাসনামলে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে হত্যার শিকার হয়েছিল। তার হত্যাকারীদের দলে তার সহপাঠীরাও ছিল। সেই ঘটনার কোনো বিচার হয়নি। জীবনের পথ চলায় সেই চিহ্নিত খুনিদের কারও কারও সঙ্গে দেখা হয় আর মনে পড়ে যায় অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র আনন্দের মুখখানা। সেই সময় সাধারণ শিক্ষার্থীরা সেই হত্যার প্রতিবাদে জোরালো কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। কিন্তু আজ শিক্ষার্থীরা একজোট। যে দল বা সংগঠনই তারা করুক না কেন, শিক্ষাঙ্গনে কারও মৃত্যুই তারা মানবে না।
আনন্দ নিহত হওয়ার পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই উপদল সবার কাছে পরিচিতি পায় ধর্ষক গ্রুপ ও খুনি গ্রুপ হিসেবে। এবার আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রথম ক্ষমতার তাপ টের পাওয়া গিয়েছিল জাহাঙ্গীরনগরসহ আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ দফায় জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসে ধর্ষক আর খুনি গ্রুপের বাইরে ছাত্রলীগ নিজের দাপটের প্রকাশ ঘটাতে অভিনব (!) কায়দা বেছে নেয়—প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের কর্মীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের ছাদ থেকে ছুড়ে ফেলা। বারকয়েক এমন ঘটনা ঘটে; টেন্ডারবাজি নিয়ে কয়েক দফা নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এমন ভয়াবহ ও হিংস্র থাবার নিচে বুক পেতেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে জাহাঙ্গীরনগরসহ ‘মানুষ গড়ার কারখানা’ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
তবে জুবায়ের হত্যাকাণ্ড আরও কিছু দিকে দৃষ্টি ফেরায়। এ হত্যাকাণ্ডটি ঘিরে সবচেয়ে বড় অভিযোগ উঠেছে প্রশাসনের বিরুদ্ধে, যেই প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি একজন শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রতিষ্ঠানটির ‘অভিভাবক’ হিসেবে গণ্য হন। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সবার দেখভালের দায়িত্ব তাঁর ওপরই বর্তায়। তাঁর প্রতিষ্ঠানে একজন শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার দায় তিনি কিছুতেই অস্বীকার করতে পারেন না। দুঃখের বিষয় হলো, প্রশাসনের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর পদে আসীন ব্যক্তিরা প্রায়শই ভুলে যান তাঁদের প্রথম পরিচয় তাঁরা শিক্ষক। শিক্ষার্থী-শিক্ষক সম্পর্ক সারা জীবনের—প্রাতিষ্ঠানিক কোনো গণ্ডির মধ্যে এটি সীমাবদ্ধ থাকে না। কিন্তু চলমান শিক্ষক রাজনীতিতে ক্ষমতাবান থাকার জন্য এবং এভাবে নিজের পদ আঁকড়ে থাকতে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের কর্মীদের তাঁরা নানাভাবে ব্যবহার করেন।
বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক রাজনীতির চলমান সংস্কৃতিতে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেতাদের সঙ্গে শিক্ষক নেতাদের ঘনিষ্ঠতা এবং নানা ধরনের ‘লেনদেন’-এর খবর গণমাধ্যমে না এলেও এ নিয়ে সব বিশ্ববিদ্যালয়েই জোরালো বাতচিত রয়েছে। এই ‘লেনদেন’-নির্ভর সংস্কৃতিরই নব্য সংস্করণ হলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের ’উপাচার্য গ্রুপের’ তাণ্ডব। স্বয়ং উপাচার্য সন্ত্রাস লালন করেন আর তাঁকে কেন্দ্র করে ছাত্রদের মধ্যে একটি পেটোয়া বাহিনী তৈরি হতে পারে, সেটা এতটা স্পষ্টভাবে আগে দেখা যায়নি।
পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জুবায়ের হত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের দাবিতে উপাচার্যের কার্যালয় ঘেরাও করে যখন বিক্ষোভ করছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, তখন ছাত্রলীগের নামে কয়েক শ ছাত্র পুলিশের সামনেই স্লোগান দিচ্ছিলেন, ‘উপাচার্য, তোমার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই।’ আসলে কিসের ভয় একজন উপাচার্যের? সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভয়? নাকি গদি হারানোর ভয়? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তো নিয়মতান্ত্রিকভাবে তাদের দাবি আদায়ের আন্দোলন গড়ে তোলার বাইরে কিছু করেনি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের চলমান আন্দোলনে আরও কিছু খানাখন্দ যোগ হয়েছে। শিক্ষকেরা বিভক্ত হয়েছেন প্রতিবাদ-সুবিধার তরিকায়। শিক্ষক সমিতির মিটিংয়ে উপাচার্যপন্থী শিক্ষকেরা চড়াও হয়েছেন শিক্ষক সমিতির সভাপতিসহ অন্যদের বিরুদ্ধে। শিক্ষক সমিতির সভাপতিকে অসম্মান করেছেন প্রক্টর। হাতাহাতি, ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটেছে। একদল শিক্ষক ক্লাস বর্জন করতে চাইছেন, প্রতিবাদস্বরূপ অন্য দল ক্লাস নিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন যে বিশ্ববিদ্যালয় চলছে স্বাভাবিক গতিতেই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতির ঢং এবং রং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নয়। রংধনুর রঙে সাজানো গ্রুপগুলো। একই শিবিরে থাকছে আওয়ামীপন্থী, বিএনপিপন্থী, বাম এবং জামায়াত। এখানে উপাচার্য গ্রুপ এবং উপাচার্যবিরোধী গ্রুপ হিসেবেই এই শিবিরগুলোর পরিচয়।
আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়েও ঘটেছে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অথচ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে নবীন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে আন্দোলন। সেখানে শিক্ষক নিয়োগকে কেন্দ্র করে উপাচার্যকে হেনস্তা করেছিল ছাত্রলীগ। তাদের দ্বারা অসম্মানিত হলেন প্রশাসনিক ভবনের কর্মকর্তারা। তবু তাতে উপাচার্যের মান যায়নি। কারণ, হয়তো উনার মান এখন ক্ষমতার কাছে বন্ধক রাখা আছে। ছাত্রলীগ হামলা চালিয়েছে বাম সংগঠনগুলোর মিছিলে, বাম সংগঠনের মেয়েদের ওপর আক্রমণ করা হয়েছে, তাতে উপাচার্যের কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু তাঁর মান গেছে যখন বর্ধিত বেতন-ফির বিরুদ্ধে বাম ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের একপর্যায়ে শিক্ষার্থীরা ব্যাংকের মূল গেটে তালা লাগিয়ে দেয় আর কয়েকজন শিক্ষকদের সঙ্গে তাদের বচসা হয়। তারপর, শিক্ষকেরা কালো ব্যাচ পরে পরের দিন এই ঘটনার প্রতিবাদ জানানোর এবং আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা করার ঘোষণা দিলেন। হায়! কী করুণ ও মর্মান্তিক এই ক্ষমতার মাহাত্ম্য!
গত বছর উপাচার্যরা অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। তাঁদের অনেক দাবির মধ্যে একটা দাবি ছিল, সাংসদদের সমমর্যাদা পাওয়া। এতেই বোঝা গিয়েছিল উপাচার্যরা এখন আসলে কী চান। আরও বেশি ক্ষমতা চাওয়াই ফসল হলো আজকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চলমান পরিস্থিতি।
আমাদের এই উপাচার্যরা যেন আজকের দিনের ফাউস্ট। অর্থ, যশ, প্রতিপত্তির বিনিময়ে নিজের আত্মা বিক্রি করতে ব্যস্ত। ছাত্রলীগ বা ছাত্রদলের এই নেতারাই যে তার গদি ঠিক রাখার অস্ত্র। শিক্ষক প্রতিনিয়তই ছাত্রনেতাদের কাছে ক্ষমতা ভিক্ষা চাইছেন। তাঁদের হয়তো এতে মান যায় না, কিন্তু তাঁদের সহকর্মী হিসেবে আমরা অসম্মান বোধ করি; লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে আসে আমাদের।
ঘটনাগুলোকে নিয়ে অসহায় চাপা কষ্ট কেবলই আমাদের অপরাধী করে। আমাদের সহপাঠী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাশ হয়ে ফিরে গেছে, আমাদের ছাত্রদেরও আমরা বাঁচাতে পারি না; যেমন বাঁচাতে পারিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস এবং সংস্কৃতি বিভাগের ছাত্র আবু বকরকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্ত্রের সংস্কৃতি, মারধরের ধারাবাহিকতা, হত্যা, কেন যেন সময়কে এগোতে দেয় না, কেবলই স্তব্ধ করে। আমরা কেন শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারি না? ক্রমেই আমরা হয়ে যাচ্ছি আত্মা বিক্রির বাজারে ব্যস্ত বিক্রেতা আর শিক্ষার্থীর রক্তের ওপর দিয়েই আমরা ক্যাম্পাসে যাই, ফিরে আসি।
জোবাইদা নাসরীন: সহকারী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পিএইচডি গবেষক, ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য।
zobaidanasreen@gmail.com
আনন্দ নিহত হওয়ার পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই উপদল সবার কাছে পরিচিতি পায় ধর্ষক গ্রুপ ও খুনি গ্রুপ হিসেবে। এবার আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রথম ক্ষমতার তাপ টের পাওয়া গিয়েছিল জাহাঙ্গীরনগরসহ আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ দফায় জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসে ধর্ষক আর খুনি গ্রুপের বাইরে ছাত্রলীগ নিজের দাপটের প্রকাশ ঘটাতে অভিনব (!) কায়দা বেছে নেয়—প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের কর্মীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের ছাদ থেকে ছুড়ে ফেলা। বারকয়েক এমন ঘটনা ঘটে; টেন্ডারবাজি নিয়ে কয়েক দফা নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এমন ভয়াবহ ও হিংস্র থাবার নিচে বুক পেতেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে জাহাঙ্গীরনগরসহ ‘মানুষ গড়ার কারখানা’ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
তবে জুবায়ের হত্যাকাণ্ড আরও কিছু দিকে দৃষ্টি ফেরায়। এ হত্যাকাণ্ডটি ঘিরে সবচেয়ে বড় অভিযোগ উঠেছে প্রশাসনের বিরুদ্ধে, যেই প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি একজন শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রতিষ্ঠানটির ‘অভিভাবক’ হিসেবে গণ্য হন। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সবার দেখভালের দায়িত্ব তাঁর ওপরই বর্তায়। তাঁর প্রতিষ্ঠানে একজন শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার দায় তিনি কিছুতেই অস্বীকার করতে পারেন না। দুঃখের বিষয় হলো, প্রশাসনের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর পদে আসীন ব্যক্তিরা প্রায়শই ভুলে যান তাঁদের প্রথম পরিচয় তাঁরা শিক্ষক। শিক্ষার্থী-শিক্ষক সম্পর্ক সারা জীবনের—প্রাতিষ্ঠানিক কোনো গণ্ডির মধ্যে এটি সীমাবদ্ধ থাকে না। কিন্তু চলমান শিক্ষক রাজনীতিতে ক্ষমতাবান থাকার জন্য এবং এভাবে নিজের পদ আঁকড়ে থাকতে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের কর্মীদের তাঁরা নানাভাবে ব্যবহার করেন।
বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক রাজনীতির চলমান সংস্কৃতিতে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেতাদের সঙ্গে শিক্ষক নেতাদের ঘনিষ্ঠতা এবং নানা ধরনের ‘লেনদেন’-এর খবর গণমাধ্যমে না এলেও এ নিয়ে সব বিশ্ববিদ্যালয়েই জোরালো বাতচিত রয়েছে। এই ‘লেনদেন’-নির্ভর সংস্কৃতিরই নব্য সংস্করণ হলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের ’উপাচার্য গ্রুপের’ তাণ্ডব। স্বয়ং উপাচার্য সন্ত্রাস লালন করেন আর তাঁকে কেন্দ্র করে ছাত্রদের মধ্যে একটি পেটোয়া বাহিনী তৈরি হতে পারে, সেটা এতটা স্পষ্টভাবে আগে দেখা যায়নি।
পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জুবায়ের হত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের দাবিতে উপাচার্যের কার্যালয় ঘেরাও করে যখন বিক্ষোভ করছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, তখন ছাত্রলীগের নামে কয়েক শ ছাত্র পুলিশের সামনেই স্লোগান দিচ্ছিলেন, ‘উপাচার্য, তোমার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই।’ আসলে কিসের ভয় একজন উপাচার্যের? সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভয়? নাকি গদি হারানোর ভয়? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তো নিয়মতান্ত্রিকভাবে তাদের দাবি আদায়ের আন্দোলন গড়ে তোলার বাইরে কিছু করেনি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের চলমান আন্দোলনে আরও কিছু খানাখন্দ যোগ হয়েছে। শিক্ষকেরা বিভক্ত হয়েছেন প্রতিবাদ-সুবিধার তরিকায়। শিক্ষক সমিতির মিটিংয়ে উপাচার্যপন্থী শিক্ষকেরা চড়াও হয়েছেন শিক্ষক সমিতির সভাপতিসহ অন্যদের বিরুদ্ধে। শিক্ষক সমিতির সভাপতিকে অসম্মান করেছেন প্রক্টর। হাতাহাতি, ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটেছে। একদল শিক্ষক ক্লাস বর্জন করতে চাইছেন, প্রতিবাদস্বরূপ অন্য দল ক্লাস নিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন যে বিশ্ববিদ্যালয় চলছে স্বাভাবিক গতিতেই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতির ঢং এবং রং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নয়। রংধনুর রঙে সাজানো গ্রুপগুলো। একই শিবিরে থাকছে আওয়ামীপন্থী, বিএনপিপন্থী, বাম এবং জামায়াত। এখানে উপাচার্য গ্রুপ এবং উপাচার্যবিরোধী গ্রুপ হিসেবেই এই শিবিরগুলোর পরিচয়।
আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়েও ঘটেছে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অথচ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে নবীন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে আন্দোলন। সেখানে শিক্ষক নিয়োগকে কেন্দ্র করে উপাচার্যকে হেনস্তা করেছিল ছাত্রলীগ। তাদের দ্বারা অসম্মানিত হলেন প্রশাসনিক ভবনের কর্মকর্তারা। তবু তাতে উপাচার্যের মান যায়নি। কারণ, হয়তো উনার মান এখন ক্ষমতার কাছে বন্ধক রাখা আছে। ছাত্রলীগ হামলা চালিয়েছে বাম সংগঠনগুলোর মিছিলে, বাম সংগঠনের মেয়েদের ওপর আক্রমণ করা হয়েছে, তাতে উপাচার্যের কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু তাঁর মান গেছে যখন বর্ধিত বেতন-ফির বিরুদ্ধে বাম ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের একপর্যায়ে শিক্ষার্থীরা ব্যাংকের মূল গেটে তালা লাগিয়ে দেয় আর কয়েকজন শিক্ষকদের সঙ্গে তাদের বচসা হয়। তারপর, শিক্ষকেরা কালো ব্যাচ পরে পরের দিন এই ঘটনার প্রতিবাদ জানানোর এবং আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা করার ঘোষণা দিলেন। হায়! কী করুণ ও মর্মান্তিক এই ক্ষমতার মাহাত্ম্য!
গত বছর উপাচার্যরা অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। তাঁদের অনেক দাবির মধ্যে একটা দাবি ছিল, সাংসদদের সমমর্যাদা পাওয়া। এতেই বোঝা গিয়েছিল উপাচার্যরা এখন আসলে কী চান। আরও বেশি ক্ষমতা চাওয়াই ফসল হলো আজকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চলমান পরিস্থিতি।
আমাদের এই উপাচার্যরা যেন আজকের দিনের ফাউস্ট। অর্থ, যশ, প্রতিপত্তির বিনিময়ে নিজের আত্মা বিক্রি করতে ব্যস্ত। ছাত্রলীগ বা ছাত্রদলের এই নেতারাই যে তার গদি ঠিক রাখার অস্ত্র। শিক্ষক প্রতিনিয়তই ছাত্রনেতাদের কাছে ক্ষমতা ভিক্ষা চাইছেন। তাঁদের হয়তো এতে মান যায় না, কিন্তু তাঁদের সহকর্মী হিসেবে আমরা অসম্মান বোধ করি; লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে আসে আমাদের।
ঘটনাগুলোকে নিয়ে অসহায় চাপা কষ্ট কেবলই আমাদের অপরাধী করে। আমাদের সহপাঠী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাশ হয়ে ফিরে গেছে, আমাদের ছাত্রদেরও আমরা বাঁচাতে পারি না; যেমন বাঁচাতে পারিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস এবং সংস্কৃতি বিভাগের ছাত্র আবু বকরকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্ত্রের সংস্কৃতি, মারধরের ধারাবাহিকতা, হত্যা, কেন যেন সময়কে এগোতে দেয় না, কেবলই স্তব্ধ করে। আমরা কেন শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারি না? ক্রমেই আমরা হয়ে যাচ্ছি আত্মা বিক্রির বাজারে ব্যস্ত বিক্রেতা আর শিক্ষার্থীর রক্তের ওপর দিয়েই আমরা ক্যাম্পাসে যাই, ফিরে আসি।
জোবাইদা নাসরীন: সহকারী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পিএইচডি গবেষক, ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য।
zobaidanasreen@gmail.com
No comments