বিষোদ্গার ও পশ্চাদ্মুখী রাজনীতি-সমকালীন প্রসঙ্গ by আবু সাঈদ খান

কদিনের ব্যবধানে আয়োজিত দুই নেত্রীর দুই জনসভা নিয়ে রাজনীতি এখন সরগরম। আমাদের দেশে রাজনৈতিক উত্তাপের অনেকখানি জুড়ে থাকে সরকার ও বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীদের মধ্যে কটাক্ষ, বিষোদ্গার ও পরস্পরকে হেয় করার প্রতিযোগিতা। তর্ক-বিতর্ক, বাক্যবাণ, যুক্তি-পাল্টা যুক্তি, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে কৌতুকও গণতন্ত্রের সৌন্দর্য বলে বিবেচিত হয়। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে আক্রমণাত্মক ভাষাও ব্যবহৃত হয়। তবে যাই ঘটুক, সবই হতে হবে


নিয়মনীতিভিত্তিক, শিষ্টাচারের সীমা মেনে। ক্ষমতার জন্য নীতি বিসর্জন দিয়ে যা ইচ্ছা তা বললে আখেরে সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশকে ব্যাহত করে। জনগণ আশা করে, রাজনীতি হবে উদার, গণতান্ত্রিক ও পরিশীলিত। কিন্তু বাস্তবে কী দেখছি?
১১ অক্টোবর রোডমার্চ শেষে সিলেটে বিরোধীদলীয় নেত্রীর জনসভা এবং এর পরদিন ১২ অক্টোবর নীলফামারীতে প্রধানমন্ত্রীর জনসভা হয়েছে। এ দুই সভায় বিরোধীদলীয় নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী কী বলেছেন তা নিয়ে স্বাভাবিকভাবে জনগণের বিশেষ আগ্রহ আছে। নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া নিজ নিজ অবস্থানে অনড়। ইতিপূর্বে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন হবে এবং সে নির্বাচনে বিরোধী দলকে আসতে হবে। এর জবাবে খালেদা জিয়া বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে, আওয়ামী লীগকেও এতে অংশ নিতে হবে। এই পরস্পরবিরোধী অবস্থান রাজনীতিকে কোনো সংঘর্ষের দিকে নিয়ে যাবে কি-না তা নাগরিকদের উদ্বেগের বিষয়। তবে পরস্পরের প্রতি আক্রমণাত্মক বক্তব্য সেই উদ্বেগকে বাড়িয়ে দিয়েছে আরও।
শুধু প্রধানমন্ত্রীর প্রতি বিষোদ্গারের কারণে নয়, ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কৌশল নির্দেশনার কারণেও খালেদা জিয়ার সিলেট জনসভা আলোচিত। সেখানে তিনি তরুণ নেতৃত্বের হাতে দায়িত্ব তুলে দেওয়া ও জামায়াতের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলার নীতিকে স্পষ্ট করেছেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, বিগত নির্বাচনের পর বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীদের নিয়ে ঢাকায় সমাবেশ করা হয়েছিল। তখন ফল বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে তাদের অনেকেই যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের সঙ্গে সখ্যকে দায়ী করেছিলেন। পাশাপাশি বিএনপির থিঙ্কট্যাঙ্ক বলে পরিচিত বুদ্ধিজীবী এবং দলের সিনিয়র নেতাদের মধ্যে তারেক রহমান ও হাওয়া ভবনের কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। তাই বিগত দিনগুলোতে তারেক রহমানকে সামনে না আনা ও জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ দুই-ই গুরুত্ব পেয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। পত্রপত্রিকায় এমন খবরও প্রকাশ করা হয়েছিল যে, তারেক আপাতত রাজনীতিতে আসছেন না, যুক্তরাজ্যে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছেন।
বিগত দুই বছর জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে এক মঞ্চে না ওঠার সিদ্ধান্ত কার্যকর ছিল। দল দুটির নেতারা এক সঙ্গে আন্দোলন ও এক মঞ্চে বক্তব্য দেননি। মনে হয়েছিল, বিএনপির রাজনীতিতে আরও একটি ইতিবাচক উপাদান যুক্ত হতে যাচ্ছে। একজন মুক্তিযোদ্ধা হলেও জিয়াউর রহমান রাজনীতিতে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ও পাকিস্তানি ধারায় পুনঃপ্রবর্তক। তিনি সেনাছাউনিতে বসে উর্দি পরে বিএনপি গঠন করেন, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের দলে ভেড়ান এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পথ খুলে দিয়ে জামায়াতে ইসলামীসহ মৌলবাদী ও যুদ্ধাপরাধী অভিযুক্তদের রাজনীতি করার সুযোগ অবারিত করেন। খালেদা জিয়া স্বৈরাচারী এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ দলটিকে জননির্ভর দলে পরিণত করেন এবং ত্রয়োদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনে ইতিবাচক অবদান রাখেন। জিয়াউর রহমানের বিএনপি ছিল ক্যান্টনমেন্টমুখী, আর খালেদা জিয়ার বিএনপি জনমুখী চরিত্র ধারণ করে। নিঃসন্দেহে তা একধাপ অগ্রগতি। আর জামায়াতের সঙ্গে এক মঞ্চে না ওঠার সিদ্ধান্তের পর মনে হয়েছিল যে, খালেদা জিয়া তার স্বামী জিয়াউর রহমানের আরেক পাপ রাজাকার তোষণনীতি থেকে দলকে মুক্ত করবেন। কিন্তু বিগত হরতালে বিএনপি আবার জামায়াতের সঙ্গে হাত ধরাধরির নীতি গ্রহণ করে। ঢাকার জনসভায় আবার এক মঞ্চে ওঠে। সেখানে যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচারাধীন মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদ ও দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মুক্তিও দাবি করেন খালেদা জিয়া। সিলেটের জনসভায় মুক্তি দাবি করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রসঙ্গেও নেতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। খালেদা জিয়ার বক্তৃতায় আক্রোশের পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি ক্ষমতায় যাওয়ার পর আওয়ামী লীগ নেতাদের জেলে পুরে ডাণ্ডাবেড়ি পরানোর জোট নেতাদের বক্তব্য সমর্থন করে বলেন, যেহেতু এটি জনগণের দাবি, তাই কিছুটা হলেও তা আমাদের করতে হবে।
খালেদা জিয়া নতুন নেতৃত্বের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, নির্বাচনের পর দেশ পরিচালনার জন্য একটি নীতিমালা তৈরি করে নতুনদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন। সেই নতুন বলতে তিনি কী বুঝিয়েছেন? বিষয়টি স্পষ্ট না করলেও বিএনপির কর্মীরা ম্যাসেজ পেয়েছেন, তারেকই আসছেন। এতে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা উদ্বিগ্ন, তবে তারেকের সহযোগীরা উৎফুল্ল। বেশি উৎফুল্ল জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা। তারেকের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে জামায়াত বিগত নির্বাচনে অধিক মনোনয়ন বাগিয়েছিল। এমনকি বিএনপির জনপ্রিয় প্রার্থীদের বাদ দিয়ে জামায়াতকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে ফরিদপুর সদর আসনে পরপর পাঁচবার বিজয়ী এমপি কামাল ইউসুফকে বাদ দিয়ে জামায়াতের মহাসচিব আলী আহসান মুজাহিদের মনোনয়নদানের বিষয়টি উল্লেখ্য। ওই নির্বাচনে মুজাহিদ চারদলীয় জোটের মনোনয়ন পেয়েও নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যেতে পারেননি। সেখানে কামাল ইউসুফ স্বতন্ত্রভাবেই মহাজোট প্রার্থী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অল্প ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। সে যা-ই হোক, জামায়াতের সঙ্গে নতুন করে হাত ধরাধরি নীতি ও তারেককে রাজনীতিতে আনার মধ্যে যে যোগসূত্র রয়েছে, তা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
খালেদা জিয়া অনাকাঙ্ক্ষিত একটি উক্তিও করেছেন সিলেটের জনসভায়। তিনি বলেন, "প্রধানমন্ত্রী পূজামণ্ডপে গিয়ে বলেছেন, 'আমাদের মা গজে চড়ে এসেছে।' তাহলে তার মা দুর্গা? তার তো ধর্মের ঠিক নেই।" প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার পূজামণ্ডপে যাওয়াটা অন্যায় নয়, বরং সেটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য জরুরি। বিএনপি নেতারাও বিভিন্ন সময়ে পূজামণ্ডপে বা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে থাকেন। এটিই রেওয়াজ। সেখানে গিয়ে হিন্দু ধর্মের আলোকে কোনো উক্তি করা অপরাধ নয় বরং তা প্রশংসনীয় কাজ। কিন্তু এসব জেনেশুনে তিনি প্রধানমন্ত্রীর ধর্মবিশ্বাসকে যেভাবে কটাক্ষ করেছেন, তা অনভিপ্রেতই নয়, হীন রাজনীতিপ্রসূত।
পরদিন নীলফামারীতে অনুষ্ঠিত জনসভায় প্রধানমন্ত্রী এ বক্তব্যের জবাব দিয়েছেন। তিনি খালেদা জিয়ার বক্তব্যের জবাবে বলেন, 'বিরোধীদলীয় নেতা আমার ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন তুলে আমাকে উদ্দেশ করে বলেছেন, তার তো ধর্মের ঠিক নেই। আমি শুধু আপনাদের এটুকু বলতে পারি, আমি মুসলমান। ফজরের নামাজ পড়ে প্রতিদিনের কাজ শুরু করি। কিন্তু তার (খালেদা জিয়া) সকাল হয় দুপুর ১২টায়। তাহলে তিনি রাতে কী করেন? কারও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এ বক্তব্য ইঙ্গিতপূর্ণ। এমন পাল্টাপাল্টি বক্তব্য আমরা শুনতে চাই না।
প্রধানমন্ত্রীর ওই দিনের বক্তৃতায় আরও বলেছেন, 'বিরোধীদলীয় নেত্রী দুর্নীতি দমনের কথা বলছেন। অথচ তার শাসনামলে তিনি নিজে ও তার ছেলেরা দুর্নীতির আখড়া গড়ে তুলেছেন। জিয়া অরফানেজের টাকা ভাগবাটোয়ারা করেছেন। এতিমদের টাকা মেরে খেতেও ছাড়েননি তারা। তার ছেলেরা কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন, লুটপাট করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন তারেক ও কোকো।'
তারেক ও কোকোর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ আছে। এর বিচার হওয়া উচিত, তা নিয়ে দ্বিমতের সুযোগ নেই। তবে জনগণ জানতে চায়_ কেবল বিগত সরকার নয়, বর্তমান সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আছে_ এসবের বিচার হবে কি-না।
আমাদের দেশে 'দুর্নীতি দমন কমিশন' কখনও ক্ষমতাসীন দলকে স্পর্শ করে না। কেবল সাবেক সরকারের মন্ত্রীদেরই কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে কি রাজনীতির দিনবদল আদৌ সম্ভব?
আমাদের বিশ্বাস, ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী দুই শাসক দলেই যেমন ভালো লোক আছেন, তেমনি দুর্নীতিবাজ, দখলবাজ, চাঁদাবাজ আছেন। সেই দলই ভালো দল, যে দল এসব অপরাধীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেবে না, বরং তাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। অতীতে এ মানসিকতা বিএনপি সরকারের মধ্যে দেখিনি, বর্তমান মহাজোট সরকারের মধ্যেও তা অনুপস্থিত।
জনগণ সরকারের কেবল সাফাই শুনতে চায় না, তারা জানতে চায়_ তাদের দুর্ভোগ লাঘবে সরকার কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। বিরোধী দলের ওপর আক্রমণের চেয়ে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, সুশাসনের ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা জানতে জনগণ অধিক আগ্রহী। আর সংঘাত নয়, সরকার ও বিরোধী দল এক টেবিলে বসুক, সংসদের ভেতরে ও বাইরে আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান হোক, সেটিই আজ প্রত্যাশিত।
এখানে এক দল অন্য দলের সমালোচনা করছে। কিন্তু আত্মসমালোচনা করছে না, সংশোধিত হওয়ার চেষ্টা করছে না। ফলে রাজনীতি আজ পশ্চাদ্গামী।
আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে, সংসদ অচল হয়ে পড়েছে, সেদিকে কারও ভ্রূক্ষেপ নেই। ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বীদের টার্গেট নিছক ক্ষমতা, তা যেভাবেই হোক। এ ক্ষমতার খেলায় বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে নিয়েছে, আওয়ামী লীগও চিহ্নিত স্বৈরাচারীকে মহাজোটে রেখেছে। উভয় দলের নেতারা ঘরোয়া আলোচনায় স্বীকার করেন, এটা কৌশল। কিন্তু কৌশলের কারণে যখন নীতি বিসর্জিত হয়, তখন তাকে আমরা কী বলব? আসলে নীতিহীন কৌশল সুবিধাবাদেরই নামান্তর। সুবিধাবাদী ধারার স্থানে কবে কীভাবে আদর্শবাদী ধারা প্রতিষ্ঠিত হবে_ সেটি আজ বড় প্রশ্ন।

আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
 

No comments

Powered by Blogger.