দক্ষিণ এশিয়ার যৌথ সমৃদ্ধি অঞ্চল-আঞ্চলিক সহযোগিতা by ফ র আল-সিদ্দিক

মরা যদি আমাদের অঞ্চলের সমৃদ্ধি চাই তাহলে শুধু ভারত-বাংলাদেশ নয়, আমাদের সমগ্র উপমহাদেশটি এবং সে সঙ্গে গান্ধার (আফগানিস্তান), পারস্য (ইরান) এবং ব্রহ্মদেশকে (মিয়ানমার) নিয়ে বর্তমান ইউরোপিয়ান বাণিজ্য সংস্থা ইইসির মতো একটি দক্ষিণ এশিয়া কো-প্রস্পারিটি স্ফেয়ার গড়ে তুলতে হবে। এ লক্ষ্যে উজ্জীবিত হয়ে আমরা যদি ইউরোপের ইতিহাসের দিকে তাকাই, তাহলে আমরা কী দেখতে পারব? এক সময় সেখানে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের অবস্থান


ছিল। সেই রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে কোনটা ছিল রোমান ক্যাথলিক ধর্মের সমর্থক, কোনটা ছিল রাশিয়ান অর্থডক্স ধর্মের সমর্থক আর কোনটা ছিল প্রটেস্টার্ন ধর্মের সমর্থক। এই ধর্মীয় রাষ্ট্রগুলো তাদের নিজ নিজ ধর্মের শরিয়াহ (ইনকুইজিশন) আইন অনুসারে চলত। সে জন্য সেই যুগটাকে বলা হতো ইনকুইজিশনের যুগ। সে যুগে মানবাধিকারের বদলে ধর্মীয় পুরোহিতদের অমানবিক আচরণ ও নিষ্ঠুরতারই প্রাধান্য ছিল। এই তিন ধর্মের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যুগ যুগ ধরে কলহ-বিবাদ লেগেই ছিল। তাই সে যুগে ইউরোপের জাতিগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক উন্নতি তেমন একটা হচ্ছিল না। তারা তখন শুধু নিজেদের মধ্যে কাটাকাটি-মারামারি করেই মরছিল।
এরপর সেখানে এলো জ্ঞান-বিজ্ঞান ও যুক্তির যুগ, মানে 'এইজ অব রিজন।' এ যুগটির প্রভাবে ইউরোপে অনেকটা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তা এবং সে সঙ্গে জাতীয় রাষ্ট্র গড়ে ওঠে। ফলে এক রাষ্ট্রের সঙ্গে আরেক রাষ্ট্রের মারামারি-হানাহানির সমস্যাটির খুব একটা সমাধান না হলেও ইউরোপীয় জাতিগুলো বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও ন্যায়নীতির দিক দিয়ে অনেক দূর এগিয়ে যায়। ইউরোপের ভাষাগুলোর অবস্থান ছিল বেশ জটিল। সেগুলো ছিল নর্ডিক, ল্যাটিনিক, সিরিলিক ইত্যাদি ভাষাগোষ্ঠীতে বিভক্ত। এর ওপর জাতীয় এবং ঔপনিবেশিক স্বার্থ জড়িয়ে পড়ে এ বিভক্তিকে আরও জটিল করে দিয়েছিল। তাই তো আমরা দেখতে পাই, বিগত শতাব্দীর প্রথমার্ধে সেখানে দুটি ভীষণভাবে নিষ্ঠুর ও রক্তাক্ত মহাযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল এ ভাষা ও ঔপনিবেশিক স্বার্থে বিভক্ত জাতিগুলোর মধ্যে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সুফলস্বরূপ বিভিন্ন রাষ্ট্রের উপনিবেশগুলো বিলুপ্ত হওয়ার ফলে বর্তমান ইউরোপে চলছে আঞ্চলিক মৈত্রীর ভিত্তিতে গড়া একটি ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যের যুগ। ফলে এখন ভাষা ও ধর্ম নির্বিশেষে পুরো ইউরোপ মিলে একেকটি একেক ধরনের জাতিতে পরিণত হয়েছে। সেখানে তারা তুর্কি ভাষাগোষ্ঠীর একটি রাষ্ট্র তুরস্ককেও সঙ্গে নিতে যাচ্ছে। ফলে গড়ে উঠছে একটি রাজনৈতিক হানাহানিমুক্ত, সমৃদ্ধিশালী একটি ইউরোপ।
ইউরোপের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে ইউরোপিয়ান সহযোগিতা সংস্থা ইইসির মতো আমাদেরও গড়ে তুলতে হবে দক্ষিণ এশিয়ার উপমহাদেশীয় অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংস্থা। ইইসির মতো এ সংস্থায়ও থাকবে অভিন্ন মুদ্রা 'টাকা'। এ ধরনের সম্পর্ক যদিও আমরা সার্ক, সাপটা ইত্যাদি মৈত্রী সংগঠনের মাধ্যমে গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছি, তবুও সে প্রচেষ্টা এখন পর্যন্ত খুব একটা ফলপ্রসূ হচ্ছে না। এর প্রধান কারণ হলো, আমাদের এ উপমহাদেশের জনগণের একটি বিরাট অংশ এখনও সেই ইনকুইজিশনের যুগের ধ্যান-ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না। সে সঙ্গে এ অঞ্চলের বিরাটসংখ্যক নেতা-নেত্রীও তাদের পড়শি দেশগুলোকে শত্রু রাষ্ট্র বলে মনে করে, সে দেশগুলোর বিরুদ্ধে হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ ও অসহযোগিতা প্রদর্শন করে চলেছে। তাদের এ হিংসা-বিদ্বেষের জন্যই আমরা একদিকে যেমন ইউরোপের ইইসির মতো একটি পারস্পরিক সহযোগিতা ও সৌহার্দ্যের মঞ্চ তৈরি করতে ব্যর্থ হচ্ছি, তেমনি আমরা বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটানের সঙ্গে উপ-আঞ্চলিক চুক্তি করতেও ব্যর্থ হচ্ছি। এর জন্যই এ অঞ্চলে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির এত গুরুত্ব। এসব দ্বিপক্ষীয় চুক্তিগুলোই এককালে বহুপক্ষীয় চুক্তিগুলো সংগঠিত হতে উৎসাহ জোগাবে।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে দুটি ব্যাপারে এ দেশের পত্র-পত্রিকায় কোনো আলোচনাই হচ্ছে না, সে দুটি বিষয় আমি এখানে তুলে ধরতে চাই। এর প্রথমটি হলো, বাংলাদেশ ইট, রিফ্রাকটরিজ ও চীনামাটির তৈজসপত্র তৈরির জন্য উপযোগী কাদামাটি ক্লেমিনেরাল সম্পদে খুবই সমৃদ্ধ। আমরা খুব স্বল্প পুঁজিতে এসব দ্রব্য উৎপাদনের হার বৃদ্ধি করতে পারি। ভারতের বাজারে এ দ্রব্যগুলোর বেশ চাহিদাও আছে। ভারতে এ দ্রব্যগুলোর চাহিদার কারণ, সেখানে এগুলো যথেষ্ট পরিমাণে উৎপাদিত না হওয়ার জন্য নয়। বাংলাদেশে প্রস্তুত এ দ্রব্যগুলোর মান অনেক উন্নত বলে ভারতে এগুলোর এত চাহিদা। ভারত এগুলো আমদানি করতে যে অনাগ্রহী, তাও নয়। তবুও শুধু বাংলাদেশি আমলা ও বর্ডার গার্ডদের সৃষ্ট বাধা-বন্ধকতার জন্যই আমরা ভারতের চাহিদা অনুপাতে যথেষ্ট পরিমাণে উৎপাদিত না হওয়ার জন্য নয়। বাংলাদেশে প্রস্তুত এ দ্রব্যগুলোর মান অনেক উন্নত বলে ভারতে এগুলোর এত চাহিদা। ভারত এগুলো আমদানি করতে যে অনাগ্রহী, তাও নয়। তবুও শুধু বাংলাদেশি আমলা ও বর্ডার গার্ডদের সৃষ্ট বাধা-বন্ধকতার জন্যই আমরা ভারতের চাহিদা অনুপাতে যথেষ্ট পরিমাণ দ্রব্য সে দেশে রফতানি করতে পারছি না। আমার বিশ্বাস, এসব বাধা-বন্ধকতা প্রশমন করে এবং দু'দেশের মধ্যকার সীমান্ত হাটগুলোতে এসব দ্রব্যের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতে পারলে আমরা এত বিপুল পরিমাণে ভারতে রফতানি করতে পারব যে, এ দু'দেশের মধ্যে বিরাজিত রফতানি বৈষম্য বেশকিছুটা কমে যাবে। আর দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, বাংলাদেশ যে প্রক্রিয়ায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ করার ভাব করে প্রতি বছর মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার পানিতে ঢালছে, সে প্রক্রিয়ায় বন্যা আজ পর্যন্ত একটুও নিয়ন্ত্রিত হয়নি। এভাবে চললে এ বন্যা ভবিষ্যতেও নিয়ন্ত্রিত হবে না।
প্রথমেই আমাদের বুঝতে হবে, এ দেশে বন্যাপ্রবণতা বৃদ্ধির প্রধান কারণ হলো, প্রতি বছরই এ দেশের নদীগুলোর ঢাল কমে যাচ্ছে। তাই এ দেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণকে সার্থক করতে হলে এই ঢাল কমে যাওয়াকে তো রোধ করতেই হবে, সে সঙ্গে পরিকল্পিতভাবে পলিমাটি ধরে রাখার মাধ্যমে এ ঢালকে বৃদ্ধি করে, অনেকগুণ বাড়িয়ে দিতে হবে। এ কাজটি করতে পারলে এ দেশে বন্যার প্রকোপ তো কমবেই, সে সঙ্গে নদীগুলোর নাব্যতাও অনেকগুণ বেড়ে যাবে; কিন্তু এ কাজটি তো বাংলাদেশের একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। এ কাজটি করতে হবে ভারতের সঙ্গে সমন্বিতভাবে।

ফ র আল-সিদ্দিক :সাবেক পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি
 

No comments

Powered by Blogger.