'ক্ষুধার্থ ও নির্বোধ থাক'-সমসময় by অজয় দাশগুপ্ত

'ক্ষুধার্থ থাক, নির্বোধ থাক'_ এক মনীষীর বাণী এটা। প্রথমটি না হয় মানা যায়, কিন্তু দ্বিতীয়টি? ক্ষুধার্থ থাকাই যায় এবং তা দূর করার তাড়নাও থাকে। আপনি এ ক্ষুধাকে পেটের ক্ষুধা বলতে পারেন, জ্ঞানের জন্য অতৃপ্তিও ধরতে পারেন। 'নির্বোধ' থাকার বিষয়টিও কি এভাবে দেখা যায়? আপনি নিজেকে যদি সবজান্তা ভাবেন, তাহলে নতুনকে জানা ও আয়ত্ত করার তাড়না থাকে না। বাঙালি নাকি নিজেকে সবজান্তা ভাবে, এমন অভিমত কোনো কোনো বিশিষ্টজন করেছেন।


আর এ কারণেই নাকি তারা বেশিদূর এগোতে পারে না। আবার এমন কৌতুকও রয়েছে, বাঙালি পরশ্রীকাতর। নিজে ভালো থাকার চেষ্টা যতটা না করে, অন্যে যেন ভালো না থাকে_ সে জন্য চেষ্টা করে আরও বেশি। একটা কৌতুক আছে এভাবে : দুই লোক নরক পরিদর্শনে বের হয়েছে। তারা সেখানে ভয়ঙ্কর সব দৃশ্য দেখল। আগুনে দগ্ধ হচ্ছে নারী-পুরুষ। কেউবা অতল গরম পানিতে ডুবে যাচ্ছে। ভীষণ-দর্শন দৈত্যরা অনেককে পেটাচ্ছে। এমন অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে প্রতিটি নরককুণ্ডে রয়েছে পাহারাদার। কেউ পালাতে চাইলে তাকে ফের অত্যাচারীর কাছে ঠেলে দেওয়া হয়। কিন্তু বাঙালিদের নরককুণ্ডে কোনো পাহারাদার নেই। কেন এমন বিধান_ ওই দুই দর্শনার্থী সেটা জানতে চাইলে নরককর্তা জানান, বাঙালিরা কেউ নরক-যন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্য বের হওয়ার চেষ্টা করলে অন্য বাঙালিরাই তাকে নরকে টেনে নামাবে। এ কারণে তাদের জন্য প্রহরীর দরকার পড়ে না। এটা হয়তো নিছকই সেকেলে কৌতুক।
বাঙালিরা কিন্তু উঠছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের আমানত ও ঋণের বিস্তারিত তথ্য থাকে। ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর দেশের সব ব্যাংকে এক কোটি টাকা কিংবা তারও বেশি অর্থ জমা ছিল ২ হাজার ১০৫টি অ্যাকাউন্টে। সে সময় কোনো কোনো সংবাদপত্রে শিরোনাম ছিল : 'দেশে দুই হাজারের বেশি কোটিপতি।' তখন সংখ্যাটিকে বেশ বড় হিসেবেই উল্লেখ করা হয়। মনে আছে, সত্তরের দশকের শেষদিকে দেশে ২৪ জন কোটিপতি রয়েছে, এমন তথ্যে বেশ হৈচৈ পড়ে গিয়েছিল। বলা হচ্ছিল, পাকিস্তানের ২২ পরিবারের স্থলে ২৪ বাঙালি পরিবার! এখন আরেকটি হিসাব দেখা যাক। ২০১০ সালের ৩১ ডিসেম্বরের হিসাব দেখুন :বাংলাদেশ ব্যাংক জানাচ্ছে, ব্যাংকগুলোতে বেসরকারি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের এক কোটি টাকা বা তারও বেশি অর্থ জমা রয়েছে ১৯ হাজার ৯৬৭টি অ্যাকাউন্টে। ৭৫ লাখ থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত জমা রয়েছে আরও ৯ হাজার ৪০৬টি অ্যাকাউন্টে। ৫০ লাখ থেকে ৭৫ লাখ টাকা জমা আছে ২০ হাজারের বেশি অ্যাকাউন্টে। এক সময়ে 'লাখপতি' খুব চালু শব্দ ছিল। এখন লাখ টাকা অনেকের হাতেই নস্যি। একটি ভালো সোফাসেট কিংবা খাট কিনতে এর চেয়ে বেশি টাকা ব্যয় করতে হয়। সম্পদ আহরণের অনেক উপায় রয়েছে আমাদের দেশে। এটি বৈধ উপায়ে হতে পারে, অবৈধ উপায়েও হতে পারে। সরকারকে কর ফাঁকি দিয়ে হতে পারে, অন্যের সম্পদ জবরদখল করে হতে পারে। সরকারি সম্পদ জবরদখল করেও হতে পারে। 'ক্ষুধার্থ থাক'_ এ বাক্যের অনুসরণ করেও হতে পারে। এ ক্ষুধা ধনসম্পদ উপার্জনের। কথাটি কিন্তু বলেছেন সদ্যপ্রয়াত অ্যাপলের কর্ণধার স্টিভ জবস। তিনি মনে করতেন, জীবনক্ষুধা থাকা চাই। অন্যথায় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। এ ক্ষুধা জানার ও শেখার। বিল গেটস বলেছেন, আধুনিক প্রযুক্তি আয়ত্তে থাকলে একটি ছোট ঘরে বসেও আপনি কোটি কোটি টাকা উপার্জন করতে পারেন। এ জন্য প্রযুক্তি হাতে থাকা চাই_ যন্ত্র এবং তাত্তি্বক ও বাস্তব জ্ঞান উভয় হাতিয়ার থাকতে হবে। দোয়েল ল্যাপটপ তরুণ প্রজন্মের জন্য এ সুবিধা সৃষ্টি করে দিতে পারে। তারা শুধু পাঠ্য বিষয় পড়বে না, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আরও অনেক রহস্য তাদের সামনে উন্মোচিত হয়ে যাবে। ধনভাণ্ডারও খুলে যেতে পারে। আবার দেখুন, এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে কত সহজেই ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করা হচ্ছে :সমকালের একটি খবরের শিরোনাম_ 'সরকারি ল্যাপটপ তৈরিতে বেসরকারি লুটপাট'। এতে বলা হয় : সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সহায়তায় বেসরকারি একটি কোম্পানি লুটে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। নামকাওয়াস্তে মূলধন দিয়েই ল্যাপটপ কোম্পানির ৩৫ শতাংশের মালিকানা বাগিয়ে নিয়েছে বেসরকারি কোম্পানি ২এম টেকনোলোজিস লিমিটেড [সমকাল : ১৫ অক্টোবর, ২০১১]। প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের এক পদস্থ কর্মকর্তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হওয়ার সুবাদে এ ব্যবসা বাগিয়ে নিয়েছে কোম্পানিটি। লেখার শুরুতে যে নরক সংক্রান্ত কৌতুক বলেছি, তাতে বাঙালি বাঙালিকে কেবল 'পশ্চাতে টানে'। কিন্তু ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তাকে দেখা যাচ্ছে, আরেক বাঙালিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করছেন। হোক না আত্মীয়, বাঙালি তো বটে!
স্টিভ জবস বলেছেন নির্বোধ থাকতে। আক্ষরিক অর্থে ধরলে কথাটি বিপজ্জনক অর্থ নিয়ে হাজির হতে পারে। আর যদি ধরা হয়, যে কম জানে তাকে আরও বেশি জানতে হবে এবং সে জন্য চেষ্টা চালাতে হবে_ তাহলে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা সৃষ্টি হয়। গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষার প্রসার ঘটছে দেশে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আসনে ভর্তির জন্য পরীক্ষা দিচ্ছে প্রায় অর্ধশত। অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েরও একই চিত্র। মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তেও ভিড় জমায় শিক্ষার্থীরা। তিতুমীর কলেজ, ইডেন কলেজ, সোহরাওয়ার্দী কলেজ, বরিশালের বিএম বা ব্রজমোহন কলেজ ও হাতেম আলী কলেজ, চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ ও হাজী মুহম্মদ মুহসীন কলেজ, ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ, খুলনার বিএল বা ব্রজলাল কলেজ, সিলেটের এমসি বা মুরারিচাঁদ কলেজ, (প্রকৃতপক্ষে এগুলো হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, যেখানে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স পড়ানো হয়) প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলগুলোতেও শিক্ষার্থীদের প্রচুর ভিড়। জ্ঞানের জগতের প্রতি এ আকর্ষণ উৎসাহব্যঞ্জক। যারা এ রাজ্যে সাফল্যের সঙ্গে প্রবেশ করতে পারবেন, তাদের কেউ কেউ এ রাজ্যেই থেকে যাবেন এবং অন্যদের মধ্যে তা বিতরণ করবেন। কেউবা ধনসম্পদ উপার্জনে বেশি মনোযোগী হবেন। ইতিমধ্যেই সেটা ঘটতে শুরু করেছে, তা কোটিপতি সংখ্যা বৃদ্ধির তথ্য থেকে স্পষ্ট। যাদের ব্যাংকে এক কোটি টাকা বা তারও বেশি অর্থ জমা রাখার ক্ষমতা থাকে তাদের আরও সম্পদ থাকাই স্বাভাবিক। গুলশান-বনানী-ধানমণ্ডি তো বটেই, এখন মিরপুর বা মোহাম্মদপুরেও ৫-৭ কাঠা জমির মালিককে 'কোটি টাকার সম্পদের মালিক' ধরা হয়। অভিজাত এলাকায় এক হাজার বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাটও কোটি টাকার কমে মিলবে না। অনেকের কলকারখানা ও ব্যবসা আছে। এই জনগোষ্ঠী যদি শিক্ষার পেছনে তাদের সম্পদের একটি অংশ নিয়মিত ব্যয় করে, তা দেশের জন্য কল্যাণকর হবে। অনেকে তা করেও থাকে। কিন্তু শিক্ষার যেভাবে প্রসার ঘটছে এবং শিক্ষার মান বৃদ্ধির যে প্রবল তাগিদ তার তুলনায় এটা যথেষ্ট কি-না সেটাই প্রশ্ন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ছাত্রাবাস' নিয়ে উপাচার্যের মন্তব্য ছিল : 'যার মালিকানা আমাদের নেই, তা উদ্ধার করব কীভাবে?' এ প্রতিষ্ঠানটি এক সময় ছিল ব্যক্তিগত দানের কলেজ। ষাটের দশকে সরকার তা নিজের নিয়ন্ত্রণে নেয়। ২০০৫ সালে হয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এ দেশে সাম্প্রদায়িক সমস্যা ছিল প্রকট। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জগন্নাথ কলেজের আশপাশের অনেক সচ্ছল হিন্দু পরিবার তখন দেশত্যাগে বাধ্য হয়। জবরদস্তিরও শিকার হন অনেকে। বরিশাল শহরের একটি ঘটনা বলি। একটি ত্রিতল ভবনের মালিকের নিচতলা সরকার 'রিকুইজিশন' করে সরকারি অফিস বানানোর অজুহাতে। তারপর দোতলাও জোর করে দখলে নেওয়া হয় এবং শেষ পর্যন্ত মালিক পরিবারের সদস্যরা তৃতীয় তলা স্বেচ্ছায় ছেড়ে 'দেশত্যাগ' করেন। জগন্নাথ কলেজের আশপাশের কয়েকটি 'পরিত্যক্ত' হিন্দুবাড়ি ছাত্ররা হোস্টেল হিসেবে ব্যবহার করতে থাকে। কিন্তু এসব বাড়ির মালিকানা কলেজের ছিল না। শিক্ষাদানে যুক্ত একটি প্রতিষ্ঠান ভুয়া কাগজপত্র তৈরিতে পারদর্শিতা দেখায়নি, যা পেরেছে কিছু ব্যক্তি। তাদের রাজনৈতিক কানেকশন ছিল কিংবা নিজেরাই রাজনীতিক। তারা পুলিশের সহায়তায় এসব বাড়ির 'মালিক' হয়ে যায়। এখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা তাদের 'ছাত্রাবাস' ফেরত চাইছে। 'পরিত্যক্ত সম্পত্তি' শিক্ষার কাজে লাগলে সেটা বরং মন্দের ভালো। কিন্তু কেন এই সম্পত্তি পরিত্যক্ত, এর পেছনে কত মানুষের যে কান্না, কত পরিবার যে ইচ্ছার বিরুদ্ধে জন্মভিটা ত্যাগ করেছে সে কাহিনী শিক্ষার্থীদের কে জানাবে? জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ উদ্যোগ নেবে? নাকি এসব ছাত্রাবাসের মূল মালিকদের ইতিহাস জানবে না কেউ কোনোদিন, শিক্ষার্থীরা কেবল জানবে যে তারা তাদের সম্পত্তি ফেরত পেতে চাইছে? এ ধরনের সম্পত্তি দেশের সর্বত্র রয়েছে, যার ইতিহাস বড়ই করুণ।
সমাজে ধনবান মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এ সংখ্যা আরও বাড়ূক, তাতে আপত্তি নেই। সম্পদ নতুন সম্পদ সৃষ্টি করতে পারে_ এ কারণেও অনেকের সম্পদ বাড়বে। তরুণ প্রজন্ম তাদের বিদ্যা-বুদ্ধি কাজে লাগিয়েও নিজের ও দেশের জন্য সম্পদ বাড়াতে পারে। ল্যাপটপ প্রজন্মের কাছে এটাই থাকবে প্রত্যাশা। আবার কেউ কেউ রাষ্ট্র কিংবা ব্যক্তিকে বঞ্চিত করেও নিজের সম্পদ বাড়াতে পারে। সব ক্ষেত্রেই কাজ করে এক ধরনের ক্ষুধা। আবার জ্ঞানের জন্যও থাকে ক্ষুধা। অগাধ সম্পদ যাদের রয়েছে কিংবা আগামীতে যারা নতুন নতুন সম্পদের মালিক হবেন, তারা যেন এর একটি অংশ জ্ঞান-ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার কাজে লাগাতে উৎসাহী হয়, এটাই কাম্য থাকবে।

অজয় দাশগুপ্ত :সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.