বাংলার দ্রোহী আবুল হুসেন by শামস শামীম

বিশ শতকের গোড়ার দিকের মনীষী ও সংস্কারক আবুল হুসেন। বাংলার মুসলমানদের বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের প্রধান সংগঠক ও পৃষ্ঠপোষকের ৭৩তম মৃত্যুবার্ষিকী ছিল গতকাল। যশোরের পানিসারা গ্রামের মাতুলালয়ে ১৮৯৭ সালের ৬ জানুয়ারি তার জন্ম। মৃত্যু ১৫ অক্টোবর ১৯৩৮। তার পিতা মুহম্মদ মুসা এবং মাতা আসিরুন নেসা খাতুন। আবুল হুসেন ব্রিটিশদের দোসর জমিদারদের উদ্দেশ করে উপরোক্ত কথা তার 'বাংলার বলশী' গ্রন্থে উলেল্গখ করলেও পশ্চিমের গণতন্ত্র


দ্বারা প্রভাবিত আমাদের আজকের সমাজ, রাষ্ট্র ও সরকারের ক্ষেত্রে কথাগুলো এখনও সময়োপযোগী। আজকের দিনেও পল্লীর কৃষক সমান দুর্দশাগ্রস্ত। সামান্য ঋণের জন্য শক্তিশালী রাষ্ট্র তার কোমরে দড়ি বেঁধে কোর্টে তোলে। এনজিওগুলো সামান্য কিস্তির টাকা দিতে না পারায় কৃষকবধূর বালা, নাকের নোলক ও ঘটিবাটি নিয়ে যায়। ভোটের দলের কাছে প্রতিনিয়ত প্রতারিত কৃষক। সার-বীজের জন্য চলছে লড়াই। গুলি লাগছে কৃষকের বুকে। বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশনে কৃষিতে সবুজ বিপল্গবের নামে শুরু হয়েছে কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ। অতি ফলনের আগ্রাসী বিজ্ঞাপনে কৃষকদের প্রলুব্ধ করে দেশীয় বীজ ও প্রজাতিকে হটিয়ে হাইব্রিড নিয়ে আসা হয়েছে। রাসায়নিক বিষ বিক্রি করে ফুলেফেঁপে উঠছে বহুজাতিক কোম্পানি। এতসব প্রতারণা, বঞ্চনা ও নিপীড়নের পরও এখন পর্যন্ত কৃষকই জাতীয় উন্নয়নের অগ্রগতির চাবিকাঠি হিসেবে বিবেচিত! বাংলার বীর্যবান কৃষকের দুর্দশায় ব্যথিত আবুল হুসেন তার ক্ষুরধার লেখনিতে ভদ্রলোক দাবিদারদের একহাত দেখিয়েছেন। জাতীয় উন্নতির জন্য কৃষকের ভাগ্য পরিবর্তনের বিকল্প নেই_ তিনি এ বিষয়টি অনেক আগেই বুঝে তা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজছিলেন। তার লেখায় মুক্তবুদ্ধির বাঙালি মুসলমানের নবজাগরণের সঙ্গে নিগৃহীত কৃষকদের উঠে দাঁড়ানোর ইঙ্গিতটিও স্পষ্ট ছিল। তার পথ ধরেই আমরা পরে এসএম সুলতানের ক্যানভাসে বাংলার বীর্যবান কৃষকের অবয়ব দেখতে পাই।
বিংশ শতাব্দীতে তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞান বিমুখ গোঁড়া মুসলমানদের পাশে দ্বীপশিখা হাতে দাঁড়িয়েছিলেন। বাঙালি মুসলমানের মনের বদ্ধ গিঁট খুলে দিয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরই অর্থনীতি ও বাণিজ্য বিভাগে মাসিক ১২৫ টাকা বেতনে লেকচারার পদে যোগ দেন। ১৯২৭ সালে ঢাকায় গঠিত মুসলিম সাহিত্য সমাজ ও বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের পুরোধা তিনি। এ সময় প্রকাশ করেন শিখা পত্রিকা। তার ঢাকা ত্যাগের পরেই শিখা পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়; মুসলিম সাহিত্য সমাজের কার্যক্রমও ঝিমিয়ে পড়ে। তিনি 'অ্যান্টি পর্দা লীগ' গঠন করে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মুসলমানদের মনে কুঠারাঘাত করেন। শিখা ছাড়াও তরুণপত্র, অভিধান, জাগরণ পত্রিকার সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাকালে একটি প্রকাশিত প্রবন্ধ নিয়ে প্রতিক্রিয়াশীলদের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। 'নিষেধের বিড়ম্বনা' এবং 'আদেশের নিগ্রহ' নামক দুটি প্রবন্ধের জন্য তাকে ঢাকার নবাবরা পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় বিচারের নামে চরম অপমান করে। পরে আইন পেশায় যোগ দিয়ে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে প্রথম মাস্টার অব ল' লাভ করেন। আবুল হুসেন এখনও প্রচার-প্রচারণার আড়ালে। তার প্রকাশিত রচনাবলি এখনও সহজলভ্য নয়। নতুন প্রজন্ম এমনকি পূর্ব প্রজন্মও তার সম্পর্কে তেমন অবহিত নয়।
আবুল হুসেন বাংলার সংগ্রামী কৃষকদের নিয়ে বাংলার বলশী গ্রন্থে কৃষকের সংগ্রামকে তুলে ধরেছেন জাতীয় কর্তব্যজ্ঞানে। জমিদারি শোষণ-পীড়ন থেকে কৃষকের মুক্তি ও কৃষির উন্নতি নিয়ে তার মৌলিক চিন্তার পরিচয় মেলে এই গ্রন্থে। এসবের পাশাপাশি বাঙালি মুসলমানের শিক্ষা সমস্যাকে একজন আধুনিক চিন্তকের ভূমিকায় প্রত্যক্ষ করে এ থেকে মুক্তির পথ খুঁজেছেন তিনি। মুসলিম সাহিত্য সমাজের মুখপত্র শিখা পত্রিকায় শিখাগোষ্ঠীর মৌলিক চিন্তার পরিচয় শিখাসমগ্রে প্রত্যক্ষ করা যায়। মুসলিম সাহিত্য সমাজের বার্ষিক সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, 'আজ আমাদের সব শুভ চেষ্টা আমাদের জ্ঞান ও বুদ্ধিকে মুক্ত করা'। গোঁড়া ধার্মিকদের ভয়ে স্বজনরা তার রচনা প্রকাশ না করে কলকাতায় নিয়ে যান। সেখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রক্ষিত স্থানে অগি্নসংযোগ হলে তা পুড়ে
ছাই হয়ে যায়।
 

No comments

Powered by Blogger.