স্কুলে শিক্ষার্থী ভর্তিতে অরাজকতা
সোলায়মান তুষার: দেশব্যাপী স্কুলে শিক্ষার্থী ভর্তিতে এক প্রকার অরাজকতা শুরু হয়েছে। অভিভাবকদের জিম্মি করে আদায় করা হচ্ছে অর্থ। নামে-বেনামে নেয়া হচ্ছে হাজার হাজার টাকা। রাজধানীর নামীদামি স্কুলগুলোতেই এ অরাজকতা বেশি। সরকারের জারি করা নীতিমালাকে কোন তোয়াক্কাই করা হচ্ছে না। অভিভাবকদের কাছ থেকে বাড়তি অর্থ আদায় করা হলেও সরকার কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকারি দলের লোকজন জড়িত থাকায় অভিভাবকরা অসহায়। সরকার একটি কমিটি গঠন করা হলেও এটি এক প্রকার অকার্যকর। বাড়তি ফি সংক্রান্ত সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে রাজধানীর মনিপুর উচ্চবিদ্যালয়ে সাংবাদিক লাঞ্ছিত হয়েছেন। শিক্ষামন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন নীতিমালা লঙ্ঘনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তার এ ঘোষণা কতটা কার্যকর হবে সেটাও এখন দেখার বিষয়। তবে স্কুলপ্রধানরা বলেছেন, সরকার যে টাকা ধার্য করেছে তা দিয়ে ব্যয় মেটানো সম্ভব নয়। তাই বাড়তি টাকা নেয়া হচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে নামীদামি স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তির নামে গলাকাটা ফি নেয়া হচ্ছে। সরকারি কোন নীতিমালা না থাকায় তেমন কিছু বলারও ছিল না। অভিভাবকদের দাবির প্রেক্ষিতে ১৪ই ডিসেম্বর একটি নীতিমালা জারি করে সরকার। রাজধানীর নিম্ন মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয় গত ১৪ই ডিসেম্বর নীতিমালা জারি করে। নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়, ভর্তির আবেদনের ফরমের জন্য সর্বোচ্চ ১০০ টাকা নেয়া যাবে। সেশন চার্জসহ ভর্তি ফি সর্বসাকুল্যে মফস্বল এলাকায় ৫০০ টাকা, উপজেলা সদর এলাকায় ১ হাজার টাকা, জেলা সদর এলাকায় ২ হাজার টাকা, ঢাকা মেট্রোপলিটন ছাড়া অন্যান্য মেট্রোপলিটন এলাকায় ২হাজার টাকা এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় ৫ হাজার টাকার বেশি নেয়া যাবে না। ভর্তি ফি ও ভর্তি ফরম বাবদ সরকার কর্তৃক নির্ধারিত টাকার চেয়ে বেশি আদায় করলে এমপিও বাতিলসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু এ নীতিমালার তোয়াক্কাই করা হচ্ছে না। রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে ১৪৯৩ জনের লটারি হয়েছে ভর্তির জন্য। মোট ১৫০০’র বেশি ভর্তি করা হবে। প্রথম শ্রেণীতে ভর্তির জন্য আদায় করা হচ্ছে ১২ হাজার ২০০ টাকা। এছাড়া ইংরেজি ভার্সনে আদায় করা হচ্ছে ১৪ হাজার ১০০’ টাকা। মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি বাবদ ৬৭ হাজার পর্যন্ত আদায় করা হচ্ছে। আইডিয়াল স্কুলের মূল শাখায় বাংলা মাধ্যমে ১৩ হাজার ৭০০ টাকা, কলোনি শাখায় ৬ হাজার ৭০০ টাকা এবং মুগদা শাখায় ৩৪ হাজার টাকা আদায় করা হচ্ছে। এছাড়া আজিমপুর স্কুলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হচ্ছে বলে জানান অভিভাবকরা। গাজীপুরের অভিভাবক সাহাবউদ্দিন জানান, আমি কয়েকটি স্কুলে খবর নিয়ে দেখেছি কোথাও ১০ হাজার আবার কোথাও ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হচ্ছে। তাহলে সরকারি নীতিমালা করার মানে কি ? ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মঞ্জুয়ারা বেগম বলেন, আমার প্রতিষ্ঠানে ৬৫০ জন শিক্ষক কর্মকর্তা আছে। এর মধ্যে এমপিওভুক্ত ১১০ জন। সামনে আরও ৫০-৬০ শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। বিপুল সংখ্যক শিক্ষক-কর্মকর্তার বেতন দিতে হয় স্কুল থেকে। তিনি বলেন, ভিকারুননিসায় শুধুমাত্র প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি করা হয়। এখানে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তিতে ১২ হাজার ২০০ টাকা নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা মেয়েদের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা দিই। সরকার যে টাকা ধার্য করেছে তা দিয়ে ভর্তি করালে প্রতিষ্ঠান চালানো সম্ভব হবে না। মঞ্জুয়ারা আরও বলেন, টাকার অভাবে একটি ভবন করতে পারছি না। বাড়তি টাকা নেয়ার কারণ ও সার্বিক পরিস্থিতি জানিয়ে তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে একটি চিঠি লিখবেন বলে জানান। এদিকে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, নীতিমালা লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত ভর্তি ফি আদায়কারী স্কুলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। গতকাল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন। রাজধানীর নামীদামি স্কুলে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তিতে সরকারি নীতিমালা মানা হচ্ছে না। এ নিয়ে গত কয়েক দিন ধরে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অবিভাবকরা। মণিপুর উচ্চবিদ্যালয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে আরটিভির সাংবাদিককে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় মন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, এ ঘটনায় ওই স্কুলে একটি তদন্ত দল পাঠানো হবে। সেই তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। রাজধানীর মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে ছাত্রভর্তি নিয়ে উত্থাপিত অভিযোগ ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা খতিয়ে দেখতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রফেসর নোমান-উর রশীদের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। গতকাল শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এ তদন্ত কমিটি গঠন করেন। কমিটির অপর সদস্যরা হলেন- মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (মাধ্যমিক) সহিদুল ইসলাম এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক শফিকুর রহমান। এ কমিটিকে আগামী ২ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ছাত্রভর্তিতে অতিরিক্ত অর্থ আদায় ছাড়াও মঙ্গলবার সকালে বেসরকারি টেলিভিশন আরটিভির রিপোর্টার অপর্ণা সিংহ ও তার ইউনিটকে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট কেউ জড়িত কিনা তা খতিয়ে দেখা হবে। প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক বা শিক্ষকদের মধ্যে কেউ জড়িত কিনা দেখা হবে তা-ও। এ স্কুলে প্রাথমিক পর্যায়ে ছাত্রছাত্রী ভর্তির জন্য অভিভাবকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হচ্ছে। ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান ও সরকার গঠিত কমিটির সদস্য অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন বলেছেন, রাজধানীর স্কুলগুলোতে বাড়তি টাকা নেয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, কয়েকটি স্কুল পরিদর্শন করে আমরা দেখেছি নীতিমালার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি টাকা নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করবো ওইসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে।
No comments