স্বাধীনতার ৪০ বছর-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৭২ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। হাবিবুর রহমান, বীর উত্তম জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণেও যুদ্ধ করেছেন তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানের দিকে বেপরোয়াভাবে এগিয়ে আসছে একদল পাকিস্তানি সেনা। হাবিবুর রহমান মেশিনগান দিয়ে গুলি করে তাদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কোনো বাধাই পাকিস্তানি সেনারা মানছে না। অপ্রতিরোধ্য তারা। এমন সময় হাবিবুর রহমানের মেশিনগানের গুলি শেষ


হয়ে গেল। জীবন-মৃত্যুর কঠিন এক সন্ধিক্ষণ। তাঁর কাছে শেষ সম্বল চারটি গ্রেনেড। সেগুলো পাকিস্তানি সেনাদের লক্ষ্য করে ছুড়লেন। এমন সময় হঠাৎ একঝাঁক গুলি এসে লাগল হাবিবুর রহমান ও তাঁর সঙ্গে থাকা সহযোদ্ধার শরীরে। রক্তে ভেসে যেতে থাকল পরিখা। এ ঘটনা ১৯৭১ সালের। ২৬ নভেম্বর, রাধানগরে।
রাধানগর সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট থানার (বর্তমানে উপজেলা) অন্তর্গত। সীমান্ত এলাকার ছোট এক বাজার। ১৯৭১ সালে রাধানগরে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত এক প্রতিরক্ষা অবস্থান। প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ও টসি ব্যাটালিয়ন। ২৬ নভেম্বর মিত্র বাহিনীর ৫/৫ গুর্খা রেজিমেন্ট ও মুক্তিবাহিনীর একটি দল রাধানগরে আক্রমণ করে। এই আক্রমণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাল্টা আক্রমণে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী বিশেষত, মিত্রবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ৫/৫ গুর্খা রেজিমেন্টের কোম্পানি কমান্ডার, একজন লেফটেন্যান্টসহ প্রায় ১৫০ জন শহীদ হন। মুক্তিবাহিনীর কয়েকজন শহীদ এবং হাবিবুর রহমানসহ বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত হন।
এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কর্নেল এস আই এম নূরুন্নবী খান (বীর বিক্রম) রাধানগর যুদ্ধ নিয়ে অপারেশন রাধানগর নামের একটি বই লিখেছেন। এ বইয়ের বিভিন্ন পৃষ্ঠায় আছে হাবিবুর রহমানের বীরত্ব ও সাহসের কথা। এক স্থানে লিখেছেন: ‘...২৬ নভেম্বর শিমুলতলা গ্রামের অবস্থানে থাকাকালীন সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রচণ্ড প্রতিহামলা ঠেকাতে গিয়ে সুবেদার হাবিব (হাবিবুর রহমান) নিজ অবস্থানে অটল থেকে তাঁর অস্ত্রের শেষ বুলেটটি পর্যন্ত ছোড়েন। শিমুলতলা মসজিদসংলগ্ন বাংকারের পাশেই ছিল মেশিনগান পোস্ট। পাকিস্তানিদের চীনা ওয়েভ পদ্ধতির আক্রমণের মুখে গুলি করতে করতে ওই মেশিনগানের গুলি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। সুবেদার হাবিবের কারণে পাকিস্তানিরা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। গুলি বন্ধ হয়ে গেলে পাকিস্তানি সেনারা তাঁর অবস্থানের ওপর চড়াও হয়। তাঁর বাংকার টার্গেট করে অসংখ্য গুলি করে। হাবিব তাঁর শেষ সম্বল চারটি হ্যান্ডগ্রেনেড নিক্ষেপ করে ওদের অগ্রযাত্রা প্রতিহত করার চেষ্টা করেন। হ্যান্ডগ্রেনেড নিক্ষেপ করার পর আত্মরক্ষার জন্য তাঁর আর কিছু ছিল না। পাকিস্তানিরা তাঁকে অসংখ্য গুলির আঘাতে ঝাঁঝরা করে মৃত ভেবে তাঁকে ফেলে রেখে যায়। গভীর রাতে গ্রামের মসজিদের ইমাম ওই বাংকারের কাছে এসে অস্ফুট আওয়াজ শুনে উঁকি দিয়ে তাঁকে দেখতে পান। তিনি হাবিবকে উদ্ধার করে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে আসেন।’
হাবিবুর রহমান চাকরি করতেন ইপিআরে (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, পরে বিডিআর, এখন বিজিবি)। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন দিনাজপুর ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টারে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। ছাতক, গোয়াইনঘাটসহ আরও কয়েকটি অপারেশনে তিনি অংশ নেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য হাবিবুর রহমানকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী, তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ৩৩।
হাবিবুর রহমানের পৈতৃক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সদর উপজেলার মজলিশপুর ইউনিয়নের মৈন্দ গ্রামে। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে বর্তমানে তিনি এখানেই বসবাস করছেন। তাঁর বাবার নাম মো. আজিজুর রহমান। মা আমেনা খাতুন। স্ত্রী মেহেরুন্নেছা। তাঁদের তিন ছেলে ও চার মেয়ে।
হাবিবুর রহমান বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা দেশে স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে, তারা দেশের শত্রু। এসব দুষ্ট লোকের বিচার হওয়া উচিত।’
সূত্র: হাবিবুর রহমান বীর উত্তমের সাক্ষাৎকার, নিয়েছেন প্রথম আলোর সরাইল প্রতিনিধি বদর উদ্দিন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ, ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস।
গ্রন্থনা: তারা রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.