তথ্য কমিশন-এখনও ব্যর্থতার পাল্লাই ভারী by রোবায়েত ফেরদৌস
অনেকে মনে করছেন, তথ্য কমিশনের কাজে গতির অভাব রয়েছে এবং এ চিন্তা করার পেছনে যথেষ্ট যুক্তিও আছে। তথ্য কমিশন যে সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান নয়, কমিশনকে যে তার কাজের মাধ্যমে জনগণের কাছে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে হবে_ সে লক্ষ্য অর্জন থেকে তথ্য কমিশন এখনও অনেক দূরে অবস্থান করছে; এর মূল কারণ তথ্য কমিশনের আমলানির্ভরতা
পৃথিবীর প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই পাহাড় প্রমাণ গোপনীয়তার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে
_জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ, উইকিলিকস্
'আমলাতন্ত্রকে কুটি কুটি করি ছেঁড়া ন্যাকড়ার মতো'
_ মায়াকোভস্কি, রুশ কবি
এক. তথ্য অধিকার আইন : ২৯ মার্চ ২০০৯ জাতীয় সংসদে 'তথ্য অধিকার আইন ২০০৯' পাস করা হয় এবং ১ জুলাই ২০০৯ থেকে আইনটি কার্যকর হয় এবং ওই তারিখেই প্রধান তথ্য কমিশনার ও দু'জন তথ্য কমিশনারের সমন্বয়ে তথ্য কমিশন বাংলাদেশ গঠিত হয়। ৮টি অধ্যায় ও ৩৭টি ধারা সংবলিত এই আইনের উদ্দেশ্য নিছক তথ্যপ্রাপ্তির জন্য তথ্যপ্রাপ্তি নয় বা কেবল তথ্যে জনগণের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা নয় বরং এর মৌল উদ্দেশ্য জনগণের পক্ষ থেকে তথ্য অধিকার চর্চা করে সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সংস্থা এবং সরকারি-বিদেশি অর্থায়নে সৃষ্ট বা পরিচালিত বেসরকারি সংস্থার কাজের_ ক. স্বচ্ছতা আনয়ন; খ. জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা ও বৃদ্ধি করা; গ. দুর্নীতি হ্রাস করা; ঘ. সর্বোপরি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। তবে গেল দুই বছরে জনগণ যেসব তথ্যের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছে তার বেশিরভাগই তথ্য অধিকার আইনের মৌল যে উদ্দেশ্য_ তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। যেমন বিপুলসংখ্যক আবেদন পড়েছে কীভাবে বন্দুকের লাইসেন্স পাওয়া যায়, কীভাবে ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলা যায়, মহিলা ও শিশু বিষয়ক অধিদফতরে কী ধরনের নাগরিক সেবা পাওয়া যায় ইত্যাদি। যেসব তথ্য কর্তৃপক্ষ আটকে রাখতে চায় বা দিতে চায় না এবং যেসব কাজের সঙ্গে আর্থিক বিষয়াদি তথা দুর্নীতির আশঙ্কা থাকে সেসব তথ্য চাওয়ার মাধ্যমে কর্তৃপক্ষের কাজকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আওতায় আনা যায়। কিন্তু যেভাবে তথ্য চাওয়া হচ্ছে তাতে সরকারি কর্মচারীদের ওপর কাজের চাপ বাড়ছে; কিন্তু স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা তৈরি করা, দুর্নীতি হ্রাস করা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আইনটির যতটা ভূমিকা রাখার কথা ছিল ঠিক ততটা পারছে কি-না তা নিয়ে সংশয় আছে। উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান 'নিজেরা করি' জুলাই ২০১০ থেকে ভূমিহীন নারী-পুরুষদের তথ্যপ্রাপ্তির আবেদন পর্যালোচনা করে একটি রিপোর্ট উপস্থাপন করে। এতে বলা হয়েছে : স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে ১৪টি আবেদনের মধ্যে তথ্য মিলেছে ৩টির; সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বিষয়ক ৩১টি আবেদনের মধ্যে তথ্য মিলেছে ১০টির; স্থানীয় সমবায় সংক্রান্ত ৩টি আবেদনের ক্ষেত্রে কোনো তথ্যই নির্ধারিত সময়ে পাওয়া যায়নি; খাসজমি ও জলা সংক্রান্ত ২৫টি আবেদনের মধ্যে ৫টির তথ্য মিলেছে। তাদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, যেসব তথ্যের ক্ষেত্রে আর্থিক বিষয়, অনিয়ম, দুর্নীতির সংশেল্গষ থাকার আশঙ্কা থাকে সেসবের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তৃণমূল মানুষরা তথ্য পায়নি। আরও বিস্ময়কর যে, গেল দুই বছরে ৬৪ জেলার মধ্যে ২৯ জেলা থেকে তথ্য অধিকার আইনের অধীনে ফরম পূরণ করে তথ্যপ্রাপ্তির জন্য একটি আবেদনও পড়েনি! এই হচ্ছে তৃণমূল পর্যায়ে তথ্য অধিকার আইনের বাস্তবায়ন চিত্র।
দুই. আমলাপ্রধান তথ্য কমিশন : অনেকে মনে করছেন, তথ্য কমিশনের কাজে গতির অভাব রয়েছে এবং এ চিন্তা করার পেছনে যথেষ্ট যুক্তিও আছে। তথ্য কমিশন যে সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান নয়, কমিশনকে যে তার কাজের মাধ্যমে জনগণের কাছে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে হবে_ সে লক্ষ্য অর্জন থেকে তথ্য কমিশন এখনও অনেক দূরে অবস্থান করছে; এর মূল কারণ তথ্য কমিশনের আমলানির্ভরতা। দুঃখজনক যে, তথ্য কমিশনের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যই সাবেক আমলা। আমলারা গোপনীয়তার সংস্কৃতির মধ্যে থেকে কাজ করে অভ্যস্ত। আমলাদের পক্ষে ব্রিটিশের 'ঔপনিবেশিক' আর পাক সামরিক শাসনের 'বদ্ধ/আটকে রাখা'র সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে তথ্যমুক্তির বিষয়টিকে খোলা হাওয়ায় খোলা বাস্তবতায় চিন্তা করা কঠিন। গেল প্রায় দুইশ' বছর ধরে আমলারা জনগণের কাছ থেকে তথ্য লুকিয়ে রাখার সংস্কৃতিচর্চা করে গেছে, ঐতিহাসিকভাবেই আমলারা সবসময় জনগণ আর জনগণের স্বার্থ থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে বিপদমুক্ত দূরত্ব বজায় রেখে কাজ করেছে। সেই আমলাদেরই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জনগণের কাছে অবাধে তথ্য সরবরাহের বিষয়টি বাস্তবায়ন করার; যারা জনগণ এ যাবৎকাল থেকে তথ্য আটকে রাখতেন তাদের দিয়ে কী করে জনগণের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার বাস্তবায়িত হবে তা বোধগম্য নয়। সরকারের আরও অনেক রকমের কমিশন আছে, সেখানে আমলা থাকলে সমস্যা নেই, কিন্তু তথ্য অধিকার বাস্তবায়নের জন্য কমিশনে কোনো অবস্থাতেই কোনো আমলা থাকা ঠিক হবে না; এটি তথ্য কমিশনের ওপর জনগণের আস্থা তৈরিতে বাধা হিসেবে কাজ করবে এবং জনগণের সঙ্গে তথ্য কমিশনের স্বতঃস্ফূর্ত সম্পর্ক তৈরিতে অন্তরায় হয়ে দেখা দেবে। তথ্য কমিশনে আমলানির্ভরতার বিষয়টি দার্শনিকভাবে, ঐতিহাসিকভাবে ও চর্চাগতভাবে স্ববিরোধী। তাই তথ্য কমিশন পুনর্গঠনের সময় কমিশনে মুক্তচিন্তা ও অবাধ তথ্যপ্রবাহের চর্চায় অভ্যস্ত মানুষ যেমন সাংবাদিক, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, কিংবা সাংবাদিকতা, তথ্যবিজ্ঞান, আইনজ্ঞদের যুক্ত করা দরকার।
তিন. তথ্য অধিকার বাস্তবায়নে কিছু সুপারিশ : আমাদের প্রতীতি, তথ্য অধিকার আইন নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী আইন। রাষ্ট্রে তথ্য অধিকার আইন ব্যবহারের সম্ভাবনা অসীম; এ আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করা গেলে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার কাজে স্বচ্ছতা আনয়ন, জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি হ্রাস ও সর্বোপরি রাষ্ট্রের সর্বত্র সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব নয়। এ জন্য তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নের চিহ্নিত সীমাবদ্ধতাগুলো কাটিয়ে উঠতে হবে এবং এ লক্ষ্যে আগামীতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কর্মতৎপরতা চালিয়ে যেতে হবে। যেমন_ তৃণমূল পর্যায়ে সাধারণ-গরিব-প্রান্তিক মানুষের কাছে আইনটি সহজ করে তুলে ধরতে হবে। তথ্য জানা যে মানবিক ও নাগরিক অধিকার জনগণকে সে বিষয়ে অধিকতর সচেতন করার লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে তৃণমূল পর্যায়ে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিতে হবে এবং এর সৃজনশীল প্রচার নিশ্চিত করতে হবে। আইনটির মূল উদ্দেশ্য যে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং এর মাধ্যমে দুর্নীতি দূর করা তা তুলে ধরতে হবে। তথ্য কমিশনের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য আমলা। আমলারা ঐতিহাসিকভাবে বদ্ধ আর গোপনীয় সংস্কৃতিতে কাজ করেন। তাই তথ্য কমিশন পুনর্গঠনের সময় কমিশনে সাংবাদিক, গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ কিংবা সাংবাদিকতা, তথ্যবিজ্ঞান, আইন বা গণযোগাযোগ বিশেষজ্ঞদের যুক্ত করা দরকার। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যর্থতা, অস্পষ্টতা বা দুর্নীতির খবর প্রকাশ হলে ইমেজ সংকটে পড়বে এ রকম ধারণা কাজ করে, এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে; বরং সংশোধন করে ভালো ইমেজ নির্মাণে তথ্য অধিকার আইন যে অনুঘটকের ভূমিকা রাখতে পারে এ বোধটি তৈরি করতে হবে। আইন বাস্তবায়নের বিষয়টিতে তদারকি আরও জোরদার করা দরকার। মনে রাখতে হবে তথ্য জনগণের স্বত্ব, সরকারের নয়; প্রাচীন ও প্রচল ধারণা হচ্ছে, প্রকাশ করার মতো যুক্তি না থাকলে সবকিছুই গোপনীয়। আসলে পরিবর্তিত ধারণা হওয়া উচিত সব তথ্যই প্রকাশের উপযুক্ত, যদি প্রকাশ না করার মতো কোনো যৌক্তিক কারণ থাকে। স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে তথ্য প্রদানের মানসিকতা সৃষ্টি করা। সব স্তরে তথ্য প্রকাশের সংস্কৃতি নির্মাণ করতে হবে। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো 'ম্যাক্সিমাম ডিসক্লোসার'-এর নীতি গ্রহণ করে সময় সময় তথ্য প্রদান করবে। গোপনীয়তার সংজ্ঞা পাল্টে ফেলতে হবে; ইন্টারনেট আর তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে ঔপনিবেশিক আর সামরিক শাসনের বদ্ধ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে খোলা হাওয়ায় খোলা বাস্তবতায় চিন্তা করতে হবে। বাকি বিশ্বে মুক্তচিন্তার যে বাতাস বইছে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করতে হবে। তথ্য কমিশনের কাজে আরও গতির সঞ্চার করতে হবে। সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান নয়, কমিশনকে তার কাজের মাধ্যমে জনগণের কাছে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে হবে।
রোবায়েত ফেরদৌস : সহযোগী অধ্যাপক গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় robaet.ferdous@yahoo.com
_জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ, উইকিলিকস্
'আমলাতন্ত্রকে কুটি কুটি করি ছেঁড়া ন্যাকড়ার মতো'
_ মায়াকোভস্কি, রুশ কবি
এক. তথ্য অধিকার আইন : ২৯ মার্চ ২০০৯ জাতীয় সংসদে 'তথ্য অধিকার আইন ২০০৯' পাস করা হয় এবং ১ জুলাই ২০০৯ থেকে আইনটি কার্যকর হয় এবং ওই তারিখেই প্রধান তথ্য কমিশনার ও দু'জন তথ্য কমিশনারের সমন্বয়ে তথ্য কমিশন বাংলাদেশ গঠিত হয়। ৮টি অধ্যায় ও ৩৭টি ধারা সংবলিত এই আইনের উদ্দেশ্য নিছক তথ্যপ্রাপ্তির জন্য তথ্যপ্রাপ্তি নয় বা কেবল তথ্যে জনগণের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা নয় বরং এর মৌল উদ্দেশ্য জনগণের পক্ষ থেকে তথ্য অধিকার চর্চা করে সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সংস্থা এবং সরকারি-বিদেশি অর্থায়নে সৃষ্ট বা পরিচালিত বেসরকারি সংস্থার কাজের_ ক. স্বচ্ছতা আনয়ন; খ. জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা ও বৃদ্ধি করা; গ. দুর্নীতি হ্রাস করা; ঘ. সর্বোপরি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। তবে গেল দুই বছরে জনগণ যেসব তথ্যের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছে তার বেশিরভাগই তথ্য অধিকার আইনের মৌল যে উদ্দেশ্য_ তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। যেমন বিপুলসংখ্যক আবেদন পড়েছে কীভাবে বন্দুকের লাইসেন্স পাওয়া যায়, কীভাবে ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলা যায়, মহিলা ও শিশু বিষয়ক অধিদফতরে কী ধরনের নাগরিক সেবা পাওয়া যায় ইত্যাদি। যেসব তথ্য কর্তৃপক্ষ আটকে রাখতে চায় বা দিতে চায় না এবং যেসব কাজের সঙ্গে আর্থিক বিষয়াদি তথা দুর্নীতির আশঙ্কা থাকে সেসব তথ্য চাওয়ার মাধ্যমে কর্তৃপক্ষের কাজকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আওতায় আনা যায়। কিন্তু যেভাবে তথ্য চাওয়া হচ্ছে তাতে সরকারি কর্মচারীদের ওপর কাজের চাপ বাড়ছে; কিন্তু স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা তৈরি করা, দুর্নীতি হ্রাস করা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আইনটির যতটা ভূমিকা রাখার কথা ছিল ঠিক ততটা পারছে কি-না তা নিয়ে সংশয় আছে। উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান 'নিজেরা করি' জুলাই ২০১০ থেকে ভূমিহীন নারী-পুরুষদের তথ্যপ্রাপ্তির আবেদন পর্যালোচনা করে একটি রিপোর্ট উপস্থাপন করে। এতে বলা হয়েছে : স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে ১৪টি আবেদনের মধ্যে তথ্য মিলেছে ৩টির; সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বিষয়ক ৩১টি আবেদনের মধ্যে তথ্য মিলেছে ১০টির; স্থানীয় সমবায় সংক্রান্ত ৩টি আবেদনের ক্ষেত্রে কোনো তথ্যই নির্ধারিত সময়ে পাওয়া যায়নি; খাসজমি ও জলা সংক্রান্ত ২৫টি আবেদনের মধ্যে ৫টির তথ্য মিলেছে। তাদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, যেসব তথ্যের ক্ষেত্রে আর্থিক বিষয়, অনিয়ম, দুর্নীতির সংশেল্গষ থাকার আশঙ্কা থাকে সেসবের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তৃণমূল মানুষরা তথ্য পায়নি। আরও বিস্ময়কর যে, গেল দুই বছরে ৬৪ জেলার মধ্যে ২৯ জেলা থেকে তথ্য অধিকার আইনের অধীনে ফরম পূরণ করে তথ্যপ্রাপ্তির জন্য একটি আবেদনও পড়েনি! এই হচ্ছে তৃণমূল পর্যায়ে তথ্য অধিকার আইনের বাস্তবায়ন চিত্র।
দুই. আমলাপ্রধান তথ্য কমিশন : অনেকে মনে করছেন, তথ্য কমিশনের কাজে গতির অভাব রয়েছে এবং এ চিন্তা করার পেছনে যথেষ্ট যুক্তিও আছে। তথ্য কমিশন যে সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান নয়, কমিশনকে যে তার কাজের মাধ্যমে জনগণের কাছে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে হবে_ সে লক্ষ্য অর্জন থেকে তথ্য কমিশন এখনও অনেক দূরে অবস্থান করছে; এর মূল কারণ তথ্য কমিশনের আমলানির্ভরতা। দুঃখজনক যে, তথ্য কমিশনের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যই সাবেক আমলা। আমলারা গোপনীয়তার সংস্কৃতির মধ্যে থেকে কাজ করে অভ্যস্ত। আমলাদের পক্ষে ব্রিটিশের 'ঔপনিবেশিক' আর পাক সামরিক শাসনের 'বদ্ধ/আটকে রাখা'র সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে তথ্যমুক্তির বিষয়টিকে খোলা হাওয়ায় খোলা বাস্তবতায় চিন্তা করা কঠিন। গেল প্রায় দুইশ' বছর ধরে আমলারা জনগণের কাছ থেকে তথ্য লুকিয়ে রাখার সংস্কৃতিচর্চা করে গেছে, ঐতিহাসিকভাবেই আমলারা সবসময় জনগণ আর জনগণের স্বার্থ থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে বিপদমুক্ত দূরত্ব বজায় রেখে কাজ করেছে। সেই আমলাদেরই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জনগণের কাছে অবাধে তথ্য সরবরাহের বিষয়টি বাস্তবায়ন করার; যারা জনগণ এ যাবৎকাল থেকে তথ্য আটকে রাখতেন তাদের দিয়ে কী করে জনগণের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার বাস্তবায়িত হবে তা বোধগম্য নয়। সরকারের আরও অনেক রকমের কমিশন আছে, সেখানে আমলা থাকলে সমস্যা নেই, কিন্তু তথ্য অধিকার বাস্তবায়নের জন্য কমিশনে কোনো অবস্থাতেই কোনো আমলা থাকা ঠিক হবে না; এটি তথ্য কমিশনের ওপর জনগণের আস্থা তৈরিতে বাধা হিসেবে কাজ করবে এবং জনগণের সঙ্গে তথ্য কমিশনের স্বতঃস্ফূর্ত সম্পর্ক তৈরিতে অন্তরায় হয়ে দেখা দেবে। তথ্য কমিশনে আমলানির্ভরতার বিষয়টি দার্শনিকভাবে, ঐতিহাসিকভাবে ও চর্চাগতভাবে স্ববিরোধী। তাই তথ্য কমিশন পুনর্গঠনের সময় কমিশনে মুক্তচিন্তা ও অবাধ তথ্যপ্রবাহের চর্চায় অভ্যস্ত মানুষ যেমন সাংবাদিক, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, কিংবা সাংবাদিকতা, তথ্যবিজ্ঞান, আইনজ্ঞদের যুক্ত করা দরকার।
তিন. তথ্য অধিকার বাস্তবায়নে কিছু সুপারিশ : আমাদের প্রতীতি, তথ্য অধিকার আইন নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী আইন। রাষ্ট্রে তথ্য অধিকার আইন ব্যবহারের সম্ভাবনা অসীম; এ আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করা গেলে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার কাজে স্বচ্ছতা আনয়ন, জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি হ্রাস ও সর্বোপরি রাষ্ট্রের সর্বত্র সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব নয়। এ জন্য তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নের চিহ্নিত সীমাবদ্ধতাগুলো কাটিয়ে উঠতে হবে এবং এ লক্ষ্যে আগামীতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কর্মতৎপরতা চালিয়ে যেতে হবে। যেমন_ তৃণমূল পর্যায়ে সাধারণ-গরিব-প্রান্তিক মানুষের কাছে আইনটি সহজ করে তুলে ধরতে হবে। তথ্য জানা যে মানবিক ও নাগরিক অধিকার জনগণকে সে বিষয়ে অধিকতর সচেতন করার লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে তৃণমূল পর্যায়ে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিতে হবে এবং এর সৃজনশীল প্রচার নিশ্চিত করতে হবে। আইনটির মূল উদ্দেশ্য যে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং এর মাধ্যমে দুর্নীতি দূর করা তা তুলে ধরতে হবে। তথ্য কমিশনের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য আমলা। আমলারা ঐতিহাসিকভাবে বদ্ধ আর গোপনীয় সংস্কৃতিতে কাজ করেন। তাই তথ্য কমিশন পুনর্গঠনের সময় কমিশনে সাংবাদিক, গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ কিংবা সাংবাদিকতা, তথ্যবিজ্ঞান, আইন বা গণযোগাযোগ বিশেষজ্ঞদের যুক্ত করা দরকার। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যর্থতা, অস্পষ্টতা বা দুর্নীতির খবর প্রকাশ হলে ইমেজ সংকটে পড়বে এ রকম ধারণা কাজ করে, এ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে; বরং সংশোধন করে ভালো ইমেজ নির্মাণে তথ্য অধিকার আইন যে অনুঘটকের ভূমিকা রাখতে পারে এ বোধটি তৈরি করতে হবে। আইন বাস্তবায়নের বিষয়টিতে তদারকি আরও জোরদার করা দরকার। মনে রাখতে হবে তথ্য জনগণের স্বত্ব, সরকারের নয়; প্রাচীন ও প্রচল ধারণা হচ্ছে, প্রকাশ করার মতো যুক্তি না থাকলে সবকিছুই গোপনীয়। আসলে পরিবর্তিত ধারণা হওয়া উচিত সব তথ্যই প্রকাশের উপযুক্ত, যদি প্রকাশ না করার মতো কোনো যৌক্তিক কারণ থাকে। স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে তথ্য প্রদানের মানসিকতা সৃষ্টি করা। সব স্তরে তথ্য প্রকাশের সংস্কৃতি নির্মাণ করতে হবে। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো 'ম্যাক্সিমাম ডিসক্লোসার'-এর নীতি গ্রহণ করে সময় সময় তথ্য প্রদান করবে। গোপনীয়তার সংজ্ঞা পাল্টে ফেলতে হবে; ইন্টারনেট আর তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে ঔপনিবেশিক আর সামরিক শাসনের বদ্ধ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে খোলা হাওয়ায় খোলা বাস্তবতায় চিন্তা করতে হবে। বাকি বিশ্বে মুক্তচিন্তার যে বাতাস বইছে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করতে হবে। তথ্য কমিশনের কাজে আরও গতির সঞ্চার করতে হবে। সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান নয়, কমিশনকে তার কাজের মাধ্যমে জনগণের কাছে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে হবে।
রোবায়েত ফেরদৌস : সহযোগী অধ্যাপক গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় robaet.ferdous@yahoo.com
No comments