কালের আয়নায়-নারায়ণগঞ্জের মেয়র নির্বাচন এবং আওয়ামী লীগের ভূমিকা by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
দেশে এখন বড় এবং গণভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক দল বলতে একটাই আছে, তা আওয়ামী লীগ। আগে তবু ডানে-বামে ন্যাপ, গণতন্ত্রী দল, সিপিবি, জাসদ ইত্যাদি ছোট-বড় 'লাইক মাইনডেড' দল ছিল। আওয়ামী লীগ থেকে এসব দলে যাওয়া-আসা করা যেত। এখন এসব দলের অধিকাংশই সাইনবোর্ডসর্বস্ব আওয়ামী লীগ নিয়ে লেখালেখিটা একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে দেখে আমার কোনো কোনো পাঠক একটু বিরক্ত হয়েছেন। ঢাকার অদূরবর্তী বাড্ডার এক শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধু প্রায়ই
আমাকে টেলিফোন করেন এবং দেশের অবস্থা নিয়ে তার মতামত আমাকে জানান। গত বৃহস্পতিবার (১৩ অক্টোবর) সকালে (লন্ডন সময়) তিনি আমাকে টেলিফোন আলাপে একটু বিরক্তিই প্রকাশ করেছেন এবং বলেছেন, 'দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ সরকার তার শুভাকাঙ্ক্ষীদের কোনো পরামর্শই শুনতে রাজি নয়। তাহলে সুদূর বিদেশে বসে কেন অযথা কালি-কলম খরচ করছেন এবং শরীরটাকে এই বয়সে টেনশনে ভোগাচ্ছেন?'
বাড্ডার এই ভদ্রলোক নিজেও আওয়ামী লীগের সমর্থক। কিন্তু দেশের বর্তমান অবস্থা দেখে হতাশ। আমিও যে সবসময় সবল আশাবাদ মনে ধরে রাখতে পারি তা নয়। তবু লিখি। শোনাউল্লা শোনে না, বকাউল্লা বকে যায়। তার একটা কারণ আছে। বাড্ডায় শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধুকে আর টেলিফোনে কারণটা বলিনি। এখন কালি-কলমে লিখছি। গল্পের উপমা দিয়ে লিখছি।
গল্পটা দেশে থাকতে আড্ডায় বসে শোনা। এক গৃহস্থ তার স্ত্রী, ছেলেমেয়ে নিয়ে একটি ভাঙা ছনের ঘরে বাস করেন। ছনের চাল বহুদিন ধরে মেরামত করা হয় না। ফলে গ্রীষ্মকালে গৃহস্থের অসুবিধা না হলেও বর্ষা মৌসুমে খুবই অসুবিধা হয়। ফুটো ছনের চাল বেয়ে অঝোর বৃষ্টির পানি ঘরের সর্বত্র ঝরতে থাকে। গৃহস্থ-পরিবার ছাতি মাথায় দিয়ে ঘরের মধ্যে বসে থাকেন। একদিন তা দেখে তার এক সচ্ছল প্রতিবেশী, যার ভালো ঘরবাড়ি আছে, তিনি গৃহস্থকে বললেন, 'তুমি এই চালফুটো ঘরে বসবাস করছ কেন?' গৃহস্থ কাতর কণ্ঠে বললেন, 'আমার তো ঘর একটাই। সামর্থ্যের অভাবে ফুটো চাল মেরামত করতে পারি না। এই ঘর ছেড়ে আর কোথায় যাব?'
আওয়ামী লীগ নিয়ে একটু বেশি বেশি লিখি বলে আমার যেসব পাঠক বন্ধু একটু বিরক্ত, তাদের বলি, সারা জীবন যে নীতি ও আদর্শের সমর্থনে কলম চালিয়েছি, আজ যদি সেই নীতি ও আদর্শের দলটি চালফুটো ঘরের মতো হয়ে যায়, তাহলে আর কোথায় যাব? আমাদের মাথা গোঁজার মতো একটি বিকল্প ঘর তো নেই। তাই সুদূর বিদেশে বসেও আওয়ামী লীগকে নিয়েই বেশি বেশি লিখি আর মাইকেল মধুসূদনের ভাষায় নিজেকে বলি, 'মজিনু বিফল তপে, অবরেণ্যে বরি।'
দেশে এখন বড় এবং গণভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক দল বলতে একটাই আছে, তা আওয়ামী লীগ। আগে তবু ডানে-বামে ন্যাপ, গণতন্ত্রী দল, সিপিবি, জাসদ ইত্যাদি ছোট-বড় 'লাইক মাইনডেড' দল ছিল। আওয়ামী লীগ থেকে এসব দলে যাওয়া-আসা করা যেত। এখন এসব দলের অধিকাংশই সাইনবোর্ডসর্বস্ব। নেতৃত্বের দলাদলিতে বহুধা বিভক্ত। তারা নীতি ও আদর্শের কথা বলেন। কিন্তু তা বাস্তবায়নের পথে এক পা এগোবার ক্ষমতা তাদের নেই। আওয়ামী লীগও নীতি ও আদর্শের কথা বলে, কিন্তু তাদের যাত্রা সেই নীতি ও আদর্শের উল্টোপথে। তাদের ঘর অটুট আছে। কিন্তু সেই ঘরের চাল ফুটো হয়ে যাচ্ছে।
সে কথা কেউ বলতে গেলে তারা হন বেজার। আর না বললে দেশের মানুষের প্রতি করা হয় অবিচার। ভালো হোক আর মন্দ হোক, আওয়ামী লীগ যদি না থাকে, তাহলে বিএনপি দেশটাকে '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাতারাতি যে তালেবানিস্তানে পরিণত করবে, দেশের সচেতন মানুষের তাতে সন্দেহ নেই। সুতরাং চাল যতই ফুটো হোক, আওয়ামী লীগের ঘরে ছাতি মাথায় বসে থাকা ছাড়া আমাদের মতো মানুষের আর উপায় কী?
আওয়ামী লীগের এখন সাংগঠনিকভাবে যে নাজুক অবস্থা, তা নারায়ণগঞ্জের মেয়র নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন দানে অপারগতা ও অক্ষমতার মধ্যেই বোঝা যায়। অনুপস্থিত জমিদার দিয়ে যেমন জমিদারি চলে না, তেমনি অনুপস্থিত সেক্রেটারি জেনারেল দিয়েও একটি দল চলতে পারে না। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে দু'জন দলীয় মনোনয়ন প্রার্থীর একজনকে বসিয়ে দিয়ে অপরজনকে মনোনয়ন দিলে আওয়ামী লীগের সমর্থন ও ভোট অন্তত নির্বাচনে ভাগ হতো না। এখন ভাগাভাগির দরুন বিএনপির 'তৈমুর লঙের' রাজ্য দখল সহজ হয়ে গেলে বিস্ময়ের কিছু নেই।
নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় প্রমাণিত হলো, দলের ওপর হাইকমান্ডের কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ একেবারেই শিথিল হয়ে গেছে। তা না হলে মেয়র পদের দু'জন প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে একজনের দ্বারা দলের নির্দেশ মান্য ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রত্যাহার করিয়ে অপরজনকে মনোনয়ন দেওয়া গেল না কেন? চট্টগ্রামের সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোনয়নেও প্রায় একই ব্যাপার হয়েছে। সিটি মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী দলের মনোনয়ন লাভের আগেই নিজেকে আওয়ামী-প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেন এবং দলের হাইকমান্ড তা মেনে নিতে বাধ্য হন। চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগে এমনিতেই দলাদলি প্রচণ্ড। ফলে আওয়ামী লীগের হাইজ্যাক করা এক কমিশনারকেই বিএনপি মেয়র পদে মনোনয়ন দিয়ে চট্টগ্রামে অসম্ভবকে সম্ভব করে। অর্থাৎ এক লাখের মতো ভোটের ব্যবধানে মহিউদ্দিন চৌধুরীর সব দম্ভ ভেঙে দেয়।
ঢাকা সিটি করপোরেশনে তো আওয়ামী লীগ মেয়র পদে একজন আগাম প্রার্থী ঠিক করা দূরের কথা, নির্বাচন দিতেই সাহস করছে না। ফলে অনির্দিষ্টকাল ধরে সিটি করপোরেশন রয়ে গেছে বিএনপির নিয়ন্ত্রণে। আওয়ামী লীগের জন্য আরেকটা বিষয় আরও সর্বনাশা মনে হয় তা হলো, দলের অনেক পুরনো কর্মী ও নেতা দল ক্ষমতায় থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য, লাইসেন্স-পারমিটবাজিতে এত ব্যস্ত যে, সংগঠনের কাজে সময় দিতে পারছেন না। অন্যদিকে নতুন নেতাকর্মী তৈরি হচ্ছে না। দুর্নীতি, সন্ত্রাস প্রভৃতি অভিযোগ মাথায় নিয়ে যেসব কর্মী ও নেতা এক-এগারোর সময় পলাতক অথবা অঘোষিতভাবে দল থেকে বহিষ্কৃত অবস্থায় ছিলেন, তারা আবার এসে দলের আঙিনায় বেশ শক্ত ঠাঁই করে নিচ্ছেন। ফেনীর বেচারা জয়নাল হাজারী। তার জন্য আমার দুঃখ হয়। তার চেয়েও 'ডাকসাইটে' বলে যারা অভিযুক্ত হয়েছিল, তারা দলে বেশ সহজেই পুনর্বাসিত হচ্ছে; কিন্তু হাজারীর ভাগ্য আর ফেরেনি।
নারায়ণগঞ্জের মেয়র পদে সরাসরি প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া পরিস্থিতির কারণে আওয়ামী লীগের জন্য কঠিন কাজ হওয়ায় এই পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দলীয় মনোনয়ন প্রার্থীদের জন্য ওপেন রাখা হবে বলে মনে হয়েছিল। তাও একটা মন্দের ভালো ছিল। এখন যা খবর পাচ্ছি তাতে মনে হয়, এ ব্যাপারেও আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার প্রমাণ দেখাচ্ছেন না। বরং 'ডিভিসিভ' নীতির আশ্রয় নিয়েছেন। এই নীতি আওয়ামী লীগের জন্য আপাত সাফল্য এনে দিতে পারে। কিন্তু পরিণতি হবে খুবই ক্ষতিকর। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ভবিষ্যতে ক্রেডিবিলিটি হারাতে পারে, যা আগামী সাধারণ নির্বাচনে ছায়া ফেলার আশঙ্কা আছে।
আওয়ামী লীগের তিনজন জুনিয়র নেতা নারায়ণগঞ্জে দৌড়ে গিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থীর একজনকে সমর্থন জানিয়ে এসেছেন। ওই প্রার্থী দাবি করেছেন, এটা তার পক্ষে দলের সমর্থন। ফলে অপর প্রার্থীকে বলতে হয়েছে, এটা ওই তিন জুনিয়র নেতার ব্যক্তিগত সমর্থন, দলের সমর্থন নয়। আমার প্রশ্ন, ওই তিন জুনিয়র নেতার কয়টা মাথা আছে যে, তারা হাইকমান্ডের ইশারা ছাড়া প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থীর একজনকে সমর্থন জানাতে ছুটে যেতে পারেন? অন্যদিকে দলের সিনিয়র নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, ওই তিন জুনিয়র নেতার একজন প্রার্থীকে সমর্থন জানানো তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। এটা দলের সমর্থন নয়। অনেকে সন্দেহ করতে পারেন, সুরঞ্জিত বাবুও অদৃশ্য ইশারাতেই এই কথাটা বলেছেন। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডের যে বা যারাই এই ডাবল গেমটি খেলে থাকুন, তাদের চাতুর্যটি ঢাকা থাকছে না। সকলেই সন্দেহ করছেন, দেয়ার ইজ এ গেম, বিহাইন্ড দ্য গেম অর্থাৎ এই খেলার পেছনেও খেলা আছে।
পাকিস্তান আমলে সত্তর সালের নির্বাচনের আগের একটি ঘটনা মনে পড়ে। তখন আমি অধুনালুপ্ত দৈনিক 'পূর্বদেশের' সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করি। 'পূর্বদেশের' সম্পাদক ছিলেন মাহবুবুল হক। তার বাড়ি ছিল ফেনীতে। তিনি শ্রমিক নেতা ছিলেন। আওয়ামী লীগার ছিলেন না। আইয়ুবের আমলে পাকিস্তান জাতীয় সংসদে স্বতন্ত্র সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সত্তর সালের সংসদ নির্বাচনেও তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নেন। তার ভয় ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা নিয়ে। আওয়ামী লীগের পক্ষে তখন সর্বত্র জনজোয়ার।
আমাকে একদিন ডেকে নিয়ে তিনি বললেন, 'গাফ্ফার, তোমার তো শেখ সাহেবের সঙ্গে খুবই ভালো সম্পর্ক। তুমি আমার হয়ে তাকে একটা অনুরোধ জানাবে? ফেনীর আসনটি আমাকে একেবারে ছেড়ে দিতে বলছি না। তিনি যাকে ওই আসনে নমিনেশন দেবেন, তাকে সমর্থন দিতে নিজে যেন কোনো সভায় না যান এবং তার সমর্থনে দলকেও তেমনভাবে যেন না নামান। অন্তত ভোটারদের বুঝতে দেন, আমার প্রতিও তার সমর্থন নেই, তা নয়।'
তিনি আমার সম্পাদক। তাছাড়া তাকে মাহবুব ভাই বলে ডাকতাম। বঙ্গবন্ধুকে তার অনুরোধ জানিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু জবাব দিয়েছিলেন, 'মাহবুবুল হক তার এলাকায় জনপ্রিয় তা আমি জানি। তবু বাংলার স্বাধিকার ইস্যুতে যে নির্বাচন তাতে আমার প্রার্থী হেরে গেলেও ক্ষতি নেই, কিন্তু আমি ডাবল গেম খেলতে পারব না। আমার রাজনীতি নীতির রাজনীতি। চালাকির রাজনীতি নয়।'
আমার ভয় হয়, বর্তমান আওয়ামী লীগের রাজনীতি যতটা নীতি ও আদর্শভিত্তিক, তার চেয়ে অনেক বেশি আপস ও চালাকিভিত্তিক। আবার বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে এই চালাকির খেলায় আওয়ামী লীগের পারদর্শিতা অনেক কম। বিএনপি ও জামায়াত তাদের অর্থবল, প্রচারণা ও চালাকির দ্বারা রাতকে দিন বলে প্রমাণ করতে পারে, আওয়ামী লীগ তা পারে না। বরং চালাকি করতে গেলে সঙ্গে সঙ্গে ধরা পড়ে।
নারায়ণগঞ্জের মেয়র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আগামী ৩০ অক্টোবর। হাতে সময় আছে মাত্র পনের দিন। এই অল্প সময়ের মধ্যেই যদি দলটি তার বর্তমান ভূমিকা সংশোধন করে জনগণের পছন্দের ও ইচ্ছার প্রার্থীকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন জানাতে না পারে, তাহলে এই নির্বাচনে যিনিই নির্বাচিত হোন, তাতে আওয়ামী লীগ আরও ক্রেডিবিলিটি হারাবে এবং তার প্রতিক্রিয়া বর্তাবে আগামী সাধারণ নির্বাচনে। আর আগামী নির্বাচন যদি যথাসময় ও বিনাবাধায় অনুষ্ঠিত হয় এবং আওয়ামী লীগের তাতে বিপর্যয় ঘটে, তাহলে দেশ, জাতি এবং গণতন্ত্রের জন্য সেই বিপর্যয় বিরাট সর্বনাশ ডেকে আনবে। আওয়ামী লীগকে নিয়ে তাই বারবার লিখতে হয়। কারণ, এই দলটির বাঁচামরার ওপর দেশটির বাঁচামরা নির্ভর করে।
লন্ডন, ১৪ অক্টোবর ২০১১, শুক্রবার
বাড্ডার এই ভদ্রলোক নিজেও আওয়ামী লীগের সমর্থক। কিন্তু দেশের বর্তমান অবস্থা দেখে হতাশ। আমিও যে সবসময় সবল আশাবাদ মনে ধরে রাখতে পারি তা নয়। তবু লিখি। শোনাউল্লা শোনে না, বকাউল্লা বকে যায়। তার একটা কারণ আছে। বাড্ডায় শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধুকে আর টেলিফোনে কারণটা বলিনি। এখন কালি-কলমে লিখছি। গল্পের উপমা দিয়ে লিখছি।
গল্পটা দেশে থাকতে আড্ডায় বসে শোনা। এক গৃহস্থ তার স্ত্রী, ছেলেমেয়ে নিয়ে একটি ভাঙা ছনের ঘরে বাস করেন। ছনের চাল বহুদিন ধরে মেরামত করা হয় না। ফলে গ্রীষ্মকালে গৃহস্থের অসুবিধা না হলেও বর্ষা মৌসুমে খুবই অসুবিধা হয়। ফুটো ছনের চাল বেয়ে অঝোর বৃষ্টির পানি ঘরের সর্বত্র ঝরতে থাকে। গৃহস্থ-পরিবার ছাতি মাথায় দিয়ে ঘরের মধ্যে বসে থাকেন। একদিন তা দেখে তার এক সচ্ছল প্রতিবেশী, যার ভালো ঘরবাড়ি আছে, তিনি গৃহস্থকে বললেন, 'তুমি এই চালফুটো ঘরে বসবাস করছ কেন?' গৃহস্থ কাতর কণ্ঠে বললেন, 'আমার তো ঘর একটাই। সামর্থ্যের অভাবে ফুটো চাল মেরামত করতে পারি না। এই ঘর ছেড়ে আর কোথায় যাব?'
আওয়ামী লীগ নিয়ে একটু বেশি বেশি লিখি বলে আমার যেসব পাঠক বন্ধু একটু বিরক্ত, তাদের বলি, সারা জীবন যে নীতি ও আদর্শের সমর্থনে কলম চালিয়েছি, আজ যদি সেই নীতি ও আদর্শের দলটি চালফুটো ঘরের মতো হয়ে যায়, তাহলে আর কোথায় যাব? আমাদের মাথা গোঁজার মতো একটি বিকল্প ঘর তো নেই। তাই সুদূর বিদেশে বসেও আওয়ামী লীগকে নিয়েই বেশি বেশি লিখি আর মাইকেল মধুসূদনের ভাষায় নিজেকে বলি, 'মজিনু বিফল তপে, অবরেণ্যে বরি।'
দেশে এখন বড় এবং গণভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক দল বলতে একটাই আছে, তা আওয়ামী লীগ। আগে তবু ডানে-বামে ন্যাপ, গণতন্ত্রী দল, সিপিবি, জাসদ ইত্যাদি ছোট-বড় 'লাইক মাইনডেড' দল ছিল। আওয়ামী লীগ থেকে এসব দলে যাওয়া-আসা করা যেত। এখন এসব দলের অধিকাংশই সাইনবোর্ডসর্বস্ব। নেতৃত্বের দলাদলিতে বহুধা বিভক্ত। তারা নীতি ও আদর্শের কথা বলেন। কিন্তু তা বাস্তবায়নের পথে এক পা এগোবার ক্ষমতা তাদের নেই। আওয়ামী লীগও নীতি ও আদর্শের কথা বলে, কিন্তু তাদের যাত্রা সেই নীতি ও আদর্শের উল্টোপথে। তাদের ঘর অটুট আছে। কিন্তু সেই ঘরের চাল ফুটো হয়ে যাচ্ছে।
সে কথা কেউ বলতে গেলে তারা হন বেজার। আর না বললে দেশের মানুষের প্রতি করা হয় অবিচার। ভালো হোক আর মন্দ হোক, আওয়ামী লীগ যদি না থাকে, তাহলে বিএনপি দেশটাকে '৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাতারাতি যে তালেবানিস্তানে পরিণত করবে, দেশের সচেতন মানুষের তাতে সন্দেহ নেই। সুতরাং চাল যতই ফুটো হোক, আওয়ামী লীগের ঘরে ছাতি মাথায় বসে থাকা ছাড়া আমাদের মতো মানুষের আর উপায় কী?
আওয়ামী লীগের এখন সাংগঠনিকভাবে যে নাজুক অবস্থা, তা নারায়ণগঞ্জের মেয়র নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন দানে অপারগতা ও অক্ষমতার মধ্যেই বোঝা যায়। অনুপস্থিত জমিদার দিয়ে যেমন জমিদারি চলে না, তেমনি অনুপস্থিত সেক্রেটারি জেনারেল দিয়েও একটি দল চলতে পারে না। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে দু'জন দলীয় মনোনয়ন প্রার্থীর একজনকে বসিয়ে দিয়ে অপরজনকে মনোনয়ন দিলে আওয়ামী লীগের সমর্থন ও ভোট অন্তত নির্বাচনে ভাগ হতো না। এখন ভাগাভাগির দরুন বিএনপির 'তৈমুর লঙের' রাজ্য দখল সহজ হয়ে গেলে বিস্ময়ের কিছু নেই।
নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় প্রমাণিত হলো, দলের ওপর হাইকমান্ডের কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ একেবারেই শিথিল হয়ে গেছে। তা না হলে মেয়র পদের দু'জন প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে একজনের দ্বারা দলের নির্দেশ মান্য ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রত্যাহার করিয়ে অপরজনকে মনোনয়ন দেওয়া গেল না কেন? চট্টগ্রামের সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোনয়নেও প্রায় একই ব্যাপার হয়েছে। সিটি মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী দলের মনোনয়ন লাভের আগেই নিজেকে আওয়ামী-প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেন এবং দলের হাইকমান্ড তা মেনে নিতে বাধ্য হন। চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগে এমনিতেই দলাদলি প্রচণ্ড। ফলে আওয়ামী লীগের হাইজ্যাক করা এক কমিশনারকেই বিএনপি মেয়র পদে মনোনয়ন দিয়ে চট্টগ্রামে অসম্ভবকে সম্ভব করে। অর্থাৎ এক লাখের মতো ভোটের ব্যবধানে মহিউদ্দিন চৌধুরীর সব দম্ভ ভেঙে দেয়।
ঢাকা সিটি করপোরেশনে তো আওয়ামী লীগ মেয়র পদে একজন আগাম প্রার্থী ঠিক করা দূরের কথা, নির্বাচন দিতেই সাহস করছে না। ফলে অনির্দিষ্টকাল ধরে সিটি করপোরেশন রয়ে গেছে বিএনপির নিয়ন্ত্রণে। আওয়ামী লীগের জন্য আরেকটা বিষয় আরও সর্বনাশা মনে হয় তা হলো, দলের অনেক পুরনো কর্মী ও নেতা দল ক্ষমতায় থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য, লাইসেন্স-পারমিটবাজিতে এত ব্যস্ত যে, সংগঠনের কাজে সময় দিতে পারছেন না। অন্যদিকে নতুন নেতাকর্মী তৈরি হচ্ছে না। দুর্নীতি, সন্ত্রাস প্রভৃতি অভিযোগ মাথায় নিয়ে যেসব কর্মী ও নেতা এক-এগারোর সময় পলাতক অথবা অঘোষিতভাবে দল থেকে বহিষ্কৃত অবস্থায় ছিলেন, তারা আবার এসে দলের আঙিনায় বেশ শক্ত ঠাঁই করে নিচ্ছেন। ফেনীর বেচারা জয়নাল হাজারী। তার জন্য আমার দুঃখ হয়। তার চেয়েও 'ডাকসাইটে' বলে যারা অভিযুক্ত হয়েছিল, তারা দলে বেশ সহজেই পুনর্বাসিত হচ্ছে; কিন্তু হাজারীর ভাগ্য আর ফেরেনি।
নারায়ণগঞ্জের মেয়র পদে সরাসরি প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া পরিস্থিতির কারণে আওয়ামী লীগের জন্য কঠিন কাজ হওয়ায় এই পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দলীয় মনোনয়ন প্রার্থীদের জন্য ওপেন রাখা হবে বলে মনে হয়েছিল। তাও একটা মন্দের ভালো ছিল। এখন যা খবর পাচ্ছি তাতে মনে হয়, এ ব্যাপারেও আওয়ামী লীগ হাইকমান্ড সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার প্রমাণ দেখাচ্ছেন না। বরং 'ডিভিসিভ' নীতির আশ্রয় নিয়েছেন। এই নীতি আওয়ামী লীগের জন্য আপাত সাফল্য এনে দিতে পারে। কিন্তু পরিণতি হবে খুবই ক্ষতিকর। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ভবিষ্যতে ক্রেডিবিলিটি হারাতে পারে, যা আগামী সাধারণ নির্বাচনে ছায়া ফেলার আশঙ্কা আছে।
আওয়ামী লীগের তিনজন জুনিয়র নেতা নারায়ণগঞ্জে দৌড়ে গিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থীর একজনকে সমর্থন জানিয়ে এসেছেন। ওই প্রার্থী দাবি করেছেন, এটা তার পক্ষে দলের সমর্থন। ফলে অপর প্রার্থীকে বলতে হয়েছে, এটা ওই তিন জুনিয়র নেতার ব্যক্তিগত সমর্থন, দলের সমর্থন নয়। আমার প্রশ্ন, ওই তিন জুনিয়র নেতার কয়টা মাথা আছে যে, তারা হাইকমান্ডের ইশারা ছাড়া প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থীর একজনকে সমর্থন জানাতে ছুটে যেতে পারেন? অন্যদিকে দলের সিনিয়র নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, ওই তিন জুনিয়র নেতার একজন প্রার্থীকে সমর্থন জানানো তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। এটা দলের সমর্থন নয়। অনেকে সন্দেহ করতে পারেন, সুরঞ্জিত বাবুও অদৃশ্য ইশারাতেই এই কথাটা বলেছেন। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডের যে বা যারাই এই ডাবল গেমটি খেলে থাকুন, তাদের চাতুর্যটি ঢাকা থাকছে না। সকলেই সন্দেহ করছেন, দেয়ার ইজ এ গেম, বিহাইন্ড দ্য গেম অর্থাৎ এই খেলার পেছনেও খেলা আছে।
পাকিস্তান আমলে সত্তর সালের নির্বাচনের আগের একটি ঘটনা মনে পড়ে। তখন আমি অধুনালুপ্ত দৈনিক 'পূর্বদেশের' সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করি। 'পূর্বদেশের' সম্পাদক ছিলেন মাহবুবুল হক। তার বাড়ি ছিল ফেনীতে। তিনি শ্রমিক নেতা ছিলেন। আওয়ামী লীগার ছিলেন না। আইয়ুবের আমলে পাকিস্তান জাতীয় সংসদে স্বতন্ত্র সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। সত্তর সালের সংসদ নির্বাচনেও তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নেন। তার ভয় ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা নিয়ে। আওয়ামী লীগের পক্ষে তখন সর্বত্র জনজোয়ার।
আমাকে একদিন ডেকে নিয়ে তিনি বললেন, 'গাফ্ফার, তোমার তো শেখ সাহেবের সঙ্গে খুবই ভালো সম্পর্ক। তুমি আমার হয়ে তাকে একটা অনুরোধ জানাবে? ফেনীর আসনটি আমাকে একেবারে ছেড়ে দিতে বলছি না। তিনি যাকে ওই আসনে নমিনেশন দেবেন, তাকে সমর্থন দিতে নিজে যেন কোনো সভায় না যান এবং তার সমর্থনে দলকেও তেমনভাবে যেন না নামান। অন্তত ভোটারদের বুঝতে দেন, আমার প্রতিও তার সমর্থন নেই, তা নয়।'
তিনি আমার সম্পাদক। তাছাড়া তাকে মাহবুব ভাই বলে ডাকতাম। বঙ্গবন্ধুকে তার অনুরোধ জানিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু জবাব দিয়েছিলেন, 'মাহবুবুল হক তার এলাকায় জনপ্রিয় তা আমি জানি। তবু বাংলার স্বাধিকার ইস্যুতে যে নির্বাচন তাতে আমার প্রার্থী হেরে গেলেও ক্ষতি নেই, কিন্তু আমি ডাবল গেম খেলতে পারব না। আমার রাজনীতি নীতির রাজনীতি। চালাকির রাজনীতি নয়।'
আমার ভয় হয়, বর্তমান আওয়ামী লীগের রাজনীতি যতটা নীতি ও আদর্শভিত্তিক, তার চেয়ে অনেক বেশি আপস ও চালাকিভিত্তিক। আবার বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে এই চালাকির খেলায় আওয়ামী লীগের পারদর্শিতা অনেক কম। বিএনপি ও জামায়াত তাদের অর্থবল, প্রচারণা ও চালাকির দ্বারা রাতকে দিন বলে প্রমাণ করতে পারে, আওয়ামী লীগ তা পারে না। বরং চালাকি করতে গেলে সঙ্গে সঙ্গে ধরা পড়ে।
নারায়ণগঞ্জের মেয়র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আগামী ৩০ অক্টোবর। হাতে সময় আছে মাত্র পনের দিন। এই অল্প সময়ের মধ্যেই যদি দলটি তার বর্তমান ভূমিকা সংশোধন করে জনগণের পছন্দের ও ইচ্ছার প্রার্থীকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন জানাতে না পারে, তাহলে এই নির্বাচনে যিনিই নির্বাচিত হোন, তাতে আওয়ামী লীগ আরও ক্রেডিবিলিটি হারাবে এবং তার প্রতিক্রিয়া বর্তাবে আগামী সাধারণ নির্বাচনে। আর আগামী নির্বাচন যদি যথাসময় ও বিনাবাধায় অনুষ্ঠিত হয় এবং আওয়ামী লীগের তাতে বিপর্যয় ঘটে, তাহলে দেশ, জাতি এবং গণতন্ত্রের জন্য সেই বিপর্যয় বিরাট সর্বনাশ ডেকে আনবে। আওয়ামী লীগকে নিয়ে তাই বারবার লিখতে হয়। কারণ, এই দলটির বাঁচামরার ওপর দেশটির বাঁচামরা নির্ভর করে।
লন্ডন, ১৪ অক্টোবর ২০১১, শুক্রবার
No comments