উপজেলা পরিষদ-যথা পূর্বং তথা পরং! by ফয়জুর রহমান ফকির
নথি নেই, পত্র নেই, টাকা নেই, পয়সা নেই, ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার। চিঠি পাঠানো হয়েছে গালভরা ভাষায়। বার্ষিক পরিকল্পনা, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, বাজেট ইত্যাদি করতে হবে। এত সব চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানদের উন্মাতাল কথাবার্তার পর টাকার ব্যবস্থা হয়েছে বছরে ৫০-৯০ লাখ টাকা। এটার আবার কত কত বিভাজন করে উপজেলা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের গতিকে বেগবান করতে হবে। নিষ্ঠুর রসিকতা
২০০৯ সালের এপ্রিলে উপজেলা পরিষদ আইন (রহিত পুনঃপ্রচলন ও সংশোধন) জাতীয় সংসদে অনুমোদন করা হয়। আইনের তৃতীয় তফসিলে ১০টি মন্ত্রণালয়ের জনসম্পৃক্ত ১৩টি বিভাগকে উপজেলায় হস্তান্তর করা হয়। বস্তুত এটি এ দেশের প্রশাসনিক কাঠামোতে দিনবদলের জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ, যা অতীতে কখনও দৃষ্ট হয়নি। উন্নত অনেক দেশের উদাহরণ টেনে আরও কিছু মন্ত্রণালয় (স্বরাষ্ট্র, ভূমি, বন ও পরিবেশ, মাধ্যমিক শিক্ষা, অর্থের আংশিক ইত্যাদি) হস্তান্তর করা যেত; কিন্তু বিপ্লবটা অনেক বড় হয়ে যাবে। সাহসে হয়তো ঘাটতি ছিল তাই হয়নি, না হোক ভবিষ্যতে সে পথেই হাঁটতে হবে। যাত্রাটা তো শুরু করা গেল। আইনটি বাস্তবায়নের জন্য যথারীতি কিছু বিধিবিধান জারি করতে হলো। আইনের ২৪(৩) ধারা অনুসরণে মুখ্য সচিব আবদুল আজিজকে প্রধান এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব অশোক মাধব রায়কে সদস্য সচিব করে ১০ মন্ত্রণালয়ের সচিবদের সদস্য করে একটি জাতীয় কমিটি তৈরি হয়। ওই কমিটি সভা করে আইনের ৬৩ ধারা অনুযায়ী (আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে সরকার_ সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা বিধি প্রণয়ন করিতে পারিবে)
৩০-১২-২০০৯ তারিখে উপজেলায় হস্তান্তরিত বিভাগগুলোর কর্মকর্তাদের তালিকা, তাদের কার্যাবলির বিস্তৃত বিবরণসহ বিধিমালার বই উপজেলায় উপজেলায় পাঠানো হলো। সেখানে প্রতিটি বিভাগের কর্মতালিকা প্রণয়নের আগে ঘোষিত হলো_ 'তিনি উপজেলা চেয়ারম্যানের তত্ত্বাবধানে এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসের সমন্বয়ে কাজ করিবেন।' সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের বিষয়ে বলা হয়, 'উপজেলা নির্বাহী অফিসার উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানকে তাহার নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগে সহায়তা ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করিবেন' ইত্যাদি।
কষ্টসৃষ্ট বিধিমালা জারির পরও চেয়ারম্যান/ভাইস চেয়ারম্যানদ্বয় অথবা পরিষদের সঙ্গে হস্তান্তরিত বিভাগগুলোর কোনো মিলন ঘটল না। অবস্থাদৃষ্টে পাঁচ মাস পর ২৮.৪.২০১০ তারিখে স্থানীয় সরকার বিভাগ একটি পত্র পাঠাল সব হস্তান্তরিত বিভাগে। তাতে বলা হয়_ 'ইতিমধ্যে সরকারের গোচরীভূত হয়েছে যে, জারিকৃত ওই প্রজ্ঞাপন, বিধি ও অন্যান্য নির্দেশনা উপজেলা পরিষদ কর্তৃক যথাযথভাবে অনুসৃত হচ্ছে না। তা ছাড়া উপজেলা পরিষদের কার্যক্রম বাস্তবায়ন বিধিমালা-২০১০-এর বিধি-১৪ অনুযায়ী চেয়ারম্যানের অনুমোদন প্রয়োজন এমন সব কাগজপত্র ও নথি উপজেলা নির্বাহী অফিসারের মাধ্যমে চেয়ারম্যানের কাছে উপস্থাপন করতে হবে। বাস্তবে সেসব নথিপত্র চেয়ারম্যানের কাছে অনুমোদনের জন্য উপস্থাপিত হচ্ছে না, বর্ণিত অবস্থায় উপরোলি্লখিত আইন, প্রজ্ঞাপন, বিধি ও অন্যান্য নির্দেশনা যথাযথভাবে অনুসরণের লক্ষ্যে তার নিয়ন্ত্রণাধীন উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদানের জন্য অনুরোধ করা হলো।'
অতঃপর ওই পরিপত্রের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ২০১০ সালের মে মাসের মধ্যেই হস্তান্তরিত ১০টি মন্ত্রণালয় থেকে স্থানীয় সরকার বিভাগকে অনুসরণ করে নিজ নিজ বিভাগগুলোর পরিপত্র করে বলা হয়, 'স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে জারিকৃত প্রজ্ঞাপন, বিধি ও অন্যান্য নির্দেশনা অনুসরণ করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।' কিন্তু উপজেলা পরিষদ আইন বাস্তবায়নের জন্য উপজেলা পরিষদ সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি কর্তৃক প্রেরিত সব বিধিমালা এবং নিজ নিজ মন্ত্রণালয় থেকে প্রেরিত সব পরিপত্রই নিষ্ফল হলো। যথা পূর্বং তথা পরং।
শুভঙ্করের ফাঁকিটিকেও ধরা হলো, 'প্রয়োজন এমন সকল কাগজপত্র ও নথি' এও ২১-০৯-২০১০ তারিখে গেজেটেড প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এসআরও নং-৩২৩ আইন/২০১০ জারি করা হলো। ওই আইনে বলা হলো_ 'উপজেলা পরিষদ আইন ১৯৯৮ (১৯৯৮ সালের ২৪নং আইন)-এর ধারা ৬৩তে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার উপজেলা পরিষদের (কার্যক্রম বাস্তবায়ন) বিধিমালা ২০১০-এ নিম্নরূপ সংশোধন করিল যথা_ উপরোক্ত বিধিমালার বিধি-১৪-এর উপবিধি (১) এবং পরিবর্তে নিম্নরূপ উপবিধি (১) প্রতিস্থাপিত হইবে, যথা_ (১) আইনের তৃতীয় তফসিলে উলি্লখিত দপ্তরগুলোর কর্মকর্তাগণ, সরকার কর্তৃক উপজেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তরিত বিষয়ে সব কাগজপত্র ও নথি, উপজেলা নির্বাহী অফিসারের মাধ্যমে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছে অনুমোদনের জন্য পেশ করিবেন।' রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে মোঃ মনজুর হোসেন, সচিব। বিষয়টি কর্মকর্তাদের জন্য বাধ্যতামূলক করা হলো। এত কিছু আইন, বিধি, পরিপত্র, ঘটনার পরও কোনো নথি, কাগজপত্র এলো না চেয়ারম্যানের কাছে। তাহলে এও নিশ্চিত যে, প্রতিটি আইন, বিধি, পরিপত্রের সঙ্গে এক চোখ বন্ধ করে মুচকি হাসিটিও পাঠানো হয়েছিল। হিপক্র্যাসির নিকৃষ্টতম উদাহরণ তৈরি হলো। তাই প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য ওপর থেকে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ আশার অতীত রইল।
উপজেলার ভাগ্যলিপিতে শুধু লেখা হলো_ ছোটখাটো দুটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ইউএনওর সঙ্গে যৌথভাবে। তাই বাধ্যতামূলকভাবে একটি বিভাগের কিছু নথি আসে অনর্থক। আর পিআইপিও সেকশনের অনৈতিক এবং অর্থহীন টিআর এবং কাবিখার ফাইল আসে প্রতিস্বাক্ষরের জন্য। যে সেকশনটি থাকাই উচিত নয়, কারণ ওই সেকশন আছে কেবল কালি-কালিমা লেপনের জন্য। নথি নেই, পত্র নেই, টাকা নেই, পয়সা নেই, ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার। চিঠি পাঠানো হয়েছে গালভরা ভাষায়। বার্ষিক পরিকল্পনা, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, বাজেট ইত্যাদি করতে হবে। এত সব চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানদের উন্মাতাল কথাবার্তার পর টাকার ব্যবস্থা হয়েছে বছরে ৫০-৯০ লাখ টাকা। লাখ টাকা। এটার আবার কত কত বিভাজন করে উপজেলা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের গতিকে বেগবান করতে হবে। নিষ্ঠুর রসিকতা। অথচ উচ্চকণ্ঠে চিৎকার করে বলা হস্তান্তরিত ১৩টি বিভাগ ইত্যাদি। সেখানেও বছরে জাতীয় বাজেট থেকে উপজেলায় আসা ৩০ কোটি থেকে ৬০ কোটি টাকার কোনো হদিসই উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ পায় না। অপমানে অপমানে চোখ-মুখ লাল করে বসে থাকাই সার। অথচ স্বশাসিত স্থানীয় সরকার ছাড়া রাষ্ট্রের জাগরণ ও
গতি কবে, কোথায় ঘটেছে একটি উদাহরণ চাই।
ফয়জুর রহমান ফকির : চেয়ারম্যান ময়মনসিংহ সদর উপজেলা, ময়মনসিংহ
No comments