শ্রদ্ধাঞ্জলি-কমরেড শিবলী কাইয়ুম-বিপ্লবীরা ক্রমাগত পিছু হটে জীবনের সঙ্গে লড়ে যায়, চলে যায় অভিমান ঘুচিয়ে by আরিফুজ্জামান তুহিন
শিবলী ভাইয়ের সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছে মাস চারেক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক আলোচনা অনুষ্ঠানে। বিষয়বস্তু ছিল লিবিয়ায় চলমান সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ও বাংলাদেশের মানুষের লড়াইয়ের প্রেক্ষিত_এ রকম কিছু। আমিও আলোচক হিসেবে ছিলাম সেখানে। শিবলী ভাই এসেছিলেন অনেক পরে। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল ঝড়ে বিধ্বস্ত একজন মানুষ। তখনো জানি না যে শিবলী ভাই শরীরের মধ্যে ভয়ংকর এক অসুখ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বিপ্লবের লাল
ঝাণ্ডা ওড়ানোর জন্য। সেই শিবলী ভাই গত শুক্রবার ১৮ নভেম্বর মধ্যরাতে মিরপুরের ডেল্টা ক্যান্সার হাসপাতালে মারা গেছেন। তিনি অন্ত্রের ক্যান্সারে ভুগছিলেন।
মৃত্যু একটি প্রাকৃতিক অনিবার্যতা। কিন্তু তবু মৃত্যু কাম্য নয়, আর সেই মৃত্যু যদি হয় কোনো নিবেদিত বিপ্লবীর, তাহলে মেনে নেওয়ার বদলে বুকের মধ্যে 'হাওয়া ঘোরেফেরে'। অভিমানের মেঘ উড়ে যায়।
শিবলী কাইয়ুম এ সময়ের সাহসী মানুষদের একজন। নয়া গণতান্ত্রিক গণমোর্চার প্রতিষ্ঠাকালীন আহ্বায়ক ছিলেন তিনি। বিপ্লবী ছাত্র যুব আন্দোলনেরও প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে এ দেশের সর্বহারা শ্রেণীর বিপ্লবের এক সাহসী সন্তান হারাল নিপীড়িত জনগণ। স্বৈরাচার আন্দোলনের এই সাহসী ছাত্রনেতা তখন বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী করতেন। স্বৈরাচার এরশাদ ক্ষমতায় আসার পরের দিন তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর সাত বছরের জেলও দেয় করে তৎকালীন স্বৈরাচার এরশাদ। তবে আন্দোলনের চাপে তাঁকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয় শাসকগোষ্ঠী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র থাকাকালে শিবলী ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। আমরা সে সময় হাতি-ঘোড়া মারি। রাত জেগে বিপ্লবের ছক আঁকি। দলবেঁধে অপরাজেয় বাংলা থেকে জেলখানা হয়ে শাহবাগ, সারা রাত পথে হাঁটি। এ ধরনের এক অদ্ভুদ স্বপ্নবোনা সময় শিবলী ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের পরিচয়। সেই বন্ধুদের এখন অনেকেই গণমাধ্যমকর্মী, কেউবা ব্যাংকার, জজ, উকিল, ম্যাজিস্ট্রেট অথবা বহুজাতিক কম্পানির কনিষ্ঠ কেরানি। কিন্তু শিবলী ভাই তাঁর জায়গা থেকে সরে যাননি। মৃত্যুর আগেও তিনি স্বপ্ন দেখে গেছেন একটি শোষণমুক্ত সমাজের। আর আমরা ক্রমাগত বিপ্লবকে অ্যাকোয়ারিয়ামের পচা মাছ বানিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের স্যাঙ্গাত বাহিনীতে পরিণত হয়েছি।
কত দিন তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছে, বিপ্লবের পথ, সশস্ত্র বিপ্লবের সঙ্গে গণসংগ্রামের সমন্বয়_আরো কত শত বিষয়। তর্ক করেছি। আর তিনি সতর্ক, শীতল কণ্ঠে উত্তর দিয়ে গেছেন।
মাত্র তো পঞ্চাশ। এ বয়সেরও অধিক ইতিহাস নিয়ে যুদ্ধাপরাধীরা বেঁচে আছে। আর শিবলী ভাইরা আমাদের ছেড়ে চলে যান। প্রয়োজনীয় মানুষের এ প্রস্থান, আর আবজর্নার স্তূপ ক্রমে বাড়ে, তাতে প্রকৃতিরই বা কী লাভ। কী ইশারা!
শিবলী কাইয়ুম সাহসী মানুষ ছিলেন। সাহসের কি আলাদা কোনো নাম আছে? যেমনটি থাকে বৃষ্টি কিংবা ঘাসফড়িংয়ের? আমি শুধু বুঝি, জীবন দিয়ে লড়ে যাওয়া হলো সাহসের আরেকটি নাম। ২০০৭ সালে সেনাবাহিনীর সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের যে লড়াই হয়, যা পরবর্তী সময়ে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে, সে লড়াইয়ের সময় শিবলী ভাইকে পেয়েছি অকৃত্রিমভাবে। তখন আমরা পালিয়ে পালিয়ে বেড়াই। আন্দোলনরত বেশ কিছু ছাত্রনেতাকে একদিন বেইলি রোডে এক সাক্ষাতে ধমকই দিলেন। সেদিন শিবলী ভাই কোনো তত্ত্ব আওড়াননি। তিনি শুধু বলেছিলেন, বিপ্লবীরা লড়ে যায়, আর ভীতুরা প্রতিদিন মরে।
সেদিনের সে কথা যেন আজও আমাকে ঘোরের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। মনে পড়ে, শিবলী কাইয়ুম হলেন সেই মানুষ, যিনি স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলন করেছিলেন এরশাদ যেদিন ক্ষমতায় এসেছিল তার পরদিন থেকেই। এ কারণে তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রেপ্তার করে সাত বছরের জেল দেওয়া হয়।
আমাদের এত ভয় কিসের? এর পর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারও ছাত্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। জেলে আটক শিক্ষক ও ছাত্রদের আন্দোলনের কারণে ছাড়তে বাধ্য হয় সামরিক-বেসামরিক সুশীল স্বৈরাচার।
শিবলী কাইয়ুমকে রাজনৈতিকভাবে অনেকে মূল্যায়ন করবেন। আমি তাঁর প্রয়োজন দেখছি না এ মুহূর্তে। কারণ এ ভূমিতে কোনো হরিদাস পাল বিপ্লবের প্রশ্নে অনেক তত্ত্ব লিখতে পারেন, কিন্তু মাঠের লড়াইয়ে যাদের দেখা মেলে না শিবলী ভাই সেই দলে ছিলেন না। ভারত টিপাইমুখে বাঁধ দিচ্ছে, মার্কিনরা ইরাক-আফগানিস্তান আক্রমণ করছে, শিবলী তাঁর সংগঠন। নয়া গণতান্ত্রিক গণমোর্চার কমরেডদের নিয়ে সভা-সমাবেশ করেছেন। যখন রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়েছে কথিত সন্ত্রাস দমনের নামে যত্রতত্র ক্রসফায়ার, শিবলী ও তাঁর বন্ধুদের তখন দেখেছি রাজপথে। এই সাহসী মানুষটিকে আর দেখব না রাজপথে।
জানি বিপ্লব ও বিপ্লবীর মৃত্যু নেই।
মৃত্যু একটি প্রাকৃতিক অনিবার্যতা। কিন্তু তবু মৃত্যু কাম্য নয়, আর সেই মৃত্যু যদি হয় কোনো নিবেদিত বিপ্লবীর, তাহলে মেনে নেওয়ার বদলে বুকের মধ্যে 'হাওয়া ঘোরেফেরে'। অভিমানের মেঘ উড়ে যায়।
শিবলী কাইয়ুম এ সময়ের সাহসী মানুষদের একজন। নয়া গণতান্ত্রিক গণমোর্চার প্রতিষ্ঠাকালীন আহ্বায়ক ছিলেন তিনি। বিপ্লবী ছাত্র যুব আন্দোলনেরও প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে এ দেশের সর্বহারা শ্রেণীর বিপ্লবের এক সাহসী সন্তান হারাল নিপীড়িত জনগণ। স্বৈরাচার আন্দোলনের এই সাহসী ছাত্রনেতা তখন বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী করতেন। স্বৈরাচার এরশাদ ক্ষমতায় আসার পরের দিন তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর সাত বছরের জেলও দেয় করে তৎকালীন স্বৈরাচার এরশাদ। তবে আন্দোলনের চাপে তাঁকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয় শাসকগোষ্ঠী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র থাকাকালে শিবলী ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। আমরা সে সময় হাতি-ঘোড়া মারি। রাত জেগে বিপ্লবের ছক আঁকি। দলবেঁধে অপরাজেয় বাংলা থেকে জেলখানা হয়ে শাহবাগ, সারা রাত পথে হাঁটি। এ ধরনের এক অদ্ভুদ স্বপ্নবোনা সময় শিবলী ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের পরিচয়। সেই বন্ধুদের এখন অনেকেই গণমাধ্যমকর্মী, কেউবা ব্যাংকার, জজ, উকিল, ম্যাজিস্ট্রেট অথবা বহুজাতিক কম্পানির কনিষ্ঠ কেরানি। কিন্তু শিবলী ভাই তাঁর জায়গা থেকে সরে যাননি। মৃত্যুর আগেও তিনি স্বপ্ন দেখে গেছেন একটি শোষণমুক্ত সমাজের। আর আমরা ক্রমাগত বিপ্লবকে অ্যাকোয়ারিয়ামের পচা মাছ বানিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের স্যাঙ্গাত বাহিনীতে পরিণত হয়েছি।
কত দিন তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছে, বিপ্লবের পথ, সশস্ত্র বিপ্লবের সঙ্গে গণসংগ্রামের সমন্বয়_আরো কত শত বিষয়। তর্ক করেছি। আর তিনি সতর্ক, শীতল কণ্ঠে উত্তর দিয়ে গেছেন।
মাত্র তো পঞ্চাশ। এ বয়সেরও অধিক ইতিহাস নিয়ে যুদ্ধাপরাধীরা বেঁচে আছে। আর শিবলী ভাইরা আমাদের ছেড়ে চলে যান। প্রয়োজনীয় মানুষের এ প্রস্থান, আর আবজর্নার স্তূপ ক্রমে বাড়ে, তাতে প্রকৃতিরই বা কী লাভ। কী ইশারা!
শিবলী কাইয়ুম সাহসী মানুষ ছিলেন। সাহসের কি আলাদা কোনো নাম আছে? যেমনটি থাকে বৃষ্টি কিংবা ঘাসফড়িংয়ের? আমি শুধু বুঝি, জীবন দিয়ে লড়ে যাওয়া হলো সাহসের আরেকটি নাম। ২০০৭ সালে সেনাবাহিনীর সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের যে লড়াই হয়, যা পরবর্তী সময়ে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে, সে লড়াইয়ের সময় শিবলী ভাইকে পেয়েছি অকৃত্রিমভাবে। তখন আমরা পালিয়ে পালিয়ে বেড়াই। আন্দোলনরত বেশ কিছু ছাত্রনেতাকে একদিন বেইলি রোডে এক সাক্ষাতে ধমকই দিলেন। সেদিন শিবলী ভাই কোনো তত্ত্ব আওড়াননি। তিনি শুধু বলেছিলেন, বিপ্লবীরা লড়ে যায়, আর ভীতুরা প্রতিদিন মরে।
সেদিনের সে কথা যেন আজও আমাকে ঘোরের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। মনে পড়ে, শিবলী কাইয়ুম হলেন সেই মানুষ, যিনি স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলন করেছিলেন এরশাদ যেদিন ক্ষমতায় এসেছিল তার পরদিন থেকেই। এ কারণে তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রেপ্তার করে সাত বছরের জেল দেওয়া হয়।
আমাদের এত ভয় কিসের? এর পর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারও ছাত্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। জেলে আটক শিক্ষক ও ছাত্রদের আন্দোলনের কারণে ছাড়তে বাধ্য হয় সামরিক-বেসামরিক সুশীল স্বৈরাচার।
শিবলী কাইয়ুমকে রাজনৈতিকভাবে অনেকে মূল্যায়ন করবেন। আমি তাঁর প্রয়োজন দেখছি না এ মুহূর্তে। কারণ এ ভূমিতে কোনো হরিদাস পাল বিপ্লবের প্রশ্নে অনেক তত্ত্ব লিখতে পারেন, কিন্তু মাঠের লড়াইয়ে যাদের দেখা মেলে না শিবলী ভাই সেই দলে ছিলেন না। ভারত টিপাইমুখে বাঁধ দিচ্ছে, মার্কিনরা ইরাক-আফগানিস্তান আক্রমণ করছে, শিবলী তাঁর সংগঠন। নয়া গণতান্ত্রিক গণমোর্চার কমরেডদের নিয়ে সভা-সমাবেশ করেছেন। যখন রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়েছে কথিত সন্ত্রাস দমনের নামে যত্রতত্র ক্রসফায়ার, শিবলী ও তাঁর বন্ধুদের তখন দেখেছি রাজপথে। এই সাহসী মানুষটিকে আর দেখব না রাজপথে।
জানি বিপ্লব ও বিপ্লবীর মৃত্যু নেই।
No comments