জ্বালানিতে ঢালাও ভর্তুকির সুফল পায় না মানুষ by টিটু দত্ত গুপ্ত
জ্বালানিতে ঢালাও ভর্তুকির সুফল পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ। বরং বিপুল এ ভর্তুকির বোঝায় বিপর্যস্ত দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি। অর্থনীতিবিদ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কৃষিতে ভর্তুকি দিতে হবে, সামাজিক নিরাপত্তার জন্য বিনা মূল্যে খাদ্য বিতরণেও ভর্তুকি অব্যাহত থাকতে পারে। তবে জ্বালানিতে ঢালাওভাবে ভর্তুকি রাজনৈতিক বিলাসিতা। ঘরে বাতি জ্বালানোর জন্য যাদের কেরোসিন কিনতে হয়, কেবল তারাই ভর্তুকি
পাওয়ারযোগ্য। ফার্নেস অয়েলে ভর্তুকি দেওয়ার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। ডিজেলে ভর্তুকির সুফলও ভোগ করেন পরিবহন মালিকরা, জনগণের লাভ হয় না। ভর্তুকির এ টাকায় অবকাঠামো নির্মিত হলে বরং অর্থনীতি ও দেশের জনগণ প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হতো বলে তাঁদের ধারণা। ধাপে ধাপে ভর্তুকি কমিয়ে এর প্রভাব যাতে জনজীবনে সীমিত থাকে, সে ব্যাপারে সরকারকে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দেন তাঁরা।
জ্বালানির দাম কম থাকলে উৎপাদন বাড়বে, খরচ কমবে এবং স্বল্প আয়ের মানুষ স্বস্তিতে থাকবে_এ বিশ্বাসের ওপর ভর করে অনেকটা প্রথাগতভাবেই চলে আসছে জ্বালানিতে ভর্তুকি। কৃষি ও শিল্প উৎপাদনে বহুমাত্রিক বৃদ্ধির সঙ্গে জ্বালানি ভর্তুকির সম্পর্ক খোঁজেন অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকরা। কিন্তু দশকের পর দশক ধরে দেওয়া এ ভর্তুকির ফলে অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়েছে, মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় কতখানি নিয়ন্ত্রণে আছে, কৃষকসহ সাধারণ জনগোষ্ঠীর জীবনমানের কতটুকু উন্নতি হয়েছে, সবশেষে দেশের সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা কতখানি বেড়েছে_এ নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো সমীক্ষা হয়নি। প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ এ ভর্তুকির কতখানি অপচয় হয়েছে, এর কতখানি সুফল উদ্দিষ্ট মানুষের কাছে পেঁৗছেছে, এরও কোনো হিসাব নেই।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়ার আশঙ্কা করেন যেসব অর্থনীতিবিদ, তাঁরাও এখন বলছেন, জ্বালানিতে ঢালাওভাবে ভর্তুকি দেওয়ার কোনো যুক্তি নেই। রাজনৈতিক কারণেই সরকারগুলো জ্বালানি ভর্তুকি দিয়ে আসছে। এত দিন তবু সহনীয় মাত্রায় ছিল; কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ফার্নেস অয়েলে ভর্তুকি দেওয়ায় সামষ্টিক অর্থনীতির ভারসাম্যই ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।
জ্বালানি খাতে চলতি বছর ভর্তুকি বাবদ সরকারের খরচ হবে ৩৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এ বছর বিদ্যুতে সাত হাজার কোটি, জ্বালানি তেলে ২৬ হাজার কোটি এবং গ্যাসে পাঁচ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে সরকারকে। জ্বালানি ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বর্ধিত ভর্তুকি ব্যয় মেটাতে গিয়ে সরকারের ঋণ বেড়ে গেছে। বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চলতি অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার কথা ১৮ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা। কিন্তু অক্টোবর নাগাদ চার মাসেই ব্যাংক থেকে সরকারকে ধার করতে হয়েছে ১৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকা, যা বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার ৭৮ শতাংশ। সরকারের এ ঋণ নেওয়ার প্রবণতায় উদ্বিগ্ন খোদ কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত মাসেই অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সরকার অতিরিক্ত ঋণ নেওয়ায় বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ও অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তা ছাড়া তেলের আমদানিমূল্য পরিশোধ করতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) ডলারের চাহিদা বেড়ে গেছে। এর চাপ পড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও ডলারের বিনিময়মূল্যে।
মাত্র ৫২ দিনের ব্যবধানে দ্বিতীয়বারের মতো জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পরও জ্বালানি তেলের পেছনে বিপিসিকে বছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা লোকসান দিতে হবে। গত বৃহস্পতিবার রাতে জ্বালানি মন্ত্রণালয় ডিজেল, ফার্নেস অয়েল, পেট্রল, অকটেন ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি পাঁচ টাকা করে বাড়ানোর আগে এ লোকসানের পরিমাণ ১৪ হাজার কোটি টাকা ছিল বলে জানিয়েছে বিপিসি কর্তৃপক্ষ।
এ প্রসঙ্গে বিপিসির পরিচালক (অর্থ) সরাফ উদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পরও বিপিসিকে ডিজেলের ক্ষেত্রে লিটারপ্রতি সাড়ে ১৭ টাকা, কেরোসিনে সাড়ে ১৬ টাকা এবং ফার্নেস অয়েলের পেছনে সাড়ে চার টাকা লোকসান দিতে হবে। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর বিপিসির লোকসান প্রায় চার হাজার কোটি টাকা কমে আসবে। তার পরও জ্বালানি তেল বিক্রি বাবদ বিপিসির বছরে লোকসান থাকবে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা।
জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সরকার জ্বালানিভিত্তিক ভাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনকে উৎসাহিত করছে। সে জন্য চলতি বছর ২০ লাখ টন অতিরিক্ত ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল আমদানি করতে হবে বলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন জানায়। এতে তেল আমদানি ব্যয় দাঁড়াবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। একই সঙ্গে বাড়বে ভর্তুকি ব্যয়। গত বছর জ্বালানিতে ভর্তুকি দিতে হয়েছিল আট হাজার ২০০ কোটি টাকা। এ বছর তা বেড়ে দাঁড়াবে ১৮ হাজার কোটি টাকা। এতে সরকারের ঋণ বাড়বে। এ চাপ কিছুটা কমানোর জন্য দুই মাসেরও কম সময়ে বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম লিটারপ্রতি পাঁচ টাকা বাড়িয়েছে সরকার। দুই বারে ফার্নেস অয়েলে দাম বাড়ানো হয়েছে প্রতি লিটারে ১৩ টাকা। তবু বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহারের জন্য ফার্নেস অয়েলে এখনো চার টাকা ৯৭ পয়সা ভর্তুকি দিতে হবে। বিপিসির কর্মকর্তারা জানান, গত অর্থবছরে (২০১০-১১) দেশে প্রায় ৪৮ লাখ ৬৮ মেট্রিক টন জ্বালানি তেল ব্যবহৃত হয়েছে। আর এ বছর প্রায় ৬৬ লাখ ৭৫ হাজার মেট্রিক টন জ্বালানি তেল প্রয়োজন হবে। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এ বছর জ্বালানি তেলের চাহিদা বেড়েছে প্রায় ৩৭ দশমিক ১২ শতাংশ। বিপিসির কর্মকর্তারা জানান, গত অর্থবছরে (২০১০-১১) দেশে প্রায় ৪৮ লাখ ৬৮ মেট্রিক টন জ্বালানি তেল ব্যবহৃত হয়েছে। আর এ বছর প্রায় ৬৬ লাখ ৭৫ হাজার মেট্রিক টন জ্বালানি তেল প্রয়োজন হবে। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এ বছর জ্বালানি তেলের চাহিদা বেড়েছে প্রায় ৩৭ দশমিক ১২ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরে দেশে ডিজেল প্রয়োজন হবে প্রায় ৪০ লাখ মেট্রিক টন। আর ফার্নেস অয়েল লাগবে প্রায় ১৫ লাখ মেট্রিক টন। শুধু বিদ্যুৎ খাতেই ফার্নেস অয়েল প্রয়োজন হবে প্রায় ১৪ লাখ ১৫ হাজার মেট্রিক টনের বেশি। গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরে শুধু ফার্নেস অয়েলের চাহিদা বেড়েছে প্রায় ১০ লাখ টন বেশি। আর অকটেন প্রয়োজন হবে বছরে মাত্র এক লাখ আট হাজার মেট্রিক টন এবং পেট্রোল লাগবে প্রায় দেড় লাখ মেট্রিক টন। কেরোসিনের ব্যবহার ১০ লাখ টনের মতো। বিপিসির এক পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, দেশে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের ৬৫ শতাংশই ডিজেল। এখন ডিজেল আমদানির ক্ষেত্রে লিটারপ্রতি ব্যয় হয় প্রায় ৭৩ দশমিক ৬৮ টাকা, কেরোসিনের দাম পড়ে ৭২ দশমিক ৮৫ টাকা এবং ফার্নেস অয়েলের আমদানি ব্যয় পড়ে লিটারপ্রতি প্রায় ৫৯ দশমিক ৫৬ টাকা। ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ফার্নেস অয়েলের বাড়তি চাহিদার কারণেই চলতি বছর সরকারের ভর্তুকি ব্যয় বেড়েছে। জ্বালানিতে টার্গেটেড সাবসিডি বা উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে ভর্তুকি দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য ফার্নেস অয়েল ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। কিন্তু সাময়িক এ ব্যবস্থার জন্য বিপুল পরিমাণ ফার্নেস অয়েল কিনতে রিজার্ভ থেকে বাড়তি ডলার খরচ হচ্ছে। অথচ রেমিট্যান্স আয় বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ নেই। দাম বাড়িয়ে হয়তো সরকার বাড়তি কিছু টাকা সংগ্রহ করতে পারে, কিন্তু আমদানি ব্যয় মেটাতে হবে তো ডলারে। বাড়তি সেই ডলার আসবে কোথা থেকে?
জ্বালানি তেলে ভর্তুকি প্রসঙ্গে এ পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ার বলেন, 'তেলের দাম পাঁচ টাকা বাড়লে ট্রাক ভাড়া সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা বাড়তে পারে, কিন্তু বেড়ে যাচ্ছে দুই হাজার টাকা। ভোক্তাপর্যায়ে যদি তদারকি না থাকে, দাম বাড়ার প্রভাব নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থাই যদি সরকারের না থাকে তাহলে জনজীবনে দুর্ভোগ বাড়বেই। কারণ আমাদের দেশে সব খাতই সরবরাহকারীদের নিয়ন্ত্রণে। সরকার বাজারদরেও জ্বালানি তেল বিক্রি করতে পারে তখনি, যখন তারা বাজারে এর প্রভাব নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে।' এটি সম্ভব বলেও মনে করেন ড. তামিম।
তামিমের মতে, 'কৃষিতে ভর্তুকি লাগবে। কিন্তু পরিবহন খাতে ভর্তুকি না দিলেও চলে। দাম কত বাড়লে পরিবহন ব্যয় কত বাড়তে পারে তা হিসাব করে সরকার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বসে ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়ে কঠোরভাবে তা তদারকি করতে পারে। আর এ হিসাব জনসমক্ষে তুলে ধরে একটা প্রচারণাও চালাতে পারে। তখন সাধারণ মানুষই প্রতিরোধ করবে। ভারতে জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়। কিন্তু সেখানে ইচ্ছা করলেই পরিবহন মালিকরা বাস-ট্রাকের ভাড়া বাড়াতে পারেন না। আমাদের এখানে কথায় কথায় ধর্মঘট। ফলে বেকায়দায় পড়ে সরকার।' বিপিসির সাবেক চেয়ারম্যান মেজর (অব.) মুক্তাদির আলী জানান, ভারতের মতো বাংলাদেশেও পেট্রোল ও অকটেনে ভর্তুকি দেওয়া হয় না। তবে এ দুটো জ্বালানির পরিমাণ দেশের জ্বালানি চাহিদার তুলনায় নগণ্য। পেট্রোল, অকটেন থেকে বছরে বিপিসির হয়তো ১৫ কোটি টাকা লাভ হয়, আর ফার্নেস অয়েল, কেরোসিন, ডিজেল বিক্রি করে বিপিসির লোকসান হয় ১৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি। তিনি বলেন, একটি সাধারণ হিসাবে দেখা গেছে, তেলের দাম এক টাকা বাড়লে পরিবহন খরচ বাড়ার কথা ১ পয়সা।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক ড. কে এ এস মুরশিদ বলেন, ভর্তুকির ব্যাপারে রাজনীতি বা জনপ্রিয়তার মতো বিষয় জড়িত থাকলেও সমাজের বঞ্চিত অবহেলিত মানুষের প্রতি একটা দায়বোধও কাজ করে। তবে ভর্তুকির সুফল যদি টার্গেটেড জনগোষ্ঠী পায় তবেই তা যথার্থ হয়। তিনি বলেন, 'আমরা যদি ঢালাওভাবে জ্বালানিতে ভর্তুকি বাড়াতেই থাকি তাহলে অপচয় বাড়বে। আর তার সুফলও মানুষ পাবে না।' তিনি মনে করেন, কৃষি ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ভর্তুকি থাকা দরকার। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ভর্তুকি যে উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়, তা পুরোপুরি সফল হয় না। স্বল্প আয়ের মানুষজনকে স্বস্তিতে রাখার উদ্দেশ্যে ভর্তুকি দেওয়া হয়। অথচ তাদের খুব উপকার হয় না। দামি গাড়ির মালিক যে দামে ডিজেল কিনছেন, সেচ পাম্পের জন্যও সেই দাম। তেলের দাম বাড়ার প্রভাব ভোক্তাদের ওপর আনুপাতিক হারে পড়ছে না। এ ক্ষেত্রে সরকারের কঠোর তদারকি দরকার। সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট বিভাগ, পরিবহন খাতের সমিতি ও ভোক্তাদের প্রতিনিধিরা মিলে ঠিক করা উচিত ভাড়া কত বাড়তে পারে। তিন পক্ষ মিলেই এর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা উচিত। তিনি বলেন, খাদ্য নিরাপত্তার কথা ভেবে কৃষিতে ব্যবহৃত জ্বালানিতে ভর্তুকি দিতে হবে সরকারকে। তাই বলে উচ্চবিত্তের গাড়িতে ও কলকারখানায় ব্যবহারের জ্বালানিতে ভর্তুকি দিতে হবে, এমন কথা নেই। দেশের সীমিত সম্পদ কেবল ভর্তুকি দিয়ে নিঃশেষ করা যাবে না। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভর্তুকি গ্রহণযোগ্য নয়। আর কোনো ভর্তুকি সারা জীবন চলতে পারে না। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ ইউসুফ হোসেন এ বিষয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এখনো আমরা সিএনজির দাম বাড়ানো সংক্রান্ত কোনো প্রস্তাব পাইনি। পেলে বিবেচনা করব। আমার ব্যক্তিগত মত হলো, যেসব অভিজাত এলাকায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ২৪ ঘণ্টা গ্যাস সরবরাহ থাকে, সেসব এলাকায় দাম বাড়ানো যেতে পারে। এতে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।'
সেপ্টেম্বরে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পরপরই সিএনজির দাম ঘনমিটারপ্রতি পাঁচ টাকা বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছিল। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. হোসেন মনসুর তখন বলেছিলেন, দেশের গ্যাস পানির দরে বিক্রি হচ্ছে। এ দামে পৃথিবীর কোথাও গ্যাস বিক্রি হয় না। গ্যাস দিয়ে অটোরিকশা চলছে, ট্রাক চলছে, তাদের জ্বালানি খরচ কমছে। কিন্তু এর সুফল যাত্রী ও ভোক্তারা পাচ্ছে না। সস্তা পেয়ে গ্যাসের দিকে ঝুঁকছে সবাই। ব্যক্তিগত গাড়ি চলছে গ্যাসে। ওদিকে শিল্পে গ্যাস দেওয়া যাচ্ছে না। আমদানি করা জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পাশাপাশি গ্যাসের দামও বাড়ানো উচিত বলে তিনি মনে করেন। অভিযোগ ছিল, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে সরকার দেশে তেলের দাম বাড়ায়, কমলে কমায় না। তবে ২০০৭ সাল থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়া-কমার সঙ্গে সংগতি রেখে জ্বালানির দাম নির্ধারণ শুরু করেছে সরকার। সেই থেকে এ পর্যন্ত জ্বালানি তেলের দাম তিনবার কমেছে, তিনবার বেড়েছে। এর আগে তিন দফায় লিটারপ্রতি কমেছে ১১ টাকা করে। কেরোসিন ও ডিজেলের দাম উঠেছিল লিটারপ্রতি ৫৫ টাকায়। তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালের অক্টোবরে লিটারপ্রতি সাত টাকা কমিয়ে দাম নির্ধারণ করে ৪৮ টাকায়। পরে দুই দফায় কেরোসিন ও ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি আরো চার টাকা করে কমেছিল। চলতি বছরের ৫ মে থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দুবারে সাত টাকা বেড়েছে বহুল ব্যবহৃত এ দুটি জ্বালানি তেলের দাম, এখন দাঁড়িয়েছে ৫১ টাকায়। সবশেষে গত ১০ নভেম্বর পাঁচ টাকা বাড়ানোয় এখন কেরোসিন ও ডিজেলের দাম হয়েছে ৫৬ টাকা, অর্থাৎ চার বছর আগের দামের চেয়ে এক টাকা বেশি। ভারতের কলকাতায় ডিজেলের দাম প্রায় ৭০ টাকা, আর পেট্রোল বিক্রি হয় ১১৭ টাকায়। সর্বশেষ বৃদ্ধির পরও বাংলাদেশে পেট্রলের দাম ৮৬ টাকা। দামের পার্থক্য থাকায় ভারতে জ্বালানি তেল পাচারের আশঙ্কা করেন সরকারি নীতিনির্ধারকরা।
জ্বালানির দাম কম থাকলে উৎপাদন বাড়বে, খরচ কমবে এবং স্বল্প আয়ের মানুষ স্বস্তিতে থাকবে_এ বিশ্বাসের ওপর ভর করে অনেকটা প্রথাগতভাবেই চলে আসছে জ্বালানিতে ভর্তুকি। কৃষি ও শিল্প উৎপাদনে বহুমাত্রিক বৃদ্ধির সঙ্গে জ্বালানি ভর্তুকির সম্পর্ক খোঁজেন অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকরা। কিন্তু দশকের পর দশক ধরে দেওয়া এ ভর্তুকির ফলে অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়েছে, মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় কতখানি নিয়ন্ত্রণে আছে, কৃষকসহ সাধারণ জনগোষ্ঠীর জীবনমানের কতটুকু উন্নতি হয়েছে, সবশেষে দেশের সামগ্রিক উৎপাদনশীলতা কতখানি বেড়েছে_এ নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো সমীক্ষা হয়নি। প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ এ ভর্তুকির কতখানি অপচয় হয়েছে, এর কতখানি সুফল উদ্দিষ্ট মানুষের কাছে পেঁৗছেছে, এরও কোনো হিসাব নেই।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়ার আশঙ্কা করেন যেসব অর্থনীতিবিদ, তাঁরাও এখন বলছেন, জ্বালানিতে ঢালাওভাবে ভর্তুকি দেওয়ার কোনো যুক্তি নেই। রাজনৈতিক কারণেই সরকারগুলো জ্বালানি ভর্তুকি দিয়ে আসছে। এত দিন তবু সহনীয় মাত্রায় ছিল; কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ফার্নেস অয়েলে ভর্তুকি দেওয়ায় সামষ্টিক অর্থনীতির ভারসাম্যই ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।
জ্বালানি খাতে চলতি বছর ভর্তুকি বাবদ সরকারের খরচ হবে ৩৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এ বছর বিদ্যুতে সাত হাজার কোটি, জ্বালানি তেলে ২৬ হাজার কোটি এবং গ্যাসে পাঁচ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে সরকারকে। জ্বালানি ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বর্ধিত ভর্তুকি ব্যয় মেটাতে গিয়ে সরকারের ঋণ বেড়ে গেছে। বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চলতি অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার কথা ১৮ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা। কিন্তু অক্টোবর নাগাদ চার মাসেই ব্যাংক থেকে সরকারকে ধার করতে হয়েছে ১৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকা, যা বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার ৭৮ শতাংশ। সরকারের এ ঋণ নেওয়ার প্রবণতায় উদ্বিগ্ন খোদ কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত মাসেই অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সরকার অতিরিক্ত ঋণ নেওয়ায় বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ও অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তা ছাড়া তেলের আমদানিমূল্য পরিশোধ করতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) ডলারের চাহিদা বেড়ে গেছে। এর চাপ পড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও ডলারের বিনিময়মূল্যে।
মাত্র ৫২ দিনের ব্যবধানে দ্বিতীয়বারের মতো জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পরও জ্বালানি তেলের পেছনে বিপিসিকে বছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা লোকসান দিতে হবে। গত বৃহস্পতিবার রাতে জ্বালানি মন্ত্রণালয় ডিজেল, ফার্নেস অয়েল, পেট্রল, অকটেন ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি পাঁচ টাকা করে বাড়ানোর আগে এ লোকসানের পরিমাণ ১৪ হাজার কোটি টাকা ছিল বলে জানিয়েছে বিপিসি কর্তৃপক্ষ।
এ প্রসঙ্গে বিপিসির পরিচালক (অর্থ) সরাফ উদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পরও বিপিসিকে ডিজেলের ক্ষেত্রে লিটারপ্রতি সাড়ে ১৭ টাকা, কেরোসিনে সাড়ে ১৬ টাকা এবং ফার্নেস অয়েলের পেছনে সাড়ে চার টাকা লোকসান দিতে হবে। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর বিপিসির লোকসান প্রায় চার হাজার কোটি টাকা কমে আসবে। তার পরও জ্বালানি তেল বিক্রি বাবদ বিপিসির বছরে লোকসান থাকবে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা।
জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সরকার জ্বালানিভিত্তিক ভাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনকে উৎসাহিত করছে। সে জন্য চলতি বছর ২০ লাখ টন অতিরিক্ত ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল আমদানি করতে হবে বলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন জানায়। এতে তেল আমদানি ব্যয় দাঁড়াবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। একই সঙ্গে বাড়বে ভর্তুকি ব্যয়। গত বছর জ্বালানিতে ভর্তুকি দিতে হয়েছিল আট হাজার ২০০ কোটি টাকা। এ বছর তা বেড়ে দাঁড়াবে ১৮ হাজার কোটি টাকা। এতে সরকারের ঋণ বাড়বে। এ চাপ কিছুটা কমানোর জন্য দুই মাসেরও কম সময়ে বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম লিটারপ্রতি পাঁচ টাকা বাড়িয়েছে সরকার। দুই বারে ফার্নেস অয়েলে দাম বাড়ানো হয়েছে প্রতি লিটারে ১৩ টাকা। তবু বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহারের জন্য ফার্নেস অয়েলে এখনো চার টাকা ৯৭ পয়সা ভর্তুকি দিতে হবে। বিপিসির কর্মকর্তারা জানান, গত অর্থবছরে (২০১০-১১) দেশে প্রায় ৪৮ লাখ ৬৮ মেট্রিক টন জ্বালানি তেল ব্যবহৃত হয়েছে। আর এ বছর প্রায় ৬৬ লাখ ৭৫ হাজার মেট্রিক টন জ্বালানি তেল প্রয়োজন হবে। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এ বছর জ্বালানি তেলের চাহিদা বেড়েছে প্রায় ৩৭ দশমিক ১২ শতাংশ। বিপিসির কর্মকর্তারা জানান, গত অর্থবছরে (২০১০-১১) দেশে প্রায় ৪৮ লাখ ৬৮ মেট্রিক টন জ্বালানি তেল ব্যবহৃত হয়েছে। আর এ বছর প্রায় ৬৬ লাখ ৭৫ হাজার মেট্রিক টন জ্বালানি তেল প্রয়োজন হবে। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এ বছর জ্বালানি তেলের চাহিদা বেড়েছে প্রায় ৩৭ দশমিক ১২ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরে দেশে ডিজেল প্রয়োজন হবে প্রায় ৪০ লাখ মেট্রিক টন। আর ফার্নেস অয়েল লাগবে প্রায় ১৫ লাখ মেট্রিক টন। শুধু বিদ্যুৎ খাতেই ফার্নেস অয়েল প্রয়োজন হবে প্রায় ১৪ লাখ ১৫ হাজার মেট্রিক টনের বেশি। গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরে শুধু ফার্নেস অয়েলের চাহিদা বেড়েছে প্রায় ১০ লাখ টন বেশি। আর অকটেন প্রয়োজন হবে বছরে মাত্র এক লাখ আট হাজার মেট্রিক টন এবং পেট্রোল লাগবে প্রায় দেড় লাখ মেট্রিক টন। কেরোসিনের ব্যবহার ১০ লাখ টনের মতো। বিপিসির এক পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, দেশে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের ৬৫ শতাংশই ডিজেল। এখন ডিজেল আমদানির ক্ষেত্রে লিটারপ্রতি ব্যয় হয় প্রায় ৭৩ দশমিক ৬৮ টাকা, কেরোসিনের দাম পড়ে ৭২ দশমিক ৮৫ টাকা এবং ফার্নেস অয়েলের আমদানি ব্যয় পড়ে লিটারপ্রতি প্রায় ৫৯ দশমিক ৫৬ টাকা। ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ফার্নেস অয়েলের বাড়তি চাহিদার কারণেই চলতি বছর সরকারের ভর্তুকি ব্যয় বেড়েছে। জ্বালানিতে টার্গেটেড সাবসিডি বা উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে ভর্তুকি দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, জরুরি ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য ফার্নেস অয়েল ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। কিন্তু সাময়িক এ ব্যবস্থার জন্য বিপুল পরিমাণ ফার্নেস অয়েল কিনতে রিজার্ভ থেকে বাড়তি ডলার খরচ হচ্ছে। অথচ রেমিট্যান্স আয় বাড়ানোর কোনো উদ্যোগ নেই। দাম বাড়িয়ে হয়তো সরকার বাড়তি কিছু টাকা সংগ্রহ করতে পারে, কিন্তু আমদানি ব্যয় মেটাতে হবে তো ডলারে। বাড়তি সেই ডলার আসবে কোথা থেকে?
জ্বালানি তেলে ভর্তুকি প্রসঙ্গে এ পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ার বলেন, 'তেলের দাম পাঁচ টাকা বাড়লে ট্রাক ভাড়া সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা বাড়তে পারে, কিন্তু বেড়ে যাচ্ছে দুই হাজার টাকা। ভোক্তাপর্যায়ে যদি তদারকি না থাকে, দাম বাড়ার প্রভাব নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থাই যদি সরকারের না থাকে তাহলে জনজীবনে দুর্ভোগ বাড়বেই। কারণ আমাদের দেশে সব খাতই সরবরাহকারীদের নিয়ন্ত্রণে। সরকার বাজারদরেও জ্বালানি তেল বিক্রি করতে পারে তখনি, যখন তারা বাজারে এর প্রভাব নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে।' এটি সম্ভব বলেও মনে করেন ড. তামিম।
তামিমের মতে, 'কৃষিতে ভর্তুকি লাগবে। কিন্তু পরিবহন খাতে ভর্তুকি না দিলেও চলে। দাম কত বাড়লে পরিবহন ব্যয় কত বাড়তে পারে তা হিসাব করে সরকার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বসে ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়ে কঠোরভাবে তা তদারকি করতে পারে। আর এ হিসাব জনসমক্ষে তুলে ধরে একটা প্রচারণাও চালাতে পারে। তখন সাধারণ মানুষই প্রতিরোধ করবে। ভারতে জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়। কিন্তু সেখানে ইচ্ছা করলেই পরিবহন মালিকরা বাস-ট্রাকের ভাড়া বাড়াতে পারেন না। আমাদের এখানে কথায় কথায় ধর্মঘট। ফলে বেকায়দায় পড়ে সরকার।' বিপিসির সাবেক চেয়ারম্যান মেজর (অব.) মুক্তাদির আলী জানান, ভারতের মতো বাংলাদেশেও পেট্রোল ও অকটেনে ভর্তুকি দেওয়া হয় না। তবে এ দুটো জ্বালানির পরিমাণ দেশের জ্বালানি চাহিদার তুলনায় নগণ্য। পেট্রোল, অকটেন থেকে বছরে বিপিসির হয়তো ১৫ কোটি টাকা লাভ হয়, আর ফার্নেস অয়েল, কেরোসিন, ডিজেল বিক্রি করে বিপিসির লোকসান হয় ১৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি। তিনি বলেন, একটি সাধারণ হিসাবে দেখা গেছে, তেলের দাম এক টাকা বাড়লে পরিবহন খরচ বাড়ার কথা ১ পয়সা।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক ড. কে এ এস মুরশিদ বলেন, ভর্তুকির ব্যাপারে রাজনীতি বা জনপ্রিয়তার মতো বিষয় জড়িত থাকলেও সমাজের বঞ্চিত অবহেলিত মানুষের প্রতি একটা দায়বোধও কাজ করে। তবে ভর্তুকির সুফল যদি টার্গেটেড জনগোষ্ঠী পায় তবেই তা যথার্থ হয়। তিনি বলেন, 'আমরা যদি ঢালাওভাবে জ্বালানিতে ভর্তুকি বাড়াতেই থাকি তাহলে অপচয় বাড়বে। আর তার সুফলও মানুষ পাবে না।' তিনি মনে করেন, কৃষি ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ভর্তুকি থাকা দরকার। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ভর্তুকি যে উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়, তা পুরোপুরি সফল হয় না। স্বল্প আয়ের মানুষজনকে স্বস্তিতে রাখার উদ্দেশ্যে ভর্তুকি দেওয়া হয়। অথচ তাদের খুব উপকার হয় না। দামি গাড়ির মালিক যে দামে ডিজেল কিনছেন, সেচ পাম্পের জন্যও সেই দাম। তেলের দাম বাড়ার প্রভাব ভোক্তাদের ওপর আনুপাতিক হারে পড়ছে না। এ ক্ষেত্রে সরকারের কঠোর তদারকি দরকার। সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট বিভাগ, পরিবহন খাতের সমিতি ও ভোক্তাদের প্রতিনিধিরা মিলে ঠিক করা উচিত ভাড়া কত বাড়তে পারে। তিন পক্ষ মিলেই এর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা উচিত। তিনি বলেন, খাদ্য নিরাপত্তার কথা ভেবে কৃষিতে ব্যবহৃত জ্বালানিতে ভর্তুকি দিতে হবে সরকারকে। তাই বলে উচ্চবিত্তের গাড়িতে ও কলকারখানায় ব্যবহারের জ্বালানিতে ভর্তুকি দিতে হবে, এমন কথা নেই। দেশের সীমিত সম্পদ কেবল ভর্তুকি দিয়ে নিঃশেষ করা যাবে না। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভর্তুকি গ্রহণযোগ্য নয়। আর কোনো ভর্তুকি সারা জীবন চলতে পারে না। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ ইউসুফ হোসেন এ বিষয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এখনো আমরা সিএনজির দাম বাড়ানো সংক্রান্ত কোনো প্রস্তাব পাইনি। পেলে বিবেচনা করব। আমার ব্যক্তিগত মত হলো, যেসব অভিজাত এলাকায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ২৪ ঘণ্টা গ্যাস সরবরাহ থাকে, সেসব এলাকায় দাম বাড়ানো যেতে পারে। এতে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।'
সেপ্টেম্বরে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পরপরই সিএনজির দাম ঘনমিটারপ্রতি পাঁচ টাকা বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছিল। পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. হোসেন মনসুর তখন বলেছিলেন, দেশের গ্যাস পানির দরে বিক্রি হচ্ছে। এ দামে পৃথিবীর কোথাও গ্যাস বিক্রি হয় না। গ্যাস দিয়ে অটোরিকশা চলছে, ট্রাক চলছে, তাদের জ্বালানি খরচ কমছে। কিন্তু এর সুফল যাত্রী ও ভোক্তারা পাচ্ছে না। সস্তা পেয়ে গ্যাসের দিকে ঝুঁকছে সবাই। ব্যক্তিগত গাড়ি চলছে গ্যাসে। ওদিকে শিল্পে গ্যাস দেওয়া যাচ্ছে না। আমদানি করা জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পাশাপাশি গ্যাসের দামও বাড়ানো উচিত বলে তিনি মনে করেন। অভিযোগ ছিল, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে সরকার দেশে তেলের দাম বাড়ায়, কমলে কমায় না। তবে ২০০৭ সাল থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়া-কমার সঙ্গে সংগতি রেখে জ্বালানির দাম নির্ধারণ শুরু করেছে সরকার। সেই থেকে এ পর্যন্ত জ্বালানি তেলের দাম তিনবার কমেছে, তিনবার বেড়েছে। এর আগে তিন দফায় লিটারপ্রতি কমেছে ১১ টাকা করে। কেরোসিন ও ডিজেলের দাম উঠেছিল লিটারপ্রতি ৫৫ টাকায়। তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালের অক্টোবরে লিটারপ্রতি সাত টাকা কমিয়ে দাম নির্ধারণ করে ৪৮ টাকায়। পরে দুই দফায় কেরোসিন ও ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি আরো চার টাকা করে কমেছিল। চলতি বছরের ৫ মে থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দুবারে সাত টাকা বেড়েছে বহুল ব্যবহৃত এ দুটি জ্বালানি তেলের দাম, এখন দাঁড়িয়েছে ৫১ টাকায়। সবশেষে গত ১০ নভেম্বর পাঁচ টাকা বাড়ানোয় এখন কেরোসিন ও ডিজেলের দাম হয়েছে ৫৬ টাকা, অর্থাৎ চার বছর আগের দামের চেয়ে এক টাকা বেশি। ভারতের কলকাতায় ডিজেলের দাম প্রায় ৭০ টাকা, আর পেট্রোল বিক্রি হয় ১১৭ টাকায়। সর্বশেষ বৃদ্ধির পরও বাংলাদেশে পেট্রলের দাম ৮৬ টাকা। দামের পার্থক্য থাকায় ভারতে জ্বালানি তেল পাচারের আশঙ্কা করেন সরকারি নীতিনির্ধারকরা।
No comments