এক দশক পর মুক্তির আদেশ-এ দুর্ভাগ্যের শেষ কোথায়?
কালজয়ী হিসেবে স্বীকৃত 'সবার উপরে' চলচ্চিত্রে প্রশান্ত চৌধুরীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন খ্যাতিমান অভিনেতা ছবি বিশ্বাস। একটি খুনের মামলায় তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। পুত্র শঙ্কর, যার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন উত্তম কুমার_ আইনজীবী হিসেবে আদালতে দারুণ লড়ে ১২ বছর পর পিতাকে মুক্ত করেন। মুক্ত জীবনে ফিরে এসে ছবি বিশ্বাসের কণ্ঠে প্রশান্ত চৌধুুরীর সেই ক্ষোভ-যন্ত্রণা-আবেগে ভরা মর্মস্পর্শী উচ্চারণ 'ফিরিয়ে দাও আমার ১২টি বছর'_
সিনেমা হলগুলোতে দর্শকদের কাঁদিয়েছে। চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার ইউসুফ হোসেনের পুত্র আবুল হোসেনও মুক্ত জীবনে এসে সেই একই যন্ত্রণা-বেদনা ও হাহাকার করে বলতে পারেন : 'ফিরিয়ে দাও আমার ১২টি বছর'। ১৯৯৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর তারও হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হলে ২০০১ সালের ১৬ আগস্ট হাইকোর্ট তাকে বেকসুর খালাস দেন। হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের অনুলিপি পরের বছর ১০ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে পেঁৗছায়। এরপর তা মামলার আদালত নথিতে পড়ে থাকে। সম্প্রতি বিষয়টি জেলা ও দায়রা জজ আবদুল কুদ্দুস মিঞার নজরে এলে তিনি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেন। এরপর দ্রুতই তার মুক্তির নির্দেশ কারাগারে পেঁৗছায় এবং বেকসুর খালাস লাভেরও দীর্ঘ সময় পর গত মঙ্গলবার তিনি মুক্তিলাভ করেন। আবুল হোসেনের অভিযোগ, প্রতিবেশী এক লোককে হত্যার ঘটনায় তাকে অন্যায়ভাবে ফাঁসানো হয়েছিল এ মামলায়। পুলিশ তার কাছে অর্থ দাবি করলে তিনি তা দিতে পারেননি। উচ্চ আদালতের রায়ের কপি ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে পেঁৗছাতে এই যে এক দশকের বিলম্ব, তার মূলেও যে বাড়তি খরচ করতে না পারা তাতে সন্দেহ কী! এ ঘটনা নিয়ে কোনো চলচ্চিত্র নির্মিত হবে কি-না, কে জানে। এমনটি ঘটলে ছবি বিশ্বাসের মতো বাংলাদেশের কোনো অভিনেতার কালজয়ী সংলাপ হয়তো আমরা শুনতে পাব :'৩২ বছর বয়সে কারাগার থেকে ফিরে যাচ্ছি। জীবন-যৌবন সবই হারালাম। কী নিয়ে বাঁচব?' এমন দুর্ভাগ্যের আরও কাহিনী মাঝে মধ্যেই সংবাদপত্রে ছাপানো হয়, টেলিভিশনের পর্দায় সচিত্র দেখানো হয়। তাতে কখনও কিছু কাজ হয়, কখনওবা হয় না। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এ ধরনের খবর দেখে তৎপর হলে তাতেও কিছু ফল মেলে। জেলা ও দায়রা জজ আবদুল কুদ্দুস মিয়ার মতো সংবেদনশীল ও মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন কারও কারও সক্রিয়তাও ধুলার পুরু স্তর সরিয়ে বের করা ফাইলের জীর্ণ ফিতা খুলে ফেলতে পারে। কিন্তু এ ধরনের ঘটনা তো ব্যতিক্রম। এটাকে কি নিয়মে পরিণত করা যায় না? বিচারের বাণী কি নীরবে-নিভৃতে কাঁদতেই থাকবে? আবুল হোসেনের ঘটনাটি কি সংশ্লিষ্টদের চোখ খুলে দেওয়ার কারণ হতে পারে না? এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই। সর্বোচ্চ আদালত এক ঐতিহাসিক রায়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পথ খুলে দিয়েছিল। কিন্তু এখনও বিচার প্রার্থী, বিশেষ করে দরিদ্র জনসাধারণের ন্যায়বিচার পেতে ভোগান্তির শেষ নেই। এ ক্ষেত্রে কী করণীয়, তেমন নির্দেশনা প্রত্যাশা করা যেতেই পারে। যাদের কারণে আবুল হোসেনের মুক্তির আদেশ পেঁৗছাতে এত বিলম্ব, তাদের শাস্তির ব্যবস্থাও করা চাই। আবুল হোসেন যেন নতুন জীবন শুরু করতে পারেন, সে জন্যও আবদুল কুদ্দুস মিঞার মতো প্রসারিত হোক অনেক দরদি হাত।
No comments