লংমার্চের ডায়েরি-দেশের সম্পদ বাঁচানোর জন্য লড়াকুদের দীর্ঘ যাত্রার কেবল শুরু
তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতৃত্বে গত ২৮ থেকে ৩১ অক্টোবর ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জের বাদশাগঞ্জে লংমার্চ অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় কমিটির অন্যতম দাবিগুলো ছিল_সম্প্রতি বাপেঙ্ কর্তৃক আবিষ্কৃত সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনায় অবস্থিত সুনেত্র গ্যাসক্ষেত্র এবং সিলেটের রশিদপুর গ্যাসক্ষেত্র থেকে জাতীয় সংস্থার মাধ্যমে অবিলম্বে গ্যাস উত্তোলন করতে হবে।
স্থলভাগের অবশিষ্ট গ্যাসক্ষেত্রগুলো বিদেশি কম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার জন্য আরেকটি ভয়ংকর জাল 'পিএসসি-২০১১' প্রক্রিয়া বন্ধ কর। অবশ্যই আর কোনো পিএসসি নয়। রপ্তানিমুখী পিএসসি ২০০৮ ও কনোকো-ফিলিপসের সঙ্গে চুক্তি বাতিল কর। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট সমাধানে 'খনিজ সম্পদ রপ্তানি নিষিদ্ধ আইন' পাসসহ জাতীয় কমিটি সাত দফা দাবির সমর্থনে লংমার্চ শুরু করে। লংমার্চের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ কাফেলায় ছিলেন আরিফুজ্জামান তুহিন। সেই লংমার্চের চার দিন তিনি খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন আন্দোলন, সমাবেশ_সর্বোপরি সাধারণ মানুষ কিভাবে নিচ্ছেন লংমার্চকে। লংমার্চকে ঘিরে দুই পর্বের ধারাবাহিকের আজ ছাপা হলো শেষ পর্ব
৩০ অক্টোবর ময়মনসিংহ
গতকাল রাতে ময়মনসিংহের জিমনেশিয়ামে লংমার্চের নেতা-কর্মীদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। শীতের আমেজ টের পাচ্ছিলাম গাজীপুর থেকেই। ময়মনসিংহে এসে শীতের সেই ঝাঁজ আরো ভালো করে অনুভব করলাম। জিমনেশিয়ামের মেঝেতে ঢালাই বিছানা। বিছানা বলতে পাতলা শামিয়ানার চাদর। সারি সারি কর্মীরা শুয়েছেন সেই বিছানায়। কারো মুখে কোনো অভিযোগ নেই। এ কাফেলা যেন হতাশার বাংলাদেশে আশার ছোট্ট এক টুকরো মেঘ।
সকাল ১০টায় আবার চলা শুরু করল লংমার্চ। ময়মনসিংহ শহরের মধ্য দিয়ে লংমার্চ এগিয়ে যাচ্ছে।
পথে দুই জায়গায় সমাবেশ করল জাতীয় কমিটি। একটি গৌরীপুরে, অন্যটি শম্ভুগঞ্জে। গৌরীপুরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের লোকজনের বাধার মুখে পড়ে জাতীয় গণতান্ত্রিক গণমঞ্চের গানের দল। এ গানের দলটি আলাদা একটি পিকআপ ভ্যানে করে সারা লংমার্চে গান করেছে। লংমার্চে আরো গানের দল ছিল। এর মধ্যে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল বাসদের সাংস্কৃতিক সংগঠন চারণ ও সংস্কৃতি মঞ্চ। এসব দল লংমার্চে গণসংগীত এবং তেল-গ্যাসের সাম্প্রতিক চুক্তি নিয়ে গান তৈরি করেছে, যা বিভিন্ন স্থানে গেয়েছে। গানের সুর, যন্ত্র অথবা গায়কি সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। যা ছিল, তা হলো গানের কথা। সেই গানের কথা যে প্রতিরোধের আরেকটি ভাষা তৈরি করতে পারে, সেই প্রতিরোধের ভাষাকে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা বাধা দিতে আসেন।
জেগে ওঠা তরুণের বিপরীতে
জাতীয় সংগ্রাম ও শ্রেণীসংগ্রামের তত্ত্ব
লংমার্চ বিকেলে এসে পেঁৗছে নেত্রকোনায়। সমাবেশের স্থল শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ। জাতীয় কমিটির একটি বিষয় বেশ লক্ষণীয়, তা হলো যেসব জায়গায় এ কমিটি সমাবেশ করেছে, তার অধিকাংশই শহীদ মিনার। শহীদ মিনারে সমাবেশ করার অর্থ শুধু উন্মুক্ত জায়গার কারণে নয় বলেই আমার মনে হয়েছে। এর পেছনে ভিন্ন রাজনীতি রয়েছে বলে আমার ধারণা। এই রাজনীতি হলো পূর্ব বাংলার স্বাধিকার লড়াইয়ের ইতিহাস চেতনার রাজনীতি। সেই স্মৃতির মিনার যখন ইতিহাসের ধূসর পাণ্ডুলিপি ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়ায় অস্থিমজ্জা নিয়ে, তখন জ্যান্ত মানুষ, জীবনের পথে, রাস্তায় হাঁটা মানুষ কিংবা কলকারখানার আর খেতের মানুষ সামনের দিকের ভরসা পায়।
শহীদ মিনারে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পর শুরু হলো জাতীয় কমিটিতে অংশগ্রহণরত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের বক্তব্য। আজকের সমাবেশের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল, বক্তব্য দিতে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতারা মঞ্চে উঠেছেন। সব ছাত্রনেতাই আমার পরিচিত, কাছের মানুষ।
বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর হিল্লোল রায়ের বক্তব্য শুনে মনে হলো, ছাত্রনেতারা গত এক দশকের ক্লান্তি কাটিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছেন। হিল্লোলের সোজাসাপ্টা বক্তব্য ছিল এ রকম_'একজন ছাত্রও বাংলাদেশে থাকতে দেশের সম্পদ বাইরে পাচার হতে দেবে না।' এই স্পিরিটটার খুব দরকার। বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ছাত্র কেন্দ্র, বিপ্লবী ছাত্র সংঘ, জাতীয় গণফ্রন্ট সমর্থিত বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের কেন্দ্রীয় নেতারা বক্তব্য দিলেন। ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি আরিফুল ইসলাম, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি সাকন দুর্দান্ত বক্তব্য দিলেন। জাতীয় গণফ্রন্ট সমর্থিত বিপ্লবী মৈত্রীর খালিদের বক্তব্য শুনে ভালো লাগল। মাত্র কয়েক দিন আগে জাতীয় কমিটির ডাকা অর্ধদিবস হরতালে জেল খেটে বেরিয়েছেন খালিদ।
ছাত্রনেতাদের বক্তব্য খুব সোজা। জাতীয় সম্পদ রক্ষায় ছাত্রদের ভূমিকা কী, সেখানে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলো মাঠের লড়াইয়ে কিভাবে হাজির থাকবে_সে ঘোষণাই দিলেন তাঁরা।
আমি আগ্রহ নিয়ে শুনছিলাম ছাত্রনেতাদের বক্তব্য। ছাত্রনেতাদের বক্তব্য শেষ হলে শুরু হলো জাতীয় নেতাদের বক্তব্য। দু-একজনের বক্তব্য শুনে আমি পাশের চায়ের দোকানে দাঁড়ালাম। ঠিক এখন মনে পড়ছে না, তবে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কোনো কেন্দ্রীয় নেতা হবেন, তিনি বক্তব্য দিচ্ছিলেন। আমার কান খাড়া হয়ে গেল। আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম তাঁর বক্তব্য। আমার একাডেমিক পড়াশোনা ও একাডেমীর বাইরের পড়াশোনা দিয়ে তাঁর বক্তব্য ধরতে পারলাম না। তিনি যা বললেন, তার সোজা অর্থ হলো, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রাম আর শ্রেণীসংগ্রাম এক। তেল-গ্যাসের আন্দোলন শ্রেণীসংগ্রামের আন্দোলন।
আমার মাথার মধ্যে তখন ঘুরছে শ্রেণীতত্ত্ব, যা শুধু কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বেই কেবল হতে পারে বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের প্রশ্নে। আর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অথবা উপনিবেশবিরোধী লড়াই কি শ্রেণীসংগ্রাম? যদি তা-ই হয়, তাহলে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে যারা শ্রেণীশত্রু খতম করেছিল তাদের কেন সমালোচনা করা হয়? তাহলে কি সিপিবি শ্রেণীশত্রু খতমের লাইন নিয়েছে, তাহলে কি এ পার্টি আত্মগোপন করবে_এ ধরনের হাজারো প্রশ্ন আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল।
৩১ অক্টোবর নেত্রকোনা
গতকাল রাতে স্থানীয় স্কুলে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু আমাদের মতো যারা কোনো পার্টির সঙ্গে লংমার্চে যায়নি, তাদের অবস্থা বেশ খানিকটা কাহিল। এর ওপর সংস্কৃতির নয়াসেতুর কর্মী যিশুর শীতে গলা ফুলে গেছে। রাতে স্থানীয় কোনো হোটেলে থাকার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। এ শহরের কোনো হোটেলে সিট খালি নেই। আমাদের সঙ্গে পার্টিবিহীন পেলাম সাবেক বামপন্থী বর্তমানে উন্মোচন ব্লগের আজাদ আবুল কালাম, সাংস্কৃতিক সংগঠন নয়াসেতুর অপুকে। এই প্রথম সাংবাদিক পরিচয় ব্যবহার করতে হলো। কালের কণ্ঠের নেত্রকোনা প্রতিনিধি মিজানুর রহমান নান্নু ভাইকে ফোন দিলাম। অবশেষে তিনি একটি থাকার জায়গা জোগাড় করলেন।
আমরা দল ধরে রাতে শোওয়ার জায়গার জন্য অপেক্ষা করছি স্থানীয় এক ব্যবসায়ীর অফিসে। সেখানে নেত্রকোনার বড় বড় সব ব্যবসায়ী রয়েছেন। এর মধ্যে আমার পূর্বপরিচিত একমাত্র মিন্টু ভাই। একজন আজাদ ভাইকে প্রশ্ন করে বসলেন, 'আওয়ামী লীগ-বিএনপি সবাই খারাপ, তাহলে ভালো কে?' আজাদ ভাই কোনো রকম সংকোচ বোধ করলেন না। বললেন, 'আমরা ভালো।' তিনি আবার বললেন, 'আপনার যদি ভালো লোকই হবেন, তাহলে সংখ্যায় এত কম কেন?' এবারও আজাদ ভাইয়ের সোজা বক্তব্য, 'ইতিহাস সাক্ষী দেয় ভালো মানুষ সংখ্যায় কম থাকে।'
রাতে ঘুম ভালো হয়েছে। সকাল ১০টার মধ্যে আবারও যাত্রা শুরু।
নেত্রকোনা শহরের মধ্য দিয়ে লংমার্চ যাচ্ছে। লংমার্চে স্লোগান ধরলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিপি রাগিব আহসান মুন্না। ছোটখাটো মানুষ। এই বয়সেও গলায় তেজ আছে। এ মানুষটিকে আমি ছোটবেলায় দেখেছি আমাদের বাড়িতে। সাংগঠনিক কাজে তিনি এসেছিলেন। সে একটা সময় ছিল বামদের। এখন তো সব 'ডান' সময়।
বাদশাগঞ্জে মহাসমাবেশ ও হারিয়ে যাওয়া মানুষ
আগে থেকেই ঠিক করা ছিল, বাদশাগঞ্জে দুপুরের খাওয়ার পর সমাবেশ শুরু হবে। কিন্তু নেত্রকোনায় যেখানে দুপুরের খাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে সেখান থেকে মাইকে সিপিবিকর্মী জলি তালুকদার ঘোষণা করলেন খাবারের স্থানের নাম। লংমার্চের বহরের আগে সিপিবি সভাপতি মনজুরুল আহসান সবার আগেই ছিলেন। কিন্তু নির্ধারিত স্থানে পেঁৗছে দেখা গেল, সেখানে খাবার দেওয়া হচ্ছে না। লংমার্চের হাজার হাজার মানুষ এক ঘণ্টার ওপরে নিখোঁজ ছিলেন! এর পর খাওয়া নিয়ে ছাত্র মৈত্রী ও ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে অনভিপ্রেত ঘটনার কারণে বাদশাগঞ্জের নির্ধারিত সমাবেশে পেঁৗছতে অনেক দেরি হয়ে যায়। এ ঘটনার দায় কোনোভাবেই সিপিবি ও ওয়ার্কার্স পার্টির শীর্ষস্থানীয় নেতারা এড়াতে পারেন না।
সুনেত্র, যেখানে গ্যাস পাওয়ার প্রাথমিক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, সেখানে সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। বাদশাগঞ্জ হাই স্কুলের বিশাল মাঠ। মঞ্চে উপবিষ্ট সারি সারি জাতীয় নেতা। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ সুনেত্র ঘোষণা দিলেন।
গণংসহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক সাকি ভাইয়ের সঙ্গে শেষবারের মতো চা খেয়ে উঠে পড়লাম বাসে। দীর্ঘ লংমার্চ শেষে আমরা ঢাকার পথে রওনা দিলাম। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। হাওরে সন্ধ্যার নির্জনতা নেমে এসেছে।
জাতীয় কমিটির পতাকাবিহীন লড়াকুরা
জাতীয় কমিটিতে বিভিন্ন পার্টির কর্মী ও নেতারা রয়েছেন। এর বাইরে জাতীয় কমিটিতে বেশ কিছু তরুণ-তরুণী রয়েছেন, যাঁরা কোনো বামপন্থী রাজনৈতিক দলের কর্মী নন। এসব কর্মীর একটা অংশ কোনো পাঠচক্র, সাংস্কৃতিক সংগঠন, লাইব্রেরি আন্দোলন অথবা ব্যক্তিমানুষ। জাতীয় কমিটিতে এ ধরনের মানুষের সংখ্যা কম হলেও বাস্তবে তাঁরা একটি শক্তি। কারণ বামপন্থী রাজনৈতিক দলের বাইরে যে কোটি কোটি জনগণ, তাঁদের যদি সম্পদ বাঁচানোর এ আন্দোলনে মাঠে নামাতে হয় তাহলে এই পার্টিবিহীন, পতাকাবিহীন যেসব মানুষ জাতীয় কমিটিতে রয়েছেন, তাঁদের অংশগ্রহণকে আরো গভীর প্রজ্ঞা ও বিশ্লেষণ দিয়ে বুঝতে হবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ধরনের একটি গ্রুপ এসেছে, যারা কোনো সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নয়। তাদের মধ্যে মুনা নামের একটি মেয়েকে দেখেছি লংমার্চের চার দিনই স্লোগানের নেতৃত্ব দিতে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী আতিউর রহমান ফারুকও ছিলেন মিছিলের নেতৃত্বের অগ্রভাবে। এ ছাড়া আনহা ছিল সবার নেত্রী। মানিকগঞ্জের শহীদ রফিক স্মৃতি পাঠাগারের অনেকে এসেছিলেন।
পার্টিবিহীনদের মধ্যে অরূপ রাহী, মাহবুব রশিদ, আজাদ আবুল কালাম, প্রকৌশলী কল্লোল মুস্তফা, শাহরিয়ার সানি, মেহেদী ভাই, আতিয়া ফেরদৌসী চৈতী উল্লেখযোগ্য।
লালন কী মার্কসবাদী ছিলেন
আমি উঠেছি জাতীয় কমিটির ১১ নম্বর বাসে। এ বাসে আনু স্যার, প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, সাকি ভাইসহ অনেকে উঠেছেন। রাতে ময়মনসিংহে খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে গণসংহতি আন্দোলন। অনেক দিন পর মুরগির মাংস ও সবজি দিয়ে পেট ভরে ভাত খেলাম। এই খাওয়ার জন্যই মানুষ কত সংগ্রাম করে!
রাত ২টার পরে বাস ঢাকার উদ্দেশে ছাড়বে, যাতে ভোরবেলায় ঢাকায় পেঁৗছানো যায়। আমরা ময়নমসিংহ বাস টার্মিনালের পাশের টংঘরে বসে চা খাচ্ছি আর সমানে আড্ডা মারছি। এখানে পতাকাবিহীন, পার্টিবিহীন কর্মীর সংখ্যা বেশি। এর মধ্যে অবশ্য অবশ্য গণসংহতি আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতা ফিরোজ আহমেদ। পতাকাবিহীনদের মধ্যে মাহবুব রশিদ, আজাদ আবুল কালাম, যিশু মহম্মদ, ব্লগার পারভেজ আলম, তানজির মেহেদী উপস্থিত। ভীষণ তর্ক জমে উঠেছে। আলাপের বিষয় 'লালন'। শ্রী চৈতন্যোত্তর যে ভক্তিবাদের আন্দোলন, সেই আন্দোলনকে ইউরোপীয় জ্ঞানকাঠামো দিয়ে বিচার করতে গিয়েই নদিয়া ডিসকোর্সকে বুঝতে পারেনি। যিশু লালনকে বাউল বলতে নারাজ। যিশুর বক্তব্য, 'লালন কোথাও নিজেকে বাউল দাবি করেননি। তিনি ফকির। এই ফকির হলেন, মার্কসের সর্বহারা বা ডিক্লাস হওয়া।' ফিরোজ ভাই বললেন, 'বিষয়টি এ রকম নয়। সুধীর চক্রবর্তী আমাদের বলছেন, হিন্দু সাধকদের বাউল বলা হতো, আর মুসলিম সাধকদের ফকির বলা হতো।' অরূপ রাহী এবার নিশ্চুপ থেকে আওয়াজ তুললেন। বললেন, 'আমি সুধীর চক্রবর্তীর এ ব্যাখ্যা নিলাম না।'
বাউল ও ফকিরদের যে গুহ্য সাধনা (গোপন) রয়েছে, সেই ধারা দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনেও রয়েছে বলে বৈঠকে উপস্থিত সবাই স্বীকার করলেন। এ কারণে কমিউনিস্ট আন্দোলনে গুহ্য তত্ত্বেরও সবাই বিরোধিতা করলেন। সব কিছুই জনগণের কাছে পরিষ্কার করতে হবে, মেলে ধরতে হবে।
অবশেষে যিশু বললেন, মার্কস আসলে লালনপন্থী ছিলেন। আলাপ শেষ হলো না। তবু বাস ছাড়ার তাগিদ। আবার সেই জ্যামের-জটের ঢাকা। আবার সেই নিয়মের মধ্যে ফেরা।
৩০ অক্টোবর ময়মনসিংহ
গতকাল রাতে ময়মনসিংহের জিমনেশিয়ামে লংমার্চের নেতা-কর্মীদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। শীতের আমেজ টের পাচ্ছিলাম গাজীপুর থেকেই। ময়মনসিংহে এসে শীতের সেই ঝাঁজ আরো ভালো করে অনুভব করলাম। জিমনেশিয়ামের মেঝেতে ঢালাই বিছানা। বিছানা বলতে পাতলা শামিয়ানার চাদর। সারি সারি কর্মীরা শুয়েছেন সেই বিছানায়। কারো মুখে কোনো অভিযোগ নেই। এ কাফেলা যেন হতাশার বাংলাদেশে আশার ছোট্ট এক টুকরো মেঘ।
সকাল ১০টায় আবার চলা শুরু করল লংমার্চ। ময়মনসিংহ শহরের মধ্য দিয়ে লংমার্চ এগিয়ে যাচ্ছে।
পথে দুই জায়গায় সমাবেশ করল জাতীয় কমিটি। একটি গৌরীপুরে, অন্যটি শম্ভুগঞ্জে। গৌরীপুরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের লোকজনের বাধার মুখে পড়ে জাতীয় গণতান্ত্রিক গণমঞ্চের গানের দল। এ গানের দলটি আলাদা একটি পিকআপ ভ্যানে করে সারা লংমার্চে গান করেছে। লংমার্চে আরো গানের দল ছিল। এর মধ্যে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল বাসদের সাংস্কৃতিক সংগঠন চারণ ও সংস্কৃতি মঞ্চ। এসব দল লংমার্চে গণসংগীত এবং তেল-গ্যাসের সাম্প্রতিক চুক্তি নিয়ে গান তৈরি করেছে, যা বিভিন্ন স্থানে গেয়েছে। গানের সুর, যন্ত্র অথবা গায়কি সেখানে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। যা ছিল, তা হলো গানের কথা। সেই গানের কথা যে প্রতিরোধের আরেকটি ভাষা তৈরি করতে পারে, সেই প্রতিরোধের ভাষাকে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা বাধা দিতে আসেন।
জেগে ওঠা তরুণের বিপরীতে
জাতীয় সংগ্রাম ও শ্রেণীসংগ্রামের তত্ত্ব
লংমার্চ বিকেলে এসে পেঁৗছে নেত্রকোনায়। সমাবেশের স্থল শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ। জাতীয় কমিটির একটি বিষয় বেশ লক্ষণীয়, তা হলো যেসব জায়গায় এ কমিটি সমাবেশ করেছে, তার অধিকাংশই শহীদ মিনার। শহীদ মিনারে সমাবেশ করার অর্থ শুধু উন্মুক্ত জায়গার কারণে নয় বলেই আমার মনে হয়েছে। এর পেছনে ভিন্ন রাজনীতি রয়েছে বলে আমার ধারণা। এই রাজনীতি হলো পূর্ব বাংলার স্বাধিকার লড়াইয়ের ইতিহাস চেতনার রাজনীতি। সেই স্মৃতির মিনার যখন ইতিহাসের ধূসর পাণ্ডুলিপি ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়ায় অস্থিমজ্জা নিয়ে, তখন জ্যান্ত মানুষ, জীবনের পথে, রাস্তায় হাঁটা মানুষ কিংবা কলকারখানার আর খেতের মানুষ সামনের দিকের ভরসা পায়।
শহীদ মিনারে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পর শুরু হলো জাতীয় কমিটিতে অংশগ্রহণরত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের বক্তব্য। আজকের সমাবেশের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল, বক্তব্য দিতে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতারা মঞ্চে উঠেছেন। সব ছাত্রনেতাই আমার পরিচিত, কাছের মানুষ।
বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর হিল্লোল রায়ের বক্তব্য শুনে মনে হলো, ছাত্রনেতারা গত এক দশকের ক্লান্তি কাটিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছেন। হিল্লোলের সোজাসাপ্টা বক্তব্য ছিল এ রকম_'একজন ছাত্রও বাংলাদেশে থাকতে দেশের সম্পদ বাইরে পাচার হতে দেবে না।' এই স্পিরিটটার খুব দরকার। বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ছাত্র কেন্দ্র, বিপ্লবী ছাত্র সংঘ, জাতীয় গণফ্রন্ট সমর্থিত বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের কেন্দ্রীয় নেতারা বক্তব্য দিলেন। ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি আরিফুল ইসলাম, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি সাকন দুর্দান্ত বক্তব্য দিলেন। জাতীয় গণফ্রন্ট সমর্থিত বিপ্লবী মৈত্রীর খালিদের বক্তব্য শুনে ভালো লাগল। মাত্র কয়েক দিন আগে জাতীয় কমিটির ডাকা অর্ধদিবস হরতালে জেল খেটে বেরিয়েছেন খালিদ।
ছাত্রনেতাদের বক্তব্য খুব সোজা। জাতীয় সম্পদ রক্ষায় ছাত্রদের ভূমিকা কী, সেখানে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলো মাঠের লড়াইয়ে কিভাবে হাজির থাকবে_সে ঘোষণাই দিলেন তাঁরা।
আমি আগ্রহ নিয়ে শুনছিলাম ছাত্রনেতাদের বক্তব্য। ছাত্রনেতাদের বক্তব্য শেষ হলে শুরু হলো জাতীয় নেতাদের বক্তব্য। দু-একজনের বক্তব্য শুনে আমি পাশের চায়ের দোকানে দাঁড়ালাম। ঠিক এখন মনে পড়ছে না, তবে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কোনো কেন্দ্রীয় নেতা হবেন, তিনি বক্তব্য দিচ্ছিলেন। আমার কান খাড়া হয়ে গেল। আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম তাঁর বক্তব্য। আমার একাডেমিক পড়াশোনা ও একাডেমীর বাইরের পড়াশোনা দিয়ে তাঁর বক্তব্য ধরতে পারলাম না। তিনি যা বললেন, তার সোজা অর্থ হলো, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রাম আর শ্রেণীসংগ্রাম এক। তেল-গ্যাসের আন্দোলন শ্রেণীসংগ্রামের আন্দোলন।
আমার মাথার মধ্যে তখন ঘুরছে শ্রেণীতত্ত্ব, যা শুধু কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বেই কেবল হতে পারে বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের প্রশ্নে। আর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অথবা উপনিবেশবিরোধী লড়াই কি শ্রেণীসংগ্রাম? যদি তা-ই হয়, তাহলে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে যারা শ্রেণীশত্রু খতম করেছিল তাদের কেন সমালোচনা করা হয়? তাহলে কি সিপিবি শ্রেণীশত্রু খতমের লাইন নিয়েছে, তাহলে কি এ পার্টি আত্মগোপন করবে_এ ধরনের হাজারো প্রশ্ন আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল।
৩১ অক্টোবর নেত্রকোনা
গতকাল রাতে স্থানীয় স্কুলে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু আমাদের মতো যারা কোনো পার্টির সঙ্গে লংমার্চে যায়নি, তাদের অবস্থা বেশ খানিকটা কাহিল। এর ওপর সংস্কৃতির নয়াসেতুর কর্মী যিশুর শীতে গলা ফুলে গেছে। রাতে স্থানীয় কোনো হোটেলে থাকার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। এ শহরের কোনো হোটেলে সিট খালি নেই। আমাদের সঙ্গে পার্টিবিহীন পেলাম সাবেক বামপন্থী বর্তমানে উন্মোচন ব্লগের আজাদ আবুল কালাম, সাংস্কৃতিক সংগঠন নয়াসেতুর অপুকে। এই প্রথম সাংবাদিক পরিচয় ব্যবহার করতে হলো। কালের কণ্ঠের নেত্রকোনা প্রতিনিধি মিজানুর রহমান নান্নু ভাইকে ফোন দিলাম। অবশেষে তিনি একটি থাকার জায়গা জোগাড় করলেন।
আমরা দল ধরে রাতে শোওয়ার জায়গার জন্য অপেক্ষা করছি স্থানীয় এক ব্যবসায়ীর অফিসে। সেখানে নেত্রকোনার বড় বড় সব ব্যবসায়ী রয়েছেন। এর মধ্যে আমার পূর্বপরিচিত একমাত্র মিন্টু ভাই। একজন আজাদ ভাইকে প্রশ্ন করে বসলেন, 'আওয়ামী লীগ-বিএনপি সবাই খারাপ, তাহলে ভালো কে?' আজাদ ভাই কোনো রকম সংকোচ বোধ করলেন না। বললেন, 'আমরা ভালো।' তিনি আবার বললেন, 'আপনার যদি ভালো লোকই হবেন, তাহলে সংখ্যায় এত কম কেন?' এবারও আজাদ ভাইয়ের সোজা বক্তব্য, 'ইতিহাস সাক্ষী দেয় ভালো মানুষ সংখ্যায় কম থাকে।'
রাতে ঘুম ভালো হয়েছে। সকাল ১০টার মধ্যে আবারও যাত্রা শুরু।
নেত্রকোনা শহরের মধ্য দিয়ে লংমার্চ যাচ্ছে। লংমার্চে স্লোগান ধরলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিপি রাগিব আহসান মুন্না। ছোটখাটো মানুষ। এই বয়সেও গলায় তেজ আছে। এ মানুষটিকে আমি ছোটবেলায় দেখেছি আমাদের বাড়িতে। সাংগঠনিক কাজে তিনি এসেছিলেন। সে একটা সময় ছিল বামদের। এখন তো সব 'ডান' সময়।
বাদশাগঞ্জে মহাসমাবেশ ও হারিয়ে যাওয়া মানুষ
আগে থেকেই ঠিক করা ছিল, বাদশাগঞ্জে দুপুরের খাওয়ার পর সমাবেশ শুরু হবে। কিন্তু নেত্রকোনায় যেখানে দুপুরের খাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে সেখান থেকে মাইকে সিপিবিকর্মী জলি তালুকদার ঘোষণা করলেন খাবারের স্থানের নাম। লংমার্চের বহরের আগে সিপিবি সভাপতি মনজুরুল আহসান সবার আগেই ছিলেন। কিন্তু নির্ধারিত স্থানে পেঁৗছে দেখা গেল, সেখানে খাবার দেওয়া হচ্ছে না। লংমার্চের হাজার হাজার মানুষ এক ঘণ্টার ওপরে নিখোঁজ ছিলেন! এর পর খাওয়া নিয়ে ছাত্র মৈত্রী ও ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে অনভিপ্রেত ঘটনার কারণে বাদশাগঞ্জের নির্ধারিত সমাবেশে পেঁৗছতে অনেক দেরি হয়ে যায়। এ ঘটনার দায় কোনোভাবেই সিপিবি ও ওয়ার্কার্স পার্টির শীর্ষস্থানীয় নেতারা এড়াতে পারেন না।
সুনেত্র, যেখানে গ্যাস পাওয়ার প্রাথমিক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, সেখানে সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। বাদশাগঞ্জ হাই স্কুলের বিশাল মাঠ। মঞ্চে উপবিষ্ট সারি সারি জাতীয় নেতা। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ সুনেত্র ঘোষণা দিলেন।
গণংসহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক সাকি ভাইয়ের সঙ্গে শেষবারের মতো চা খেয়ে উঠে পড়লাম বাসে। দীর্ঘ লংমার্চ শেষে আমরা ঢাকার পথে রওনা দিলাম। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। হাওরে সন্ধ্যার নির্জনতা নেমে এসেছে।
জাতীয় কমিটির পতাকাবিহীন লড়াকুরা
জাতীয় কমিটিতে বিভিন্ন পার্টির কর্মী ও নেতারা রয়েছেন। এর বাইরে জাতীয় কমিটিতে বেশ কিছু তরুণ-তরুণী রয়েছেন, যাঁরা কোনো বামপন্থী রাজনৈতিক দলের কর্মী নন। এসব কর্মীর একটা অংশ কোনো পাঠচক্র, সাংস্কৃতিক সংগঠন, লাইব্রেরি আন্দোলন অথবা ব্যক্তিমানুষ। জাতীয় কমিটিতে এ ধরনের মানুষের সংখ্যা কম হলেও বাস্তবে তাঁরা একটি শক্তি। কারণ বামপন্থী রাজনৈতিক দলের বাইরে যে কোটি কোটি জনগণ, তাঁদের যদি সম্পদ বাঁচানোর এ আন্দোলনে মাঠে নামাতে হয় তাহলে এই পার্টিবিহীন, পতাকাবিহীন যেসব মানুষ জাতীয় কমিটিতে রয়েছেন, তাঁদের অংশগ্রহণকে আরো গভীর প্রজ্ঞা ও বিশ্লেষণ দিয়ে বুঝতে হবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ধরনের একটি গ্রুপ এসেছে, যারা কোনো সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নয়। তাদের মধ্যে মুনা নামের একটি মেয়েকে দেখেছি লংমার্চের চার দিনই স্লোগানের নেতৃত্ব দিতে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী আতিউর রহমান ফারুকও ছিলেন মিছিলের নেতৃত্বের অগ্রভাবে। এ ছাড়া আনহা ছিল সবার নেত্রী। মানিকগঞ্জের শহীদ রফিক স্মৃতি পাঠাগারের অনেকে এসেছিলেন।
পার্টিবিহীনদের মধ্যে অরূপ রাহী, মাহবুব রশিদ, আজাদ আবুল কালাম, প্রকৌশলী কল্লোল মুস্তফা, শাহরিয়ার সানি, মেহেদী ভাই, আতিয়া ফেরদৌসী চৈতী উল্লেখযোগ্য।
লালন কী মার্কসবাদী ছিলেন
আমি উঠেছি জাতীয় কমিটির ১১ নম্বর বাসে। এ বাসে আনু স্যার, প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, সাকি ভাইসহ অনেকে উঠেছেন। রাতে ময়মনসিংহে খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে গণসংহতি আন্দোলন। অনেক দিন পর মুরগির মাংস ও সবজি দিয়ে পেট ভরে ভাত খেলাম। এই খাওয়ার জন্যই মানুষ কত সংগ্রাম করে!
রাত ২টার পরে বাস ঢাকার উদ্দেশে ছাড়বে, যাতে ভোরবেলায় ঢাকায় পেঁৗছানো যায়। আমরা ময়নমসিংহ বাস টার্মিনালের পাশের টংঘরে বসে চা খাচ্ছি আর সমানে আড্ডা মারছি। এখানে পতাকাবিহীন, পার্টিবিহীন কর্মীর সংখ্যা বেশি। এর মধ্যে অবশ্য অবশ্য গণসংহতি আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতা ফিরোজ আহমেদ। পতাকাবিহীনদের মধ্যে মাহবুব রশিদ, আজাদ আবুল কালাম, যিশু মহম্মদ, ব্লগার পারভেজ আলম, তানজির মেহেদী উপস্থিত। ভীষণ তর্ক জমে উঠেছে। আলাপের বিষয় 'লালন'। শ্রী চৈতন্যোত্তর যে ভক্তিবাদের আন্দোলন, সেই আন্দোলনকে ইউরোপীয় জ্ঞানকাঠামো দিয়ে বিচার করতে গিয়েই নদিয়া ডিসকোর্সকে বুঝতে পারেনি। যিশু লালনকে বাউল বলতে নারাজ। যিশুর বক্তব্য, 'লালন কোথাও নিজেকে বাউল দাবি করেননি। তিনি ফকির। এই ফকির হলেন, মার্কসের সর্বহারা বা ডিক্লাস হওয়া।' ফিরোজ ভাই বললেন, 'বিষয়টি এ রকম নয়। সুধীর চক্রবর্তী আমাদের বলছেন, হিন্দু সাধকদের বাউল বলা হতো, আর মুসলিম সাধকদের ফকির বলা হতো।' অরূপ রাহী এবার নিশ্চুপ থেকে আওয়াজ তুললেন। বললেন, 'আমি সুধীর চক্রবর্তীর এ ব্যাখ্যা নিলাম না।'
বাউল ও ফকিরদের যে গুহ্য সাধনা (গোপন) রয়েছে, সেই ধারা দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনেও রয়েছে বলে বৈঠকে উপস্থিত সবাই স্বীকার করলেন। এ কারণে কমিউনিস্ট আন্দোলনে গুহ্য তত্ত্বেরও সবাই বিরোধিতা করলেন। সব কিছুই জনগণের কাছে পরিষ্কার করতে হবে, মেলে ধরতে হবে।
অবশেষে যিশু বললেন, মার্কস আসলে লালনপন্থী ছিলেন। আলাপ শেষ হলো না। তবু বাস ছাড়ার তাগিদ। আবার সেই জ্যামের-জটের ঢাকা। আবার সেই নিয়মের মধ্যে ফেরা।
No comments