কল্পকথার গল্প-দাতাদের শর্তে খরচের গর্তে by আলী হাবিব
গল্প দিয়েই শুরু করা যাক। গল্পের নায়ক হারু একটি স্কুলে পড়ে। স্কুলে শিক্ষক যখন পড়ান, হারু তখন তাকিয়ে থাকে বাইরের দিকে। খেলার মাঠ দেখে। দেখে আকাশ। একটু দূরে নদী। ক্লাসরুমে চাটাইয়ের বেড়া। নিচে মাটি। ওপরে টিনের চাল। পেছনের বেঞ্চে বসে থাকে হারু। ক্লাসে অঙ্কের শিক্ষক অঙ্ক শেখাচ্ছেন, 'গরু-গাধার দল। বুঝতে পারিসে কিছু। তোদের মাথায় গোবর। তোদের দিয়ে কিছু হবে না।
' হারুর কোনো দিকে খেয়াল নেই। সে তাকিয়ে আছে মেঝের মাটির দিকে। সেখানে একটি ইঁদুর মাটি খুঁড়ছে। হারু মনোযোগ দিয়ে তাই দেখছে। অঙ্কের দিকে তার খেয়াল নেই। শিক্ষক ক্লাসের ব্ল্যাকবোর্ডে একটা অঙ্কের সমাধান করে দিয়ে বললেন, 'মাথায় গেল কিছু? কিরে হারু, গেছে পুরোটা?' হারুর মন তো এতক্ষণ ছিল ইঁদুরের দিকে। ইঁদুরের গর্তে ঢোকা দেখছিল। সে তাড়াতাড়ি জবাব দিল, 'না স্যার, লেজটা এখনো বাইরে আছে।' ঋণের গর্তে ঢুকে আমরা এখন বাইরে শুধু লেজ নাড়াচ্ছি।
এক কবিকে নিয়ে পড়া যাক। নামেই শুধু নয়, লেখাতেও শক্তি ছিল তাঁর। লিখেছিলেন, 'যেতে পারি কিন্তু কেন যাব'। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের এই কবিতাটি বোধ হয় নিজেদের মতো করে লিখে নিয়েছেন আমাদের মহান দাতারা, 'দিতে পারি কিন্তু কেন দেবে!' এটাই এখন তাঁদের মূলমন্ত্র। দাতাদের অনেক টাকা আছে। আমাদের মতো গরিবদের সেই টাকা দিয়ে দেওয়া যেতেই পারে। পাচ্ছি আমরা। দাতাদের কাছ থেকে সাহায্য পাচ্ছি। সেই সাহায্যের টাকায় হাতে নেওয়া হচ্ছে প্রকল্প। বাস্তবায়নের চেয়ে বেশি হচ্ছে গল্প। কিন্তু আসছে, টাকা আসছে। শর্ত পূরণ করতে পারলে ভবিষ্যতেও টাকা আসবে। ভবি ভোলানোর পথ হচ্ছে, শর্ত পূরণ। শর্তের গর্তে পা দিলে তবেই আসবে ঋণ। আমাদের কাছে ধরা দেবে নতুন এক দিন। কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিতে আমরা হাতে নিতে পারব নানা প্রকল্প। যত প্রকল্প তত অর্থ। তত ঋণ নামের সাহায্য। 'আসবে যত সাহায্য/কমবে তত আহার্য'_কে যেন লিখেছেন? কবি আসাদ চৌধুরী?
কিন্তু শর্ত ছাড়া কবে কোথায় কী হয়েছে? সব কিছুর নেপথ্যে শর্ত থাকা চাই। শর্তের বাইরে যাওয়ার জো নেই। পুরনো ও প্রচলিত একটি গল্প এই ফাঁকে বলে নেওয়া যায়। একটা আইলের দুই পাশে দুটো জমি। জমির আইলে একটা তালগাছ কেমন করে যেন জন্মেছে। সেই তালগাছ নিয়ে পাশাপাশি দুই জমিঅলার মধ্যে দ্বন্দ্ব। ডাকা হলো সালিস। সাত গাঁয়ের মাতব্বররা এসে হাজির। বিবদমান দুই পক্ষের কাছে জানতে চাওয়া হলো, সালিস যা রায় দেবে, তা মেনে নিতে তাদের কোনো আপত্তি আছে কি না? দুই পক্ষই সবিনয়ে জানাল, একই কথা। উভয় পক্ষই বলে দিল, 'সালিস মানি; কিন্তু তালগাছটা আমার।' এই হলো বিষয়। হেরে যেতে কেউ তো আর রাজি নয়।
একটু পৌরাণিক আমলের দিকেই ফিরে তাকানো যেতে পারে। ট্রয়ের যুদ্ধের কাহিনীই বলা যাক। একটি সোনার আপেল নিয়ে অ্যাথেনা, হেরা ও আফ্রোদিতি_স্বর্গের তিন দেবীর মধ্যে বচসা। কে পাবেন সেই সোনার আপেল? বিচারের ভার পড়ল ট্রয়ের রাজকুমার প্যারিসের ওপর। নিরাবরণ তিন দেবী দাঁড়ালেন প্যারিসের সামনে। সবাই দাবি করছেন সোনার আপেল। শর্ত জুড়ে দিলেন নিজেরাই। প্যারিস যদি অ্যাথেনার হাতে তুলে দেন সেই সোনার আপেল, তাহলে তিনি পাবেন জ্ঞান, পারদর্শী হবেন যুদ্ধবিদ্যায়। হেরা জানালেন, তিনি আপেল পেলে তার বিনিময়ে প্যারিস হবেন রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী। আফ্রোদিতি জানালেন, তাঁকে আপেল দিলে প্যারিস বিশ্বসেরা প্রেমিক হিসেবে পরিচিতি পাবেন। বিশ্বের সুন্দরীতমা নারী হেলেনকে পাবেন তিনি। প্যারিস আপেল তুলে দিলেন আফ্রোদিতির হাতে। এর পরের ইতিহাস তো সবারই জানা। প্যারিসের শর্ত পূরণ হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ট্রয়ের জন্য বিপদের গর্ত তিনি খুঁড়েছিলেন।
ভারতীয় পুরাণেও এই শর্ত পূরণের গল্প আছে। দ্রোণাচার্যকে পাণ্ডবদের অস্ত্রবিদ্যার গুরু হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। শর্ত ছিল, তিনি শুধু পাণ্ডবদেরই অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা দেবেন। অর্জুনই হবেন অস্ত্রবিদ্যায় সবচেয়ে পারদর্শী। ওদিকে একলব্য এসেছিলেন দ্রোণের কাছে অস্ত্রবিদ্যা শিখতে। কিন্তু তিনি তো আর উচ্চবংশজাত নন। এই শর্তে বাদ পড়ে গেলেন। কিন্তু ভেঙে পড়ার মানুষ নন একলব্য। তিনি বনের ভেতরে গিয়ে দ্রোণকে গুরু মেনে, তাঁর মূর্তি তৈরি করে সেই মূর্তি সামনে নিয়ে ধনুর্বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। একদিন পাণ্ডবরা মৃগয়ায় গেলে তাঁদের সঙ্গে যাওয়া কুকুরটিকে বাণ মারেন একলব্য। বাণ মুখে নিয়ে ফিরে আসে কুকুরটি। পাণ্ডবরা যান একলব্যের কাছে। জানতে চান তাঁর গুরু সম্পর্কে। একলব্য জানান, তাঁর গুরু দ্রোণাচার্য। পাণ্ডবরা ফিরে আসেন। অর্জুন এ সম্পর্কে প্রশ্ন করেন। দ্রোণ বলেন, তিনি কাউকে ধনুর্বিদ্যা শিক্ষা দেননি। কিন্তু বনের মাঝে একলব্যকে দেখে তিনি অবাক হয়ে যান। একলব্য জানান, তিনি দ্রোণাচার্যকেই গুরু মানেন। এবার দ্রোণাচার্যের শর্ত পূরণ করতে হবে তাঁকে। দ্রোণাচার্য চাইলেন গুরুদক্ষিণা। কী সেটা। নিজের বৃদ্ধাঙ্গুলি কেটে দিতে হবে গুরুদক্ষিণা। একলব্য প্রফুল্লচিত্তে গুরুর আদেশ মেনে বৃদ্ধাঙ্গুলি কেটে নিবেদন করলেন গুরুর পায়ে। একটি প্রতিভা নষ্ট হয়ে গেল। কিন্তু যে শর্ত দিয়েছিলেন দ্রোণাচার্য, সেটা পূরণ করা হলো।
পৌরাণিক যুগ পেরিয়ে গেলেও শর্তের গর্ত পার হতে পারছি না আমরা। শর্তের জালে আমরা বন্দি। দাতাদের সঙ্গে সন্ধি করে তাদেরই বন্দনা করতে বাধ্য হই। ব্যাপারটা এমনিতে হয়তো মন্দ নয়। কিন্তু তাদের শর্ত পূরণ করতে গিয়ে আমাদের খরচের গর্ত যেমন বড় হয়, তেমনি নানা দিক থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যেতে হয় আমাদের। আজ যে শিশু জন্ম নিল, তার জন্য একটি সুন্দর দেশ রেখে যাওয়ার বদলে আমরা রেখে যাচ্ছি গুচ্ছির ঋণ। সেই ঋণ কি শোধ হবে কোনো দিন? ঋণ শোধ করার পরও তো বন্ধ করে রাখার চেষ্টা করা হয়। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশকে ঋণ দেওয়া হয় কঠিন শর্তে। ঘরে যখন অভাব, ঋণের নামে সাহায্য নিয়েই যখন চলতে হবে, তখন তা না নিয়েও তো উপায় নেই আমাদের। নিতে হচ্ছে কঠিন শর্তে ঋণ। মানতে হচ্ছে উপদেশের নামে দাতাদের সব নির্দেশ। ভর্তুকি প্রত্যাহার করে নিতে বলা হচ্ছে। নেওয়া হচ্ছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে দাতাদের নির্দেশ মেনে। ক্রয় আইন পরিবর্তন করা হচ্ছে দাতাদের পরামর্শ নামের নির্দেশে। ঋণ প্রকল্পের নামে কৃষি খাতেও বিশ্বব্যাংকের ফাঁদে পড়েছে বাংলাদেশ। আর পদ্মা সেতু নিয়ে যে নাটক হয়েছে, দেশের মানুষ তো সেই নাটকের প্রত্যক্ষদর্শী। কেন এমন হয়? দাতারা কেন অভিভাবক সাজতে চায়। কারণ টাকা। আমাদের টাকা নেই। তাদের আছে। তাদের টাকায় আমাদের চলতে হয়। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে ঋণ দেয়। এমনিতে দেয় না। সেই ঋণের বিনিময়ে তারা যথারীতি সুদও আদায় করে। এটা তাদের ব্যবসা। এই ব্যবসা বিশ্বজুড়ে করতে হয় তাদের। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যেন তাদের এই খবরদারিটা একটু বেশি মাত্রায়ই লক্ষ করা যায়। এমন বাড়াবাড়ি ধরনের সে খবরদারি যে কৃষিমন্ত্রীও সংসদে বাজেট প্রসঙ্গে আলোচনার সময় বিশ্বব্যাংককে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, 'হেদায়েত করা একটু কমান।' শিল্পমন্ত্রীও একসময় বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, 'সরকার বিশ্বব্যাংকের জনস্বার্থবিরোধী পরামর্শ মানবে না।' দেশের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর, সুশাসন ও স্বচ্ছতা বিষয়ে বিশ্বব্যাংককে অবহিত করবে সরকার। অবহিত করা নাকি কৈফিয়ত দেওয়া? দেশের পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড কম্পানি হবে কি না, সে বিষয়ে পরামর্শ দেয় বিশ্বব্যাংক। শেয়ারবাজার তো এই সময়ে দেশের আলোচিত একটি বিষয়। সেখানেও দাতাদের নাক গলাতে দেখা গেছে।
একটা গল্প বলা যাক। এক ভদ্রলোক যাচ্ছিলেন পথ দিয়ে। না, পথে ফুটপাত নেই। মোটেও ভালো বলা যায় না সে রাস্তাটিকে। এবড়োখেবড়ো রাস্তা। মাঝেমধ্যে ছোটখাটো কাদাপানির নালা। মাঠের রাস্তা। সেই রাস্তা দিয়ে ভদ্রলোক যাচ্ছিলেন। যেতে যেতে কোনো গান কি তাঁর মনে আসছিল? আসতেই পারে। কল্পনার গল্প যখন, তখন ধরে নিতেই বা আপত্তি কেন। ধরা যাক মাঠের মাঝ দিয়ে যেতে যেতে মৃদুমন্দ হাওয়ায় একটু একটু চেনা স্বরও ভাঁজছিলেন তিনি। যেতে যেতে তিনি দেখলেন সামনে একটা ছোটখাটো বাজার। তিনি ওই বাজারেই যাবেন। গল্পটা যেহেতু ওই বাজারেই শেষ হবে, কাজেই বাজারই গল্পের নায়কের গন্তব্য। ভদ্রলোক যেতে যেতে একটু বোধ হয় অন্যমনস্কও হয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ তাঁর সামনে পড়ল একটি বড় নালা। মাঠের পথ দিয়ে আসতে আসতে তিনি অনেক নালা পেরিয়ে এসেছেন। কিন্তু এ নালাটি ছিল আগেরগুলোর চেয়ে বড়। এবারে তাঁকে একটু জোরেই লাফ দিতে হলো। বিধি বাম। তিনি লাফিয়ে নালাটি পার হলেন, কিন্তু ভদ্রলোক যেমনটি আন্দাজ করেছিলেন, নালাটি তার চেয়ে বড় হওয়ায় তাঁর পরনের প্যান্টের সেলাই পেছন দিক থেকে খুলে গেল। ভদ্রলোক পড়লেন মহাবিপদে। কী করবেন তিনি এখন? তাঁর সঙ্গে অতিরিক্ত কোনো কাপড় নেই। প্যান্ট থাকলেও ওখানে চেঞ্জ করার কোনো জায়গা ছিল না। বরাত ভালো, ওই রাস্তায় তখন কোনো মানুষ ছিল না। ভদ্রলোক কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে ছোট বাজারটিতে পেঁৗছে গেলেন। নিজের আড়াল বজায় রেখে দেখে নিলেন দর্জির দোকান কোথায় আছে। এক দৌড়ে ঢুকে গেলেন সেই দর্জির দোকানে। দোকানের ট্রায়াল রুমে ঢুকে দর্জিকে বললেন তাঁর দুর্গতির কথা। বললেন, তিনি প্যান্ট খুলে দিয়ে ট্রায়াল রুমে অপেক্ষা করবেন। এই সময়ের মধ্যে প্যান্টটা সেলাই করে দিতে হবে। দর্জি খুব নির্বিকারভাবে তাঁকে জানালেন, প্যান্ট এখনই সেলাই করে দেওয়া যাবে, কিন্তু শর্ত একটাই, বিনিময়ে দিতে হবে ৩০০ টাকা। ভদ্রলোক অবাক। ব্যাপারটা স্বাভাবিক নয়। একটা প্যান্ট সেলাই করতেও তো এত টাকা লাগার কথা নয়। কিন্তু দর্জিকে অবাক করে দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, আমি আপনাকে ৬০০ টাকা দিচ্ছি, আপনি আমার প্যান্টটা সেলাই করে দিন। এবার দর্জির অবাক হওয়ার পালা। বিস্মিত দর্জি জিজ্ঞেস করলেন, আমি চাইলাম ৩০০ টাকা, আপনি ৬০০ টাকা দিতে চাইছেন কেন? ভদ্রলোক বললেন, আপনার টাকা চাওয়া শুনে আমার প্যান্টের সেলাই আরো বেশি খুলে গেছে।
এমনটিই হয়। দাতাদের শর্ত আমাদের খরচের গর্ত বড় করে দেয়। আমরা নিরুপায়। ঋণ ছাড়া আমাদের চাওয়ারও তো কিছু নেই।
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com
এক কবিকে নিয়ে পড়া যাক। নামেই শুধু নয়, লেখাতেও শক্তি ছিল তাঁর। লিখেছিলেন, 'যেতে পারি কিন্তু কেন যাব'। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের এই কবিতাটি বোধ হয় নিজেদের মতো করে লিখে নিয়েছেন আমাদের মহান দাতারা, 'দিতে পারি কিন্তু কেন দেবে!' এটাই এখন তাঁদের মূলমন্ত্র। দাতাদের অনেক টাকা আছে। আমাদের মতো গরিবদের সেই টাকা দিয়ে দেওয়া যেতেই পারে। পাচ্ছি আমরা। দাতাদের কাছ থেকে সাহায্য পাচ্ছি। সেই সাহায্যের টাকায় হাতে নেওয়া হচ্ছে প্রকল্প। বাস্তবায়নের চেয়ে বেশি হচ্ছে গল্প। কিন্তু আসছে, টাকা আসছে। শর্ত পূরণ করতে পারলে ভবিষ্যতেও টাকা আসবে। ভবি ভোলানোর পথ হচ্ছে, শর্ত পূরণ। শর্তের গর্তে পা দিলে তবেই আসবে ঋণ। আমাদের কাছে ধরা দেবে নতুন এক দিন। কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিতে আমরা হাতে নিতে পারব নানা প্রকল্প। যত প্রকল্প তত অর্থ। তত ঋণ নামের সাহায্য। 'আসবে যত সাহায্য/কমবে তত আহার্য'_কে যেন লিখেছেন? কবি আসাদ চৌধুরী?
কিন্তু শর্ত ছাড়া কবে কোথায় কী হয়েছে? সব কিছুর নেপথ্যে শর্ত থাকা চাই। শর্তের বাইরে যাওয়ার জো নেই। পুরনো ও প্রচলিত একটি গল্প এই ফাঁকে বলে নেওয়া যায়। একটা আইলের দুই পাশে দুটো জমি। জমির আইলে একটা তালগাছ কেমন করে যেন জন্মেছে। সেই তালগাছ নিয়ে পাশাপাশি দুই জমিঅলার মধ্যে দ্বন্দ্ব। ডাকা হলো সালিস। সাত গাঁয়ের মাতব্বররা এসে হাজির। বিবদমান দুই পক্ষের কাছে জানতে চাওয়া হলো, সালিস যা রায় দেবে, তা মেনে নিতে তাদের কোনো আপত্তি আছে কি না? দুই পক্ষই সবিনয়ে জানাল, একই কথা। উভয় পক্ষই বলে দিল, 'সালিস মানি; কিন্তু তালগাছটা আমার।' এই হলো বিষয়। হেরে যেতে কেউ তো আর রাজি নয়।
একটু পৌরাণিক আমলের দিকেই ফিরে তাকানো যেতে পারে। ট্রয়ের যুদ্ধের কাহিনীই বলা যাক। একটি সোনার আপেল নিয়ে অ্যাথেনা, হেরা ও আফ্রোদিতি_স্বর্গের তিন দেবীর মধ্যে বচসা। কে পাবেন সেই সোনার আপেল? বিচারের ভার পড়ল ট্রয়ের রাজকুমার প্যারিসের ওপর। নিরাবরণ তিন দেবী দাঁড়ালেন প্যারিসের সামনে। সবাই দাবি করছেন সোনার আপেল। শর্ত জুড়ে দিলেন নিজেরাই। প্যারিস যদি অ্যাথেনার হাতে তুলে দেন সেই সোনার আপেল, তাহলে তিনি পাবেন জ্ঞান, পারদর্শী হবেন যুদ্ধবিদ্যায়। হেরা জানালেন, তিনি আপেল পেলে তার বিনিময়ে প্যারিস হবেন রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী। আফ্রোদিতি জানালেন, তাঁকে আপেল দিলে প্যারিস বিশ্বসেরা প্রেমিক হিসেবে পরিচিতি পাবেন। বিশ্বের সুন্দরীতমা নারী হেলেনকে পাবেন তিনি। প্যারিস আপেল তুলে দিলেন আফ্রোদিতির হাতে। এর পরের ইতিহাস তো সবারই জানা। প্যারিসের শর্ত পূরণ হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ট্রয়ের জন্য বিপদের গর্ত তিনি খুঁড়েছিলেন।
ভারতীয় পুরাণেও এই শর্ত পূরণের গল্প আছে। দ্রোণাচার্যকে পাণ্ডবদের অস্ত্রবিদ্যার গুরু হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। শর্ত ছিল, তিনি শুধু পাণ্ডবদেরই অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা দেবেন। অর্জুনই হবেন অস্ত্রবিদ্যায় সবচেয়ে পারদর্শী। ওদিকে একলব্য এসেছিলেন দ্রোণের কাছে অস্ত্রবিদ্যা শিখতে। কিন্তু তিনি তো আর উচ্চবংশজাত নন। এই শর্তে বাদ পড়ে গেলেন। কিন্তু ভেঙে পড়ার মানুষ নন একলব্য। তিনি বনের ভেতরে গিয়ে দ্রোণকে গুরু মেনে, তাঁর মূর্তি তৈরি করে সেই মূর্তি সামনে নিয়ে ধনুর্বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন। একদিন পাণ্ডবরা মৃগয়ায় গেলে তাঁদের সঙ্গে যাওয়া কুকুরটিকে বাণ মারেন একলব্য। বাণ মুখে নিয়ে ফিরে আসে কুকুরটি। পাণ্ডবরা যান একলব্যের কাছে। জানতে চান তাঁর গুরু সম্পর্কে। একলব্য জানান, তাঁর গুরু দ্রোণাচার্য। পাণ্ডবরা ফিরে আসেন। অর্জুন এ সম্পর্কে প্রশ্ন করেন। দ্রোণ বলেন, তিনি কাউকে ধনুর্বিদ্যা শিক্ষা দেননি। কিন্তু বনের মাঝে একলব্যকে দেখে তিনি অবাক হয়ে যান। একলব্য জানান, তিনি দ্রোণাচার্যকেই গুরু মানেন। এবার দ্রোণাচার্যের শর্ত পূরণ করতে হবে তাঁকে। দ্রোণাচার্য চাইলেন গুরুদক্ষিণা। কী সেটা। নিজের বৃদ্ধাঙ্গুলি কেটে দিতে হবে গুরুদক্ষিণা। একলব্য প্রফুল্লচিত্তে গুরুর আদেশ মেনে বৃদ্ধাঙ্গুলি কেটে নিবেদন করলেন গুরুর পায়ে। একটি প্রতিভা নষ্ট হয়ে গেল। কিন্তু যে শর্ত দিয়েছিলেন দ্রোণাচার্য, সেটা পূরণ করা হলো।
পৌরাণিক যুগ পেরিয়ে গেলেও শর্তের গর্ত পার হতে পারছি না আমরা। শর্তের জালে আমরা বন্দি। দাতাদের সঙ্গে সন্ধি করে তাদেরই বন্দনা করতে বাধ্য হই। ব্যাপারটা এমনিতে হয়তো মন্দ নয়। কিন্তু তাদের শর্ত পূরণ করতে গিয়ে আমাদের খরচের গর্ত যেমন বড় হয়, তেমনি নানা দিক থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যেতে হয় আমাদের। আজ যে শিশু জন্ম নিল, তার জন্য একটি সুন্দর দেশ রেখে যাওয়ার বদলে আমরা রেখে যাচ্ছি গুচ্ছির ঋণ। সেই ঋণ কি শোধ হবে কোনো দিন? ঋণ শোধ করার পরও তো বন্ধ করে রাখার চেষ্টা করা হয়। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশকে ঋণ দেওয়া হয় কঠিন শর্তে। ঘরে যখন অভাব, ঋণের নামে সাহায্য নিয়েই যখন চলতে হবে, তখন তা না নিয়েও তো উপায় নেই আমাদের। নিতে হচ্ছে কঠিন শর্তে ঋণ। মানতে হচ্ছে উপদেশের নামে দাতাদের সব নির্দেশ। ভর্তুকি প্রত্যাহার করে নিতে বলা হচ্ছে। নেওয়া হচ্ছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে দাতাদের নির্দেশ মেনে। ক্রয় আইন পরিবর্তন করা হচ্ছে দাতাদের পরামর্শ নামের নির্দেশে। ঋণ প্রকল্পের নামে কৃষি খাতেও বিশ্বব্যাংকের ফাঁদে পড়েছে বাংলাদেশ। আর পদ্মা সেতু নিয়ে যে নাটক হয়েছে, দেশের মানুষ তো সেই নাটকের প্রত্যক্ষদর্শী। কেন এমন হয়? দাতারা কেন অভিভাবক সাজতে চায়। কারণ টাকা। আমাদের টাকা নেই। তাদের আছে। তাদের টাকায় আমাদের চলতে হয়। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে ঋণ দেয়। এমনিতে দেয় না। সেই ঋণের বিনিময়ে তারা যথারীতি সুদও আদায় করে। এটা তাদের ব্যবসা। এই ব্যবসা বিশ্বজুড়ে করতে হয় তাদের। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যেন তাদের এই খবরদারিটা একটু বেশি মাত্রায়ই লক্ষ করা যায়। এমন বাড়াবাড়ি ধরনের সে খবরদারি যে কৃষিমন্ত্রীও সংসদে বাজেট প্রসঙ্গে আলোচনার সময় বিশ্বব্যাংককে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, 'হেদায়েত করা একটু কমান।' শিল্পমন্ত্রীও একসময় বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, 'সরকার বিশ্বব্যাংকের জনস্বার্থবিরোধী পরামর্শ মানবে না।' দেশের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর, সুশাসন ও স্বচ্ছতা বিষয়ে বিশ্বব্যাংককে অবহিত করবে সরকার। অবহিত করা নাকি কৈফিয়ত দেওয়া? দেশের পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড কম্পানি হবে কি না, সে বিষয়ে পরামর্শ দেয় বিশ্বব্যাংক। শেয়ারবাজার তো এই সময়ে দেশের আলোচিত একটি বিষয়। সেখানেও দাতাদের নাক গলাতে দেখা গেছে।
একটা গল্প বলা যাক। এক ভদ্রলোক যাচ্ছিলেন পথ দিয়ে। না, পথে ফুটপাত নেই। মোটেও ভালো বলা যায় না সে রাস্তাটিকে। এবড়োখেবড়ো রাস্তা। মাঝেমধ্যে ছোটখাটো কাদাপানির নালা। মাঠের রাস্তা। সেই রাস্তা দিয়ে ভদ্রলোক যাচ্ছিলেন। যেতে যেতে কোনো গান কি তাঁর মনে আসছিল? আসতেই পারে। কল্পনার গল্প যখন, তখন ধরে নিতেই বা আপত্তি কেন। ধরা যাক মাঠের মাঝ দিয়ে যেতে যেতে মৃদুমন্দ হাওয়ায় একটু একটু চেনা স্বরও ভাঁজছিলেন তিনি। যেতে যেতে তিনি দেখলেন সামনে একটা ছোটখাটো বাজার। তিনি ওই বাজারেই যাবেন। গল্পটা যেহেতু ওই বাজারেই শেষ হবে, কাজেই বাজারই গল্পের নায়কের গন্তব্য। ভদ্রলোক যেতে যেতে একটু বোধ হয় অন্যমনস্কও হয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ তাঁর সামনে পড়ল একটি বড় নালা। মাঠের পথ দিয়ে আসতে আসতে তিনি অনেক নালা পেরিয়ে এসেছেন। কিন্তু এ নালাটি ছিল আগেরগুলোর চেয়ে বড়। এবারে তাঁকে একটু জোরেই লাফ দিতে হলো। বিধি বাম। তিনি লাফিয়ে নালাটি পার হলেন, কিন্তু ভদ্রলোক যেমনটি আন্দাজ করেছিলেন, নালাটি তার চেয়ে বড় হওয়ায় তাঁর পরনের প্যান্টের সেলাই পেছন দিক থেকে খুলে গেল। ভদ্রলোক পড়লেন মহাবিপদে। কী করবেন তিনি এখন? তাঁর সঙ্গে অতিরিক্ত কোনো কাপড় নেই। প্যান্ট থাকলেও ওখানে চেঞ্জ করার কোনো জায়গা ছিল না। বরাত ভালো, ওই রাস্তায় তখন কোনো মানুষ ছিল না। ভদ্রলোক কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে ছোট বাজারটিতে পেঁৗছে গেলেন। নিজের আড়াল বজায় রেখে দেখে নিলেন দর্জির দোকান কোথায় আছে। এক দৌড়ে ঢুকে গেলেন সেই দর্জির দোকানে। দোকানের ট্রায়াল রুমে ঢুকে দর্জিকে বললেন তাঁর দুর্গতির কথা। বললেন, তিনি প্যান্ট খুলে দিয়ে ট্রায়াল রুমে অপেক্ষা করবেন। এই সময়ের মধ্যে প্যান্টটা সেলাই করে দিতে হবে। দর্জি খুব নির্বিকারভাবে তাঁকে জানালেন, প্যান্ট এখনই সেলাই করে দেওয়া যাবে, কিন্তু শর্ত একটাই, বিনিময়ে দিতে হবে ৩০০ টাকা। ভদ্রলোক অবাক। ব্যাপারটা স্বাভাবিক নয়। একটা প্যান্ট সেলাই করতেও তো এত টাকা লাগার কথা নয়। কিন্তু দর্জিকে অবাক করে দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, আমি আপনাকে ৬০০ টাকা দিচ্ছি, আপনি আমার প্যান্টটা সেলাই করে দিন। এবার দর্জির অবাক হওয়ার পালা। বিস্মিত দর্জি জিজ্ঞেস করলেন, আমি চাইলাম ৩০০ টাকা, আপনি ৬০০ টাকা দিতে চাইছেন কেন? ভদ্রলোক বললেন, আপনার টাকা চাওয়া শুনে আমার প্যান্টের সেলাই আরো বেশি খুলে গেছে।
এমনটিই হয়। দাতাদের শর্ত আমাদের খরচের গর্ত বড় করে দেয়। আমরা নিরুপায়। ঋণ ছাড়া আমাদের চাওয়ারও তো কিছু নেই।
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com
No comments