অনুবাদ-বুদ্ধিজীবীদের দায়বদ্ধতা by নোয়াম চমস্কি

নোয়াম চমস্কি এ সময়ের একজন বিখ্যাত লেখক, দার্শনিক এবং ভাষাতত্ত্ববিদ। তিনি সাম্প্রতিক সময়ে 'বোস্টন রিভিউ'তে বুদ্ধিজীবীদের সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে এক দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর এই প্রবন্ধটির ভাষান্তর করেছেন অনিন্দ্য আরিফ। ধারাবাহিক এই প্রবন্ধটির আজ তৃতীয় পর্ব প্রকাশিত হলোপূর্ব প্রকাশের পরওই ঘটনার এক বছর পর হাইতিতে একটি উন্মুক্ত নির্বাচন হয় এবং ওয়াশিংটনকে বিস্মিত ও মর্মাহত করে সেখানকার জনগণ স্বাধীন ধর্মতত্ত্বে


বিশ্বাসী জনপ্রিয় যাজক জ্যা ব্যার্টান্ড অ্যারিস্টাইডকে নির্বাচিত করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্রমেই ওই নির্বাচিত সরকারকে দুর্বল করে তোলে এবং সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটায়। কুখ্যাত মিলিটারি জান্তা এবং এর অভিজাত সমর্থকদের প্রতি পর্যাপ্ত সমর্থন জানায়। ক্লিনটনের সময় সব আন্তর্জাতিক অনুমোদন লঙ্ঘন করে ব্যবসা-বাণিজ্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়, টেঙ্াকো তেল কম্পানিকে খুনি শাসকদের জন্য তেল সরবরাহে নিয়োজিত করা হয়, যা ছিল নিজের নির্দেশনা অবজ্ঞা করা। ২০০৪ সালে হাইতিতে যে দুটি নিপীড়নের ঘটনা ঘটে, তাতে ফ্রান্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কানাডা যোগ দেয়। তারা জোরপূর্বক আগ্রাসন চালায়। রাষ্ট্রপতি অ্যারিস্টাইডকে (যিনি আবার নির্বাচিত হয়েছিলেন) অপহরণ করে মধ্য আফ্রিকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তিনি এবং তাঁর দল ২০১০-১১-এর প্রহসনের নির্বাচনে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়।
১৯৬২ সালে আরেকটি কেনেডি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কলম্বিয়ায় অভিযান চালানোর জন্য বিশেষ বাহিনী পাঠানো হয়, যার নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল উইলিয়াম ইয়ারবুর্গ। তিনি কলম্বিয়ান নিরাপত্তা বাহিনীকে পরামর্শ দেন কিভাবে 'কমিউনিস্ট বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে প্যারামিলিটারি, অন্তর্ঘাতমূলক অথবা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা যায়।' কলম্বিয়ান মানবাধিকারবিষয়ক স্থায়ী কমিটির সম্মানিত সভাপতি দেশটির সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলফ্রেডো ভাজকুয়েজ ক্যারিজোসা কেনেডি প্রশাসনের এহেন কর্মকাণ্ড সম্পর্কে লিখেছিলেন, 'কেনেডি প্রশাসন আমাদের নিয়মিত বাহিনীকে বিদ্রোহ দমনকারী ব্রিগেডে পরিণত করেছে।' তিনি আরো লিখছেন, 'লাতিন আমেরিকায় বহিঃশত্রু মোকাবিলার নামে জাতীয় নিরাপত্তা মতবাদ হিসেবে যা পরিচিত, তা কার্যত দেশের অভ্যন্তরীণ শত্রু মোকাবিলার জন্য সামরিক স্থাপনা প্রতিষ্ঠার পথ তৈরি করা, যা ব্রাজিলিয়ান মতবাদ, আর্জেন্টিয়ান মতবাদ, উরুগুয়ে মতবাদ, কলম্বিয়ান মতবাদ হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল। এটি হলো কার্যত সমাজকর্মী, ট্রেড ইউনিয়নকর্মী, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যারাই সরকারের বিরুদ্ধে, এমনকি যাকে কমিউনিস্ট চরমপন্থী হিসেবে মনে করা হবে এবং আমার মতো মানবাধিকার কর্মীসহ যে কাউকেই নির্মূল করার অধিকার লাভ করে।'
১৯৮০ সালে লাতিন আমেরিকায় মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষজ্ঞ লার্স শুলজ দেখিয়েছেন যে লাতিন আমেরিকায় মার্কিন ঋণের প্রবণতা ছিল ওই দেশগুলোর সরকারগুলোকে তাদের জনগণকে অত্যাচার করার জন্য সহায়তা প্রদান... গোলার্ধের কুখ্যাত মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের সহায় হিসেবে এই ঋণ বিবেচিত হতো। এর মধ্যে ছিল সামরিক ঋণ, যা কার্টারের সময় থেকে দেওয়া হচ্ছিল। ১৯৮০ সালের দিকে এল সালভাদর ছিল সবচেয়ে কুখ্যাত মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী দেশ, যে এই কর্মকাণ্ডের জন্য সবচেয়ে বেশি মার্কিন সামরিক ঋণ পেত। কিন্তু এর পর পরই কলম্বিয়া সেই স্থান দখল করে এবং গোলার্ধের সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী দেশে পরিণত হয়। ভাজকুয়েজ ক্যারিজোসা নিজেই তাঁর বোগোটা বাসভবনে কঠিন সুরক্ষার মধ্যে বসবাস করতেন। আমি ২০০২ সালে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পক্ষ থেকে এক মিশনে যাওয়ার সময় তাঁর ওখানে ভ্রমণ করার সুবাদে তা দেখেছিলাম। সেটি ছিল কলম্বিয়ার বছরব্যাপী একটি প্রচারণার উদ্বোধন। বিশেষ করে তা ছিল ওই দেশটিতে গিয়ে মানবাধিকার এবং শ্রমিক কর্মকাণ্ডের ওপর ভয়াবহ যে আক্রমণ সংঘটিত হয়েছে তার বিরুদ্ধে প্রচারণা। ওই সময় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হয়েছিল দরিদ্র এবং প্রতিরক্ষাহীন জনগণ। কলম্বিয়ায় সন্ত্রাস এবং নির্যাতন সংযোজিত হয়েছিল রাসায়নিক যুদ্ধের নামে, বিশেষ করে মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যুদ্ধের অজুহাতে। কলম্বিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস সম্প্রতি প্রকাশ করেছে যে এই সময়ে এক লাখ ৪০ হাজার জনগণ প্যারামিলিটারির হাতে নিহত হয়েছে। এর সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুদান প্রাপ্ত সৈন্যবাহিনীর সহযোগিতা রয়েছে।
নরহত্যার চিহ্ন সর্বত্র। এক বছর আগে আমি যখন দক্ষিণ কলম্বিয়ার দূরবর্তী গ্রামগুলোর পাশের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন অনেক কবর দেখেছিলাম, যারা শিকার হয়েছে স্থানীয় বাসে প্যারামিলিটারি হামলার।
এটা হচ্ছে ভয়াবহ অপরাধের সংক্ষিপ্ততম বিবরণ, যার জন্য আমেরিকানরা যথেষ্ট শাস্তি পাওয়ার যোগ্য এবং এই বোধটা যদি আমাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র কাজ করে তা হলেও সহজে নিজেদের উন্নত করতে পারি। কিন্তু সরকারি শত্রুদের দুর্ব্যবহারের সাহসী প্রতিবাদের প্রশংসা করাটাই যথেষ্ট নয়, যতক্ষণ না একজন অর্থবহ বুদ্ধিজীবী বুদ্ধিবৃত্তিজাত দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দায়িত্ব গ্রহণ না করে, ততক্ষণ তাকে একটি ভালো কাজ হিসেবে গণ্য করা যায় না।
আমাদের চিন্তার রাজ্যের মধ্যে যারা অত্যাচারের শিকার, তাদের কেবল অবহেলাই করা হয় না, ভুলেও যাওয়া হয়, এমনকি নৈরাশ্যজনকভাবে অপমানিত করা হয়। এল সালভাদরে লাতিন আমেরিকান বুদ্ধিজীবীদের হত্যার কয়েক সপ্তাহ পরে একটি বিস্ময়কর সচিত্র ঘটনা আমাদের সামনে হাজির হলো। ভ্যাকলভ হ্যাভেল ওয়াশিংটন ভ্রমণে এলেন এবং কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দিলেন। হ্যাভেল ওয়াশিংটনে তাঁর পরমানন্দিত শ্রোতামণ্ডলীর সামনে 'স্বাধীনতার রক্ষক' হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অভিহিত করলেন, যে কি না 'যে দায়িত্বের বোঝা বহমান তা বুঝতে পেরেছে' এবং 'পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী জাতিতে পরিণত হয়েছে'; যারা কিনা অল্প কয়েক দিন আগে সালভাদরীয় প্রতিপক্ষকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিল।
উদারনৈতিক বুদ্ধিজীবী শ্রেণী তাঁর উপস্থাপনায় বিমুগ্ধ হয়েছিল। হ্যাভেল আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে আমরা 'রোমান্টিক যুগে' বাস করছি, অ্যান্থনি লুইস প্রবল উৎসাহে ফেটে পড়লেন। অন্য উল্লেখযোগ্য উদারনৈতিক ভাষ্যকাররা হ্যাভেলের 'আদর্শবাদ, তাঁর লৌহ দৃঢ় মনোভাব, তাঁর মানবতাবাদে' প্রচুর আনন্দ লাভ করলেন। তিনি 'স্বতন্ত্র দায়বদ্ধতার একটি কঠিন মতবাদ প্রচার করেছেন'। তখন কংগ্রেস 'স্পষ্টভাবে সম্মানের সঙ্গে' তাঁর প্রতিভা ও শুদ্ধতাকে স্মরণ করল এবং জিজ্ঞাসা করল যে আমেরিকায় বুদ্ধিজীবীর অভাব এত গভীর কেন? যিনি 'আত্মস্বার্থকে উপেক্ষা করে নৈতিকতাকে প্রাধান্য দিয়েছেন', তিনিই সেই দেশকে প্রশংসা করে মাথায় তুলেছেন, যে দেশটি বিভিন্ন দেশে অত্যাচার করে আর অঙ্গচ্ছেদকৃত লাশের স্তূপ করে দুর্দশাময় অবস্থা সৃষ্টি করেছে।
বিন লাদেনের হত্যাকাণ্ডের সামগ্রিক প্রক্রিয়াটিই বিন লাদেনের প্রতি সহানুভূতির উদ্রেক করে। অভিযান সম্পর্কে আরো কিছু কথা বলার আছে, ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে বড় ধরনের যুদ্ধের ঝুঁকি নেওয়ার ইচ্ছা ছিল এবং এমনকি যদি তা জিহাদিদের মধ্যে ফাঁস হয়ে যেত তাহলে তা বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটাত, যা আমি অন্যত্র আলোচনা করেছি। এ ছাড়া এই অভিযানের নামকরণটিও প্রশ্নসাপেক্ষ। অপারেশন জেরনিমো মেঙ্েিকাতে যথেষ্ট ক্ষোভের উদ্রেক করেছিল এবং খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আদিবাসীরাও প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ওবামা বিন লাদেনের সঙ্গে অ্যাপাচি প্রধানের তুলনার ব্যাপারটিকে আমলেই আনেননি। জেরনিমো আগ্রাসনকারীদের বিরুদ্ধে সাহসী প্রতিরোধে নেতৃত্ব দেন। তিনি সেই আগ্রাসনকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন 'যাদের লক্ষ্য ছিল নেটিভ আমেরিকানদের মতো তার জনগণকে নির্মম নিষ্ঠুরভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। ঈশ্বর এক দিন এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের বিচার করেবেন।' বলেছেন বিখ্যাত কৌশলবিদ জন কুইন্সি অ্যাডমস; যিনি সুনির্দিষ্ট পরিণতি ভোগকারী প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবীদের অন্যতম, অবশ্য এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডে স্বীয় ভূমিকার স্বীকারোক্তি অপরাধ সংঘটনের বহু দিন পর তিনি এই জবানবন্দি দিলেন। মানবনিধনকারী অস্ত্রশস্ত্রের নাম যত সহজে হতভাগ্য অসহায় শিকারের, যথা অ্যাপাচি, ব্লাকহক, চেইনি ইত্যাদি নাম অনুযায়ী করা হয়, এই নামকরণও তারই স্বাক্ষর বহন করে।... জার্মান যুদ্ধবিমান ল্যুফটওয়াফের নামকরণ যদি 'ইহুদি' এবং 'জিপসিদের' নাম অনুযায়ী করা হতো তাহলে আমাদের ভিন্ন রকম প্রতিক্রিয়া হতো।
এই 'জঘন্য হত্যাকাণ্ডকে' অস্বীকার করে কিছু রচনা প্রকাশিত হয়েছে। দুই বছর আগে পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় বাম-উদারনৈতিক বুদ্ধিবৃত্তিক সাময়িকী 'নিউইয়র্ক রিভিউ অব বুকসে' রাসেল বেকার বিখ্যাত 'বীরোচিত ঐতিহাসিক' এডমুন্ড মর্গানের কাছ থেকে একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা তৈরি করেছেন_যখন কলম্বাস এবং সমসাময়িক তথ্য আহরণের উদ্দেশ্যে ভ্রমণকারী ব্যক্তিরা আমেরিকায় এলেন তখন তাঁরা 'একটি ব্যাপক মহাদেশীয় বিরল জনগোষ্ঠীর সন্ধান পেলেন, যারা কৃষিকাজ এবং শিকারের সঙ্গে যুক্ত ছিল... একটি অবিরাম এবং অক্ষত বিশ্ব, যার বিস্তৃতি ঘটেছিল গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জঙ্গল থেকে হিমায়িত উত্তর পর্যন্ত, এখানে বড়জোর এক মিলিয়নের বেশি অধিবাসীর বাস ছিল।' অথচ লাখ লাখ মানুষ যার অন্তর্ভুক্ত ছিল, অগ্রসর সভ্য মানুষরা তা হিসাবে আনেনি। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি, অবশ্য চার মাস পরে সম্পাদক একটি সংশোধনী জারি করেন, যাতে বলা হয়েছে, উত্তর আমেরিকায় ১৮ মিলিয়ন জনগণ বসবাস করত এবং লাখ লাখ জনগণ 'গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জঙ্গল থেকে হিমায়িত উত্তর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।' অথচ এই অগ্রসর সভ্যতাকে 'নির্মম এবং বিশ্বাসঘাতক নিষ্ঠুরতার' সঙ্গে ধ্বংস করা হয়েছিল_তার উল্লেখ কোথাও করা হয়নি। এক বছর পর লন্ডন রিভিউ অব বুকসে বিখ্যাত ঐতিহাসিক মার্ক মাজওয়ার উল্লেখ করেছেন, আমেরিকানরা 'নেটিভ আমেরিকানদের প্রতি দুর্ব্যবহার করেছে।' আমরা কি এই 'দুর্ব্যবহার' শব্দটি গ্রহণ করতাম, যদি আমাদের শত্রুরা এ ধরনের অপরাধ সংঘটন করত?
(চলবে)

No comments

Powered by Blogger.