সুরমা নদীর গাঙচিল by ফকির আলমগীর

পমহাদেশের প্রখ্যাত গণসঙ্গীত শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মৃত্যুর ২৪ বছর পূর্ণ হলো আজ ২২ নভেম্বর। উপমহাদেশের জনগণের নতুন সংস্কৃতি আন্দোলনের এই পুরোগামী সৈনিক যদিও জন্মেছিলেন পূর্ব বাংলায় অথচ তিনি আজ এ অঞ্চলের প্রায় বিস্মৃত। ১৯১২ সালের ১৪ ডিসেম্বর বৃহত্তর সিলেটের হবিগঞ্জের মীরাশি গ্রামে শিক্ষিত জমিদার পরিবারে হেমাঙ্গ বিশ্বাস জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩০ সালে স্বদেশী আন্দোলন করার জন্য বিতাড়িত হন মুরারিচাঁদ কলেজ থেকে,


কারাবাস করেন আড়াই বছর ধরে। আক্রান্ত হন যক্ষ্মায়। ১৯৩৮-৩৯-এ তার গানে মজুর কিষানের কথা এসে যায়। সুরে এবং কথায় স্পষ্ট নজরুলী ছাপ নিয়ে লিখেছিলেন_ আগে চল মজুর-কিষান/সমর শিবিরে শোন হাঁকিছে কিষান। তিনি সারা জীবন গান করেছেন গণমানুষের জন্য। কখনোই পুঁজির দাসত্বে পরিণত হননি। 'আজকাল' পত্রিকায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, 'আমি গান গাইব। আমারে কে আটকাইবে। আমার বিশ্বাস আছে, আমি একা ফাইট কইরা যামু। অস্তিত্বের সংকটে ভুগি না আমি। তাহলে অনেক গণ্ডা ক্যাসেট, রেকর্ড করতে পারতাম। আমি মানুষেরে বিশ্বাস করি। তারা অকৃতজ্ঞ নয়। সুরমা নদীর গাঙচিল আমি শূন্যে দিলাম উড়া।' সেই সুরমা উপত্যকার গাঙচিল ডানা ভেঙে কলকাতায় পড়লেও তার মন পড়েছিল এই বাংলায়। তিনি বলতেন, ধান আর গানে একটা অদ্ভুত মিল আছে। কৃষকরা যখন ধানের জন্য লড়াই করে তখন এমনিতেই গান বেরিয়ে আসে। তাই তো চলি্লশের দশক থেকে নবজীবনের সঙ্গে সে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সঙ্গীতজীবনের শুরু। তেভাগা আন্দোলনের পথ বেয়ে তেলেঙ্গানার পথে মাউন্ডব্যাটন মঙ্গলকাব্যে তার সঙ্গীত জীবনের সফল পরিণতি।
উপমহাদেশে ছয় দশককালব্যাপী সময়কালে কমিউনিস্ট আন্দোলনে যতগুলো গর্ব করার মতো সাফল্য ও অনুসরণীয় দৃষ্টান্তের স্মারক নির্মিত হয়েছে তার মধ্যে অতি উজ্জ্বল একটি নাম হচ্ছে হেমাঙ্গ বিশ্বাস। তিনি ছিলেন উপমহাদেশের জনগণের সংগ্রামের সন্তান। তিনি নিজভূমে ফের এসেছিলেন ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। উঠেছিলেন শ্রমিকনেতা নজরুল ইসলাম খানের গোপীবাগের বাসায়। বাংলাদেশে ঘুরে যাওয়ার ক্ষেত্রে বদরুদ্দীন উমরের সহযোগিতা ছিল। নজরুল ভাইয়ের সঙ্গে হেমাঙ্গদার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। তিনি স্বাধীনভাবে ঢাকাসহ বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে অনুষ্ঠান করেছেন। সফরসঙ্গী ছিলেন তার পরিচালনাধীন দি মাস সিঙ্গার্সের সাথী শিল্পী রত্না সরকার, প্রীতি চৌধুরী, মিঠুন মুখার্জি, টুংকু সরকার ও দীপক পাত্র। মুক্তিযুদ্ধকালে আমি হেমাঙ্গদার আজগর মিস্ত্রি লেনের বাসায় কয়েক মাস অতিথি ছিলাম। সে সময়ে তার কাছ থেকে গান শেখার পাশাপাশি অনেক কিছু জানার সুযোগ ঘটেছিল। সেই থেকে হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে আমি গুরু বলে জ্ঞান করতাম। সেই দাবিতেই আমার প্রতি নির্দেশ ছিল সফরকালে আমি যেন সর্বক্ষণ সঙ্গে থাকি এবং কয়েকজন যন্ত্রশিল্পীর ব্যবস্থা করি। ডাকসুর তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আক্তারুজ্জামানসহ ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর কয়েকজন সদস্য বিমানবন্দরে হেমাঙ্গদাকে অভ্যর্থনা জানাই। এ ছাড়া ২১ ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরিতে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের সেই স্মৃতি কোনোদিন ম্লান হবে না। কারণ ঐতিহাসিক 'ঢাকার ডাকের' শিল্পীর সঙ্গে শহীদবেদিতে ফুল দেওয়ার ভাগ্য ক'জনার হয়! ঢাকার ২৭টি সাংস্কৃতিক সংগঠন সমন্বয়ে গর্বিত 'গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট' হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে সংবর্ধনা দিয়েছিল ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে। ফ্রন্টের সভাপতি ড. আহমদ শরীফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে এই সংবর্ধনা সভায় আমার নিবন্ধ পাঠ করার সৌভাগ্য হয়েছিল। তাই অনুষ্ঠানে হেমাঙ্গ বিশ্বাস সদলবলে গণসঙ্গীত পরিবেশন করে মুগ্ধ শ্রোতা-দর্শকদের বিস্মিত করেছিলেন। এ ছাড়া জাতীয় প্রেস ক্লাব, টিএসসি সড়কদ্বীপ, টঙ্গী এবং জয়দেবপুরের শিল্পাঞ্চলে গণসঙ্গীত পরিবেশন করে মাতিয়ে গিয়েছিলেন। আরও কয়েকটি সাংস্কৃতিক সংগঠন আলাদাভাবে তাকে সংবর্ধনা দিয়েছিল, এর মধ্যে আলতাফ মাহমুদ সঙ্গীত বিদ্যানিকেতন, উন্মেষ, পূবালী ব্যাংক কর্মচারী পরিষদ উল্লেখযোগ্য। তিনি দেখতে গিয়েছিলেন তার পৈতৃক ভিটা হবিগঞ্জের মীরাশি গ্রাম। এটাই ছিল তার শেষবারের মতো জন্মভূমি দেখা। জয়দেবপুরে তিনি বিশেষ আগ্রহ নিয়ে গিয়েছিলেন কবি গোবিন্দ দাস ও কবিয়াল গুরু হরি আচার্যের ভিটা দেখতে। তিনি সেদিন গোবিন্দ দাসের একটি গান সংগ্রহ করে আমাকে দিয়েছিলেন, 'স্বদেশ স্বদেশ করছো যারে, এ দেশ তোমার নয়।' সেই ঘরছাড়া বাউল যখন জন্মভূমি স্পর্শ করে ঘরের মায়া খুঁজে পেল, তখন নতুন প্রাণশক্তি নিয়ে আবার যখন বিলের বুকে ডালা মেলা হিজল গাছের ছায়ায় প্রাণ জুড়াতে আসার স্বপ্ন দেখল, ঠিক সেই মুহূর্তে সবার মায়ার বন্ধন ছিন্ন করে পরপারে চলে গেলেন। রেখে গেলেন তার নবজীবনের গান_
'আমি ভাঙা বাংলার তার ছেঁড়া
এক সুরহারা বাউল।'

ফকির আলমগীর :গণসঙ্গীত শিল্পী

No comments

Powered by Blogger.