ফারজানা’র এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারঃ বিয়ের আসরে যৌতুকলোভীকে `না` বলেছি by মাহমুদ মেনন
ফারজানা ইসলাম নিপা, বরগুনা জেলার আমতলীর মেয়ে। বিয়ের আসরে যৌতুকের দাবির প্রতিবাদ করে বিয়ে ভেঙ্গে দেওয়ায় গত কয়েক দিন ধরে তাকে নিয়ে সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা চলছে। এনিয়ে বরপক্ষ দুটি জিডি করেছে। সাংবাদিক সম্মেলন করে কনেপক্ষের ওপর বিভিন্নভাবে দোষ চাপিয়েছে। তার খবরও প্রকাশিত হয়েছে সংবাদ মাধ্যমে কিন্তু কী বলছেন ফারজানা নিপা নিজে? বাংলানিউজের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন বিস্তারিত।
বাংলানিউজ: মিডিয়ায় প্রকাশিত খবর নিয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
ফারজানা: আমাকে নিয়ে অনেক আলোচনা চলছে। কেউ কেউ আমাকে খুব সাহসী ভূমিকা পালনের জন্য প্রশংসা করেছেন। কিন্তু জীবনের এমন একটি সময় আমি পার করছি যখন এসব প্রশংসায় আনন্দিত হয়ে ওঠার সুযোগ নেই। কিন্তু আমি বলবো তারপরেও আমি আনন্দিত। আনন্দিত এই কারণে যে, সঠিক সময়ে সঠিক একটি সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছি। বিয়ের আসরেই একজন ভদ্রতার লেবাসে যৌতুক লোভী লম্পটকে ও তার পরিবারকে `না` বলে দিতে পেরেছি। খুলে ফেলতে পেরেছি গহনা, ছুঁড়ে দিতে পেরেছি বিয়ের শাড়ি।
বাংলানিউজ: ছেলেপক্ষ আপনার পরিবারের ওপর দোষ চাপাচ্ছে। আপনার মতামত কী?
ফারজানা: এখন অনেক রকমের চেষ্টা চলছে আমার পরিবারের ওপর দোষ চাপানোর। বলা হচ্ছে- আমি ও আমার পরিবার বিয়ের সামগ্রী নিয়ে কথা তুলেছি। এটা তাদের অপরাধ ঢাকার চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়। হিরণ নামের লোকটি আমার বিরুদ্ধে তিন চার রকমের কথা বলছেন। কোথাও বলা হচ্ছে, আমি ও আমার পরিবার লোভী, কোথাও বলা হচ্ছে আমার আগে অ্যাফেয়ার ছিলো, কোথাও বলছে ঘটনার জন্য আমার এক দুলাভাই দায়ী। কিন্তু আমি বলবো লোভী আমি নই, লোভী হিরণ নিজে ও তার পরিবার--- বিশেষ করে তার স্কুলশিক্ষিকা ফুফু।
বাংলানিউজ: বিয়ের দিনের ঘটনাটি খুলে বলবেন কী?
ফারজানা: বিয়ের উদ্দেশ্যে গত ১০ অক্টোবর আমি ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে আসি। সেদিনই আমার বিয়ের জন্য দেখাদেখি হয়। সেখান থেকেই শুরু হয় এ কাহিনি। দেখাদেখি ও উভয় পক্ষের পছন্দের ভিত্তিতেই বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়। তারিখ ১১.১১.১১। বরপক্ষের দাবি: ওইদিন সকাল ১১টা ১১ মিনিট ১১ সেকেন্ডে বিয়ে পড়ানো হবে। অদ্ভূত ও একই সঙ্গে মজারই মনে হয়েছিলো সে দাবি। নিজেও মনে মনে ভাবছিলাম মন্দ কী , হাজার বছরেও সংখ্যা গণনায় যে ক্ষণটি আসবে না তেমন একটি ক্ষণে বিয়ে হবে। আমিও ভেতরে ভেতরে বিয়ে নিয়ে ছিলাম উত্তেজিত।
এদিকে বিয়ের আয়োজন এগোচ্ছে। ছেলেপক্ষ প্রথম দিকে বলে আসছিলো বিয়েতে তাদের কোনো চাহিদা নেই। সেটিও একটি ভালো দিক মনে হচ্ছিলো। আমার বাবা বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের পরিদর্শক, সামান্য চাকুরে, তার একমাত্র সম্পদ আমরা ভাইবোন ও আমাদের শিক্ষা। নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে আমাদের শিক্ষা ও সামাজিক মর্যাদাই সম্বল। আমার বিয়ের জন্য বাবা তার জমি বিক্রি করেছেন। বরপক্ষকে আপ্যায়নের জন্য যোগাড়যন্ত্র চলছে হাতে সময় কম। মাত্র বিশ দিন। দেখতে দেখতে সে সময় পার হলো। শুরু হলো বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা। গায়েহলুদ করতে ছেলে পক্ষের বাড়িতে কিছু সরঞ্জাম নিয়ে বাবা গেলেন সেখানে বাবার নিয়ে যাওয়া সামগ্রীগুলো কমদামি বলে কথা উঠলো। দু’চার কথা সরাসরি শুনিয়েও দেওয়া হলো। আমার গরীব অথচ আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন বাবা তা নিরবে হজম করলেন। বাড়িতে ফিরে আমাদেরও জানতে দিলেন না। পরে জানলাম; যখন বিয়ে ভেঙ্গে গেছে তখন তিনি বিষয়টি জানালেন। এই কথাগুলো এখন বলছি কিন্তু হয়তো কখনোই বলতাম না যদি না তাদের আসল চেহারা ফুটে উঠতো।
বিয়ের দিনের প্রসঙ্গে আসি। সেদিন সকাল ১১টা ১১ মিনিট ১১ সেকেন্ডেই আমাদের বিয়ের কাবিন হয়। স্থানীয় একটি মসজিদে। দক্ষিণাঞ্চলের অনেক এলাকাতেই এমনও রেওয়াজ বিয়ের আকদ বা কাবিন বর বা কনে কোনো পক্ষের বাড়িতে নয়, মাঝামাঝি স্থান কোনো মসজিদে হয়। আমাদের বেলায়ও তা-ই হলো। বাবা আত্মীয়-স্বজন নিয়ে মসজিদে যাওয়ার আগে আমার সম্মতি নিয়ে গেলেন এবং বিয়ে হয়ে গেলো। এরপর ওইদিনই ছেলেপক্ষ এলো আমাদের বাড়িতে। বাড়ির উঠোনে প্যান্ডেল টানিয়ে বিয়ের সব আয়োজন। সেখানে বর-কনের জন্য মঞ্চ করা হয়েছে। আমার মধ্যবিত্ত বাবা তার সাধ্যের সবটুকু ঢেলে দিয়ে তার সঙ্গে আন্তরিকতা মিশিয়ে আয়োজন করেছেন খাবারের। বরপক্ষ খাওয়া দাওয়াও করেছে। এই বরযাত্রীর দলে ছিলেন বরের ফুফু। তিনি জেনেছি একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। এখানে বলে রাখি, যার সঙ্গে আমার বিয়ে হয় তিনিও একজন শিক্ষক বটেন। এই ফুফুই বিয়ের আয়োজনের এদিক সেদিক ঘুরছিলেন আর বারবার একটি কথা বলছিলেন কই কোথাও তো কোনো কিছু দেখছি না, এরা কি মেয়ের সঙ্গে আর কিছুই দেবে না। এক পর্যায়ে তিনি কথাগুলো সরাসরি পাড়লেন আমার এক আত্মীয়ের সঙ্গে। তাকে বললেন, আমরা না হয় বলেছি কিছু নেবো না, তাই বলে কি তারাও কিছু দেবে না! এরা কী শুধু মেয়েকেই বিদায় করতে চায়। এটা কোন ধরনের সামাজিকতা! ইত্যাদি ইত্যাদি।
কথাগুলো খুব দ্রুত ছড়াতে থাকে। এক সময় শোনা যায় ওঠে ছেলেপক্ষ যৌতুকের জন্য চাপ দিচ্ছে। আমার কানেও এসে পৌঁছায় সে কথা। বিয়ের কনে সেজে শাড়ি পরে ঘামছি এমন সময় এমন কিছু কথা কানে আসাতে সমস্ত শরীরই যেনো শীতল হয়ে আসছিলো। জানা যায় ছেলেপক্ষ ফ্রিজ, টিভি, খাট এসব পেতে চায়।
এভাবে এক-দুই কথা ক্রমেই বাড়তে থাকে আর আমি মঞ্চে বসে ঘামতে থাকি। একপর্যায়ে দেখি বর আমার পাশ থেকে উঠে গেলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি এসে আমাকে চুপে চুপে কিন্তু রাগতস্বরে বললেন, ‘এদের থামতে বলো এবং আমার ফুফুর কাছে মাফ চাইতে বলো নইলে অঘটন ঘটবে।’
আমি কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। চুপ করে বসে আছি। ছেলেপক্ষের আরও কয়েকজন ততক্ষণে উত্তেজিত। দেখিয়ে দেবো, এটা করবো, সেটা করবো এমন সব কথা চলছে। বর প্রথম আলোর বন্ধুসভার সদস্য। তার পক্ষে অনেক কিছুই করা সম্ভব। আমার বেচারা বাবা ছেলেপক্ষকে কিছুই বলতে পারছেন না। ঘটনার এ পর্যায়ে ছেলের ফুফু চলে এলেন মঞ্চের সামনে, এসে বললেন, বিয়ে তো হয়েই গেছে। এখন কিছু করার নেই। আমরা এই মেয়েকে বাপের বাড়িতেই পাঁচ বছর ফেলে রাখবো। তখন এরা বুঝবে ঠ্যালা কাকে বলে। আজ মেয়ে তুলে নেওয়া হবে না।’
এ কথাগুলো শুনে আমি বরের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলার তার চোখেমুখেও যেনো একই কথার সায়। আমি মনে মনে তখন অনেক কিছু ভাবলাম। এমন একটি ছেলের সংসারে গিয়ে আমি কি সুখী হতে পারবো? আমাকে যদি পাঁচ বছর বাবার বাড়িতে ফেলে রাখা হয় তখন কি হবে? আমার মস্তিষ্ক দ্রুত কাজ করতে থাকলো। মনে হচ্ছিলো এখনই একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়। এবং সিদ্ধান্তটি নিলাম। এক ঝটকায় আমি উঠে পড়লাম, মঞ্চ ছেড়ে বের হয়ে গেলাম। খুলে ফেললাম বিয়ের গহনা, ছুড়ে ফেললাম শাড়ি। বলে দিলাম এ বিয়ে আমি মানি না। এ স্বামীর সংসার আমি করবো না।
বাংলানিউজ: এমন একটি সিদ্ধান্ত কি আপনাকে বিচলিত করে?
ফারজানা: আত্মীয় স্বজনের পক্ষ থেকে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছিলো। ছেলে পক্ষ ভুল বুঝতে পেরে ন্যাকামি করলো অনেক রাত পর্যন্ত এবং শেষ পর্যন্ত আমার অনড় সিদ্ধান্তে তারা চলে গেলো। এবং বের হয়েই প্রথম যে কাজটি করলো তা আরও ন্যক্কারজনক। আমাদের বিরুদ্ধে দুটি জিডি করলো থানায়। এরপর জন্ম দিতে থাকলো একের পর এক ন্যক্কারজনক ঘটনার। এরই মধ্যে বিষয়টি গণমাধ্যমে এসে পড়লে ছেলেপক্ষ নিজের পিঠ বাঁচাতে জন্ম দিতে থাকলো নতুন নতুন গল্পের। এসবের একটি হচ্ছে, আমার পরিবার নেইল পলিশের রিমুভার চিনতে পারেনি। তা নিয়ে কথা বলেছে। এরই মধ্যে ফেসবুকে আমার নামে বাজে মন্তব্য লেখা হয়েছে। একটি মানুষ কতটা অমানুষ হলে এ কাজ করতে পারে তা যে কারো পক্ষেই বোঝা সম্ভব।
বাংলানিউজ: বর এখনো আপনাকে তার বৈধ স্ত্রী দাবি করছেন আপনার বক্তব্য কী?
ফারজানা: এখন শুনছি এই লোক নিজেকে আমার স্বামী দাবি করে বলছেন আমাদের বিয়ে নাকি এখনো টিকে আছে। একটি পুরুষ তার স্ত্রীকে তালাক বললে আমাদের সমাজে তা তালাক হয়ে যায় কিন্তু আমি যে শত শত মানুষের সামনে এ বিয়ে ভেঙ্গে দিলাম তাতে কি বিয়ে ভাঙ্গেনি। তাহলে কেনো এখনো এই দাবি?
বরপক্ষের এখন সামাজিক সম্মানে চোট লেগেছে বলে হুঁশ হয়েছে। কিন্তু যৌতুক চাওয়ার সময়, তা নিয়ে ঝগড়া করার সময় তো তাদের হুঁশ ছিলো না। আমি শুধু একটি কথাই বলবো, এই ছেলে ও তার পরিবার সামাজিকভাবে আমাকে ও আমার পরিবারকে যতটা হেয় করার চেষ্টা করবে ততটাই নিচে নামবে সে নিজে ও তার পরিবার।
বাংলানিউজ: বিষয়টির একটি ইতিবাচক সমাধানের দিকে যেতে পারে কী?
ফারজানা: ঘটনার পর আজ আট দিন পার হয়ে গেলো, ছেলেপক্ষ তাদের দোষ স্বীকার করলো না। কাগজে-কলমের সম্পর্কের দোহাই দিয়ে কোনো লাভ নেই। আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল। আমি এরই মধ্যে এ নিয়ে আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেছি। আমি চাই আমার নিজের জীবনে যে ঘটনাটি ঘটে গেলো সমাজের আর দশটি মেয়ের ক্ষেত্রে যাতে এমনটি না ঘটে। আর একটি কথা বলতে চাই ছেলেরা যেন মেয়েদের কখনোই তাদের প্রতিপক্ষ না ভাবে।
বাংলানিউজ: ভবিষ্যৎ নিয়ে কী ভাবছেন?
ফারজানা: আমি অবশ্যই এগিয়ে যাবো সামনে যতই বাধা আসুক। আমি আমার নিজের ও বাবার স্বপ্ন পূরণ করবো। হারবো না কিছুতেই।
ফারজানা: আমাকে নিয়ে অনেক আলোচনা চলছে। কেউ কেউ আমাকে খুব সাহসী ভূমিকা পালনের জন্য প্রশংসা করেছেন। কিন্তু জীবনের এমন একটি সময় আমি পার করছি যখন এসব প্রশংসায় আনন্দিত হয়ে ওঠার সুযোগ নেই। কিন্তু আমি বলবো তারপরেও আমি আনন্দিত। আনন্দিত এই কারণে যে, সঠিক সময়ে সঠিক একটি সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছি। বিয়ের আসরেই একজন ভদ্রতার লেবাসে যৌতুক লোভী লম্পটকে ও তার পরিবারকে `না` বলে দিতে পেরেছি। খুলে ফেলতে পেরেছি গহনা, ছুঁড়ে দিতে পেরেছি বিয়ের শাড়ি।
বাংলানিউজ: ছেলেপক্ষ আপনার পরিবারের ওপর দোষ চাপাচ্ছে। আপনার মতামত কী?
ফারজানা: এখন অনেক রকমের চেষ্টা চলছে আমার পরিবারের ওপর দোষ চাপানোর। বলা হচ্ছে- আমি ও আমার পরিবার বিয়ের সামগ্রী নিয়ে কথা তুলেছি। এটা তাদের অপরাধ ঢাকার চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়। হিরণ নামের লোকটি আমার বিরুদ্ধে তিন চার রকমের কথা বলছেন। কোথাও বলা হচ্ছে, আমি ও আমার পরিবার লোভী, কোথাও বলা হচ্ছে আমার আগে অ্যাফেয়ার ছিলো, কোথাও বলছে ঘটনার জন্য আমার এক দুলাভাই দায়ী। কিন্তু আমি বলবো লোভী আমি নই, লোভী হিরণ নিজে ও তার পরিবার--- বিশেষ করে তার স্কুলশিক্ষিকা ফুফু।
বাংলানিউজ: বিয়ের দিনের ঘটনাটি খুলে বলবেন কী?
ফারজানা: বিয়ের উদ্দেশ্যে গত ১০ অক্টোবর আমি ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে আসি। সেদিনই আমার বিয়ের জন্য দেখাদেখি হয়। সেখান থেকেই শুরু হয় এ কাহিনি। দেখাদেখি ও উভয় পক্ষের পছন্দের ভিত্তিতেই বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়। তারিখ ১১.১১.১১। বরপক্ষের দাবি: ওইদিন সকাল ১১টা ১১ মিনিট ১১ সেকেন্ডে বিয়ে পড়ানো হবে। অদ্ভূত ও একই সঙ্গে মজারই মনে হয়েছিলো সে দাবি। নিজেও মনে মনে ভাবছিলাম মন্দ কী , হাজার বছরেও সংখ্যা গণনায় যে ক্ষণটি আসবে না তেমন একটি ক্ষণে বিয়ে হবে। আমিও ভেতরে ভেতরে বিয়ে নিয়ে ছিলাম উত্তেজিত।
এদিকে বিয়ের আয়োজন এগোচ্ছে। ছেলেপক্ষ প্রথম দিকে বলে আসছিলো বিয়েতে তাদের কোনো চাহিদা নেই। সেটিও একটি ভালো দিক মনে হচ্ছিলো। আমার বাবা বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের পরিদর্শক, সামান্য চাকুরে, তার একমাত্র সম্পদ আমরা ভাইবোন ও আমাদের শিক্ষা। নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে আমাদের শিক্ষা ও সামাজিক মর্যাদাই সম্বল। আমার বিয়ের জন্য বাবা তার জমি বিক্রি করেছেন। বরপক্ষকে আপ্যায়নের জন্য যোগাড়যন্ত্র চলছে হাতে সময় কম। মাত্র বিশ দিন। দেখতে দেখতে সে সময় পার হলো। শুরু হলো বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা। গায়েহলুদ করতে ছেলে পক্ষের বাড়িতে কিছু সরঞ্জাম নিয়ে বাবা গেলেন সেখানে বাবার নিয়ে যাওয়া সামগ্রীগুলো কমদামি বলে কথা উঠলো। দু’চার কথা সরাসরি শুনিয়েও দেওয়া হলো। আমার গরীব অথচ আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন বাবা তা নিরবে হজম করলেন। বাড়িতে ফিরে আমাদেরও জানতে দিলেন না। পরে জানলাম; যখন বিয়ে ভেঙ্গে গেছে তখন তিনি বিষয়টি জানালেন। এই কথাগুলো এখন বলছি কিন্তু হয়তো কখনোই বলতাম না যদি না তাদের আসল চেহারা ফুটে উঠতো।
বিয়ের দিনের প্রসঙ্গে আসি। সেদিন সকাল ১১টা ১১ মিনিট ১১ সেকেন্ডেই আমাদের বিয়ের কাবিন হয়। স্থানীয় একটি মসজিদে। দক্ষিণাঞ্চলের অনেক এলাকাতেই এমনও রেওয়াজ বিয়ের আকদ বা কাবিন বর বা কনে কোনো পক্ষের বাড়িতে নয়, মাঝামাঝি স্থান কোনো মসজিদে হয়। আমাদের বেলায়ও তা-ই হলো। বাবা আত্মীয়-স্বজন নিয়ে মসজিদে যাওয়ার আগে আমার সম্মতি নিয়ে গেলেন এবং বিয়ে হয়ে গেলো। এরপর ওইদিনই ছেলেপক্ষ এলো আমাদের বাড়িতে। বাড়ির উঠোনে প্যান্ডেল টানিয়ে বিয়ের সব আয়োজন। সেখানে বর-কনের জন্য মঞ্চ করা হয়েছে। আমার মধ্যবিত্ত বাবা তার সাধ্যের সবটুকু ঢেলে দিয়ে তার সঙ্গে আন্তরিকতা মিশিয়ে আয়োজন করেছেন খাবারের। বরপক্ষ খাওয়া দাওয়াও করেছে। এই বরযাত্রীর দলে ছিলেন বরের ফুফু। তিনি জেনেছি একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। এখানে বলে রাখি, যার সঙ্গে আমার বিয়ে হয় তিনিও একজন শিক্ষক বটেন। এই ফুফুই বিয়ের আয়োজনের এদিক সেদিক ঘুরছিলেন আর বারবার একটি কথা বলছিলেন কই কোথাও তো কোনো কিছু দেখছি না, এরা কি মেয়ের সঙ্গে আর কিছুই দেবে না। এক পর্যায়ে তিনি কথাগুলো সরাসরি পাড়লেন আমার এক আত্মীয়ের সঙ্গে। তাকে বললেন, আমরা না হয় বলেছি কিছু নেবো না, তাই বলে কি তারাও কিছু দেবে না! এরা কী শুধু মেয়েকেই বিদায় করতে চায়। এটা কোন ধরনের সামাজিকতা! ইত্যাদি ইত্যাদি।
কথাগুলো খুব দ্রুত ছড়াতে থাকে। এক সময় শোনা যায় ওঠে ছেলেপক্ষ যৌতুকের জন্য চাপ দিচ্ছে। আমার কানেও এসে পৌঁছায় সে কথা। বিয়ের কনে সেজে শাড়ি পরে ঘামছি এমন সময় এমন কিছু কথা কানে আসাতে সমস্ত শরীরই যেনো শীতল হয়ে আসছিলো। জানা যায় ছেলেপক্ষ ফ্রিজ, টিভি, খাট এসব পেতে চায়।
এভাবে এক-দুই কথা ক্রমেই বাড়তে থাকে আর আমি মঞ্চে বসে ঘামতে থাকি। একপর্যায়ে দেখি বর আমার পাশ থেকে উঠে গেলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি এসে আমাকে চুপে চুপে কিন্তু রাগতস্বরে বললেন, ‘এদের থামতে বলো এবং আমার ফুফুর কাছে মাফ চাইতে বলো নইলে অঘটন ঘটবে।’
আমি কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। চুপ করে বসে আছি। ছেলেপক্ষের আরও কয়েকজন ততক্ষণে উত্তেজিত। দেখিয়ে দেবো, এটা করবো, সেটা করবো এমন সব কথা চলছে। বর প্রথম আলোর বন্ধুসভার সদস্য। তার পক্ষে অনেক কিছুই করা সম্ভব। আমার বেচারা বাবা ছেলেপক্ষকে কিছুই বলতে পারছেন না। ঘটনার এ পর্যায়ে ছেলের ফুফু চলে এলেন মঞ্চের সামনে, এসে বললেন, বিয়ে তো হয়েই গেছে। এখন কিছু করার নেই। আমরা এই মেয়েকে বাপের বাড়িতেই পাঁচ বছর ফেলে রাখবো। তখন এরা বুঝবে ঠ্যালা কাকে বলে। আজ মেয়ে তুলে নেওয়া হবে না।’
এ কথাগুলো শুনে আমি বরের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলার তার চোখেমুখেও যেনো একই কথার সায়। আমি মনে মনে তখন অনেক কিছু ভাবলাম। এমন একটি ছেলের সংসারে গিয়ে আমি কি সুখী হতে পারবো? আমাকে যদি পাঁচ বছর বাবার বাড়িতে ফেলে রাখা হয় তখন কি হবে? আমার মস্তিষ্ক দ্রুত কাজ করতে থাকলো। মনে হচ্ছিলো এখনই একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়। এবং সিদ্ধান্তটি নিলাম। এক ঝটকায় আমি উঠে পড়লাম, মঞ্চ ছেড়ে বের হয়ে গেলাম। খুলে ফেললাম বিয়ের গহনা, ছুড়ে ফেললাম শাড়ি। বলে দিলাম এ বিয়ে আমি মানি না। এ স্বামীর সংসার আমি করবো না।
বাংলানিউজ: এমন একটি সিদ্ধান্ত কি আপনাকে বিচলিত করে?
ফারজানা: আত্মীয় স্বজনের পক্ষ থেকে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছিলো। ছেলে পক্ষ ভুল বুঝতে পেরে ন্যাকামি করলো অনেক রাত পর্যন্ত এবং শেষ পর্যন্ত আমার অনড় সিদ্ধান্তে তারা চলে গেলো। এবং বের হয়েই প্রথম যে কাজটি করলো তা আরও ন্যক্কারজনক। আমাদের বিরুদ্ধে দুটি জিডি করলো থানায়। এরপর জন্ম দিতে থাকলো একের পর এক ন্যক্কারজনক ঘটনার। এরই মধ্যে বিষয়টি গণমাধ্যমে এসে পড়লে ছেলেপক্ষ নিজের পিঠ বাঁচাতে জন্ম দিতে থাকলো নতুন নতুন গল্পের। এসবের একটি হচ্ছে, আমার পরিবার নেইল পলিশের রিমুভার চিনতে পারেনি। তা নিয়ে কথা বলেছে। এরই মধ্যে ফেসবুকে আমার নামে বাজে মন্তব্য লেখা হয়েছে। একটি মানুষ কতটা অমানুষ হলে এ কাজ করতে পারে তা যে কারো পক্ষেই বোঝা সম্ভব।
বাংলানিউজ: বর এখনো আপনাকে তার বৈধ স্ত্রী দাবি করছেন আপনার বক্তব্য কী?
ফারজানা: এখন শুনছি এই লোক নিজেকে আমার স্বামী দাবি করে বলছেন আমাদের বিয়ে নাকি এখনো টিকে আছে। একটি পুরুষ তার স্ত্রীকে তালাক বললে আমাদের সমাজে তা তালাক হয়ে যায় কিন্তু আমি যে শত শত মানুষের সামনে এ বিয়ে ভেঙ্গে দিলাম তাতে কি বিয়ে ভাঙ্গেনি। তাহলে কেনো এখনো এই দাবি?
বরপক্ষের এখন সামাজিক সম্মানে চোট লেগেছে বলে হুঁশ হয়েছে। কিন্তু যৌতুক চাওয়ার সময়, তা নিয়ে ঝগড়া করার সময় তো তাদের হুঁশ ছিলো না। আমি শুধু একটি কথাই বলবো, এই ছেলে ও তার পরিবার সামাজিকভাবে আমাকে ও আমার পরিবারকে যতটা হেয় করার চেষ্টা করবে ততটাই নিচে নামবে সে নিজে ও তার পরিবার।
বাংলানিউজ: বিষয়টির একটি ইতিবাচক সমাধানের দিকে যেতে পারে কী?
ফারজানা: ঘটনার পর আজ আট দিন পার হয়ে গেলো, ছেলেপক্ষ তাদের দোষ স্বীকার করলো না। কাগজে-কলমের সম্পর্কের দোহাই দিয়ে কোনো লাভ নেই। আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল। আমি এরই মধ্যে এ নিয়ে আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেছি। আমি চাই আমার নিজের জীবনে যে ঘটনাটি ঘটে গেলো সমাজের আর দশটি মেয়ের ক্ষেত্রে যাতে এমনটি না ঘটে। আর একটি কথা বলতে চাই ছেলেরা যেন মেয়েদের কখনোই তাদের প্রতিপক্ষ না ভাবে।
বাংলানিউজ: ভবিষ্যৎ নিয়ে কী ভাবছেন?
ফারজানা: আমি অবশ্যই এগিয়ে যাবো সামনে যতই বাধা আসুক। আমি আমার নিজের ও বাবার স্বপ্ন পূরণ করবো। হারবো না কিছুতেই।
No comments