সুদানে গৃহযুদ্ধের আড়ালে আসলে কী হচ্ছে, কেনই-বা এ রক্তক্ষয়ী সংঘাত

সুদানের কোরদোফান অঞ্চলের আবেই এলাকায় জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর ঘাঁটিতে সন্ত্রাসীদের হামলায় বাংলাদেশের ছয় সেনাসদস্য নিহত ও আটজন আহত হয়েছেন। প্রায় আড়াই বছর ধরে সুদানে চলা যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন দেড় লক্ষাধিক মানুষ। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন আরও লাখ লাখ। প্রায় দুই কোটি মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন। এর মধ্যে ৬০ লাখের মতো মানুষ দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতিতে রয়েছেন।

আফ্রিকার সোনা ও জ্বালানি তেলসমৃদ্ধ দেশ সুদানে ২০২৩ সালে নতুন করে এ গৃহযুদ্ধের শুরু। সরকারি বাহিনী সুদানিজ আর্মড ফোর্সেস (এসএএফ) ও বিদ্রোহী আধা সামরিক বাহিনী র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (আরএসএফ) ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়েই মূলত এ যুদ্ধ।

আরএসএফের বিরুদ্ধে গণহত্যা, জাতিগত হত্যা এবং নারী ও শিশুদের ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। আরএসএফ ও এসএএফের পক্ষে-বিপক্ষে জড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের নানা দেশ। জাতিসংঘ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, সুদানে এ মুহূর্তে বিশ্বের সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর মানবিক বিপর্যয় চলছে।

কেন এ গৃহযুদ্ধ

সুদানে সংঘাতের ইতিহাস দীর্ঘদিনের। সংঘাতের শুরুটা সেই ২০১৯ সালে। তখন এক সামরিক অভ্যুত্থানে দেশটির দীর্ঘদিনের সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরের পতন হয়। তবে এ সামরিক অভ্যুত্থানের আগে থেকে বশিরের প্রায় তিন দশকের শাসন অবসানের দাবিতে সুদানে বিক্ষোভ হচ্ছিল। বশিরের পতনের পরও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে সুদানে সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ চলতে থাকে।

বশিরের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এসএএফপ্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান ও আরএসএফের প্রধান জেনারেল হামদান দাগালো, যিনি ‘হেমেদতি’ নামে বেশি পরিচিত। সফল সামরিক অভ্যুত্থানের পর গঠিত সরকারে প্রেসিডেন্ট হন বুরহান। হেমেদতি হন বুরহানের ডেপুটি।

বুরহান ও হেমেদতির মধ্যে বিরোধ

একটা সময় পর দেশ কীভাবে পরিচালিত হবে এবং বেসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা নিয়ে বুরহান ও হেমেদতির মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। বলা হয়ে থাকে, হেমেদতির দাবি ছিল, আরএসএফের এক লাখ সদস্যকে সেনাবাহিনীতে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত করতে হবে। এরপর নতুন বাহিনীর নেতৃত্ব থাকবে তাঁর হাতে।

কিন্তু হেমেদতির এ প্রস্তাব নিয়ে বুরহানের মনে সন্দেহ দানা বাঁধে। তাঁর আশঙ্কা হয়, হেমেদতি তাঁকে কৌশলে সরিয়ে দিতে চাইছেন। এ পরিস্থিতিতে দুজনের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয়।

সাম্প্রতিকতম গৃহযুদ্ধের শুরু

এমন একটি উত্তপ্ত সময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আরএসএফ সদস্যদের মোতায়েন করা হয়। সেনাবাহিনী এটিকে হুমকি হিসেবে দেখে। প্রতিক্রিয়ায় এসএএফ সদস্যদের রাজধানী খার্তুমের রাস্তায় নামানো হয়। কয়েক দিনের উত্তেজনা শেষে ২০২৩ সালের ১৫ এপ্রিল খার্তুমে টানা অনেকগুলো বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। শুরু হয় তীব্র বন্দুকযুদ্ধ।

কোন পক্ষে আগে বন্দুক চালিয়েছে, তা নিয়ে এসএএফ ও আরএসএফ সদস্যদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ রয়েছে।

আরএসএফ যোদ্ধা কারা

আরএসএফ গঠিত হয়েছিল ২০১৩ সালে। মূলত জানজাবিদ মিলিশিয়া বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে এটি গঠন করা হয়। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে বশিরই তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন। বিদ্রোহীদের পরাস্ত করতে বশির সরকারের পক্ষে তারা দারফুরে দীর্ঘদিন লড়াই করে। তাদের বিরুদ্ধে ওই অঞ্চলে কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান ও অ-আরব জনগোষ্ঠীর ওপর জাতিগত হত্যা চালানোর অভিযোগ ওঠে।

একপর্যায়ে হেমেদতির আরএসএফ বাহিনী ব্যাপক শক্তিশালী হয়ে ওঠে। পরে তারা ইয়েমেন ও লিবিয়ার সংঘাতেও অংশ নেয়। বলা হয়ে থাকে, ওই সময় থেকে হেমেদতি সুদানের কিছু সোনার খনি নিয়ন্ত্রণ করতেন এবং আহরণ করা সোনা সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) পাচার করতেন।

ইউএইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ, উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশটি আরএসএফকে অস্ত্র সরবরাহ করে। দেশটির ড্রোন নিয়েই তারা সম্প্রতি সুদানে সাফল্য পেয়েছে। কিন্তু ইউএই আরএসএফকে অস্ত্র সরবরাহের অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

আরএসএফের সাফল্য

গত জুনে আরএসএফ লিবিয়া ও মিসর সীমান্তে সুদানের বেশ কিছু অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। গত অক্টোবরের শেষ দিকে গুরুত্বপূর্ণ আল-ফাশের এলাকা দখল করে তারা। আল–ফাশের ছিল সুদানের সরকারি সেনাদের সর্বশেষ শক্তিশালী ঘাঁটি। আল–ফাশেরের মধ্য দিয়ে প্রায় পুরো দারফুর অঞ্চল আরএসএফের নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে।

বর্তমানে দারফুরের পার্শ্ববর্তী কোরদোফায় মনোযোগ দিয়েছে আরএসএফ। দক্ষিণ সুদানের সীমান্তবর্তী এ অঞ্চলেই এখন ব্যাপক ড্রোন হামলা চালাচ্ছে আরএফএফ।

সম্প্রতি বুরহান সরকারের সমান্তরাল বিদ্রোহী সরকার ঘোষণা করেছেন হেমেদতি। তাই আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২০১১ সালের পর সুদান হয়তো দ্বিতীয়বারের মতো ভাগ হতে যাচ্ছে।

বুরহান সরকারের নিয়ন্ত্রণ

বুরহানের নেতৃত্বাধীন এসএএফ উত্তর ও পূর্ব সুদানের বেশির ভাগ অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। মিসরই তাদের প্রধান সমর্থক। নীল নদের পানির ভাগাভাগি নিয়ে মিসর তাদের ওপর নির্ভরশীল।

লোহিত সাগরের তীরবর্তী পোর্ট সুদানে নিজের সদর দপ্তর চালু করেছেন বুরহান। তাঁর সরকারকে সুদানের বৈধ সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ।

কিন্তু পোর্ট সুদান কত দিন টিকে থাকবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ, গত মার্চে সেখানে ভয়াবহ ড্রোন হামলা চালিয়েছিল আরএসএফ। এ হামলার পেছনে কারণ, ওই মাসে রাজধানী খার্তুমের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে তারা। সুদানের প্রেসিডেন্টের ভবন রিপাবলিকান প্যালেসও এসএফের দখলে চলে গিয়েছিল। সাম্প্রতিকতম গৃহযুদ্ধের শুরুর দিকে এটি আরএসএফ দখল করেছিল।

খার্তুম দখলের ক্ষেত্রে এসএএফ ড্রোনের ব্যাপক ব্যবহার করেছে। বলা হয়, এসব ড্রোন ইরান থেকে গেছে।

[তথ্যসূত্র: বিবিসি, দ্য গার্ডিয়ান ও গ্লোবাল কনফ্লিক্ট ট্র্যাকার]

আরএসএফের হামলার মুখে বাস্তুচ্যুত মানুষ এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় চলে যাচ্ছেন। উত্তর দারফুরের তাওয়িলা শহর, ১৫ এপ্রিল ২০২৫
আরএসএফের হামলার মুখে বাস্তুচ্যুত মানুষ এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় চলে যাচ্ছেন। উত্তর দারফুরের তাওয়িলা শহর, ১৫ এপ্রিল ২০২৫ ছবি: রয়টার্স

No comments

Powered by Blogger.