বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি

পাঠক, সহজেই বুঝবেন শিরোনামটি রবিঠাকুরের একটি জনপ্রিয় গানের প্রথম কলি। শুষ্ক হৃদয় নিয়ে যখন নর-নারী দাঁড়িয়ে আছেন, তখন বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারিকে স্বাগত জানানোরই কথা। খবরের কাগজ খুললে বিভিন্ন খারাপ খবর মনটা বিষিয়ে দেয়। বিশেষ করে, কোনো কোনো কর্মকর্তাকে নিয়ে গণমাধ্যম যেসব তথ্য পরিবেশন করে তা লজ্জাজনক। কেউ পাথরকোয়ারিতে বোমামেশিন ব্যবহার করতে গিয়ে স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে টাকা নেন। কেউ অফিসে বসে ঘুষ নেন গুনে গুনে। সেবাদানকারী সংস্থাগুলোতে মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। দূরের কথা বাদ থাক, রাজধানী ঢাকার খাল-বিল, নদী-নালা, সরকারি উন্মুক্ত প্রান্তর দখল হয়ে যাচ্ছে। মনে হয় দেখার কেউ নেই। মাঝেমধ্যে উচ্ছেদ অভিযান হয় বটে, তবে থাকে না তার ধারাবাহিকতা। ফলে প্রভাব হয় ক্ষণস্থায়ী। পরিবহনব্যবস্থায় নৈরাজ্য জনজীবনে বড় ধরনের বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। লাখ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে রাজপথে। সীমিত সম্মানজনক ব্যতিক্রম বাদ দিলে গড়ে স্কুল-কলেজগুলোতে শিক্ষার মান নিম্নমুখী। বলতে গেলে কোচিং সেন্টারনির্ভর হয়ে পড়েছে গোটা শিক্ষাব্যবস্থা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা যতটা হয়, তার চেয়ে বেশি হয় ছাত্র-শিক্ষকদের রাজনীতি।
সরকারি হাসপাতালগুলোর পেছনে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হলেও রোগী সেবা পায় না। মফস্বলে থাকেন না বেশির ভাগ সরকারি ডাক্তার। অথচ বেতন নেন রাজকোষ থেকে। সাগর-রুনি, মিতু আর তনু হত্যার তদন্ত–প্রক্রিয়া একরূপ অচল হয়ে পড়ে আছে। সরকারি এমনকি বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে জালিয়াতিতে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের তো কোনো হিসাবই নেই। ঋণখেলাপিরা বরং বুক ফুলিয়ে চলেন সমাজে। রাজনৈতিক অঙ্গনে অনৈক্য পীড়াদায়ক। আবার অন্য দিকে উগ্র জঙ্গিবাদ আমাদের সব অর্জনকে ম্লান করতে তৎপর। ভালো খবরও আছে অনেক। বৈরী পরিবেশে এ দেশের কৃষক খাদ্য উৎপাদনে চমক সৃষ্টিকারী অবদান রাখছেন। তেমনটা ঘটছে পোলট্রি ও মৎস্য উৎপাদনে। আর ঘটতে যাচ্ছে পশুপালনেও। এগুলোতে সরকারের নীতিসহায়তা ছাড়াও রয়েছে বৈষয়িক প্রণোদনা। তৈরি পোশাকশিল্প খাত ক্রমবিকাশমান। প্রচুরতর কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। এখানে উদ্যোক্তা ও শ্রমিক শ্রেণির যৌথ প্রয়াস আর সরকারি সহায়তার সমন্বয় ঘটেছে। তবে পরিবেশ বিপন্ন হয়ে পড়ছে দেশটির। আমরা অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হচ্ছি। কিন্তু দেশে বেঁচে থাকা যাবে কি না—এ নিয়ে সংশয়বাদীদের দোষ দেওয়া যাবে না। সংরক্ষিত বনভূমি বিরান করে ফেলা হয়েছে অনেকাংশে। সামাজিক বনায়নের কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর সুফলও মিলছে ক্ষেত্রবিশেষে। তবে এ ক্ষেত্রে শুধু লাভজনক বৃক্ষরোপণের প্রবণতায় জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। সমতল করে ফেলা হয়েছে পাহাড় কেটে।
সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতায় ভুগছে দেশের প্রধান প্রধান সব শহর। এ ক্ষেত্রে কিছু কিছু মানুষ তাঁর ক্ষুদ্র বলয় থেকে বিচ্ছিন্ন প্রয়াস চালাচ্ছেন পরিস্থিতির অবনতি রোধে কিংবা উন্নতি ঘটাতে। সেগুলোও গণমাধ্যম গুরুত্ব দিয়েই জনগণের নজরে আনে। থাকে কিছু আশাজাগানো ঘটনাও। সেই সংখ্যাও একেবারে কম নয়। কোনো কোনোটি তো আলোড়নও তুলেছে জনজীবনে। আর এর একটি স্থান নেওয়ার কথা গিনেস বুকে, বিশ্ব রেকর্ডের দাবি নিয়ে। ঘটনাটি আপাতদৃষ্টিতে খুব বড় না-ও হতে পারে। কিন্তু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে এর সুফল ভেবে যে কেউ চমৎকৃত হবেন। দেশের নিম্নতম প্রশাসনিক ইউনিট উপজেলা। এর প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও)। দেশের প্রত্যন্ত জেলা রংপুরের একটি উপজেলা তারাগঞ্জ। এর ইউএনওর নেতৃত্বে একটি দুঃসাধ্য কাজ সম্পন্ন হয়েছে অতি সম্প্রতি। সেই উপজেলায় সাধারণ মানুষকে তিনি সংগঠিত করেছেন। সহায়তা নিয়েছেন স্থানীয় নেতাদের। উপজেলা পর্যায়ের অন্য কর্মকর্তাদের নিয়েছেন আস্থায়। আর নিরঙ্কুশ প্রেরণা ও সমর্থন পেয়েছেন জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারের। প্রথম আলোর প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে ইউএনও একটি পরিকল্পনা নেন ‘সবুজ তারাগঞ্জ গড়ি’ নামে। পরিকল্পনা করেন,
এক ঘণ্টায় আড়াই লাখ গাছ লাগাবেন তারাগঞ্জের বিভিন্ন রাস্তার পাশে। এ সংখ্যার কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা দেওয়া হয় যে এক ঘণ্টায় ২ লাখ ২৩ হাজার ৩৯০টি গাছ লাগিয়ে গিনেস রেকর্ড করেছে ফিলিপাইন। ইউএনও সেই সংখ্যা ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে অগ্রসর হন। গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে স্থান পাওয়া একটি সম্মানজনক বিষয়। গিনেস বুক অব রেকর্ডস নামে মানুষের শ্রেষ্ঠ কার্যক্রম ও অসাধারণ প্রাকৃতিক বিষয়াদি অন্তর্ভুক্ত করে ১৯৫৫ সাল থেকে প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রের জিম প্যাটিসন গ্রুপ কর্তৃক প্রকাশিত হয়ে আসছে। ১৯৯৮ সালে এসে এর বিষয়বস্তু ও প্রকাশনা পদ্ধতি অপরিবর্তিত রেখে নাম দেওয়া হয় গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড। এই বইটিই একটানা ৬২ বছর ধরে অবিতর্কিতভাবে সব সময়ের সেরা প্রকাশনার মর্যাদা লাভ করেছে। একজন ইউএনওর এতে স্থান পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমাদের পুলকিত করে। এতে স্থান হোক আর না হোক, এ ধরনের সাংগঠনিক প্রতিভাও কিন্তু চমক সৃষ্টিকারী। প্রশাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানেন ইউএনওরা মূলত বৈরী পরিবেশে কাজ করেন। তাঁদের ওপর প্রায় ক্ষেত্রেই কারণে-অকারণে ছড়ি ঘোরান স্থানীয় সাংসদ। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানরা তো আছেনই। আর বিভিন্ন জনপ্রতিনিধির ক্ষমতার দ্বন্দ্বের দায়ও অনেক ক্ষেত্রে ইউএনওর ওপর বর্তায়। উপজেলায় দ্বৈত কর্তৃত্বের সৃষ্টি হওয়ায় তাঁরা একটি নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করেন।
তাই দায়িত্ব নিয়ে নতুন কোনো সৃজনশীল কাজে হাত দিতে থাকেন দ্বিধান্বিত। এ অবস্থাকেও নিজের অনুকূলে এনে সব মহলের সমর্থনে অনেক বড় কাজ করা যায়, তারই একটি নজির সৃষ্টি করলেন তারাগঞ্জের ইউএনও জিলুফা সুলতানা। এটা তাঁর অন্য সহকর্মীদের জন্যও প্রেরণা হয়ে থাকবে। তিনি সবুজ তারাগঞ্জ গড়ার একটি প্রচেষ্টা নিয়েছেন। কাজটি করেছেন কিন্তু সেই উপজেলার মানুষ। এখন ইউএনও তাঁদের বিবেচনা করছেন সত্যিকারের তারকা হিসেবে। ১৫৩টি রাস্তায় ৪০ প্রজাতির আড়াই লাখ গাছ রোপণে অংশ নিয়েছেন সমাজের সব স্তরের মানুষ। নারী ও পুরুষ, যুবা-কিশোর ও বৃদ্ধ, শিক্ষক-কর্মচারী, খেতমজুর থেকে শুরু করে সবাই। তাঁরা এ উপজেলাকে স্বপ্নের উদ্যান হিসেবে গড়তে চান। ভোরে ফজরের নামাজের পর সব মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়। তত্ত্বাবধায়কেরা বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে ড্রামে শব্দ তুলতেই গর্ত খুঁড়ে গাছের চারা লাগানো শুরু করেন তাঁরা। এর আগেই সব সাংগঠনিক প্রস্তুতি ছিল। প্রস্তুত ছিল গাছের চারাও। সেই গাছ পরিবেশবান্ধবও বটে। আম, কাঁঠাল, আতা, বেল, জলপাই, জামরুল, লটকন, আমলকী, নিম, অর্জুনসহ সবই দেশীয় প্রজাতির। এগুলো বড় হলে বৃক্ষনির্ভর প্রাণিকুল সহায়ক হবে। মানুষের জন্য হবে বড় সম্পদ। তবে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে পরিবেশ। সন্দেহ নেই, তারাগঞ্জের খবরটির ন্যায় বিভিন্ন পরিসরে আরও অনেক প্রচেষ্টা চলছে।
সেই সব প্রচেষ্টাকে খাটো করে দেখারও সুযোগ নেই। এসব সাফল্যের মধ্যে তারাগঞ্জবাসী বিভিন্ন কারণে একটি বিশেষ অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। আর এটা সংগঠিত করেছেন একজন সরকারি কর্মকর্তা। এতসংখ্যক গাছের চারা জোগাড় থেকে শুরু করে সমাজের সব মানুষকে সংশ্লিষ্ট করা সহজসাধ্য নয়। আর গোটা সমাজ যেখানে সংশ্লিষ্ট, তখন এর সাফল্য তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও অমূলক মনে হয়। ইউএনও একটি বদলিযোগ্য চাকরি। তিনি ইতিমধ্যে এক বছর পার করেছেন তারাগঞ্জে। হয়তো থাকবেন আরও কিছুদিন। এই সময়কালেই গাছগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা তিনি নিতে পারবেন এমনটা আশা করেন। গিনেস বুকে স্থান পেলেন কি না, এটা আমাদের প্রধান বিবেচ্য নয়। আমরা দেখলাম সদিচ্ছা থাকলে আর কুশলী হলে অনেক বড় কাজেও গোটা সমাজকে সম্পৃক্ত করা যায়। আর তা করতে পারেন ইউএনও পর্যায়ের একজন কনিষ্ঠ কর্মকর্তাও। রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলা স্বপ্নের উদ্যান হবে বলে তাঁর এ আশাবাদের সঙ্গে তো গোটা সমাজই অংশীদার। তারাগঞ্জবাসীর এ সম্মিলিত উদ্যোগ আমাদের অসংখ্য হতাশার মধ্যে অবশ্যই বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.