শিক্ষকদের লাগাতার আন্দোলনে স্থবির স্কুল-কলেজ- চাকরি জাতীয়করণ দাবিতে প্রেসক্লাবের সামনে রাস্তা দখল করে শিক্ষকদের বিক্ষোভ কর্মসূচী by বিভাষ বাড়ৈ
নন-এমপিও প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্তির দাবিতে শিক্ষক-কর্মচারীদের আন্দোলন তিন মাসের জন্য স্থগিত হলেও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারল না শিক্ষাঙ্গন।
এমনকি দীর্ঘ ২৮ বছর পর প্রায় পাঁচ লাখ এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীর বাড়িভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা বৃদ্ধির পরেও বছরের শুরুতেই অস্থিরতার মুখে পড়েছে সারাদেশের এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। নতুন ইস্যু চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে এবার লাগাতার আন্দোলনে ভেঙ্গে পড়েছে সারাদেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা কার্যক্রম। টানা দুই সপ্তাহের ধর্মঘটে জিম্মি হয়ে পড়েছে লাখ লাখ শিক্ষার্থী। এদিকে অধিকাংশ শিক্ষক সংগঠন সম্মত থাকলেও সাধারণ শিক্ষকদের উস্কে দিয়ে অস্থিরতা সৃষ্টির অভিযোগ উঠেছে বিএনপিপন্থী এক শিক্ষক সংগঠনের বিরুদ্ধে। তবে মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজ জাতীয়করণ দাবি কতটুকু বাস্তবসম্মত তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংশ্লিষ্টদের বুঝতে হবে প্রাথমিক শিক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সবার আগে তা নিশ্চিত করা জরুরী। মাধ্যমিকে চাকরি জাতীয়করণ দাবি শিক্ষানীতি ও বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, শিক্ষকরা আমাদের সম্মানিত ব্যক্তি। তারা আমাদের জাতি গঠনের কারিগর। শিক্ষকদের মনে রাখতে হবে বর্তমান সরকার এক সঙ্গে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য যত সুবিধা নিশ্চিত করেছে অতীতে কোন সরকার তা করেনি। রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষমতা বাস্তবতাও আমাদের বুঝতে হবে। বিএনপিপন্থী শিক্ষক সংগঠন শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোটের নেতাদের আন্দোলনের নামে রাজনৈতিক বক্তব্যের সমালোচনা করে তিনি বলেন, সুুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির পরেও এখন চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে তাদের আন্দোলনের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির পরেও আন্দোলন করাকে ‘অবাস্তব’ আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, আন্দোলনের নামে সাধারণ শিক্ষক-কর্মচারীদের বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। প্রাইমারী আর মাধ্যমিক বা কলেজ এক নয়। প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক। আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষকদের উদ্দেশে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ২৮ বছর ধরে শিক্ষকরা ১০০ টাকা বাড়িভাড়া, ১৮ বছর ধরে ১৫০ টাকা চিকিৎসা ভাতায় চলছেন। ১ জানুয়ারি থেকে সরকার প্রায় ৫ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর বাড়িভাড়া ও চিকিৎসা-ভাতা বাড়িয়েছে। যাঁরা ক্ষমতায় থাকাকালীন শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য এক টাকাও বৃদ্ধি করেননি, তাঁদের মিথ্যা আশ্বাসে বিভ্রান্ত না হয়ে ক্লাসে ফিরে যান। এদিকে গত তিনদিন ধরে রাজধানীতে কর্মসূচী থেকে বিএনপিপন্থ’ী শিক্ষক নেতারা সরকার ও শিক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে প্রগতিশীল শিক্ষক সংগঠনগুলোর মাঝে। এই সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দ ঘটনার তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন, আমরাও জাতীয়করণ চাই তবে সাধারণ শিক্ষকদের রাজধানীতে এনে জড়ো করে নিজের রাজনৈতিক শোডাউন আর ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ দেশের শিক্ষা আন্দোলনকে বিতর্কিত করার ষড়যন্ত্র। এর মাধ্যমে শিক্ষক সমাজকে অপমান করার হচ্ছে। শিক্ষক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ জাতীয়করণের দাবি তুললেও আন্দোলনের নামে নেতাদের রাজনীতি করার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। পরিষদের আহ্বায়ক শিক্ষক নেতা আলী আহমেদ, ড. নূর মোহাম্মদ তালুকদার, অধ্যক্ষ মোঃ শাহজাহান আলম সাজু এবং সমন্বয়কারী রঞ্জিত কুমার সাহা, অধ্যক্ষ মোঃ জাহাঙ্গীর ও অধ্যক্ষ এ.কে.এম মোকছেদুর রহমান এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেছেন, বাংলাদেশ শিক্ষক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের উদ্যোগে ১২ জানুয়ারি থেকে অবিরাম ধর্মঘট চলছে। কিন্তু ২৩ জানুয়ারি প্রেসক্লাবের সামনে শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়া অশিক্ষক সুলভভাবে শিক্ষানীতি ২০১০ প্রসঙ্গে বিভ্রান্তিকর তথ্য ও শিক্ষামন্ত্রীকে উদ্দেশ করে অসৌজন্যমূলক ও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেছেন। এ ধরনের বক্তব্য চলমান শিক্ষা আন্দোলন ভিন্ন খাতে প্রভাবিত করার গভীর ষড়যন্ত্র বলে ঐক্য পরিষদ মনে করে। সেলিম ভূঁইয়া তাঁর বক্তব্যে বলেন শিক্ষানীতি-২০১০ বাস্তবায়ন হলে তিন লাখ শিক্ষক চাকরি হারাবে। এ তথ্য সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর বরং শিক্ষানীতি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়িত হলে কয়েক লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। নেতৃবৃন্দ সেলিম ভূঁইয়ার এ ধরনের বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। এ ধরনের বক্তব্য প্রদান থেকে তাঁকে বিরত থাকার জন্য সেলিম ভূঁইয়ার প্রতি আহ্বান জানান তাঁরা।
এর আগে গত ৯ জানুয়ারি জাতির জনকের ঘোষণার দীর্ঘ চার দশক পর ২৬ হাজারেরও বেশি বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৪০ বছর পর এমন ঘোষণাকে দেশের শিক্ষার উন্নয়নে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত হিসেবে অভিহিত করেছেন শিক্ষাবিদসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু এ উদ্যোগ যেন জাগিয়ে তুলেছে বেসরকারী মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজের শিক্ষক সংগঠনগুলোকে। তবে শিক্ষানীতিতে শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, জাতীয় জীবনে প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব অত্যধিক। দেশের সব মানুষের শিক্ষার আয়োজন এবং জনসংখ্যাকে দক্ষ করে তোলার ভিত্তিমূল প্রাথমিক শিক্ষা। তাই মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণের জন্য জাতিসত্তা, আর্থ-সামাজিক, শারীরিক-মানসিক সীমাবদ্ধতা এবং ভৌগোলিক অবস্থান নির্বিশেষে দেশের সকল শিশুর জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। এ কাজ করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। রাষ্ট্রের দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে, সকলের জন্য মৌলিক শিক্ষা নিশ্চিত করার তাগিদ সংবিধানে বিধৃত আছে। তাই প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব এবং রাষ্ট্রকেই এই দায়িত্ব পালন করতে হবে। বলা হয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জাতীয়করণ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। প্রাথমিক শিক্ষার দায়িত্ব বেসরকারী বা এনজিও খাতে হস্তান্তর করা যাবে না। কোন ব্যক্তি বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠান বা কোন এনজিও প্রাথমিক শিক্ষা পরিচালনা করতে চাইলে তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে রাষ্ট্রীয় বিধি-বিধান পালন করে করতে হবে। সরকারের প্রাথমিক শিক্ষার একটি বড় অংশের জাতীয়করণের ঘোষণাকে সংবিধান ও শিক্ষানীতির সবচেয়ে বড় প্রতিফলন বলে মনে করে বিশেষজ্ঞরা। তবে এবার জাতীয়করণসহ বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে সরকারকে চাপে ফেলতে বেসরকারী মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষকদের সব সংগঠন এখন আন্দোলনের মাঠে। এমপিওভুক্ত ও এমপিওবিহীন, সরকার সমর্থক ও সরকারবিরোধী সব শিক্ষক সংগঠন ভিন্ন ভিন্ন দাবি নিয়ে প্রতিদিন কর্মসূচী পালন করছে। শিক্ষক সংগঠনগুলোর দুটি বড় মোর্চার ডাকে ১০ জানুয়ারি সকাল থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট চলছে। শিক্ষাবর্ষের শুরুতে এসব প্রতিষ্ঠানে ক্লাস না হওয়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন অভিভাবকরা। শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৯ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারী রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো জাতীয়করণের ঘোষণায় তারা আশান্বিত। তারা মাধ্যমিক ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও জাতীয়করণ দেখতে চান। ধর্মঘটী কয়েক শিক্ষক নেতা বলেন, বেসরকারী শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকারী অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অথচ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার শতকরা ৯৭ ভাগই বেসরকারী। দীর্ঘদিন বিভিন্ন শিক্ষক-কর্মচারী সংগঠনের ব্যানারে চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলন হলেও সরকারের পক্ষ থেকে তাদের সে দাবি মানা হয়নি। যার কারণে তাঁরা বাধ্য হয়ে ধর্মঘট পালন করছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, রাজধানীর শীর্ষস্থানীয় কিছু সরকারী ও বেসরকারী স্কুল-কলেজে দায়সারাভাবে পাঠদান কার্যক্রম অব্যাহত আছে, যেগুলোতে শিক্ষক নেতাদের দাপট কিছুটা কম। গ্রাম, মফস্বল কিংবা জেলা পর্যায়ের বেশিরভাগ বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ধর্মঘট চলছে। শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে চলমান আন্দোলন বেগবান ও দীর্ঘ করারও হুমকি দিয়েছেন শিক্ষক নেতারা। কিন্তু এই সঙ্কট নিরসনে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) কোন সক্রিয় তৎপরতা নেই। মাউশির পক্ষ থেকে শিক্ষকদের নেই কোন যোগাযোগও। ফলে সরকার সমর্থক শিক্ষক সংগঠনের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছে সরকারের। কর্মকর্তারা বলছেন, শিক্ষকদের সব দাবি মেনে নেয়ার কোন রকম বাস্তবতা নেই। কারণ প্রতিটি দাবির পেছনেই আর্থিক সংশ্লেষণ আছে। সরকারের সীমাবদ্ধতাও আছে। চাইলেই এসব দাবি মানা সম্ভব নয়। তাছাড়া প্রত্যেক সরকারের শেষের বছরে নানা দাবিতে আন্দোলনে নামেন শিক্ষকরা। এটা নতুন কিছু নয়। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও শিক্ষকদের চলমান আন্দোলনে ইন্ধন যোগানো হচ্ছে। সরকার সমর্থক দেশের সবচেয়ে বৃহৎ শিক্ষক সংগঠন ‘শিক্ষক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের’ অন্যতম আহ্বায়ক অধ্যক্ষ শাহজাহান আলম সাজু আন্দোলন সম্পর্কে বলেছেন, ‘চাকরি জাতীয়করণ, শিক্ষানীতি-২০১০ বাস্তবায়ন, সম্মানজনক হারে বাড়িভাড়া ও চিকিৎসাভাতা বৃদ্ধি, ইনক্রিমেন্টসহ ১৭ দফা দাবিতে সারাদেশের ৩০ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গত ১২ জানুয়ারি থেকে ধর্মঘট চলছে। তবে দাবি আদায়ের নামে কোন রাজনৈতিক দলের মতো কর্মসূচী মানা যায় না। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির (মাধ্যমিক) সভাপতি রঞ্জিত কুমার সেন জানান, চাকরি জাতীয়করণসহ ১৭ দফা দাবিতে গত ১০ জানুয়ারি থেকে সারাদেশের বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবিরাম ধর্মঘট চলছে। এদিকে পুরো শিক্ষা জাতীয়করণ চান শিক্ষক-কর্মচারী ফ্রন্ট। ফ্রন্টের পক্ষ থেকে আগামী রবিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষণা করা হবে।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, শিক্ষকরা আমাদের সম্মানিত ব্যক্তি। তারা আমাদের জাতি গঠনের কারিগর। শিক্ষকদের মনে রাখতে হবে বর্তমান সরকার এক সঙ্গে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য যত সুবিধা নিশ্চিত করেছে অতীতে কোন সরকার তা করেনি। রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষমতা বাস্তবতাও আমাদের বুঝতে হবে। বিএনপিপন্থী শিক্ষক সংগঠন শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্যজোটের নেতাদের আন্দোলনের নামে রাজনৈতিক বক্তব্যের সমালোচনা করে তিনি বলেন, সুুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির পরেও এখন চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে তাদের আন্দোলনের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির পরেও আন্দোলন করাকে ‘অবাস্তব’ আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, আন্দোলনের নামে সাধারণ শিক্ষক-কর্মচারীদের বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। প্রাইমারী আর মাধ্যমিক বা কলেজ এক নয়। প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক। আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষকদের উদ্দেশে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ২৮ বছর ধরে শিক্ষকরা ১০০ টাকা বাড়িভাড়া, ১৮ বছর ধরে ১৫০ টাকা চিকিৎসা ভাতায় চলছেন। ১ জানুয়ারি থেকে সরকার প্রায় ৫ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর বাড়িভাড়া ও চিকিৎসা-ভাতা বাড়িয়েছে। যাঁরা ক্ষমতায় থাকাকালীন শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য এক টাকাও বৃদ্ধি করেননি, তাঁদের মিথ্যা আশ্বাসে বিভ্রান্ত না হয়ে ক্লাসে ফিরে যান। এদিকে গত তিনদিন ধরে রাজধানীতে কর্মসূচী থেকে বিএনপিপন্থ’ী শিক্ষক নেতারা সরকার ও শিক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে প্রগতিশীল শিক্ষক সংগঠনগুলোর মাঝে। এই সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দ ঘটনার তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন, আমরাও জাতীয়করণ চাই তবে সাধারণ শিক্ষকদের রাজধানীতে এনে জড়ো করে নিজের রাজনৈতিক শোডাউন আর ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ দেশের শিক্ষা আন্দোলনকে বিতর্কিত করার ষড়যন্ত্র। এর মাধ্যমে শিক্ষক সমাজকে অপমান করার হচ্ছে। শিক্ষক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ জাতীয়করণের দাবি তুললেও আন্দোলনের নামে নেতাদের রাজনীতি করার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। পরিষদের আহ্বায়ক শিক্ষক নেতা আলী আহমেদ, ড. নূর মোহাম্মদ তালুকদার, অধ্যক্ষ মোঃ শাহজাহান আলম সাজু এবং সমন্বয়কারী রঞ্জিত কুমার সাহা, অধ্যক্ষ মোঃ জাহাঙ্গীর ও অধ্যক্ষ এ.কে.এম মোকছেদুর রহমান এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেছেন, বাংলাদেশ শিক্ষক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের উদ্যোগে ১২ জানুয়ারি থেকে অবিরাম ধর্মঘট চলছে। কিন্তু ২৩ জানুয়ারি প্রেসক্লাবের সামনে শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়া অশিক্ষক সুলভভাবে শিক্ষানীতি ২০১০ প্রসঙ্গে বিভ্রান্তিকর তথ্য ও শিক্ষামন্ত্রীকে উদ্দেশ করে অসৌজন্যমূলক ও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেছেন। এ ধরনের বক্তব্য চলমান শিক্ষা আন্দোলন ভিন্ন খাতে প্রভাবিত করার গভীর ষড়যন্ত্র বলে ঐক্য পরিষদ মনে করে। সেলিম ভূঁইয়া তাঁর বক্তব্যে বলেন শিক্ষানীতি-২০১০ বাস্তবায়ন হলে তিন লাখ শিক্ষক চাকরি হারাবে। এ তথ্য সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর বরং শিক্ষানীতি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়িত হলে কয়েক লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। নেতৃবৃন্দ সেলিম ভূঁইয়ার এ ধরনের বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। এ ধরনের বক্তব্য প্রদান থেকে তাঁকে বিরত থাকার জন্য সেলিম ভূঁইয়ার প্রতি আহ্বান জানান তাঁরা।
এর আগে গত ৯ জানুয়ারি জাতির জনকের ঘোষণার দীর্ঘ চার দশক পর ২৬ হাজারেরও বেশি বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৪০ বছর পর এমন ঘোষণাকে দেশের শিক্ষার উন্নয়নে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত হিসেবে অভিহিত করেছেন শিক্ষাবিদসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু এ উদ্যোগ যেন জাগিয়ে তুলেছে বেসরকারী মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজের শিক্ষক সংগঠনগুলোকে। তবে শিক্ষানীতিতে শিক্ষার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, জাতীয় জীবনে প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব অত্যধিক। দেশের সব মানুষের শিক্ষার আয়োজন এবং জনসংখ্যাকে দক্ষ করে তোলার ভিত্তিমূল প্রাথমিক শিক্ষা। তাই মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণের জন্য জাতিসত্তা, আর্থ-সামাজিক, শারীরিক-মানসিক সীমাবদ্ধতা এবং ভৌগোলিক অবস্থান নির্বিশেষে দেশের সকল শিশুর জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। এ কাজ করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। রাষ্ট্রের দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে, সকলের জন্য মৌলিক শিক্ষা নিশ্চিত করার তাগিদ সংবিধানে বিধৃত আছে। তাই প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনা সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব এবং রাষ্ট্রকেই এই দায়িত্ব পালন করতে হবে। বলা হয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জাতীয়করণ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। প্রাথমিক শিক্ষার দায়িত্ব বেসরকারী বা এনজিও খাতে হস্তান্তর করা যাবে না। কোন ব্যক্তি বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠান বা কোন এনজিও প্রাথমিক শিক্ষা পরিচালনা করতে চাইলে তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে রাষ্ট্রীয় বিধি-বিধান পালন করে করতে হবে। সরকারের প্রাথমিক শিক্ষার একটি বড় অংশের জাতীয়করণের ঘোষণাকে সংবিধান ও শিক্ষানীতির সবচেয়ে বড় প্রতিফলন বলে মনে করে বিশেষজ্ঞরা। তবে এবার জাতীয়করণসহ বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে সরকারকে চাপে ফেলতে বেসরকারী মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষকদের সব সংগঠন এখন আন্দোলনের মাঠে। এমপিওভুক্ত ও এমপিওবিহীন, সরকার সমর্থক ও সরকারবিরোধী সব শিক্ষক সংগঠন ভিন্ন ভিন্ন দাবি নিয়ে প্রতিদিন কর্মসূচী পালন করছে। শিক্ষক সংগঠনগুলোর দুটি বড় মোর্চার ডাকে ১০ জানুয়ারি সকাল থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট চলছে। শিক্ষাবর্ষের শুরুতে এসব প্রতিষ্ঠানে ক্লাস না হওয়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন অভিভাবকরা। শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৯ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারী রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো জাতীয়করণের ঘোষণায় তারা আশান্বিত। তারা মাধ্যমিক ও কলেজ পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও জাতীয়করণ দেখতে চান। ধর্মঘটী কয়েক শিক্ষক নেতা বলেন, বেসরকারী শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকারী অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অথচ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার শতকরা ৯৭ ভাগই বেসরকারী। দীর্ঘদিন বিভিন্ন শিক্ষক-কর্মচারী সংগঠনের ব্যানারে চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলন হলেও সরকারের পক্ষ থেকে তাদের সে দাবি মানা হয়নি। যার কারণে তাঁরা বাধ্য হয়ে ধর্মঘট পালন করছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, রাজধানীর শীর্ষস্থানীয় কিছু সরকারী ও বেসরকারী স্কুল-কলেজে দায়সারাভাবে পাঠদান কার্যক্রম অব্যাহত আছে, যেগুলোতে শিক্ষক নেতাদের দাপট কিছুটা কম। গ্রাম, মফস্বল কিংবা জেলা পর্যায়ের বেশিরভাগ বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ধর্মঘট চলছে। শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে চলমান আন্দোলন বেগবান ও দীর্ঘ করারও হুমকি দিয়েছেন শিক্ষক নেতারা। কিন্তু এই সঙ্কট নিরসনে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) কোন সক্রিয় তৎপরতা নেই। মাউশির পক্ষ থেকে শিক্ষকদের নেই কোন যোগাযোগও। ফলে সরকার সমর্থক শিক্ষক সংগঠনের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছে সরকারের। কর্মকর্তারা বলছেন, শিক্ষকদের সব দাবি মেনে নেয়ার কোন রকম বাস্তবতা নেই। কারণ প্রতিটি দাবির পেছনেই আর্থিক সংশ্লেষণ আছে। সরকারের সীমাবদ্ধতাও আছে। চাইলেই এসব দাবি মানা সম্ভব নয়। তাছাড়া প্রত্যেক সরকারের শেষের বছরে নানা দাবিতে আন্দোলনে নামেন শিক্ষকরা। এটা নতুন কিছু নয়। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও শিক্ষকদের চলমান আন্দোলনে ইন্ধন যোগানো হচ্ছে। সরকার সমর্থক দেশের সবচেয়ে বৃহৎ শিক্ষক সংগঠন ‘শিক্ষক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের’ অন্যতম আহ্বায়ক অধ্যক্ষ শাহজাহান আলম সাজু আন্দোলন সম্পর্কে বলেছেন, ‘চাকরি জাতীয়করণ, শিক্ষানীতি-২০১০ বাস্তবায়ন, সম্মানজনক হারে বাড়িভাড়া ও চিকিৎসাভাতা বৃদ্ধি, ইনক্রিমেন্টসহ ১৭ দফা দাবিতে সারাদেশের ৩০ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গত ১২ জানুয়ারি থেকে ধর্মঘট চলছে। তবে দাবি আদায়ের নামে কোন রাজনৈতিক দলের মতো কর্মসূচী মানা যায় না। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির (মাধ্যমিক) সভাপতি রঞ্জিত কুমার সেন জানান, চাকরি জাতীয়করণসহ ১৭ দফা দাবিতে গত ১০ জানুয়ারি থেকে সারাদেশের বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবিরাম ধর্মঘট চলছে। এদিকে পুরো শিক্ষা জাতীয়করণ চান শিক্ষক-কর্মচারী ফ্রন্ট। ফ্রন্টের পক্ষ থেকে আগামী রবিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষণা করা হবে।
No comments