জলমহালের ইজারা বনাম দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন
জলমহল শব্দটি ব্রিটিশ আমলে ভূমি মন্ত্রণালয় কতর্ৃক প্রণীত গবর্নমেন্ট এস্টেট ম্যানুয়েল শীর্ষক প্রকাশিত পুস্তিকায় সর্বপ্রথম ব্যবহৃত হয়। সেই সময় থেকে এ শব্দটি ঐ মন্ত্রণালয়ের প্রায় সব সরকারী আদেশে উল্লেখ করা হচ্ছে।
মূলত সরকারের ঐ সব মন্ত্রণালয়ই এ শব্দটি ব্যবহার করে থাকে যারা জলমহলের সঙ্গে জড়িত। এ শব্দটি উন্মুক্ত ও বন্ধ (ৃযণভ টভঢ ডফম্রণ ষর্টণর তধ্রদণরধণ্র) পুকুর, নদী, হাওড় বাওড়কেই বোঝায়। এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে, এ ধরনের জলাশয়কেই বলা হয়ে থাকে জলমহাল। বিদ্যমান এ সমস্ত বিভিন্ন ধরনের জলাশয়কে ব্রিটিশ আমল থেকেই মৎস্য উৎপাদন ও বিপণনের মাধ্যমে সরকারের অর্থ আহরণের উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হতো। প্রচলিত প্রথা ছিল ইজারা দেয়া। অর্থাৎ উন্মুক্ত দরপত্র বা নিলামের মাধ্যমে সর্বোচ্চ দরপত্র দানকারীকেই সরকারীভাবে দুই বা পরবর্তীতে তিন বছরের জন্য এর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব প্রদান করা হতো।১৯৮৪ সালে ইজারা প্রথার দায়িত্ব সীমিতভাবে উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদকে প্রদান করা হয়। অর্থাৎ ছোট আকারের জলমহলকে উপজেলা পরিষদ বা ইউনিয়ন পরিষদকে হস্তান্তর করা হয়। এ প্রথারও উদ্দেশ্য ছিল অর্থ আহরণের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহকে আর্থিকভাবে শক্তিশালী করা। এ উদ্দেশ্য কতটুকু সফল হয়েছে তার কোন মূল্যায়ন এখন পর্যন্ত করা হয়নি। তবে একটি বিষয় পত্রিকান্তরে বা সরকারী অপ্রকাশিত তথ্যে প্রায়শই দৃশ্যমান হয়। দরপত্র বা নিলামের চেষ্টা ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট জলমহলকে সরকারী ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা হয়। এ প্রথার নামকরণ করা হয়েছে খাস বন্দোবস্ত বা ব্যবস্থাপনা। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক একাংশে নিয়োজিত জেলা প্রশাসক বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা এ ধরনের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এদের মতে, এ ব্যবস্থাপনায় আর্থিক আয় বৃদ্ধি পায়।
এ দাবির সপ েতারা বলে থাকেন যে, দরপত্র বা নিলাম ডাক দেয়ার েেত্র অনেক সময় কারচুপি হয়। এছাড়া রয়েছে মাস্তানী প্রথার মাধ্যমে অত্যন্ত কম অর্থ প্রদানের মাধ্যমে ইজারা লাভ করা। সরকারী বালুমহল বা পাথর মহলের েেত্রও এ যুক্তি প্রদান করা হয়। প্রশ্ন করা যেতে পারে যে, অর্থ আহরণই কি সরকারের একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া উচিত? সাম্প্রতিককালে পরিবেশ সংরণের বিষয়টি অধিকতর গুরুত্ব লাভ করেছে। সব ধরনের সরকারী মহলের েেত্র এ বিষয়টি প্রযোজ্য। এ ধরনের সঙ্গত ও সময়োপযোগী গুরুত্ব পাওয়া সত্ত্বেও অনাচার বা অনিয়ম থেমে নেই।
জনগণকে সকল শক্তি ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের মালিক হিসেবে গণ্য করার বিষয়ে সুশীল সমাজসহ কিছু রাজনৈতিক দল সোচ্চার হলেও আসলে জনগণের নাম করে এ ধরনের সম্পদ ব্যবহারের একচেটিয়া অধিকার লাভ করে গুটিকয়েক প্রভাবশালী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী। রাষ্ট্রীয় সম্পদকে কুগিত করে সুবিধাভোগী হওয়ার প্রবণতা বন্ধ করতে বিভিন্ন সরকার প্রকাশ্যে উক্তি করলেও এ গ্রহণযোগ্য সমাধান এখনও হয়নি। তবে জলাভূমি ও নদী তীরবর্তী ভূমিদসু্যদের দমনে উদ্যোগ গ্রহণ সরকারীভাবে করা হয়েছে এবং কাজও এগিয়ে চলছে। কুগিত উপায়ে রাষ্ট্রীয় সম্পদকে ব্যবহার করে বিত্তশালী হওয়ার গোষ্ঠীকে এখন ভূমিদসু্য বলা হয়। এদের দমনের বিষয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রীও অঙ্গীকারাবদ্ধ।
প্রশ্ন হলো এ ধরনের অন্য দসু্যদের দমন কেন করা হবে না। পত্রিকান্তরে দেখা যায় যে, সম্প্রতি টেংওয়ার হাওড় ব্যবহারের জন্য সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক বন ও পরিবেশবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে একটি লিখিত প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। এ প্রস্তাবের আওতায় তিনি উন্মুক্ত দরপত্র বা নিলামের মাধ্যমে এ হাওড়টিকে ফিরিয়ে আনতে আগ্রহী। অন্যদিকে আইইউসিএন'সহ হাওড়পারের দরিদ্র জনগোষ্ঠী সনাতনী ইজারা প্রথার ঘোরতর বিরোধী। আইইউসিএন রামসর খ্যাত এ হাওড়টির সংরণ ও ব্যবহারের অধিকার স্থানীয় দরিদ্র জনগোষ্ঠীকেই প্রদান করতে আগ্রহী। এ প্রসঙ্গে তারা রামসর চুক্তির বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। ইজারা প্রথা মানেই চুক্তির বরখেলাপ।
ইংরেজীতে কমন প্রপার্টি রিসোর্স (উমববমভ যরমযণর্রহ রণ্রমলরডণ) নামে একটি কথা আছে। এটা শুধু কথায়ই নয়, বরং এটি টেকসই উন্নয়ন কৌশল যার মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন করা যায়। দারিদ্র্য বিমোচন সহায়ক এ টেকসই কৌশলকে চালু করতে আশির দশকের শেষার্ধে বিশ্বব্যাংকসহ কিছু উন্নয়ন সহযোগী প্রকল্প অর্থ প্রদানে আগ্রহী হয়। কয়েকটি প্রকল্প দণি পশ্চিমাঞ্চলের যশোর জেলার কয়েকটি বাওড়কে নিয়ে শুরু করা হয়। প্রকল্প সমাপ্তির পর এর মূল্যায়নও কয়েক বছর পর একজন পরামর্শকের মাধ্যমে করানো হয়। পরামর্শকের প্রতিবেদনের যে বিষয়টি দৃশ্যমান হয় তা হলো প্রকল্পের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণরূপে অর্জন করা সম্ভব হয়নি। কারণ ছিল মূলত বাওড় তীরবর্তী এলাকায় সুবিধাভোগীদের শ্রেণী সংক্রান্ত অসমতা বা বৈষম্য। এদের মধ্যে অধিকতর বিত্তশালী সুবিধাভোগীরাই দলভিত্তিক ব্যবস্থাপনার মূল চালিকা শক্তি ছিল। অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা ছিল সুষ্ঠু বাজার বিপণন ব্যবস্থাপনা, স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের দাপট এবং কিছু েেত্র স্থানীয় প্রশাসনসহ প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় জড়িত কর্মকর্তাদের ব্যর্থতা।
পরামর্শকের প্রতিবেদনে বিষয়গুলো চিহ্নিত করে কিছু প্রতিকারমূলক সুপারিশও প্রদান করা হয়েছিল। কিন্তু প্রদত্ত সুপারিশ বাস্তবায়নে সরকার বা সংশ্লিষ্ট সাহায্যদাতা সংস্থাসমূহ কোন আগ্রহই দেখায়নি। এক দশকেরও অধিক সময় এখন অতিক্রান্ত হয়েছে। টেকসই উন্নয়ন কৌশল আদৌ টেকসই হয়েছে কিনা সে বিষয়ে জানা যায়নি। যদি কোন আগ্রহী সাংবাদিক এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করে তা হলে হয়ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা সম্ভব হবে। এ তথ্য আইইউসিএন-কেও সহায়তা করবে তাদের উদ্যোগকে সফল করতে। এ সংস্থা কর্তৃক হাওড় তীরবর্তী দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবিকার সুযোগ সম্প্রসারিত ও সুযোগ সৃষ্টি করার যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে সে বিষয়ে জেলা প্রশাসকেরও কিছু নেতিবাচক উক্তি প্রকাশিত হয়েছে। সে বিষয়টিও অনুসন্ধানযোগ্য।
কমন রিসোর্স প্রপার্টি ব্যবহারের মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের উন্নয়ন কৌশল বাংলাদেশের একশ্রেণীর স্বার্থান্বেষী মহল সহজে গ্রহণ করতে এখনও অভ্যস্ত হয়নি। টেংওয়ার হাওড়ের বিষয়ে প্রকাশিত সংবাদ ছাড়াও অতীতেও এ ধরনের ব্যবস্থাপনা কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ইচ্ছা থাকলেও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
১৯৭২-৭৪ সালে অবিভক্ত সিলেট জেলার একজন সাবেক জেলা প্রশাসক এমনই অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেছেন। তিনি ঐ সময় হাওড়ের ইজারা প্রথার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। এ বিষয়টি মরহুম জেনারেল এমএজি ওসমানীর কাছে এক নির্ভৃত আলোচনায় তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। জেনারেল ওসমানী এ বিষয়ে একমত হয়ে উক্তি করেছিলেন যে, সনাতনী ইজারা প্রথায় সাদা কলারের (ঘদর্ধণ উমফফটরণঢ) ব্যক্তিরাই সুবিধা ভোগ করে থাকেন। তাঁর মতে, এদের সবাই ইজারা লাভ করে বটে, কিন্তু তারা সবাই ঢাকা বা জেলার শহর অঞ্চলে বসবাস করে।
সিরাজগঞ্জ জেলার নিমগাছি এলাকার পুকুরের দীর্ঘ মেয়াদী বন্দোবস্ত দেয়া হয়েছিল আশির দশকের শেষার্ধে। সুবিধাভোগীরা গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য। অর্থাৎ দরিদ্র জনগোষ্ঠী। বর্তমানে শোনা যায় দীর্ঘমেয়াদী ইজারার মেয়াদান্তে সরকারের এক বিশেষ মহল ঐ সমস্ত দীঘি/পুকুর উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে সনাতনী প্রথায় ইজারা দেয়ার পপাতী। এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। যদি সিদ্ধান্ত গ্রামীণ ব্যাংকের বিপ েযায় তাহলে ঐ অঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবিকা নির্বাহের সম্ভাবনা সমূলে বিনষ্ট হবে।
সার্বিক বিবেচনায় গণতন্ত্রকামী ও দারিদ্র্য বিমোচনে বিশ্বাসী বর্তমান সরকারের উচিত হবে এ ধরনের কৌশলকে পরিত্যাগ নয়, বরং অধিকতর সুসংহতকরণের মাধ্যমে সম্প্রসারিত করা। নগদ অর্থ আহরণই সরকারের একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। উদ্দেশ্য হওয়া উচিত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য অধিকতর আয় উপার্জনের সৃষ্টি করা।
সরকার সম্প্রতি দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র চূড়ান্ত করেছে। ইতোপূর্বেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার এতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অংশীদারিত্বের মাধ্যমে উন্নয়ন কৌশলের চূড়ান্ত করেছিল। এ কৌশল দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য মঙ্গলদায়ক। আমাদের বিশ্বাস, বর্তমান সরকার এ কৌশল বাস্তবায়নের ল্যে উদ্ভূত সমস্যাবলী সমাধানে সচেষ্ট হবে।
১০ জানুয়ারি ২০১০
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা
No comments